Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘আমার গানে’ই আমি থাকবো বেঁচে….’

শুভাশিস মুখার্জি

 

জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গানের সঙ্গে আমার প্রথম আত্মস্থতা হয় ১৯৮৮ সালের পুজোয়। তার আগে ওঁর একটিমাত্র গানের সঙ্গেই আমি পরিচিত ছিলাম। সেটি ওঁর সর্বশ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় গান। ভাটিয়ার রাগের মুখড়া। ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার…’।

যে সময়ের কথা বলছি, সে বছর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বহুদিন পর নতুন গান গাইলেন। সে এলবামে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সুরে গানটি’ই ছিল প্রথম গান। এবং নামটিও ছিল সেই গানের দ্বিতীয় লাইন উদ্ধৃত করে। আমার বয়স তখন তেরো। তার আগের বছর বাবা মারা গেছে। তারই মধ্যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গেয়ে উঠলেন —

‘যদি সত্যিই আমি গান ভালোবেসে থাকি

পৃথিবী তোমায় যাই জানিয়ে

আমার গানেই আমি থাকব বেঁচে

মরণকে হার মানিয়ে’

এ গান শ্যামল গুপ্ত কেন সে সময়ে লিখেছিলেন, জানি না। কিন্তু, এ লেখা আমায় ভেতরে ভেতরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছিল অনেকটা সে বয়সে। তখন যে পরিস্থিতি আমার জীবনের, সেখানে দাঁড়িয়ে বুঝতে শিখছি, গান ছাড়া আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন আর কিছু হতে পারে না। আমি সত্যিই আর কিছুকে গানের মতো ভালোবাসতে পারছি না। মন লাগছে না অন্য কিছুতেই। খেলাধুলো বা পড়াশুনো কিছুই আমায় তেমনভাবে আশ্রয় দেয় না, যা গান দেয়। ঠিক এই কথাই তো পৃথিবীর বুকে রেখে যেতে চান যে কোনও শিল্পী। আমিও বলতে চাই চিৎকার করে।

জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সুরের বিশেষত্ব হল, স্থায়ীতেই গানের আসল মোচড়টা বলা থাকে। সেটাকেই তিনি অন্য রঙ দেন অন্তরায় গিয়ে। যাকে বলে elaborate করা। Themeটা থাকে প্রথম দুলাইনেই, সেটার ব্যাখ্যা থাকে বাকি গানে।

এ গানে যেমন শ্যামল গুপ্ত বলছেন —

‘এমনও তো আছে তরু, সব পাতা যার ঝরে না

এমনও তো আছে নদী, হাজার খরায় মরে না

নতুনের গানে গানে তেমনই তো কেউ ফেরে,

পুরনোর জের টানিয়ে’

তেমনই জটিলেশ্বর সুরকে নিয়ে চলেছেন আরেক পথে। স্থায়ীতে পঞ্চমকেন্দ্রিক সুর বুনে, মধ্যমকে হঠাৎ প্রধান স্বর করে দিচ্ছেন অন্তরায়।

এ গানের সঞ্চারী আমার বড়ই প্রিয়। শুদ্ধ ধৈবতকে নিয়ে কেমন সুন্দর মাঝ খাম্বাজের আমেজ এনেছেন। যা এ গানের স্থায়ী বা অন্তরা কোথাও নেই।

‘একটানা বরষায় ক্লান্তির মেঘ কত ঘিরবে

আলোর আকাশপথে আবার রঙিন দিন ফিরবে’

তারপর কী অনায়াস, অথচ অসাধারণতা নিয়ে কোমল ধৈবত নিয়ে মধ্যমে ঢুকছেন আবার। আর শ্যামল গুপ্ত লিখছেন সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ কিছু কথা —

‘প্রতিদিনকার নানা কাজ থেকে মন সরিয়ে

দেবে, আমার গানের কোনও কলিকে মনে করিয়ে

নানান দুঃখ শোক ব্যথা নিরাশায়

সান্ত্বনা দেবে আনিয়ে’

এ গানটির cross এতটাই ভালো লাগে, বার বার শুনতে ইচ্ছে হয়। শিক্ষা নিই আমি — কীভাবে অন্তরা থেকে ফিরতে হয় মুখড়ায়।

জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় অনেক কালজয়ী গানের জন্মদাতা। এ গান ওঁর লেখা নয়। তবু এ গানটাই আজ বড় মনে আসছে। গত তিরিশ বছরে অকারণে কতবার গেয়ে উঠেছি এ গান। কেন, তা জানি না। না থাকা আমায় চিরকাল টানে। হয়ত সে কারণেই। নিজেকে না বোঝাতে পারার শেষ দরজা, সব ছেড়ে চলে যাওয়া। তবু, মায়াটুকু কোথাও তো রেখে যেতে হয়। এই গান সেই কথার প্রবাহ। বিষণ্ণ এক ঘোষণা। ‘আছি’ বলে ‘নেই’।

