Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভাঙড় এখন: যে যায় লঙ্কায়…

প্রদীপ সিনহা ঠাকুর

 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রটি বিগত দু’বছর যাবৎ প্রবল অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। অস্থিরতার কারণ পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন ইন্ডিয়া লিমিটেড-এর পক্ষ থেকে একটি বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ও ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণের প্রচেষ্টা ও তৎসংক্রান্ত জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক ও বিক্ষোভ। জমিহারা কৃষকদের প্রতিবাদ এবং প্রশাসন ও শাসকদলের দমনপীড়নের চাপানউতোরে ভাঙড় এই মুহূর্তে কার্যত রণভূমির চেহারা নিয়েছে। এই প্রসঙ্গে ভাঙড়ের জমি, জীবিকা, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা কমিটির সদস্য ও এই আন্দোলনের শরিক প্রদীপ সিনহা ঠাকুরের সঙ্গে কথা বললেন চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর প্রতিনিধি দেবব্রত শ্যামরায়।

প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের সময় দেওয়ার জন্য। বোঝাই যাচ্ছে, এই মুহূর্তে আপনারা সবাই খুব ব্যস্ত কারণ আজও ভাঙড়ে আপনাদের দীর্ঘ কর্মসূচী ছিল

হ্যাঁ, আমি এইমাত্র সভা থেকেই ফিরলাম। আগামী ক’দিন আমাদের ব্যস্ততা আরও বাড়বে। কাজ তো সবে শুরু হল।

অবশ্যই। আচ্ছা, আপনি রাজারজাট সাবস্টেশনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সমস্যা ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটি যদি একবার আমাদের বলেন…

সমস্যাটা বছর দু’য়েক হল দানা বেঁধেছে, কিন্তু এর আরম্ভ আরও আগে, ২০১৩ সালে, যখন পোলের হাট, মাছিভাঙ্গা, খামারাইট, ঢিবঢিবা, টোনা-সহ প্রায় ২০টি গ্রাম-সংলগ্ন পঞ্চায়েত অফিসে হঠাৎ একদিন নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হল যে একটি পাওয়ার হাউস নির্মাণের জন্য এই অঞ্চলে ১৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এখানে যেটা বলার যে, এই নোটিস টাঙানোর আগে পঞ্চায়ের স্তরে কোনওরকম আলোচনা করা হয়নি। শুধুমাত্র পাওয়ার হাউস কথাটা বলে জনসাধারণকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। এর অনেক পরে যখন পাওয়ার গ্রিড বড় বড় যন্ত্রপাতি আনতে শুরু করে, তখন মানুষের সন্দেহ হয়। এক সকালে উঠে এক কৃষক দেখেন পাওয়ার গ্রিডের কনট্রাকটর তার জমির ওপর কীসব স্ট্রাকচার নির্মাণ শুরু করে দিয়েছেন, তার অনুমতি বা ক্ষেতের ফসলের তোয়াক্কা না করেই। ধীরে ধীরে জানা যায়, পাওয়ার হাউস নয়, এখানে ৪৪০/২২০ কিলো ভোল্টের এস এফ সিক্স গ্যাস ইনসুলেটেড সাবস্টেশন এবং ট্রান্সমিশন লাইন বসবে, যা দেশের পাওয়ার গ্রিডের সবচেয়ে বড় প্রোজেক্টগুলির মধ্যে একটা। এখান থেকে মোট বারোটা ট্রান্সমিশন লাইন বেরোনোর কথা। অর্থাৎ মূল সাবস্টেশনের অংশটা ছাড়াও আরও অনেকের জমির ওপর দিয়ে লাইন যাবে, এর ফলে সেইসব কৃষকরা কার্যত নিজেদের জমির অধিকার হারাবেন, কারণ ট্রান্সমিশন লাইনের ঠিক নীচে চাষ বা অন্য কোনও কাজ করা যায় না। আর আশ্চর্য ব্যাপার, সেই সময় সরকার বা পাওয়ার গ্রিড এইসমস্ত অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের কথা ঘোষণা করেনি কিন্তু জমির মালিকের অনুমতি ছাড়াই জমির ওপর দিয়ে লাইন নিয়ে ও পোল নির্মাণের পরিকল্পনা করে ফেলেছিল। আরও যেটা বলার যে এই প্রকল্পের কারণে আশেপাশের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে তা নির্ণয়ের জন্য কোনও বিশেষজ্ঞ সমীক্ষাই করা হয়নি, প্রকল্প ঘোষণার আগে যা করা উচিত ছিল।

