Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শ্রবণকথা, শেষ পর্ব

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 

সপ্তম উপকথা, পর্ব — দুই এখানে

 

গোণ্ড আদিবাসী কিংবদন্তি অনুসারে মহাকাব্যের বিকল্প পাঠ; মূল হিন্দি পাঠ -- বেদনসিং ধুর্বে, ‘কোয়া পুনেম গোণ্ডিয়ন গাথা’ (২০১৪)-র ছায়া অবলম্বনে।

ইতিমধ্যে, আগত লৌহযুগের রণতূর্য বাজিয়ে বিজাতীয় বিধর্মী আর্যশক্তি ততদিনে হানা দিয়েছে উপমহাদেশের দোরগোড়া ছাড়িয়ে, পঞ্চনদ ছাড়িয়ে, গাঙ্গেয় উপত্যকা ছাড়িয়ে, কাশী-কোশলের দিকে, অচিরেই বিন্ধ্য-সাতপুরা-কিষ্কিন্ধা টপকিয়ে পূবদেশ আর দাক্ষিণাত্যে নিবেশ ঘটবে তার। তাম্রযুগের শিল্প, কলা, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, এবং, সর্বোপরি, লোকপ্রাকৃতের আদিদর্শন, আদিপ্রজ্ঞানের আগার মূলবাসী স্বশাসিত নগর ও গ্রামের কৌমগুলিকে পদাবনত ও ধূলিসাৎ না করলে আর্যজাতির বুঝি শান্তি নেই। এই তো দেশে দেশে যুগে যুগে রাজ্যবিস্তারের অমোঘ নিয়ম! তায় আবার, যুগান্তর আসন্ন। আর্যদের লোহার তৈরি তীর তরোয়াল বল্লমদের সামনে ধ্বংস হতে থাকল সেদিনের আদিবাসীদের নগর ও গঞ্জ। তামার অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে অসমসাহসে লড়েও ঠেকানো গেল না জাতিবিদ্বেষী আর্য দুশমনকে। ক্রমে তাদের নজর পড়ল সেই দেবনগরীর উপর। চুপিসারে রাজত্বের রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি, অমাত্য, কোটাল, হাকিমদের উপর, প্রজাসাধারণের উপর, নিরন্তর নজর রাখা শুরু করল আর্য গুপ্তচর-বাহিনী। একসময় তারা লক্ষ করল, প্রাসাদ খালি করে অন্ধ রাজারানি ছেলের কাঁধে চেপে তীর্থে গেছে।

তবে, তক্ষুণি আক্রমণ করল না তাদের সেই রণকুশলী রাজা যিনি দশটি রথে সওয়ার রণনিপুণ রাজপ্রহরীদের নিশ্ছিদ্র সুরক্ষাবলয়ের ভিতর থেকে প্রবল লড়াই করতে করতে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে অনেক দাসরাজ্য, দস্যুরাজ্য ফৌৎ করেছিলেন। দশটি সামরিক সাজে সুসজ্জিত রথে চাপা সেই রাজরক্ষী-বাহিনীর জন্য তার নাম হয়ে গিয়েছিলো — ‘দশরথ’। আবার, হাজার চেষ্টাতেও শত্রুপক্ষ তাকে যুদ্ধে বধ করতে কখনও সক্ষম হয়নি বলে, তার অপর উপাধি ছিল — ‘অবধ’। সেই ‘দশরথ’ তখন তার গুপ্তচরদের আজ্ঞা দিল — তীর্থগামী রাজা-রানি-রাজপুত্রের দিকে কড়া নজর রাখতে। বিশেষত, খেয়াল রাখতে কখন শ্রবণ দেবসন্তান জ্ঞানবতীকে একা রেখে এদিকে ওদিক কোথাও কোনও কাজে যায়। একই সাথে, দশরথ স্বয়ং রওনা দিল সেই মধ্য-উপমহাদেশীয় বনাঞ্চলে, যেটা হস্তগত করা তার অভিপ্রায় ছিল। বন-জঙ্গলের নিবিড় অন্তরালে দশরথ সেই রাজা-রানি-যুবরাজদের পায় পা মিলিয়ে চলতে থাকল, আর অপেক্ষা করতে থাকল মোক্ষম সুযোগের। সুযোগ এসেও গেল। এক সন্ধ্যাবেলায় গুপ্তচর এসে খবর দিল,