জটিলেশ্বর সেই শিল্পী, যিনি সাবেকি বাংলা গানের ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সেই সময়ে, যখন বিশ্বায়নের নামে নিজের জাত খোয়াচ্ছে বাংলা গান। পরোয়া করেননি সে ঝড়কে। নিজের পরিচিতি থেকে সরেননি জীবনে কখনও। সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্তর প্রতি আজন্ম দুর্বলতা ছিল তাঁর। সঙ্গীতস্রষ্টা হিসাবে মনে মনে এঁদের গুরুর আসন দিয়েছিলেন জটিলেশ্বর। শ্রদ্ধাবান ছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষের প্রতি। গান শিখেছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে, যতদূর মনে পড়ছে। এঁদের চলে যাওয়ার পরের সময়ে তাঁর নিজের গাওয়া গান ছাড়াও তাঁর রচিত গান কণ্ঠে ধারণ করে পরের প্রজন্মের অনেকটাই উঠে দাঁড়িয়েছিল। এখনকার অনেক নামী শিল্পীর আশ্রয় শুরুতে ছিল জটিলেশ্বরের গান। ওই সময়ে তিনি বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে ছিলেন সমগ্র বাংলা গানের জগতে। ওই টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়ে তিনিই ছিলেন অনেক উদীয়মান তৃণের লালনকর্তা।

এ প্রজন্মের যে কোনও শিল্পী’র কাছে তিনি ছিলেন মানদণ্ডস্বরূপ। তাঁর একটা গান গেয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন কত শিল্পী। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তৈরি করেছেন তিনি। নামী অনামী কেউই তাঁর সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হননি।

বাংলা গানের রসিক শ্রোতা-মাত্র জানেন, জটিলেশ্বর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে তিনি ছিলেন সুগায়ক, সুকবি এবং নিপুণ সুরস্রষ্টা। জনপ্রিয়তার প্রচলিত সংজ্ঞায় হয়তো তাঁর থেকে উঁচুতে অনেকেই আছেন। কিন্তু সে তো তাঁর অনেক পরিচয়ের একটিমাত্র রূপকে ভিত্তি করে।

গীতিরচয়িতা হিসাবে জটিলেশ্বরের প্রবণতা ছিল গানের বাণীকে প্রচলিত বিষয় ও স্টাইলের থেকে উলটোপথে হাঁটাবার। এই নতুন নির্জন পথে পদচারণা আমরা দেখি জটিলেশ্বর-বিরচিত গানগুলির ছত্রে-ছত্রে। গানের বিষয় ও প্রকাশভঙ্গি তাঁর গানে খুঁজে পেয়েছিল মুক্তির আকাশ। তাঁর ত্রিসত্তার কোনওটিকে যদি প্রিয়তম বলতে হয়, আমি বেছে নেব তাঁর কবিসত্তাকেই। আমি গীতিকার জটিলেশ্বরের ভক্ত। মেজাজে ধ্রুপদী হলেও প্রকাশে তিনি ছিলেন সমকালীন। অসামান্য সব গান রচনা করে গেছেন। গানের বিষয় ও আঙ্গিক, এবং অবশ্যই শব্দচয়ন ওঁকে সমকালীন গীতিকারদের থেকে স্বতন্ত্র করেছে। ‘এ কোন সকাল’-এর কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এ গান ছাড়াও নিচে আরও এমন কিছু আমার প্রিয় গান রসিক পাঠক-শ্রোতার জন্য দিলাম, যার থেকে আমার বক্তব্য কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠা পাবে।

বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে…

আমি তো হার মেনেই আছি…

ও বাউল গেরুয়া তো পরেছ… এই গানে প্রথম ও পরের ‘তারে’ শব্দদুটো কেমন চমৎকারভাবে এসেছে…

রাজা মুকুট পরে বসে আছ…

তোমার সঙ্গে দেখা না হলে ভালোবাসার দেশটা আমার দেখা হত না…

আমার স্বপন কিনতে পারে এমন আমির কই…

সেই সময়ের প্রচলিত ও জনপ্রিয় গানের তুলনায় ওঁর গানের বাণী ছিল অনেকাংশে আধুনিক।

তিনি নিজেই লিখেছেন —

‘…..আমি দূরে দূরেই আছি, দেখি দূরে সরো কি করে!’

বাংলা গানের অন্যতম সেবক জটিলেশ্বরের সৃষ্টির থেকে দূরে সরে থাকা আমাদের পক্ষে অসম্ভব।