আরেকটা কথা জানিয়ে রাখি, পি জি সি আই এল-এর ২০১৪ নোটিফিকেশন অনুযায়ী, এই রাজারহাট সাবস্টেশন থেকে ট্রান্সমিশন লাইন পশ্চিমবঙ্গের সাতটি জেলার আশিটি গ্রামের ওপর দিয়ে যাবে, তারপর ঝাড়খণ্ডের পাকুর জেলায় ঢুকবে। সাবস্টেশন থেকে নির্গত ন’টি লাইন শুধু দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার প্রায় তিরিশ হাজার মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত করবে।  আমাদের প্রশ্ন — এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ, এলাকার সাধারণ মানুষদের সঙ্গে আলোচনা না করে, কোনও বিজ্ঞানসম্মত সমীক্ষা না করে, ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ নীতি না নিয়ে, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কেন?

এখানে আপনাকে একটু বাধা দিচ্ছি, পরিষ্কার বোঝা গেল সমস্যাটা কীভাবে শুরু হল। কিন্তু একটা কথা বলুন, রাজ্য সরকার কি নিজেই এই জমি অধিগ্রহণ করেছেন, না পাওয়ার গ্রিড?

মজাটা এখানেই। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে এই সরকার। তাই সরকারের ঘোষিত অবস্থান ছিল কোনও পরিস্থিতিতেই অনিচ্ছুক কৃষকের কাছ থেকে জোর করে জমি নেওয়া যাবে না। এবং ২০১৩ থেকে নতুন জমি অধিগ্রহণ আইন হয়েছে যে কোথাও জমি নেবার আগে তার উর্বরতা নির্ণয়, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রভাব নির্ণয়, উচ্ছেদ হওয়া জমি মালিকদের জন্য স্পষ্ট পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ নীতি ঘোষণা ইত্যাদি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ভাঙড়ে এসব কিছুই করা হয়নি। বরং আইন বাঁচাতে রাজ্য সরকার ঘোষণা করেন যে তারা পুরনো ঔপনিবেশিক আইন অনুযায়ী আগেই জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। এছাড়া সরকারের হয়ে অধিগ্রহণের কাজটা করেছে তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী। সরকার হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে আর আরাবুল ইসলাম চাষিদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে জলের দামে জমি লিখিয়ে নিয়েছে আর নিজে ফুলেফেঁপে উঠেছে। সাধারণ মানুষের খেপে ওঠার আরেকটা প্রধান কারণ এটাও।

এটা ২০১৬-র শেষদিকের কথা বলছেন, তাই তো? মনে পড়ছে, তিনজন মহিলাসহ ছয়জন গ্রামবাসী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আর তখনই গুণ্ডাবাহিনী ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভাঙড়ের মানুষ রুখে দাঁড়ায়…

শুধু রুখে দাঁড়ায় তাই নয়, গ্রামগুলির মধ্যেও যে সি পি এম-তৃণমূল শিবিরভাগ ছিল, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল, সব ভুলে গিয়ে মানুষ প্রশাসন, পাওয়ার গ্রিড ও আরাবুল বাহিনীর বিরুদ্ধে একজোট হয়। কারণ তাঁদের কাছে এটা অস্তিত্বের সঙ্কট যার থেকে আর কিছুই বড় হতে পারে না। মোটামুটি এই সময়েই আমরা এই আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হই ও ভাঙড়ে জমি, জীবিকা, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা কমিটি গড়ে ওঠে।

