Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্যাপ্টেন দুপুরে ভাত খেতে গেছে আর নাবিকেরা দখল নিয়েছে জাহাজের — সপ্তম পর্ব

চার্লস বুকাওস্কি

বাংলায়ন : শুভঙ্কর দাশ

ষষ্ঠ পর্বের পর

 

১০/৩/৯১

রাত ১১টা ৫৬

আজ আরেকটা দিন ইন্টারট্র্যাকের বাজি ধরার। যেখানে জ্যান্ত ঘোড়াগুলো দৌড়বে ওক ট্রিতে যেখানে মোটে হাজার সাতেক লোক হয়েছে। অনেকেই গাড়ি চালিয়ে আরকাডিয়া অবধি যেতে চায় না। যারা শহরের দক্ষিণ দিকে থাকে তাদের নিতে হবে হার্বার ফ্রিওয়ে তারপর পাসাডেনা ফ্রিওয়ে আর তারপর আরও গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে সারফেস স্ট্রিট বরাবর রেসের মাঠে পৌঁছনোর জন্য। ওই রাস্তাটা অনেকটা লম্বা এই গরমে। গাড়ি চালিয়ে গিয়ে ফিরে আসা ওখান থেকে আমাকে খুব ক্লান্ত করে দিত।

একজন পাতি ঘোড়ার ট্রেনার আমাকে ফোন করল। ‘ওখানে কেউ নেই। এই শেষ। আমাকে একটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে হবে। ভাবছি একটা ওয়ার্ড প্রসেসর কিনে আমি লেখক হয়ে যাব। আমি তোমাকে নিয়ে লিখব…’

ওর গলাটা ধরা ছিল ম্যাসেজ মেশিনে। আমি ওকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানালাম ২য় হওয়ার জন্য একটা ৬ থেকে ১ খেলায়। কিন্তু ওর বড় মন খারাপ ছিল।

‘ঘোড়ার পাতি ট্রেনার খতম। এই শেষ’, সে বলল।

যাকগে কাল দেখব কেমন লোক হয়। শুক্রবার। হয়ত আরও হাজার খানেক বেশি হবে। এটা ইন্টারট্র্যাক বাজি নয় শুধু এটার কারণ অর্থনীতি। অবস্থা ক্রমে খারাপ হচ্ছে তা সরকার বা মিডিয়া না মানতে চাইলেও। যারা এখনও বেঁচে আছে এই অর্থনীতিতে তারা চুপ করে আছে। সব থেকে বড় ব্যবসা যা চলছে তা হল ড্রাগের ব্যবসা। ওটা সরিয়ে দিলে দেখা যাবে সমস্ত তরুণ বেকার হয়ে গেছে। আমি, এখনও একজন লেখক হিসেবে চালিয়ে যেতে পারছি কিন্তু সেটা রাতারাতি হাওয়া হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তবু আমার বৃদ্ধ বয়সের পেন্সান আছে যা মাসে ৯৪৩ ডলার। ওরা আমাকে দিয়েছে ওটা আমার বয়স যখন ৭০ ছোঁয়। কিন্তু সেটাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভাবুন একবার সমস্ত বৃদ্ধরা রাস্তাময় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের পেন্সান ছাড়া। এটা বাদ দেবেন না। জাতীয় ঋণ আমাদের সবাইকে টেনে নিচে নামিয়ে আনতে পারে একটা বিশাল অক্টোপাসের মতো। লোকজন তখন ঘুমোবে কবরখানায়। আর একই সময় এই পচনের উপরিতলে থাকবে বেঁচে থাকার বড়লোকামী। এটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় কি? কিছু মানুষের এত বেশি টাকা আছে যে তারা জানেই না তাদের কত টাকা আছে। আর হলিউডের দিকে দেখুন তারা ৬০ মিলিয়ান ডলারের ছবি বানাচ্ছে যা এতটাই বোকা বোকা ওই গরীব বোকা লোকগুলোর মতোই যারা ওই ছবি দেখতে যায়। বড়লোকরা ঠিকই থাকে, তারা চিরকালই খুঁজে পেয়েছে তাদের সিস্টেম চালানোর রসদ।