‘রাজন, বিন্দিয়া মিলিত হয়েছে ওদের সাথে। বিন্দিয়া, জ্ঞানবতী আর দেবসন্তানকে একা রেখে শ্রবণ বনে গেছে কাঠকুটো কুড়োতে।’

ফন্দি আঁটল দশরথ জবরদস্ত। সেই অরণ্যেরই বন-গাঁয়ের কোনও এক মেয়েকে ধরে আনতে হুকুম দিল সে। আজ্ঞাবহ গুপ্তচর হিড়হিড় করে টেনে আনল এক মেয়েকে আর্য রাজার সামনে। রাজা বলে উঠল,

‘কোনও ভয় নেই। তোমাকে শুধু একটা কাজ করতে হবে। পুবদিকে নদীর তীর ছেড়ে ক্রোশ দেড় পথ। সেইখানে, শাল্মলী বৃক্ষের ছায়ায়, দেখবে, তোমারই মতো আরেকটা মেয়ে বসে আছে, তার সাথে আছে দুই অন্ধ বুড়োবুড়ি। তুমি শুধু বলবে, গভীর জঙ্গলের ভিতর, তাদের পিছনের পাহাড়টার পাথুরে খাঁজে, একটা অন্ধকার গুহার ভিতরে — একটা জলকুণ্ড রয়েছে। সেই কুণ্ডের জলের ছোঁয়ায় অন্ধত্ব দূর হয়। এই বলে তুমি তাড়াতাড়ি জঙ্গলের ভিতরে অন্তর্হিত হবে। মনে রাখবে, আমার আজ্ঞাবহ গুপ্তচরেরা তোমার উপর কড়া নজর রাখছে। তুমি যদি অন্য কিছু বলো বা অন্য কোনও কাজ করো, তাহলে তোমার কোনও ক্ষয়ক্ষতির জন্য আমরা দায়ী থাকব না।’

নিরুপায় বনবালা রওয়ানা দিল। অক্ষরে অক্ষরে হুকুম তামিল করল। আর সেই শুনে অত্যন্ত উৎসাহিত ও উত্তেজিত হয়ে বিন্দিয়া তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির অজস্র সাবধানবাণী, সতর্কীকরণ ও অন্যান্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বহিঃপ্রকাশ উপেক্ষা করেই হনহন করে রওয়ানা দিল তাদের পিছনের দিকের পাহাড়টার জঙ্গলে ঢাকা গিরিবর্ত্মের দিকে। সে’দিন হাওয়া শোঁ শোঁ তেজে বইছিল, বনের মাটি থেকে ঝরা পাতারা হাওয়ার ঝাপটে বৃন্তচ্যুত দিশেহারা বিভিন্ন গাছেদের পাতাদের সাথে উড়ে উড়ে নজর ঢেকে দিচ্ছিল মাঝেমধ্যেই। আকাশে আঁধি-তুফান আসব আসব উপক্রম। সেই হাওয়ায় দশরথের গুপ্তচরেদের বেগ পেতে হয়নি তাদের লাগানো আগুনে পাহাড়জোড়া দাবানল জ্বালিয়ে তুলতে! যতক্ষণে বাবামায়ের হাহাকারে সচকিত শ্রবণকুমার সেই শালগাছের কাছে ছুটে এল, বাবামায়ের কাছ সমস্ত কিছু শুনে মরণপন ছুটল সেই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা গিরিবর্ত্মের দিকে, ততঃক্ষণে অগ্নিকুণ্ড গিলে নিয়েছে বিন্দিয়াকে। সেই অবস্থাতেও, ধোঁয়ায় বুঁজে যাওয়া চোখ, কণ্ঠে, চারিদিক থেকে আগুন তাকে ঘিরে ধরছে বুঝে, সেই আক্ষরিক অলাতচক্রের মধ্যে থেকেই, রাজকন্যা বিন্দিয়া তারস্বরে আসতে নিষেধ করতে লাগল রাজপুত্র শ্রবণকে। জঙ্গলের পুড়তে থাকা পাতা-ফুল-ডাল-শিকড়-কাণ্ড-সমেত গাছেদের, পুড়তে থাকা চারা-লতা-মৌচাক-উইঢিপি-পাখিরবাসা-ঝরাপাতাদের আওয়াজ ছাপিয়ে শ্রবণকুমারের কানেও পৌঁছেছিল সেই চেতাবনি,

‘তফাৎ যাও! আগুন ঘিরে ধরেছে! পুড়ে যাবে!’