আপনারা বলতে কারা? আমাদের পাঠকদের কাছে আপনাদের পরিচয়টা যদি দেন…

আমাদের সংগঠনের নাম সি পি আই (এম এল) রেড স্টার। আমরা এই লড়াইয়ে ভাঙড়ের মানুষের পাশে আছি ও তাঁদের ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের সচেতন ও সংগঠিত করছি। ভাঙড়ের জমি আন্দোলনের প্রতি আমরা আদর্শগতভাবে দায়বদ্ধ।

বেশ। বোঝা গেল। তবে প্রশাসন কিন্তু আপনাদের ওপর খড়্গহস্ত। অধিগ্রহণ নিয়ে সরকারি প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার কথা মেনে নিলাম, মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু বলছেন, নকশালরা মানে আপনারা নাকি শুধু শুধু লোক খেপাচ্ছেন, গ্রিড হলে গ্রামবাসীদের কারও কোনও শারীরিক বা আর্থিক ক্ষতি হবে না, আপনারা নাকি নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গরীব মানুষদের ভুল বোঝাচ্ছেন। তাই কি?

(হেসে) প্রথমত, সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি, সরকার খড়্গহস্ত হবেন, এ আর আশ্চর্য কী? আমি ও আমাদের এক সহযোদ্ধা শর্মিষ্ঠা চৌধুরী গত বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট এই সাত মাস জেলে খেটে বেরোলাম। আমাদের বিরুদ্ধে ইউ এ পি এ দেওয়া হয়েছিল। হাইকোর্ট থেকে যে শর্তে আমি জামিন পেয়েছি তা হল, রাজারহাট-কাশীপুর-ভাঙড়, এই তিনটি থানা এলাকায় আমি ঢুকতে পারব না। এইভাবে আমাদের আন্দোলনকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু আমরা হাল ছাড়ছি না।

দ্বিতীয়ত, সরকার বলছে গ্রিড হলে কারও কোনও ক্ষতি হবে না। বেশ। আপনি বরং নিজে একটা কাজ করুন। পি জি সি আই এল-এর ওয়েবসাইটে যান। নিজের চোখে দেখতে পাবেন, পাওয়ার গ্রিড  ট্রান্সমিশন লাইনের নীচে ও কমপক্ষে ৩০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে লাঠি, ছাতা বা যেকোনও ধাতু নিয়ে যেতে মানা করছে। অথচ রাজারহাট সাবস্টেশন থেকে বেরোনো লাইন যার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ৯৫৩ কিলোমিটার এবং যা পুর্ণিয়া পর্যন্ত যাচ্ছে, এই দীর্ঘ পথের বেশিরভাগটাই হয় চাষের জমি অথবা গ্রামীণ বসতির ওপর দিয়ে। মানবশরীরের ওপর উচ্চ ভোল্টের ট্রান্সমিশন লাইনের প্রভাব নিয়ে সারা পৃথিবীতে বিস্তর সমীক্ষা হয়েছে। বেশ কিছু সমীক্ষা বলছে, পাওয়ার লাইনের কাছাকাছি যারা বাস করেন তাদের ব্রেইন ক্যানসার, লিউকেমিয়া, অ্যালজাইমার, স্তনের ক্যানসার, মিসক্যারেজ, জন্মগত শারীরিক ত্রুটি, জননে অক্ষমতা, রক্তাল্পতা, ক্লান্তি, অবসাদ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, অনিদ্রা ইত্যাদি নানা শারীরিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে কিছু সমীক্ষা এর বিপরীত মত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। তারা বলছেন, উচ্চ ভোল্টের সঙ্গে মানুষের অসুস্থতার এই যোগাযোগগুলি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়। এইখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার প্রকৃত তথ্য ইচ্ছে করেই জটিল ও অস্বচ্ছ রাখা হচ্ছে কারণ অনেক সংস্থা যারা এইসব সমীক্ষা চালাচ্ছে তারা আসলে বৃহৎ পুঁজির দাস। আর পুঁজি চায় না তারা উন্নয়নের যে মডেল মানুষকে গেলাতে চায় তার কোনও বিরুদ্ধমত বাজারে থাকুক।