আমার মনে পড়ে যখন ঘোড়দৌড়ের মাঠগুলো ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কাঁধে কাঁধ, গাঁড়ে গাঁড়, ঘাম ঝরছে, চিৎকার আর ভরতি বারের দিকে ঠেলাঠেলি। ভালো সময় ছিল সেটা। একটা ভালো দিন কাটুক, আপনি বারে ঠিক পেয়ে যাবেন একজন নারী আর সে রাতে আপনার অ্যাপার্টমেন্টে আপনারা মাল খাবেন দুজনে আর হাসবেন হা হা করে। আমরা ভেবেছিলাম ওইসব দিন (আর রাত্রি) কখনও ফুরোবে না। আর কেনই বা ফুরোবে? পার্কিং লটে বালের খেলা। ঘুষোঘুষি। সাহসের বড়াই আর বিজয়-গৌরব। ইলেক্ট্রিসিটি। বাল, জীবনটা ছিল ভালো, জীবনটা ছিল মজার। আমরা ছেলেরা সবাই পুরুষ ছিলাম, কারও কোনও বাতেলাবাজী সহ্য করিনি। আর সত্যি বলতে কি সেটা ভালো লাগত। মদ আর বে’তে গড়াগড়ি। আর ছিল প্রচুর বার, পুরো বার। কোনও টিভি সেট নেই। আপনি বকবক করবেন আর ঝামেলায় জড়াবেন। রাস্তায় মাতাল অবস্থায় যদি ধরে আপনাকে তাহলে একটা রাতের জন্য তারা আপনাকে জেলে পুরে রাখবে যাতে আপনি ফের ঠিকঠাক হয়ে ওঠেন। আপনি চাকরি হারাবেন আর আবার চাকরি পাবেন। একটা জায়গায় পড়ে থেকে কোনও লাভ নেই। কী সময় ছিল। কী জীবন ছিল। পাগলামি নানান রকম ঘটছে সারাক্ষণ আর তারপর ঘটছে আরও পাগলামি।

এখন সেসব কমে গেছে। সাত হাজার লোক একটা নাম করা ঘোড়দৌড়ের মাঠে একটা রোদের আলো ঝলমলে দুপুরবেলায়। বারে কেউ নেই। শুধু একা বাররক্ষক তোয়ালে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন সব গেল কোথায়? এত লোক আগে ছিল না কিন্তু তারা সব কোথায়? এক কোণে দাঁড়িয়ে, একটা ঘরে বসে। বুশ হয়ত আবার নির্বাচনে জিতবে কারণ ও জিতেছে একটা সহজ যুদ্ধ। কিন্তু ও অর্থনীতির জন্য কিস্যু করেনি। আপনি জানেন না যে কাল সকালে আপনার ব্যাঙ্ক আদৌ খুলবে কিনা। আমি এভাবে ব্লুস গাইতে চাইছি না। কিন্তু আপনি জানেন যে ১৯৩০-এ লোকজন অন্তত জানত তারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। আর এখন খেলাটা যেন আয়নার। আর কেউ জানে না কীভাবে এখনও সব কিছু একসাথে জুড়ে আছে। বা তারা কার জন্য ঠিক এসব কাজকর্ম করছে। যদি তারা কাজ করে আরকি।

ধুর বাঁড়া এটার থেকে বেরোতে হবে আমায়। আর কেউ তো সরকারের কাজকর্ম নিয়ে সমালোচনা করছে না। অথবা তারা যদি তা করে থাকে, তারা এমন একটা জায়গায় আছে যে কেউ তা শুনতে পাচ্ছে না।

আর আমি বসে বসে লিখছি কবিতা, একটা উপন্যাস। আমার উপায় নেই আমি এ ছাড়া কিছু করতে পারি না।

৬০ বছর অবধি আমি ছিলাম ভিখিরি। এখন আমি ভিখিরিও না বড়লোকও না।

রেসের মাঠে ওরা লোক কমাবে কন্সেশন স্ট্যান্ডে, গাড়ি পার্কিং-এর জায়গায় আর বিজনেস অফিসে আর মেন্টেনেন্সে। রেসের জন্য কমে আসবে টাকা। ছোট মাঠ। কম জকি। আরও কম হাসি ঠাট্টা। কমিউনিজম এড়িয়ে বহাল তবিয়তে আছে ক্যাপিটালিজম। আর এখন সে খাচ্ছে নিজেকে। এগিয়ে চলেছে ২০০০ এডি-র দিকে। আমি মারা যাব ততদিনে, কেটে পড়ব এখান থেকে। রেখে যাব আমার সামান্য বইয়ের স্তূপ। রেসের মাঠে সাত হাজার লোক। সাত হাজার। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। ধোঁয়াশায় কাঁদে দা সিয়েরা ম্যাড্রেস। যখন আর ঘোড়া দৌড়বে না ভেঙ্গে পড়বে আকাশ, সোজা চওড়া হয়ে সব কিছু গুঁড়িয়ে দিয়ে। গ্লাসওয়ার ৯ নম্বরটা জিতেছে। ওর উপর আমার দশ ডলার বাজি ধরা ছিল।