দিশেহারা শ্রবণ হাহাকার করতে করতে ফিরে চলল তার অন্ধ বাবা-মা সেই যে শালগাছের নীচটায় অপেক্ষা করছিল, সেই দিকে। সেইখানে পৌঁছে সে উছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদতে লাগল আর বুক চাপড়াতে লাগল। তাই দেখে তার বাপমা আরও বিচলিত ও বিহ্বল হয়ে উঠল। মনের পীড়ায় অচিরেই তাদের শরীর অবশ হয়ে এল, জলের জন্য আকুল হয়ে অতিকষ্টে তা তাদের শোকাচ্ছন্ন পুত্রের গোচরে আনল। আর সেই গোচরে আনার চেষ্টা কাল হল। শোকের আঘাত সইতে শ্রবণের যেইটুকু সময় লেগেছিল, তারই মধ্যে ‘জল! জল!’ করতে করতে সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল তারা। আবার দিশেহারা হয়ে শ্রবণ তাদের কাছে এল, দেখল বৃদ্ধ মা-বাবার শরীরে প্রাণের স্পন্দন, শ্বাসের চলাচল ক্ষীণ হয়ে গেলেও, তা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। তখনও সময় আছে বুঝে শ্রবণ জল আনতে পড়িমরি ছুটল কানহন নদীর দিকে।

ইতিমধ্যে সেই আর্যরাজা দশরথের কাছে খবর পৌঁছে গেল — গোণ্ডদেশের রাজকন্যা ঝলসে রাখ হয়ে গেছে, আর সেই দেবনগরীর অন্ধ বুড়ো রাজারানির প্রাণ বাঁচাতে রাজপুত্র শ্রবণকুমার রওয়ানা দিয়েছে নদীর দিকে। শোনা মাত্র, ধনুর্বান উঠিয়ে দশরথ চলল মৃগয়ায়। নদীর ধারে গাছগাছালিদের ছায়া আর আবডালে অপেক্ষা করতে থাকল সে। ততক্ষণে দিন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পড়ন্ত রৌদ্রের আবছায়া তাপে, নদী, গাছেদের শীতল সান্নিধ্যে, তন্দ্রার ভাব আচ্ছন্ন করেছিল দশরথকে।

বনস্থলী চিড়ে কলকল করতে করতে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলেছে স্বচ্ছতোয়া কনহন নদী। তার কাকচক্ষু জল দেখলে কোন না পিপাসুর মন-প্রাণ-শরীর চাইবে তৃষ্ণা নিবারণ? সেই হন্তারক দিনের অন্তভাগে এসে শরীরে-মনে ধ্বস্ত শ্রবণ কনহন নদীর জলের উপর মুখ নামিয়ে জল খেতে লাগল — কখনও আঁজলা ভরে, কখনও স্রোতের বুকে মুখ ডুবিয়ে দিয়েই। সাথে সাথে নিয়ে আসা জলপাত্রে জল তৃষিত মাতাপিতার জন্য জলও ভরতে থাকল সে। সেই আওয়াজে চটকা ভাঙল দশরথের। ক্ষত্রিয় পুরুষের উত্তম-মর্যাদারূপ শৌর্যের প্রদর্শনেচ্ছায় ধনুকের ছিলা টানটান হয়ে গেল তার বুঝি আপনা থেকেই। গাছগাছালি পাতপাতালিদের ফাঁক দিয়ে ঠাউর করা যাচ্ছে না বধ্য যে জন সে মানুষ না বনের কোনও পিপাসু জানোয়ার। কোনও একটাকে মারলেই ক্ষত্রিয়ের রণতৃষ্ণা নিবারিত হবে সেই মুহূর্তের মতো। তাই, সেই জলপানের শব্দ-উৎস লক্ষ করে ছিটকে চলল জ্যা-মুক্ত ‘শব্দভেদী বাণ’! ভেদ হল শ্রবণকুমারের শরীর।

