Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্ষত যে ভাবে গান গায়

সর্বজিৎ সরকার

 

একুশ বছর! কল্পনা করাই খুব কঠিন, তাই না। আর একা। সম্পূর্ণ একা। একা বললেও বোধহয় ঠিক বোঝানো যায় না। কেমন একা? কতটা একা? ফাঁকা ধূসর বিস্তীর্ণ চরাচরের মধ্যে একটা শুকিয়ে যাওয়া গাছ যার গায়ে কোনও পাতা নেই, চামড়া কুঁচকে যাচ্ছে ক্রমশ, শরীর অশক্ত দুর্বল আর ক্ষয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, ত্বকের রঙ পালটে গাঢ় বাদামী থেকে কালচে খয়েরি হয়ে আরও বেশি কালো হয়ে উঠছে ক্রমে, কোনও ঋতু যাকে আর স্পর্শ করে না কখনও, অথচ যার রাত আর দিনের মাঝখানে, তার ঘুম আর আর তার জাগরণের মধ্যে কোনও কথা, কথার অন্তহীন অভিসার জন্ম নিচ্ছে কিনা, সে কথা জানা হবে না কোনওদিনও, তেমনি একা সে। একুশ বছর। কথা বলেনি সে।

যে ঘরটায় সে থাকে, দশ বাই দশের থেকে আর একটু ছোট। জানলা নেই। একটা ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে আলো নয় আলোর দু একটা রেখা এসে পড়ে। একটা দরজা। লোহার। এরকম সারি দেওয়া ঘর এ বাড়িতে আরও আছে। মাঝখানে একটা লম্বা করিডোর তার দুদিকে সার দেওয়া ঘর। ঘর নয় আসলে কুঠুরি। শাসনের ভাষায়, সেল। পিত্তি উঠে আসা বমিতে যে রঙ থাকে তেমনি ঝাপসা সবুজ রঙ করিডোরের দুপাশের দেয়ালে। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসা। পুরো বাড়িটা ঘিরে উঁচু পাঁচিল। একটা টাওয়ার থেকে চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখে একজন সৈন্য। হাতে মেশিনগান। মোট তিরিশ জন সৈন্য পাহারা দেয় এ বাড়ির বাসিন্দাদের।

তিরিশ জন সৈন্য অথচ বন্দি মাত্র সাতজন। ছশো কয়েদিকে রাখা সম্ভব ছিল এ বাড়িতে কিন্তু রাখা হয়নি। শুধু সাতজন। চল্লিশ বছর আগে নিয়ে আসা হয়েছিল তাদের। লাইফ টার্ম ছিল কয়েকজনের। বিশ বছরের মাথায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে অথবা অসুস্থ হয়ে মুক্তি পেয়েছে বাকি ছয়জন। তাকে ছাড়া হয়নি। কয়েদি নং সাত।

এই নামেই তাকে সবাই ডাকে এখানে।

মার্জিনে এতটুকুই লিখে রেখেছিলাম। বস্তুত জেলখানার জীবন নিয়ে হঠাৎ কেন কৌতূহল হল, এটাও এই মুহূর্তে কিছুতেই মনে পড়ল না আমার। ইউ টিউবে কয়েকটা ভিডিও সার্চ করতে করতে আচমকাই পৌঁছে গিয়েছিলাম ‘দ্য স্প্যানডাউ ব্যালে’ নামের একটা ছোট ফিল্মের পাতায়। ছবিটা কয়েক বছর আগে বানানো। কিছুটা ইতিহাস আর কিছুটা কল্পনা মিলিয়ে তৈরি। একজন ব্যালে ডান্সার যাকে নাৎসিরা বন্দি করে নিয়ে এসেছে স্প্যানডাউ’এর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। তার শেষ কিছু মুহূর্তের ছবি। ছবির শুরুতেই মহিলাকে একটা জনহীন ফাঁকা মাঠের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। বোঝা যায় এটা একটা বন্দিশিবির। কমান্ডার তাকে নির্দেশ দেন সম্পূর্ণ নগ্ন হতে। বাকি সেনারা তাকে ভাবলেশহীন মুখে ঘিরে রাখে। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটা চিমনির মতো দেখতে চেম্বারে। মাথার ওপরে একটা গোল ছিদ্র। সেই সেল’এ ঢোকানোর সময় কমান্ডার হুকুম দেয়, যাও নাচ দেখাও এবার। অন্ধকার সেল এ নগ্ন নারীমূর্তি ভয় পায়, আর্ত চিৎকার করে, আর একটু একটু করে রূপান্তরিত হয় ব্যালেরিনায়। অন্ধকারে নাচে। তার আর্তি আর হাহাকার কখনও রাজহংসীর উড়ান, কখনও স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, কখনও অসহায় বন্দির অবয়বে বারেবারে পালটে যেতে থাকে।