এছাড়াও গবাদি পশুর ওপর ট্রান্সমিশন লাইনের ক্ষতিকর প্রভাব আছে। এ নিয়েও অনেক বলা যায়। তার মধ্যে না গিয়ে আপনাকে শুধু একটা তথ্য দিচ্ছি। ২০০৮ সালের ২৪শে অক্টোবর তুলে, ফ্রান্সের এক গণ আদালতে ৪০০ কিলো ভোল্ট-এর বিদ্যুৎ বন্টন লাইনের সঙ্গে গবাদি পশুর নানা রোগ হওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হয়, এবং আদালত সে দেশের ন্যাশনাল ইলেক্টিসিটি ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক সংস্থাকে গবাদি পশুপালকদের ৩৯০,৭৪৮ ইউরো ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করে।

এসব শুনে সত্যিই অবাক লাগছে। এই ক্ষতিকর দিকগুলো আমাদের মূলধারার মিডিয়াতেও এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উঠে আসেনি। আরেকটা বিষয় আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এই সাবস্টেশনটি গ্যাস ইন্সুলেটেড সাবস্টেশন, এখানে এস এফ সিক্স বা সালফার হেক্সাফ্লুওরাইড ব্যবহৃত হচ্ছে তড়িৎ অপরিবাহী মাধ্যম হিসেবে। যদিও এই এস এফ সিক্স নিষ্ক্রিয় গ্যাস, কিন্তু পরিবেশ ও মানবশরীরের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব আছে। পাশাপাশি এটাও সত্যি যে এত উচ্চ ভোল্টের সাবস্টেশনে এস এফ সিক্স ছাড়া অন্য কোনও অপরিবাহী মাধ্যম ব্যবহার করার প্রযুক্তি এখনও আমাদের জানা নেই। অতএব এই সাবস্টেশন করতে গেলে এস এফ সিক্স ব্যবহার না করে উপায় ছিল না।

খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গ তুলেছেন। এস এফ সিক্স নিষ্ক্রিয় ও অদাহ্য গ্যাস হলেও এর গ্লোবাল ওয়ার্মিং ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ২৩,৯০০ গুণ বেশি। এই গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারী, এই গ্যাস কোনওভাবে লিক করলে যারা আশেপাশে নীচু জায়গায় শুয়ে আছে, যেমন ধরুন প্ল্যান্টের মেঝে বা নিকটবর্তী গ্রামে গাছের তলায় কেউ শুয়ে আছে, এস এফ সিক্স অক্সিজেনকে সরিয়ে তাদের ফুসফুসে ঢুকে যাবে ও সেই ব্যক্তির দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটবে। গোটা ইউরোপ শুধুমাত্র উচ্চ ভোল্টের সুইচগিয়ার ছাড়া অন্য সমস্ত প্রযুক্তিতে এস এফ সিক্সের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। মার্কিন  প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রথমবার নির্বাচিত হয়েই একটি নির্দেশ জারি করেন যেখানে দেশের প্রতিটি সংস্থাকে তাদের কাজে ও প্রক্রিয়ায় এস এফ সিক্স-সহ কতটা পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে তা নির্ণয় করতে বলেন এবং তা কমিয়ে আনার সময়সীমা বেঁধে দেন। আমরা সেই একই প্রযুক্তি আমাদের দেশে ব্যবহার করছি, কিন্তু এর ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ে কোনও আলোচনা নেই, সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার কোনও পরিকল্পনা নেই, কারণ সাধারণ গরীব মানুষের জীবন ও জীবিকার তেমন কোনও দাম নেই আমাদের কাছে।

তাহলে একটা অপ্রিয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি, শিল্প বা উন্নয়নের ভবিষ্যৎ কী তবে? প্রকল্প করতে গেলে জমি লাগবেই এবং এই ধরনের প্রযুক্তিও ব্যবহার করতে হবে, সেক্ষেত্রে কী করণীয়? উন্নয়ন তো বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে না, তাই না?