শ্রবণের নিথর দেহের পাশে পড়ে থাকা তাম্রপাত্রে জল ভরে দশরথ নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই শত্রুদেশের ঘুমিয়ে থাকা রাজারানির কাছে। তাদের শুকিয়ে থাকা ওষ্ঠাধর সিঞ্চিত করে ক্রমে তাদের জাগিয়ে তুলে বুড়োবুড়িকে জল খাওয়ানো শুরুও করেছিল সে। আদতে, ততদিনে বন-গাঁ-গুলোর ধারেপাশে জমি বাগিয়ে আশ্রম গারা শুরু করেছে মুনি-ঋষি-পণ্ডিতদের দল। টিকি-দাড়ি নেড়ে জট আঁচড়িয়ে গাল চুলকিয়ে গোঁপ চুমড়িয়ে তারা আবার ভূর্জপত্রে নানান নিদান দেওয়া শুরু করেছে, তাতে রণে রাজকর্তব্যসমূহের বিধি-বিধান বিষয়েও বিচার করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। বুঝি দ্বাপরযুগের সেই ‘জেনিভা কনভেনশন’-এর গুঁতো উপেক্ষা করতে পারেননি সেই আর্য সাম্রাজ্যবিস্তারী ক্ষত্রিয়। কিন্তু অচিরেই অচেনা স্পর্শে চমকে উঠে আগন্তুকের হাত থেকে জলপাত্র ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল দুইজনেই। চৈতন্য ফিরে আসবার পর ঘটনা অনুমান করতে বেগ পেতে হয়নি প্রবীণা-প্রবীণের। অভিসম্পাত করে উঠেছিল তারা,

‘আমাদের মতোই পুত্রশোকে একদিন মৃত্যু হবে তোমার, আর তোমার পুত্রকেও আমাদের পুত্রের মতোই একদিন নদীতে নিয়ে নেবে।’

এইভাবে বিনা যুদ্ধে হাসিল হল দেবনগরী, তাই তার নতুন নাম হল — ‘অযোধ্যা’। আবার, এই রাজ্য জয় করতে কোনও ব্যপক সামরিক আয়োজন করতে হয়নি দশরথকে, ক্ষুরধার রণকৌশলেই কার্যসিদ্ধি হল, যুদ্ধে বিপক্ষের বধ-নিধনের লম্বা ফিরিস্তির ভার নিতে হল না লৌহযুগের নতুন হিসেবে নতুন করে ছড়িয়ে পড়তে থাকা গল্পকথাদের। তাই কালক্রমে লোকেদের মুখে মুখে সেই রাজ্যের নামও হয়ে গেল ‘অবধ’ — যুদ্ধে কখনও বধ না হওয়ার কারণে অযোধ্যার প্রথম আর্যরাজার সেই ‘অবধ’ নামটার সাথেও মিলে গেল দেবনগরীর সেই নতুন নাম। নতুন রাজ্যের বিষয়ে নতুন গাল-গল্প-কথা-গাথা-ইতিহাস-পুরাণেরা ধরে রাখল সেই ‘অ-যোদ্ধা’ আর ‘অ-বধ’ নামগুলো, তার পূর্বতন আদিবাসীনাম মিটিয়ে দিয়ে পাঁজি-পুঁথি-ভূর্জপত্রে তার পুরনো নাম হিসেবে লিখে রাখল ‘দেবনগরী’।

এত কিছু সত্ত্বেও, বিধুর মহাকাব্য জানান দেয়, সেই নিদারুণ সন্ধ্যায় জ্ঞানবতী-দেবসন্তানের দেওয়া সেই অভিসম্পাত অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। বহু বছর পর জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রর সস্ত্রীক সানুজ বনবাসকালে পুত্রশোকে অধীর হতে হতে মৃত্যু হয় বৃদ্ধ দশরথের। সেই ঘটনারও বহুদিন পর, বনবাসান্তে অপরাপর মহাবলশালী আদিবাসী দলপতি রাবণকে হারিয়ে, অযোধ্যায় ফিরে এসে রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করে, ঈর্ষা-ঘৃণা-সন্দেহে জর্জর হয়ে সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে, তারপর একদিন সরযূ নদীর জলে একা একা হেঁটে হেঁটে মিলিয়ে গিয়েছিল রামচন্দ্র।

 

আগামী পর্বে নতুন অধ্যায় — বস্তারে মাইনিং, প্রথম পর্ব