চাকরি ছাড়ার পর থেকে আমি এই কাজটাই করি। তাতে যদিও খুব সামান্যই রোজগার হয়। বড় জোর সিগারেটের খরচা আর বাস বা অটো ভাড়া। ভাগ্যিস বাড়িতে কম্পিউটারটা ছিল। অনলাইনের কাজ। কয়েকটা ওয়েবসাইটের জন্যে রিসার্চ করে দেওয়া। তথ্য জোগাড় করে একটা পাঁচশো শব্দের সামারি বানিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া। নেটিজেনদের অত সময় কোথায় খুঁজে খুঁজে পড়বে, তলিয়ে ভাববে। আমার জন্যে কাজের নির্দেশ আসে মেইলে, আমি কাজ করে কাজ পাঠাই, তাও মেইলে। সত্যি বলতে ওপাশের লোকটাকে আমি আজ অবধি দেখিনি। সে ছেলে না মেয়ে তাও জানি না। নামে যদিও ছেলেই মনে হয়।

আমার এবারের বিষয়টা বেশ অদ্ভুত। নির্দেশে শুধু বলেছে, ইংরিজিতে, ‘ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দি বডি হোয়েন ইট ইজ টরচারড’। ব্যাপারটা বুঝতেই আমার সময় লেগে গেল একদিন। অথচ তিন দিনে শেষ করতে হবে কাজটা।

অত্যাচারের সময় শরীর যেভাবে কথা বলে। সত্যি আজব একটা বিষয়। কোথা থেকে শুরু করব খুঁজতে তাই তো বুঝতে পারছি না!

অন্ধকার। এখানে এখন যে অন্ধকারটা দেখছি তা এতটাই কালো, এত ঘন, যে আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার হাতদুটো আমার অজান্তেই কখন সামনের দিকে চলে গেছে। হাতড়াচ্ছে তারা। অন্ধকার। কিচ্ছু দেখছি না। হাতড়ে হাতড়ে চেষ্টা করছি কিছু একটা ছুঁতে। দেওয়াল? কোনও আসবাব? কোনও জিনিস? বাটি, গেলাস, মরা পোকা? আগের কয়েদি ফেলে গিয়েছিল, এমন কিছু? আমি জানি না। কিছু একটা। শুধু কিছু একটা ছুঁতে চাইছি। শুধু এটা জানি। আমি বুঝতে পারছি না এই ঘরটার দৈর্ঘ্য কত। প্রস্থই বা কত? আমার মাথা আস্তে আস্তে ভারি হয়ে আসছে। স্পষ্ট করে ভাবতে পারছি না। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কে শুনবে। আমি তো জানি এই ঘরটার দেওয়াল এত পুরু যে বাইরে কোনও আওয়াজ যাবে না।

নাৎসি বন্দীদের বয়ান আছে এমন দুটো সাইট খুঁজে পেয়েছি। তাতে বেশ কিছু তথ্য পেলাম। কিন্তু তথ্য এক জিনিস আর অনুভব আর এক জিনিস। বুঝতে পারছি না কীভাবে সামারাইজ করব। পাঁচশো শব্দে! আমার নিজের কোনও টর্চারের অভিজ্ঞতা নেই। তাহলে?