অপ্রিয় প্রশ্ন কেন? অবশ্যই এই প্রশ্ন উঠে আসা উচিত। প্রশ্ন হল কাদের জন্য এই উন্নয়ন? উন্নয়ন তো কোনও শ্রেণি-ঊর্ধ্ব ধারণা নয়। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থকে কেন্দ্রে রেখে যে উন্নয়ন আমরা সবসময় তার পাশে আছি। কিন্তু সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রেখে, তাঁদের ভুল বুঝিয়ে, তাঁদের মেরে যে উন্নয়ন তা আসলে আদানি-আম্বানির উন্নয়ন, বুলেট ট্রেনের উন্নয়ন, আমরা সেই উন্নয়নের ধারণার বিরোধিতা করি।

বেশ। আন্দোলনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এখন ভাঙড়ে গ্রিড-বিরোধী আন্দোলন কোন পর্যায়ে রয়েছে? আপনারা কি এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী? সেদিন দেখলাম, রেজ্জাক মোল্লা সাহেব জোর দিয়ে বলছেন, পঞ্চায়েত ভোটের আগেই প্রকল্প শেষ হবে…

শুধু তাই নয়, রেজ্জাক মোল্লা ভাঙড়ের মানুষকে একমাস সময় দিয়েছেন। ৭ই জানুয়ারির সভা থেকে বলেছেন, এর মধ্যে আবার গ্রিডের  কাজ শুরু করতে না দিলে ভাঙড়ের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হবে। গ্রামকে গ্রাম অন্ধকার করে দেওয়া হবে। একজন জনপ্রতিনিধি, রাজ্য সরকারের মন্ত্রী যিনি নিজেকে একসময় ‘চাষার ব্যাটা’ বলতেন, তিনি খোলাখুলি এইভাবে হুমকি দিচ্ছেন। অর্থাৎ ভাঙড় আন্দোলন আবার নতুন করে রাষ্ট্রীয় আক্রমণের মুখে পড়েছে। অথচ একবছর আগে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করেছিলেন, মানুষ না চাইলে পাওয়ার গ্রিড হবে না। কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি? সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই সরকারই আজ জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। গত বছর ১৭ই জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে জমিরক্ষা কমিটির মফিজুল আর আলমগীর মারা গেছে, এক বছর হতে চলল, ঐদিন শহীদ দিবস পালন করব আমরা, আপনি পারলে ঐ দিন আসবেন, জানেন…পঞ্চায়েত থেকে আজ অবধি ওঁদের ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি। আর এদিকে রাজ্য সরকার প্রতিবছর মাটি উৎসব করছেন। এ প্রহসন ছাড়া আর কী! তবে এলাকার মানুষ গ্রিড চাইছেন না, গত ৭ই জানুয়ারির সভায় একটিও এলাকার লোক ছিল না, বাইরে থেকে লোক এনে তাদের খিচুড়ি খাইয়ে সভা ভরানো হয়েছে। অতএব সরকারের দমনপীড়ন যেমন তীব্রভাবে নেমে এসেছে, মানুষের প্রতিরোধও তীব্রতর হয়েছে। এলাকা গরীব সংখ্যালঘু মহিলারা কলকাতায় রাজপথে গিয়ে মিছিল করেছেন, এমন মিছিল যা কলকাতা আগে দেখেনি। বাড়ির মেয়েরা বেরিয়ে এসেছেন, এটা এই আন্দোলনের একটা বড় পাওনা। মাফিয়া আরাবুল ইসলামের যে দাপট ছিল তা থেকে গ্রামগুলি বেরিয়ে আসতে পেরেছে। শাসকদলের গুণ্ডাবাহিনীকে ওখানকার মানুষ আর ভয় পায় না। এই আন্দোলনের দাবীগুলি হল, বন্দুকের নলের মুখে জোর করে যে বহুফসলি অতি-উর্বর জমি লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা কৃষককে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। জমিরক্ষা কমিটির প্রত্যেকের নামে যে ২৫-২৬টা করে মামলা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। সঠিক অধিগ্রহণ পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রোজেক্ট অপেক্ষাকৃত অনুর্বর জমিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, এতটা সময় দিয়ে বিষয়গুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার জন্য। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর তরফ থেকে আপনাদের এই গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের সাফল্য কামনা করি। ভালো থাকবেন। পরবর্তীকালে আবার কথা হবে।

নিশ্চয়ই কথা হবে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পত্রিকাকেও অনেক ধন্যবাদ।