Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভিড়-ঠাসা কবিতারা

মধুরিমা দত্ত

 

বাইপাসে ইদানীং এ-পিঠ ও-পিঠ দেখা যায় না। সারাক্ষণ ধুলো উড়ছে, সারাটাক্ষণ কেবলই গাঁকগাঁক শব্দে এ গাড়ি অন্য গাড়িকে পাশ কাটাচ্ছে, সকলের বড্ড তাড়া। অনেক গাড়িই এখন বইমেলামুখী। সাদা কাগজে ‘বইমেলা’ লিখে বাসের সামনে চেটানো। বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা। শুধু বই নয়, স্বপ্নের মেলা, চিন্তনেরও। কত-কত বই, কত-কত প্রকাশক। কোনও স্টলে লোকের ভিড়, কোনও স্টলে একা প্রকাশক বসে আছেন দু’ফর্মার মলিন বই হাতে। লাইন লম্বা যেখানে, সেখানে ক্যামেরার ঝলকানি বেশি। যেখানে আড়াল, সেখানে কেবল বইদের সাজানো দেহ, কেউ এসে নেড়েচেড়ে, উলটে পালটে দেখবে বলে মৃত লেখকেরা চেয়ে আছে অপলক। কেবল বইয়ের মেলা তো না। স্বপ্নের মেলা, স্বপ্নভঙ্গেরও।

লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়নটা খুঁজে পাচ্ছে না বাঁকুড়া থেকে আসা ছেলেটা। ভোরের ট্রেনে হাওড়া নেমে শ্যামবাজারের বন্ধুর মেসে দু’গাল মুখে দিয়েই বেরিয়ে পড়েছে কলকাতা বইমেলা দেখবে বলে। তার এই প্রথম কলকাতা বইমেলা দেখা। এই প্রথম বইয়ে পড়া কবিতার রক্তমাংসের কবিদের সাথে আলাপ করার সুযোগ। ফেসবুকে একটু কিন্তু-কিন্তু করেই কবিদের বন্ধুত্বের রিক্যুয়েস্ট পাঠানো। সত্যি বলতে কী, ফেসবুক না-থাকলে জানাও যেত না কত মানুষ লিখে যাচ্ছে, কত কত বই বেরোচ্ছে একপক্ষকাল অন্তর। আসলে তো লিটল ম্যাগাজিন একটা বিকল্প যাপন। প্রতিষ্ঠানের হয়ে ফরমায়েশি লেখার বদলে নিজের উচ্চারণ আরও ধারালো করতেই তো এত-এত মানুষ লিটিল ম্যাগাজিন করে চলেছে। সে’ও করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে-পড়তে দু’তিনটে টিউশনিতে যে ক’টা টাকা ওঠে, তা দিয়ে বই কেনে আর বই গড়ে। নিজের কথা লেখে, নিজেদের কথা বলে। পিঠের ব্যাগে খান-কুড়ি পত্রিকা নিয়ে ছেলেটা এসেছে সেই ভোরবেলা, সেই সব কবিদের কাছে নিজের কথা পৌঁছে দেবে বলে, যাঁদের এতদিন কবিতায় স্পর্শ করত কেবল। আসার আগে সকলকেই ফোন মেসেজ করে দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা মোতাবেক সকলেরই লিটল ম্যাগাজিন চত্বরেই থাকার কথা। কিন্তু প্যাভিলিয়নটাই পাওয়া দুষ্কর ঠেকে তার।

শেষমেশ, ইয়া বড়-বড় প্রতিষ্ঠান পেরিয়ে এককোণে সারি বাঁধা স্বপ্নকূল। টেবিলে-টেবিলে বই, হাওয়ায়-হাওয়ায় পালটে ফেলার গন্ধ। হাতে লেখা ব্যানারে অদ্ভুত এক আভা, বইগুলোর গন্ধে তার নেশার মতো হয়। মনে-মনে নিজেকেই বাহবা দিতে ইচ্ছে হয়। ভাগ্যিস এসেছিল, অনেক সময় সহযোদ্ধাদের গল্প শুনলে সাহস বাড়ে। সে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করাতে চায়, লিটিল ম্যাগাজিন কিনে পড়ুন। আন্দোলন যে বেঁচে আছে সেই ভরসাটুকুই তো সম্বল। আলাপী কয়েকজনের সাথে মোলাকাতও হয়ে যায়। কয়েকজনের টেবিলে নিজের কয়েক কপি পত্রিকা সাজাতে-সাজাতে ভাবে, পরের সংখ্যা থেকে ডিজিটাল কভার করতে হবে। বড় সুন্দর প্রচ্ছদ করেছে সকলে, কী নিখুঁত বাঁধাই। আরও তিনটে টিউশন জোগাড় হলেই ডিজিটাল প্রিন্টের টাকাটা হয়েই যাবে….