এখানে নিয়ে আসার আগে ওরা আমার হাত বেঁধে দিয়েছিল। পিছমোড়া করে। আমার চোখ, কান, ঠোঁট, পুরোটাই ঢেকে দিয়েছিল একটা থলের মধ্যে। গলার কাছটা বাঁধা। আমার গায়ে একটা সুতোও ছিল না। শীত করছিল আমার। কাঁপছিলাম। কে যেন প্রচণ্ড জোরে একটা চড় মারল বাঁ গালে। তারপর ডান গালে। ব্যথা। আর রাগ। ভয়ঙ্কর একটা রাগ গ্রাস করছিল আমায়। কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। আমি প্রাণপনে হাতদুটো ছাড়াতে চেষ্টা করছিলাম। পারছিলাম না। কে যেন আবার চড় মারল। তারপর আবার। আবার, আবার। মারতেই থাকল। থামছে না। আমার মাথাটা একবার এদিক আর একবার ওদিক করছিল। যেন একটা পেন্ডুলাম। ব্যথা। যন্ত্রণা। ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছিল গালদুটো। কোনও বোধ কাজ করছিল না আমার আর। বুঝতে পারছিলাম মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অন্য আর একটা হাত চুলের মুঠি ধরে টানল। মাথাটা উঁচু, চোয়ালটা উপর দিকে, আবার, আবার, আবার, আঘাত থামছে না। আমি চেতনা হারাচ্ছিলাম। মনে নেই। আর কিছু মনে নেই আমার।

কঁকিয়ে উঠে, শীৎকারে, একটা অসহ্য ব্যথায়, ধাক্কা মারতে মারতে, শরীর, আমার শরীর, হঠাৎ এক ঝটকায় আমাকে শুধু বলে গেল, কিছু একটা, কেউ একটা, আমার পেছন থেকে, ফুঁড়ে, আমার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।

আমার আর কিছু মনে পড়ে না।

মাথাটা ধরে গিয়েছিল। অনেকটা সময় নেট দেখছি। পড়ছি। নোট করছি। লিখে রাখছি কিছু কিছু। লেখাটা শেষ করব কি ভাবে এখনও জানি না। কিন্তু শেষ তো করতেই হবে। টাকাটা খুব দরকার। বৌয়ের কাছে রোজ টাকা চাইতে ভালো লাগে না। কিন্তু যন্ত্রণার কি আদৌ কোনও ভাষা হয়? কিংবা হয় হয়ত। একটা দুঃস্বপ্নের ভাষা। অবচেতনের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকে। তারপর হঠাৎ আচমকা বেরিয়ে আসে। হানা দেয়। রোজের জীবনকে ছিঁড়েখুঁড়ে, ক্ষত বিক্ষত করতে করতে দেখা দিয়ে যায়। তাতে রাগ আসে। ভয়ঙ্কর একটা রাগ। অন্ধ ক্রোধ। মনে হয় ভাঙি। সব ভাঙি। ভেঙে চুরমার করে দিই সবকিছু। কেন ভাঙছি জানি না। কিসের জন্যে ভাঙছি তাও জানি না। শুধু এই ব্যথাটাকে, এই যন্ত্রণাটাকে, বের করে দিতে হবে শরীর থেকে। মাথার ভেতর থেকে।

কয়েদি নং সাত। স্প্যানডাউ-এর কয়েদখানায় যাকে চল্লিশ বছর আটকে রাখা হল সে নিজে একজন জঘন্য যুদ্ধঅপরাধী। কয়েক লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে যখন গ্যাস চেম্বারে শ্বাসরোধ করে খুন করা হচ্ছে, তখন সে নিজে ফ্যুয়েরারের ডান হাত। অথচ যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে আসছে তার কিছুকাল আগেই সে একা আসছে বিপক্ষের কাছে শান্তির বার্তা নিয়ে। ধরা পড়ে নয়। আত্মসমর্পণ করতেও নয়। শান্তি প্রস্তাব নিয়ে। কেন? সে কি জানত না ধরা পড়ার অর্থ মৃত্যুদণ্ড। তাহলে?

আসার কারণ হিসেবে সে বলেছিল, দুটো ছবি আমাকে তাড়া করে যাচ্ছে। একটা, সারি সারি শিশুর কফিন আর তার পেছনে তাদের মায়েদের দীর্ঘ সারি। আর দ্বিতীয়টা, সারি দেওয়া মায়ের কফিন যার পেছন পেছন তাদের বাচ্চারা কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে।

ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে রুডলফ হেসকে যুদ্ধ অপরাধী বলা হলেও মানবতার হত্যাকারী সাব্যস্ত করা হয়নি। স্প্যানডাউ- এর কারাগারে শুধু চল্লিশ বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল। যে সময়টা লোকটা একা, চুড়ান্ত একা হয়ে বেঁচেছিল একানব্বই বছর বয়স অবধি। ১৭ই আগস্ট, ১৯৮৭, তার মৃত্যুর তারিখ। মিত্রশক্তির তিনটে দেশ কারণ দেখিয়েছিল আত্মহত্যা। একানব্বই বছর বয়সে আত্মহত্যা! কেন? উত্তর নেই। লোকে বলে খুন। রুডলফ হেসকে হত্যা করা হয়েছিল।

পড়তে পড়তে সাদা পাতায় নিচের কথাগুলো লিখে রাখলাম। আমার কাজটার সাথে সরাসরি যোগ না থাকলেও মনে হল ভাবনাটা জরুরি।

শব্দকে আটকে রাখা যায় সলিটারি সেল-এ, টর্চার করা যায়, যে পাঁচটা ইন্দ্রিয় দিয়ে শরীর দেখে, শোনে, স্বাদ নেয়, স্পর্শ অনুভব করে, গন্ধ পায়, আঘাত করা যায় তার প্রত্যেকটাকে, কখনও এক এক করে, কখনও একসাথে, শুধু একটাই জিনিস সম্ভব হয় না শেষ অবধি।

আমার জিভ আমার নিজের। কিন্তু শব্দের ওপর কোনও অধিকার নেই আমার। তারা স্বাধীন। কোথাও থাকে না। তারা সময়ের মতো, কারও নয়। তাদের আটকে রাখা যায়, শ্বাসরোধ করা যায় কিছুদিনের জন্য, কিন্তু হত্যা করা যায় না।

শব্দেরা আজব প্রাণ। নিঃশব্দে, বুকে হেঁটে, সকলের চোখের আড়ালে অপেক্ষা করে থাকবে। যদি কেউ নিজে থেকে শুনতে চায় তাদের, মন থেকে, তার সবকিছু দিয়ে, হয়ত তখন সে জানান দেবে নিজের অস্তিত্বের কথা। কখনও ফিসফিস করে। কখনও আর্তস্বরে। কখনও নীরবে।

মাথাটা ভারি হয়ে আসছে। ঘাড় ব্যথা করছে। খেয়াল করিনি লিখতে লিখতে কখন মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে। জানলা দিয়ে বাইরে ঘুমিয়ে থাকা বাড়িগুলো দেখি। অন্ধকারে ডুবে আছে তারা। তাদের ঘর, তাদের মানুষজন, তাদের রোকজকার দিন আর রাতের সামান্য সুখ আর বিষাদের দৈনন্দিনকে জড়িয়ে শুয়ে আছে তারা। গুমোট একটা রাত তাদের ঘন হয়ে জড়িয়ে আছে। আপাত শান্তিকল্যাণে আর একইসাথে কোনও অতর্কিত ছোবলের অজ্ঞাত আশঙ্কায়।

স্প্যানডাউ-এর কুঠুরির গায়ে একটা ছোট ফুটো করা থাকত। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ মানুষটা কীভাবে মুচড়ে উঠছে, আর্তনাদ করছে, কিভাবে কেঁপে উঠছে তার শরীর, জেগে থাকতে চাইছে কিন্তু পারছে না, ভেঙে পড়ছে, ঢলে পড়ছে মৃত্যুর দিকে, থাকা থেকে না থাকার দিকে, ওই ফুটো দিয়ে সে দৃশ্য দেখতে দেখতে যে শিহরণ উঠত নাজী কমান্ডারদের শরীরে তাকে ক যৌন উত্তেজনা বলা যায়! আমি জানি না। আমার হঠাৎ মনে পড়ল একটি মেয়ের কথা। সে আমায় তার নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল। যে মানুষটির সাথে তার কিছুদিনের সম্পর্ক হয়েছিল, তিনি বিখ্যাত মানুষ। সম্পর্কটা, অন্তত মেয়েটির তাই ধারণা, প্রেমেরই ছিল। শুধু যখন তারা শুত একসাথে তখন লোকটির আদরের ভাষা কেমন অদ্ভুতভাবে পালটে যেত ব্যথার ভাষায়। ব্যথা দেওয়ার ভাষায়। মেয়েটির ভেতর প্রবেশ করার মুহূর্তে যে শুধু আঘাত করত, ছিঁড়ত, কামড়াত, চিরে দিত, ধাক্কা মারত, তীব্র এক আক্রোশে যেন ফালাফালা করে দিতে চাইত মেয়েটির শরীর। আর মেয়েটির শরীর যন্ত্রণায় মুচড়ে মুচড়ে উঠতে উঠতেও নিজের মনকে বলত, এটা আদর… এটা আদর. ..এটা আদর…। আর শরীরের সেই কথাগুলো, মনকে বোঝানো সে কথাগুলো, এই কথা বলত ঠিকই কিন্তু নিজেরাই বিশ্বাস করতে পারত না সেই কথার অনুভবে, শুধু গুমরে উঠত নিজেদের ভেতর। আর মেয়েটি যখন বাড়ি ফিরে আসত সেই কথাগুলোই তার দুচোখে জমা হয়ে হয়ে গড়িয়ে নামত কয়েক ফোঁটা জলবিন্দু হয়ে।