১০/৯/৯১

রাত ১২টা ৭ মিনিট

আমদের মতো বুড়োদের জন্য কম্পিউটার ক্লাস একটা যন্ত্রণার ব্যাপার। আপনি এটা অল্প অল্প বুঝতে চেষ্টা করেন যাতে একটা সম্পূর্ণ জ্ঞান জন্মায়। কিন্তু ঝামেলাটা হল বই বলে একরকম আর কিছু লোক বলে অন্যরকম। পারিভাষিক শব্দগুলো ধীরে ধীরে বোধগম্য হয়। কম্পিউটার শুধু করতে পারে, সে কিন্তু কিছু জানে না। আপনি তাকে ঘেঁটে দিতে পারেন আর সে আপনার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। আপনার উপর নির্ভর করে কীভাবে আপনি তার সাথে মিলেমিশে চলবেন। তবু কম্পিউটার পাগলে যেতে পারে আর উদ্ভট সব কাণ্ডকারখানা করতে পারে। সে ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারে, বের করে ফেলতে পারে ছোটখাট বোমা ইত্যাদি। আজ রাতে মনে হচ্ছে কম্পিউটারের ব্যাপারে যত কম বলা যায় তত ভালো।

ভাবছি কী হল সেই পাগলা ফ্রেঞ্চ সাংবাদিকের যে আমার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিল অনেকদিন আগে, প্যারিসে। যেভাবে লোকে বিয়ার খায় সেভাবে সে হুইস্কি খেয়েছিল। আর বোতলগুলো যত খালি হচ্ছিল সে তত উজ্জ্বল আর আকর্ষক হয়ে উঠছিল। হয়ত মারা গেছে। আমি দিনে ১৫ ঘণ্টা মদ খেতাম কিন্তু তার বেশিরভাগটাই ছিল বিয়ার আর ওয়াইন। আমারও মরে যাওয়া উচিৎ। আমি মরে যাব। খারাপ লাগছে না ওটা ভাবতে। আমার বেঁচে থাকা তো অদ্ভুত আর কুঞ্চিত আর কর্কশ, বেশিরভাগটাই অসহ্য, পুরোটাই কেটেছে উঞ্ছবৃত্তিতে। কিন্তু আমি মনে করি এভাবেই নিজেকে ছিঁড়ে ফেড়ে নিয়ে গেছি আমি নোংরার ভিতর দিয়ে যা তফাৎ গড়ে দিয়েছিল। এখন পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় আমি দেখাতে পেরেছিলাম কিছুটা উচ্চমান যা কিছুই ঘটুক না কেন। মনে পড়ছে এফ বি আইয়ের লোকজন আমাকে গাড়িতে নিয়ে যেতে যেতে কেমন বিরক্ত হয়েছিল। ‘আরে এই লোকটার মাথাটা তো খুব ঠাণ্ডা দেখছি’, একজন রেগে চেঁচিয়ে উঠেছিল। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করিনি কেন আমাকে তোলা হল বা আমরা কোথায় যাচ্ছি। আমার কাছে ব্যাপারটার গুরুত্ব ছিল না। জীবনের আরেকটা মানেহীন টুকরো। ‘আচ্ছা দাঁড়াও’ আমি ওদের বললাম, ‘আমার ভয় করছে’। সেটা ওদের বেশ ভালো লাগল। আমার কাছে ওরা ছিল ভিনগ্রহের জন্তু। আমরা একে অপরের সাথে সম্বন্ধযুক্ত হতে পারছিলাম না। কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুত। আমার কিছুই মনে হচ্ছিল না। যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি অদ্ভুত ছিল না আমার কাছে, মানে আমি বলতে চাইছি সাধারণ জ্ঞানে ব্যাপারটা অদ্ভুত ছিল। আমি শুধু দেখছিলাম হাত আর পা আর মাথা। ওরা কিছু একটা মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, সেটা ওদের ব্যাপার। আমি কোনও বিচার বা লজিক খুঁজিনি। কখনওই তা খুঁজিনি আমি। হয়ত তাই আমি কখনও কোনও সামাজিক প্রতিবাদ নিয়ে কিছু লিখিনি। আমার কাছে এই পুরো ধাঁচাটাই কোনও মানে করবে না তা সে তারা তা নিয়ে যা খুশি করুক না কেন। আপনি কখনওই কিছুটা ভালো বার করতে পারবেন না তার থেকে যা আসলে তার ভেতরে নেই। ওই ছেলেগুলো চাইছিল আমি ভয় পাই, ওরা ওতেই অভ্যস্ত। আমার জাস্ট বিরক্ত লাগছিল।

এখন আমি চলেছি কম্পিউটার ক্লাসে। কিন্তু সেটা ভালোর জন্যই যাতে শব্দ নিয়ে খেলতে পারি আমি, আমার একমাত্র পুতুল। আজ রাতে সেটা শিখতে। রেডিয়োতে ক্লাসিকাল বাজনা ভালো নয় তেমন। ভাবছি ওটা বন্ধ করে দি। আর বসি গিয়ে বৌয়ের কাছে আর বেড়ালগুলোর সঙ্গে। কখনও ধাক্কাধাক্কি করবেন না, কখনও জোর করবেন না শব্দের সাথে। কোনও প্রতিযোগিতা নেই কোথাও আর খুব অল্পই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। খুবই সামান্য।

(আবার আগামী সংখ্যায়)