Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শতাব্দী দাশের লেখা

শতাব্দী দাশ

 

বাংলা ভাষার মর্যাদা যে প্রান্তিকের তুল্য, তার যে সংরক্ষণ আবশ্যক, এ তো ফি বছর বৈশাখের পয়লায় একদিনের ‘লেটস ডু বাংলা’ ধরণের হুজুগ দেখলেই বোঝা যায়; বিজ্ঞাপন দেখলে, বিলবোর্ড দেখলে, বাংলা ছবির গান শুনলে নিরন্তর বোঝা যায়। ইংরাজী মাধ্যম স্কুলগুলিতে বাংলা আবশ্যিক করাটা পুরোদস্তুর সমর্থনযোগ্য। সেই সাথে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও জরুরি। যাঁরা বাংলা বলার জন্য ছাত্র-ছাত্রীকে অপমান করেন বা শাস্তি দেন, তাঁদের সুস্থতা সম্পর্কে আমার দীর্ঘদিনের সন্দেহ।

বিশ্বনাগরিক হওয়ার তাড়নায় নিজের ঘরবাড়ির ঠিকানা ভুলে গেলে সেটাকে অ্যামনেশিয়াই বলে, উদারতা নয়। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে শ্লাঘা নেই ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ তা অবাঙালিকে ‘মেড়ো’ বা ‘মাওড়া’ বলে দাগিয়ে দেওয়া, সৃজিত-শিবপ্রসাদের রদ্দি বাংলা ছবি দেখে ইন্টেলেক্টের লালাক্ষরণ করা কিন্তু সাম্প্রতিক মারাঠি বা পাঞ্জাবি সিনেমার অনন্য সব কাজ না দেখা ইত্যাদি সংকীর্ণতায় আবদ্ধ। কিন্তু অন্যকে অবজ্ঞা না ক’রে বাংলা ভাষার সার্বিক প্রসার অবশ্যই সমর্থন করি। ‘জোর করে চাপানো’ নিয়ে যে তত্ত্ব দেখছি, তা খানিক অবাক করছে। স্কুলে আমাকেও জোর করে ভূগোল পড়ানো হত। একটুও ভালো লাগত না। অনেক বিষয়ই ছাত্রছাত্রীদের ‘জোর করে’ পড়ানো হয়। তা না করলে স্কুলের সিলেবাসের খোলনলচেই বদলে দিতে হয়। দশম শ্রেণী পর্যন্তও ‘জোর করে’ কিছু বিষয় শিখিয়ে না দেওয়া হলে অঙ্কে অনাগ্রহী ছেলেটি মুদির দোকান থেকে জিনিস আনতে গিয়েও ভুল করতে পারে, ইতিহাসে অনাগ্রহী মেয়েটি রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্র জাদেজার তফাত নাও জানতে পারে। অপছন্দের বিষয়গুলি বাদ দিয়ে পছন্দসই বিষয় নিয়ে স্পেশালাইজেশনের জন্য তো একাদশ দ্বাদশ আর পরবর্তী ধাপ রয়েছেই।

পাহাড় বা আদিবাসী অঞ্চলে স্থানীয় ভাষার সংরক্ষণের প্রচেষ্টাও হোক, তার সাথে বাংলা ভাষা নিয়ে উদ্যোগের বিরোধ দেখছি না। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্কুলেও ‘নেপালি’ প্রথম ভাষা হিসেবে নেওয়া যায় এখনও। ইচ্ছে থাকলেও পাহাড়ের সরকারি স্কুলে আমার পড়ানো হয়নি, নেপালি আমার নিজের সিলেবাসে ছিল না বলে। এই সব আবশ্যিক নীতি তো এখনই আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে নিশ্চয়। নেপালি বা সাঁওতালির আরও বিকাশের চেষ্টাও থাকবে, আশা করি।

‘শিশুকে তিন তিনটি ভাষা শেখানোর সিদ্ধান্ত অমানবিক’ হল আরেকটি তত্ত্ব, যা এই সরকারি সিদ্ধান্তের মুণ্ডপাত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘ত্রিভাষিক নীতি’ কিন্তু অনেক দিন থেকেই ছিল আমাদের এডুকেশন পলিসির মধ্যে। ১৯৬৮ সাল থেকে বিবিধ জাতীয় শিক্ষা নীতির একটি এই ত্রিভাষিক নীতি। আগ্রহীরা ‘থ্রি ল্যাঙ্গুয়েজ ফর্মুলা’ লিখে গুগল সার্চ করলেই বিশদে জানবেন। এর ভাল-মন্দ থাকতেই পারে। মোদ্দা কথা, এ কোনও মতেই পার্থবাবু বা মুখ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্কজাত নয়, দু’দিন আগের চমক তো নয়ই। কিছু রাজ্য এই নীতি মানেনি আগে, এইটুকুই।

ভাষাশিক্ষার সঠিক পদ্ধতি ও বয়স নিয়েও মতপার্থক্য আছে। একটা মত বলে ছোটবেলায় ভাষাশিক্ষা বেশি সহজে হয়, বড় হলে মুশকিল বাড়ে। এখন যেহেতু ‘ডায়রেক্ট মেথড’-ই বেশি প্রচলিত ও আলোচিত– মানে গ্রামার শিখে ভাষা শেখা নয়, বরং প্রথমে শুনে-বলে ভাষা শেখা, তারপর পড়ে ও লিখে তা শেখা, তারপর ব্যকরণ শেখা— সেই হেতু এই মেথডের জন্য, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে, ছোটবেলাতেই নির্দিষ্ট ভাষায় ব্যক্তির ‘এক্সপোজার’-কে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

কিন্তু নীতি, তত্ত্ব ইত্যাদি একরকম। তার ইমপ্লিমেন্টেশন আরেক রকম। কাজের বেলায় দেখা যায়, যথেষ্ট টিচার নেই, টিচারদের সেই প্রশিক্ষণ নেই। তারা নিজেরা প্রাচীন গ্রামার-ট্রান্সলেশন মেথডেই ভাষা শিখেছে আর সেভাবেই স্বচ্ছন্দ। নতুন প্রশিক্ষণের জন্য যথেষ্ট ওয়ার্কশপ নেই, উদ্যোগ নেই। এই জায়গায় এসে সমস্যা হয়ে যায়। তত্ত্ব আর প্রয়োগে ফাঁক তৈরি হয়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে না হয় বাংলাকে ধরে তিনটি ভাষা হল। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে, যেখানে এমনিতেই বাংলা প্রথম ভাষা, সেখানে ইংরিজির পাশে তৃতীয় ভাষাটি কী হবে? তা এখনও স্পষ্ট নয়।

শিক্ষক হিসেবে ছাত্রবান্ধব পলিসিই চাই, ছাত্রছাত্রীদের উপর বাড়তি চাপ নয়। ত্রিভাষা নীতি তখনই সার্থকতা পাবে, ‘চাপ’ হয়ে দাঁড়াবে না, যখন যথেষ্ট শিক্ষক, যথেষ্ট ভাষাশিক্ষণের প্রশিক্ষণ আর ভাষায় ‘এক্সপোজার’-এর যথাবিহিত পরিবেশ স্কুলে থাকবে। জনমোহিনী নীতির পাশাপাশি এই দিকগুলিতে দৃষ্টি দেওয়া দরকার, বোধহয় বেশি দরকার।