রাত শেষ হয়ে আসছে। লেখা শেষ করার সময়ও। এখনও সিনোপসিসটা শুরুই করা হয়নি।

হঠাৎ একটা প্রশ্ন মনে এল। যদি কয়েদখানাই হয় তার সাথে নাচের সম্বন্ধ কী? স্প্যানডাউ ব্যালে কেন নাম হল? আর একটু সার্ফ করতে করতে পেয়েও গেলাম কথাটার মানে। নাৎসিরা বন্দিদের মৃত্যু মুহূর্তের কাতরানো, মুচড়ে ওঠা দেখে মজা পেত। এই মৃত্যু যন্ত্রণার দৃশ্য তার দেখত সেল-এর গায়ের পিপ হোল, মানে একটা ছোট ফুটো দিয়ে। ঠিক তেমনি পরবর্তীকালে মিত্র শক্তি যখন যুদ্ধবন্দি নাৎসি সেনাদের ফাঁসিতে লটকাত তখন তাদের মৃত্যুযন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠা শরীরের কাঁপতে থাকা, ছিটকে ওঠা, ফাঁসমুক্ত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টার স্পেকটেকলকে ঠাট্টা করে নাম দিয়েছিল ‘স্প্যানডাউ ব্যালে’।

শব্দেরা কারও নয়। ইতিহাসের গুমরে ওঠার নিঃশব্দ বাহক তারা। বাতাসের মতো। মহাসময়ের মতো। ক্ষমতার হাতে ব্যবহৃত হয়েও যে শুধু অপেক্ষা করে থাকে কোনও একদিন অতর্কিতে আঘাত করবার জন্যে।

হত্যা যে সভ্যতার অঙ্গ সেটা এতদিনে আমার জানা হয়ে গেছে। কিন্তু যেটা আমি বুঝতে পারি না সেটা এই যে গণহত্যা করবার জন্যে তাকে একটা নাম দেবার কী দরকার আছে? কেন একটা কারণ দর্শানোর দরকার পড়ে? কেন এ কথা বলতে হয় যে সভ্যতার, মানবতার স্বার্থে আমরা, গণহত্যা করছি? কেন এইটা বলতে হয় যে, যে মানুষ, যে দেশ, যে রাষ্ট্র, ক্ষমতায় আছে, তাকে খুন করার সময়ে জবাবদিহি করতেই হয় যে আমরা এই কারণে গণহত্যা করেছি? তাহলে কি এটাই সত্যি যে মানুষ কে কোনও একটা সময়ে কৈফিয়ৎ দিতেই হয়? কিন্তু কার কাছে? কার কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হবে? নিজের কাছে?

আমার দেশে গোরুর নামে খুন করা হয়। অন্য দেশে অন্য কোনওভাবে।

আর একটা কথাও লিখে রাখলাম এখানে। এই পৃথিবীর প্রতিটি দেশের, প্রতিটি রাষ্ট্রের, প্রতিটি মানুষের, সভ্যতার, প্রগতির চেহারা হয়ত আলাদা, কিন্তু তাদের ক্ষত তৈরি করার চেষ্টাটা একই রকম।

একটু আগে সিনোপসিসটা লিখে বাইরে এসেছি। ঝড়ের মতো লিখছিলাম শেষ একঘণ্টা। কী লিখলাম, সেটা আদৌ সামারি হল কি না, জানি না। আমি লিখলাম,

