Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কুড়ি টাকার সিনেমাহল

অরূপ ঘোষ

 

এক বছর অপেক্ষার পর সারা ভারত যা জানতে পেরেছে আজ আমিও তা জানতে পারলাম। আজ আমিও জানতে পারলাম -“কাটাপ্পা বাহুবলীকে কেন মেরেছিল?”
উত্তরটা জেনে এলাম এবং তাও স্রেফ কুড়ি টাকায়।
না, না। কোনোরকম দু’নম্বরী নয়, রীতিমতো হলে টিকিট কেটে “বাহুবলী ২” দেখলাম। কিন্তু মাত্র কুড়ি টাকা দিয়ে। এই কথাটা শুনে অনেকেরই হয়ত চোখ কপালে উঠবে।
না, “বাহুবলী২” কেমন সিনেমা সেই নিয়ে আমি এখানে লিখতে বসিনি। সেটা বরং আপনারা হলে গিয়েই দেখে আসুন। দেখাটা উচিত। আমি বরং আপনাদের সেই সিনেমা হলের কথা বলি যেখানে এখনো কুড়ি টাকায় সিনেমা দেখা যায়।
এখানে আমি আছি প্রায় ছ-সাত বছর হয়ে গেল। কিন্তু এই অঞ্চলের কোনো সিনেমা হলে কখনো সিনেমা দেখতে যাইনি।যদিও এখানে বর্তমানে সিনেমা হল বলতে সবেধণ নীলমণি একটিই, তাও সেটা আবার পাশের জেলা বাঁকুড়াতে। খুব একটা দূর নয়, মাত্র তেরো কিলোমিটার,তাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
আমাদের শহরে এখন টিকিটের দাম দেড়শো টাকা । তারওপর আবার প্রথম সপ্তাহের চারদিনের সব সীট নাকি অনলাইনে আগে থেকেই বুক হয়ে আছে। তাই ছুটিতে বাড়ি গিয়েও বাহুবলী অদেখা। এই অবস্থায় আমার সহকর্মী জয়দেবের কাছে জানতে পারলাম ফুলকুশমা হলে সিনেমাটি চলছে। ব্যাস, প্ল্যা্ন হয়ে গেল । পাঁচ তারিখ যাওয়া হচ্ছে। আমাদের এখান থেকে বাঁকুড়া গেলে প্রথম যে বাজার এলাকাটা পাব সেটাই ফুলকুশমা। এখানকার রাস্তা নিয়ে আগে অনেকবার লিখেছি, তাই এখানে আর কিছু লিখছি না। শুধু একটা কথা বলি- যদিও এখন ভরা গ্রীষ্ম তাও “ভৈরববাঁকি” পেরোতে আমার ভয় ভয় লাগে। বিশেষ করে যখন ব্রীজে নামার আগেই রাস্তার পাশে লাগানো বোর্ডে দেখতে পাই -“হড়পা বান প্রবণ নদী। সেতু পার হওয়ার আগে সতর্ক হোন।“ (ঠিকই পড়েছেন এখানে ব্রীজে ওঠা যায় না, ব্রীজে নামতে হয়। )
তিনটে পঁয়তাল্লিশে শো শুরু হবে , আমরা পৌঁছলাম দুটো কুড়ি নাগাদ। । সবে কিছুক্ষণ হলো আগের শো শেষ হয়েছে। হলের মাথায় লাগানো চোঙে গুলশন কুমার তখন হনুমান চাল্লিশা গাইছেন। আমি তো ভেবেছিলাম টিকিট কাউন্টারে লম্বা লাইন থাকবে , ঠেলাঠেলি, হুড়োমুড়ি করে টিকিট কাটতে হবে । যেমনটা কয়েকবছর আগে পর্যন্তও দেখে এসেছি, করে এসেছি। কিন্তু একী! লাইনে তখনো মাত্র চার পাঁচ জন। জয়দেবের সাথে টিকিট কাউন্টার অব্ধি গিয়ে প্রথম চমক! কাউন্টারের গায়ে লেখা –“এসো মা দুর্গা আমার ঘরেতে বসো।“ এটা আমাদের এখানে অনেকের ঘরেই দরজার পাশে দেখা যায়। সিনেমা হলের গায়ে প্রথম দেখলাম। কিন্তু এটা চমক নয় , চমক হলো টিকিটের দাম, যা দেওয়ালে লেখা আছে- “ব্যালকনি- ২৫ টাকা, স্টল -২০ টাকা” । আমিতো অবাক! এখনো কুড়ি টাকায় হলে বসে সিনেমা দেখা যায় ! কাউন্টারের পাশেই থাকা সিনেমা হলেরই একজন সবাইকে ব্যালকনির টিকিট কাটতে বারণ করছেন। ওখানে নাকি প্রচুর গরম ।তার চেয়ে স্টলে বসে দেখা অনেক ভালো।
জয়দেব লাইনে দাঁড়ালো আর আমি গেলাম রেবেলকে কোথায় রাখা যায় তার ব্যবস্থা দেখতে। হলের বাইরে একটা সাইকেল স্ট্যান্ড আছে , অনেকে সাইকেলও রাখছেন ।তবে সেখানে বাইক তো একটাও নেই। অবশ্য হলের গায়ে পাঁচিল ঘেরা একটা জায়গা থেকে বাইক নিয়ে বের হচ্ছেন অনেকে কিন্তু সেখানে তো টিকিট দেখার কোনো বালাই নেই মনে হচ্ছে। যাইহোক,একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ওটা সিনেমা হলেরই স্ট্যান্ড এবং ওখানে বাইক রাখলে টিকিট বা ভাড়ার কোনো বালাই নেই। এটা দ্বিতীয় চমক ! কেউ কখনো ভাবতে পারে যে একটা সিনেমা হলে টিকিটের দাম কুড়ি টাকা এবং তার সাথে আবার পার্কিং বিনামূল্যে !