প্যাভিলয়নের গা ঘেঁষে একটা জটলা। বোঝা যাচ্ছে, মাঝে কাউকে ঘিরে অদ্ভুত উদ্দীপনা জমেছে বেশ। ভিড়ের রংটা ধোঁয়াটে, ভিড়ের গন্ধটা নিকোটিনের। ভিড়ের একটা আলগা পর্দা সরতেই দেখা গেল বিখ্যাত কবিকে ঘিরে আছে দলটা। দলের সবার হাতেই নিজস্ব পত্রিকা। নিজেকে ভিড়ে ঢোকাতে চেষ্টা করে সে। অস্বস্তি হয়। কবিকে ডাকবে? কী বলে ডাকবে? কবিকে কি ডাকা যায়? ভাবতে-ভাবতে হাতে ধরা বই ঠাসাঠাসিতে কুঁচকে যায়। ভিড় কমলে ফিরবে ভেবে নিজেকে আলাদা করে নেয়। টেবিলে ভিড় তেমন নেই। একটা টেবিলে বেশ কিছু উৎসাহী মুখ, বড় ব্যানারে ঝুলছে সদ্যপ্রকাশিত বইয়ের বিজ্ঞাপন, পাশে লেখকের ছবি। ছবির লেখক স্টলে দাঁড়িয়ে, সেলফি উঠছে যথেচ্ছ। এত ভিড় কেন? জানতে এগিয়ে যায় সেও। বই ক্রেতা মোবাইলে কিছু একটা দেখাচ্ছেন লেখককে, লেখক হাসছেন, হ্যান্ডশেক করছেন। লেখকের পাশের মানুষটি বিল কাটছেন বইয়ের। বই বিকোচ্ছে ভালোই। মফস্বলের ছেলের চোখ এড়ায় না কিছুই। লক্ষ করে, ব্যানারে মোটা করে লেখা, “প্রকাশিত হচ্ছে লেখকের তৃতীয় কবিতার বই। পোস্টটি নিজের ওয়ালে শেয়ার করুন আর পেয়ে যান বইয়ের দামের উপর ১০ শতাংশ ছাড়। স্টলে এসে পোস্ট দেখালেই মিলবে ছাড়।” চোখ একবার রগড়ে নেয়, তবু বিস্ময় কাটে না। লিটল ম্যাগাজিন কর্মীর বইয়ের কুপন কিনা ফেসবুক পোস্ট! অস্বস্তি বাড়তে থাকে কেবল।

ছেলেটা এগিয়ে চলে আরও। পাশের সার দেওয়া টেবিলের মাঝের রাস্তার দিকে চোখ যায়। অন্য এক কবি হেঁটে চলেছেন। পিছনে সামনে ভিড়। টেবিলে-টেবিলে দাঁড়াচ্ছেন কবি। আন্দোলনের অনেক মুখেই তোষামুদে প্রশান্তি। আবারও চেষ্টা করে কবিকে নিজের বইটা দেওয়ার। কীভাবে ডাকবে কবিকে? কবির কি আলাদা কোনও সম্বোধন হয়? গুলিয়ে যায় সব। নিজের গড়া লিটল ম্যাগাজিন প্রিয় কবিকে দেবে বলে ভোরের ট্রেন ধরে মহানগরে এসেছে ছেলেটা। ফিরে গিয়ে কী বলবে বন্ধুদের? বলবে কবিতার লেখক, ফেসবুক প্রোফাইলের কবি আর শিরা ধমনীর কবি — তিনজন তবে আলাদা?

কবিদের ঘিরে গোষ্ঠী বেড়ে ওঠে, আসলে গোষ্ঠী নয়, ভিড় বেড়ে ওঠে। ছেলেটা বুঝতে পারে পিঠের ব্যাগের বইগুলোর কষ্ট হচ্ছে খুব। বুঝতে পারে ভিড় ঠেলে কবির কাছে পৌঁছানো যায় না, বরং কবির কাছে পৌঁছাতে হলে ভিড়ে মিশে যেতে হয় এখন। হালকা শীতেও ঘাম হয় ছেলেটার। ভিড় ভর্তি কবি চলে যান স্টল থেকে স্টলে। নিজস্ব ব্যাগ নিয়ে সরে আসে সে। মাঠের অন্ধকার খুঁজে বসে পড়ে। ব্যাগ খোলে। ব্যাগের ভিতর শ্বাসকষ্টে ভোগা টিউশন পড়িয়ে তৈরি লিটল ম্যাগাজিন। আরেকটু হাতড়েই প্রিয় কবির বইটা পেয়ে যায় সে। খোলা আকাশের নীচে বসে সেই কবিরই শান্ত দিঘির মতো কবিতাখানি পড়ে সে, যিনি ভিড় মেখে চলে গেছেন আলোর দিকে।