হাওয়া দিচ্ছিল দক্ষিণ দিক থেকে। যদিও ঘরের ভেতর কোনও হাওয়া ছিল না। তবু, বাইরের সেই দখিনা হাওয়াকে শরীরে নিয়েই সে কোনও একদিন তো এই অন্ধকার দমবন্ধ করা ঘরে এসেছিল। আর তাই, বন্ধ ঘরের মধ্যেও সে টের পেল, তার আপাত স্থির, আপাত স্থবির শরীরের একটা অঙ্গ তার বারণ শুনছে না। অথবা, সে তো বারণ করেইনি। ভয়ে আতঙ্কে সে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি যে সে আছে। ‘সে’? কী আশ্চর্য! তারই শরীরের একটা প্রত্যঙ্গ আর তাকেই কি না সে নিজেই ‘সে’ বলে সম্বোধন করছে! যেন এই প্রত্যঙ্গ একটা আলাদা সত্তা। আলাদা। স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। তারই শরীরের অংশ তবু যেন এক আলাদা প্রাণ আছে তার। তার নিজের শিক্ষা, রুচি, শৃঙ্খলা, বারণ, অনুশাসন, কোনও কিছুরই তোয়াক্কা না করে, তারই অজান্তে নিজে থেকে জাগছে। দাঁড়িয়ে পড়ছে। বাড়ছে। দীর্ঘ হচ্ছে। প্রলম্বিত। আরও প্রলম্বিত। আরও কঠিন। টানটান। যেন সব বশ্যতাকে অস্বীকার করতে চাইছে। যেন কোনও টার্গেট আছে তার। কোনও লক্ষ্যভেদ। একটা অভিমুখ। যেন কোনও নিষেধের বেঁধে রাখাকে ছিঁড়ে ফেলে সে একটা আলাদা, অন্য, বাইরের দরজাকেও ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে। সেখানে কী আছে সে জানে না। কিন্তু নিজের শরীরের নিগড়কে ছিঁড়ে ফেলাটা, দেওয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসাটা তার কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। সবথেকে তীব্র। সব থেকে বেশি কামনার। যেন আগুনের কোনও স্থির শিখা। বহ্নি। জ্বলছে। উত্তাপে পোড়াচ্ছে, পুড়ছে, পোড়াচ্ছে, পুড়ছে…। কঠিন। টানটান। খাড়া। যেন টর্পেডো। যেন মিসাইল। যেন ছুরির ফলা। লক্ষ্য একটাই। ফুঁড়ে ঢোকা।

লেখা এখানেই থামিয়ে দিয়েছি। বাইরে বেরিয়ে এসে গলির মুখটায় দাঁড়াই। সকাল সাতটা। এখনও পাড়াটার ঘুমের ঘোর কাটেনি। একটা আট সিটার স্করপিও এসে দাঁড়াল গলির মুখে। গাড়ির মধ্যে বেশ কয়েকজন বাচ্চা। স্কুলে যাচ্ছে। ফুল ভলিউমে গান চলছে গাড়ির ভেতর। চৌধবী কা চাঁদ হো, ইয়া আফতাব হো, যো ভী হো খুদা কি কসম, লাজবাব হো। নিশ্চই কোনও বুড়ো ড্রাইভার হবে। মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, না, এক বাইশ তেইশের তরুণ। আশ্চর্য, এখনও বাচ্চারা এই গান শোনে!

লেখাটা আমি দেব না ঠিক করলাম। এইমাত্র। যদিও টাকাটা খুবই জরুরি। বিশ ডলার হলেও আমার কাছে তো অনেকটাই। ওয়েবসাইটটা কানাডা না ইউ এস কোথাকার যেন। কেন দেব? তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের, একটা শহরে্‌ একটা ছোট পাড়ার, একটা ছোট্ট ঘরের ভেতর রাত জেগে লেখা কয়েকটা শব্দ প্রথম বিশ্বের অজানা কারও কাছে কেন বেচে দেব, সামান্য কয়েকটা টাকার জন্যে। না, ইচ্ছে করল না। আমার খুঁজে রাখা শব্দগুলো বরং আমার কাছেই থাকুক। আমার নিজের মানুষজনের জন্যে।