Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অনিত্য

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

 

শিখা ঊর্ধ্বগামী। অগ্নির। জয়পুর জঙ্গলের শেষে একটা রিসর্ট। প্লেস টু এন্টারটেন। আদিবাসী রমণী, নাচ, পাগলের মতো দিশেহারা খরগোশ, কাতর স্বরে ডাকা কয়েকটা এমু। এবং আগুন। মেয়েগুলোর মাথায় কলসি। লিখে রাখা জয়রামবাটি, বাঁকুড়া, মুকুটমণিপুর। আগুন। অতীশের বারবার ওইদিকে চোখ চলে যায়। বাবা তেরোয় গেল। দেখিস, বডি ডোনেট করা আছে কিন্তু। আমার যদি কিছু হয়। কয়েকটা বছর আগে বলেছিল। রাতবিরেতে মফস্বলী হৃদয়। হঠাৎ থেমে গেলে তখন আর চুক্তির কথা মনে থাকে না। শক, বিলাপ, কাজকর্ম। চিতার সামনে ছোট্ট করে একটা সরি বলাও হয়নি অতীশের। মায়াবী রিসর্টে আলোর কায়ারোস্কিউরো। ঘাসের ডগায় চাঁদের চলকে ওঠা। অতীশের পা টলে যায়। সুপ্রতিম। আগের দিন রাতে ওসব খেয়ে ফোনে দিনগত পাপক্ষয়। বইয়ের প্রুফ। বাংলা লেখার গতিক পাল্টে দেওয়া আমি-তুমি-আমরা। মাত্র চারঘণ্টার ব্যবধান। যোগাযোগ নেই এমন এক সহযোদ্ধার মাঝরাতে ফোন। দিনদশেক পর ওর মার মুখোমুখি হল। চিতার গল্প বলছিলেন। ঠাণ্ডা গলায়। চোখের নীচে গর্ত। স্রোত। ওর বইয়ের র‍্যাক। সন্দীপন, বিনয়, কমলকুমার। শালা, বাস্টার্ড। মাদল। সেই বাঁকুড়া। পাঁচমুড়ার টেরাকোটা গ্রামের রাস্তা। গৌতমদা নিয়ে গেছিল। সঙ্গে পৃথা। কলেজ ক্রাশ। শেষবার এসএলআর, প্রিয় ব্র্যান্ড আর মাদলের সঙ্গে হালকা করে ঠোঁট। পৃথা। সেবার প্রথম, শেষ। এখন কেন্টাকি। মেইল করে মাঝে মাঝে। গৌতমদা দেখে ফেলে আড়ালে ডেকেছিল। সারারাত স্মৃতিচারণ। বৌদি। সন্তানহীনতা। ডিপ্রেশন। অশান্তি। মেঘ। সাইক্রিয়াটিস্ট। গত মাসে কেরোসিন। গৌতমদা দরজা ভেঙে ঢুকতে ঢুকতেই থার্ড ডিগ্রি। ভেতরে মহুয়া রায়চৌধুরীর সিনেমা চলছিল। দেড়দিন লড়াই। ওটুকুই। ‘প্রেম করছিস কর, আগুনের অত কাছে যাস না’ গৌতমদা বলেছিল। মেয়েগুলো পাগলের মতো নাচছে। সুর একঘেয়ে বড়। শুধু গানের কথাগুলো জানতে ইচ্ছে করছে। টানছে কেন এত? মা তখন সেরিব্রালে পড়ল। মালতী আসত। –‘কাজের লোকেদের মতো না। কেমন যেন ঠাট।’ –‘আঃ, মা। কী যে বলো।’ দাদাবাবু, বলে যখন তখন এটা ওটা। চা, জলখাবার। অফিস বেরোনোর সময়ে সামনাসামনি। ও স্নান করে ফিরছে। পিঠ অব্দি চুল। রোজা, জানেমন। অতীশের স্মৃতি। মাঝখানেরটুকু ব্ল্যাক আউট। পরেরদিন কাগজ। মালতী আসতে দেরি করছে। –‘খোঁজ নে তো একটু?’ কাগজ খোঁজ দিল। ওদের বস্তিতে আগুন। যাবতীয় সব শেষ। মালতী তারপর আর আসেনি। কোথায় এখন? কোন আগুনে ঘরছাড়া হল ও? -–‘আরে, আরে, কী করছ’, বলে আঙুল সরিয়ে দিল শিখা। সঙ্গে রাহুল। হাতটা ছুঁল। আদিবাসী নাচ শেষ। আগুন সর্বনাশা। যা স্মৃতি পেলেই পোড়াতে আসে। কিছুই পার্মানেন্ট নয়। বন্ধু, পিতা, অতীত, ট্রমা। সবকিছু খেয়ে ছিবড়ে করে দেয়। শরীরও। শিখারা না থাকলে আঙুল ঝলসে যেত। ঘোরের ভেতর আগুনের দিকে এতটা এগিয়ে গেছিল অতীশ? চারবছর পেরোচ্ছে রাহুল। মায়াবী মুখ। স্বর। শিখার অফিস, ঘর, লড়াই। দুজনকে কাছে টেনে নিল। ওরা খানিক মান অভিমানে শেষমেশ কাছে এল। পরের নাচ শুরু। নতুন এক সংস্কৃতি। পুরুষ, রমণী। কাঠের যোগান দিতে রিসর্টের লোকগুলো হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে। অতীশের মনে হল আগুন কিছু দিতেও জানে।