আর রেবেলকে রাখতে গিয়েই খোলা দরজা দিয়ে চোখ গেল হলের ভেতরে। না কোনো চেয়ার টেয়ারের বালাই নেই। তার বদলে আছে বেঞ্চ। সারি সারি কাঠের বেঞ্চ দেখা যাচ্ছে।সিনেমা হলে বেঞ্চে বসে সিনেমা এই প্রথম দেখব।
এই হলে শুধুমাত্র ঢুকতে টিকিট লাগে কিন্তু বসতে টিকিট লাগেনা। অর্থাৎ আগে ঢুকলে পছন্দ মতো সিটে বসা যায়। আমরাও খুঁজে খুঁজে পেছনের দিকে ফ্যানের তলায় সীট নিলাম। এতক্ষণে বেঞ্চগুলোকে ভালো করে দেখার আর অনুভব করার সুযোগ পেলাম। কাঠের বেঞ্চ যতটা আরামদায়ক হওয়া সম্ভব ঠিক ততটাই আরামদায়ক। পেছনে হেলান দেওয়া ব্যবস্থাও আছে। এক একটা বেঞ্চে তিনজন করে বসতে পারবে। শো শুরু হওয়ার আগে সবলিমিয়ে গোটা পঞ্চাশেক লোক আমরা নীচে বসেছি। এই হল এতদিন চলছে কিকরে সেটাই আশ্চর্যের। আমাদের সামনের বেঞ্চ পুরোটাই ফাঁকা , সেখানেই ব্যাগ হেলমেট সব রেখে বেশ গুছিয়ে বসলাম।
এরপর শুরু হলো সিনেমা। ওহ, তার আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ। না, ধুমপান করলে কী কী ক্ষতি হতে পারে সেই সব জ্ঞান নয়, বরং বলা হলো- “দয়া করে সিনেমা রেকর্ডিং করবেন না। রেকর্ডিং করলে আপনি হয়ত সিনেমাটি বার বার দেখতে পাবেন কিন্তু আমাদের হলটি একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। “ দ্বিতীয় সতর্কীকরণ –“হলের ভেতরে কেউ ধুমপান করবেন না। ধুমপান করার ইচ্ছে হলে বাইরে গিয়ে করে আসতে পারেন কিন্তু হলের ভেতরে ধুমপানরত অবস্থায় পুলিশ ধরলে হল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।” এবং শেষ সতর্কীকরণ হলো- “আপনারা আনন্দ করুন কিন্তু মা বোনেদের সম্মনা বজায় রাখুন।আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে এমন কোনো আচরন করবেন না যাতে মা বোনেদের সম্মানহানি হয়। ” আমাদের পেছনেই দুজন মহিলা বসে। স্টলে মহিলাদের বসতে দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম । সচরাচর মহিলারা স্টলে বসেন না। যদি সাথে কোনো পুরুষ সঙ্গী না থাকে তাহলে তো বসার কোনো কথাই থাকেনা। এদের সাথে কোনো পুরুষ সঙ্গী আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
তো যাই হোক, শুরু হলো সিনেমা। আবার সেই খড়্গপুরের পুরনো “বোম্বে টকিজ”! প্রতিটা ডায়লগ বা ধুমধাম অ্যাকশনের পর হাততালি, চিৎকার আর সিটির আওয়াজ। সিনেমা যত এগোচ্ছে দর্শকের সংখ্যাও তত বাড়ছে। হলের ভেতর সিগারেট, বিড়ি আর সেন্টের মেশানো গন্ধ। একেবারে জমজমাট ব্যাপার।
অনেকের হয়ত খারাপ লাগতে পারে এই পরিবেশের কথা জেনে। কিন্তু আমার বেশ কাটল সময়টা। ভালো একটা সিনেমা আর তার সাথে জমজমাট একটা পরিবেশ। আইনক্স বা ওই ধরণের সিনেমা হলে ঢোকার সুযোগ আমার হয়নি এখনো। আমার দৌড় আমাদের শহরের নতুন সিনেমা হল অব্ধি। বেশ ভালো হল – পুরোটা এসি লাগানো, নরম আরাম দায়ক সীট, ভালো খাবার এবং নিরাপদ(সিকিউরিটি গার্ড তো আছেই তার ওপর টিকিটের দাম বেশী হওয়ায় “যে-সে ” এখন আর ঢুকতে পারে না।)। সবই ভালো তবে এতকিছু হওয়ার পরেওকিছু যেন একটা হারিয়ে গিয়েছে। আজ এই হলে সিনেমা দেখতে এসে বুঝতে পারলাম কী হারিয়ে গিয়েছে। আসলে সিনেমা হলের মধ্যে একটা প্রান থাকে, সেটাই হারিয়ে গিয়েছে। যে হলে হিরোর ডায়্লগে সিটি পড়ে না, তালি বাজে না সে হলে আর যাই থাকুক প্রাণ থাকে না। এখানে আছে সেই প্রাণ প্রাচুর্য । আর নিরাপত্তা ?-সিনেমা এগোনোর সাথে সাথে দর্শক সংখ্যা বাড়লেও আমাদের পেছনে বসা সেই দুই মহিলা, তাদের দুপাশের দুটো বেঞ্চ কিন্তু শো শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি খালিই দেখেছি।