Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মোর দ্যান এ ক্লাব

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

প্রিয় মাইকেল

কীভাবে শুরু করব জানি না। ফুয়েন্টালবিলা। আমার গ্রাম। আমার আধা-শহর। জন্ম। তুমি গেছ কোনওদিন? আলবেসেটের কাছেই। আলবেসেট। যেখানে আমার স্ট্রিট ফুটবল। বেড়ে ওঠা। সেই ৭-১ মনে পড়ছে মাইকেল, বার্সিলোনা, তোমার বার্সিলোনা আমার অ্যালবেসেটকে হারাল। তদ্দিন তোমার বার্সা আমার দ্বিতীয় পছন্দ ছিল। তোমার জন্য মাইকেল, জাস্ট তোমার জন্য। সেদিন আর পারলাম না। ১-৭। বার্সিলোনা? স্বপ্নভঙ্গ। কষ্ট। কান্না। বাবা আমাকে দেখিয়ে কাঁদল নিজেও। দেখ, তোর কষ্টে আমিও…। বাবা। এবং স্যার এনরিক ওরিজোলা। বার্সার কোচ। কী পেয়েছিলেন জানি না, নিতে চাইলেন তোমার ক্লাবে। তোমার না, তদ্দিন তুমি রিয়েলে। আমার আর তোমার পাশে খেলা হল না। বড়দের দল হলেও, ছোঁয়া তো পেতাম কোনও না কোনওদিন। সেই বাবা জানিয়ে দিল, না। ওর সমস্যা হবে। এদ্দিনকার পরিবেশ। পড়াশুনো। মুখে কিছু বলেননি। ভেতরে চাইতেন, জোর করে বার্সার খেলা দেখাতেন, তুমি রিয়েলে চলে যাবার পর রিয়েল-ভক্ত আমায় জোর করে বসিয়ে দিতেন টিভির সামনে, সামনে এগারোজন। ব্লাউগ্রানা। সেদিন বাবার কাছে গেলাম। আমি বার্সিলোনা ক্যাম্পে যাব। — মানে? জোসে আন্টোনিও, আমার বাবা, আশ্চর্যময়তার ভাষা খুঁজলেন। — আগে যে বলেছিলি…। — এখন বলছি তো। — কিন্তু কেন? এই মতবদল কেন? — বিকজ ইউ ওয়ান্ট। বিকজ ইট ইজ ইওর ড্রিম…। তোমার স্বপ্ন আমি বার্সায় খেলি। কীভাবে ফেলি বাবা? সেই বাবা। সেই মানুষটা। কাঁদলেন। জাস্ট কাঁদলেন মাইকেল। তোমাকে বোঝাতে পারব না এমন কান্না। আমিও কেঁদেছিলাম। ‘আই ক্রাইড রিভার্স…’। বাবা হাত ছেড়ে দিল বার্সার ইয়ুথ অ্যাকাডেমির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে। একদিন বন্ধ করলাম কান্না। থামতে হয় মাইকেল, কাউকে না কাউকে কোথাও না কোথাও। কান্নাও। চুপ করে থাকতাম। তারপর বুঝলাম। এখানে মিনিমাম ১৩-১৪ না হলে কাউকে নেয় না। স্যার এনরিকে আমাকে নিয়েছেন। উত্তর দেব। নিরানব্বইের নাইকি প্রিমিয়ার কাপে আমার হাতে আর্মব্যান্ড পরালেন। আমি এনরিকে? পারব। নব্বই মিনিটের ওই গোলটা মাইকেল। ইউটিউবে থাকে না। ভেতরে থাকে। বুকে …। কাপ পেলাম। ২০০১-এ আন্ডার ১৭ ইউরোপিয়ান কাপ, পরের বছর আন্ডার নাইন্টিন। স্পেন। মাইকেল, তখন বুঝেছি দেশ। দেশও হয়। হলুদ। লাল। কমলা। সব মিশিয়েই আমার দেশ। যেমন তোমার ডেনমার্ক। ছিয়াশি। মাইকেল, দুর্ভাগ্য তোমার। সেবছর ঈশ্বরের তাণ্ডব। নাচ, অসম্ভব খিদে ভর্তি এক নাচ। ফুটবল। মাইকেল, তুমিও তো খেলতে। কখনও ডেনমার্ক, কখনও বার্সা। একা মাঠ কাঁপাতে। স্বার্থহীন ফুটবল। স্বর্গের মতো এক মুখচ্ছবি। গতি। বক্সের ভেতর পা ছোঁয়ালেই তিনকাঠি, অথচ তুমি নির্দ্বিধায় গোল করাতে অন্য কাউকে দিয়ে। চিরপরিচিতর ভেতর ঢুকে পড়া রাজা, আমার রাজা, তুমি, মাইকেল লাউড্রপ। আরেকজন ছিল। তিনবছর যখন ও বার্সা ছাড়ল, মাইকেল, বুকে পেরেক বিঁধল। স্যার ফার্গি বললেন, আমরা দুজন নাকি আমৃত্যু কোনওদিন পা থেকে বল ছাড়ব না। বললেন, ‘they get you on that carousel, they can leave you dizzy …’। অথচ মাঝে মাঝে অস্বস্তি হত, জানো। মনে হত ওর সঙ্গে আর আমি খেলব না। অনেক তো হল। অনেকে বলত, দুজন রাজপুত্রের এক সিংহাসন মানায় না। মানিয়েছিল। অস্বস্তি ঝেড়ে ফেললাম। পরের ম্যাচেই ঝড়। একটু স্লো ছিল। বুঝতে দিত না কাউকে। তবু তোমার মতোই ব্যাকহিল, হাসি, তাকানো। মাইকেল, কোনওদিন জাভির সঙ্গে হাত মিলিও। বোলো, আমি, ওর মধ্যে তোমার ছায়া দেখেছিলাম। ছায়া। ছাতা। রোদ থেকে মুক্তি। পেপ। সহযোদ্ধা। কোচ। না, পেপ, আমি তোমার চাকরি মারিনি। স্যার ক্রুয়েফের ড্রিম টিমের মানুষদের কোনও চাকরি হয় না। হয় একটাই, খিদে। স্বপ্ন। আমার সাধ্য কী, তোমাকে মারব? ট্রফি দিয়েছিলে প্রথম, চুলে আদর কেটে বলেছিলে, সাবাশ চ্যাম্প। চেলসি ম্যাচের রাত। ২০০৯। ইনজুরি টাইম। লিওর দেওয়া পাস। শট। ইনসাইড, আউটসাইড করে না। শটটা মেরেছিলাম ‘রাইট ফ্রম মাই হার্ট’। পেপের সেই দৌড়। গ্যালারি। তুমি, পেপ, তোমার মনে পড়ছে? ওঃ দেখো। চিঠিটা কাকে লিখছিলাম, আর খেই হারিয়ে শেষমেশ কাকে লিখছি। কিছু মনে কোরো না মাইকেল। আসলে তোমার এই ডাইহার্ড ফ্যান অনেক মানুষকে নিয়ে বেঁচে থাকে। তাদের নাম কখনও জাভি হার্নান্দেজ। কখনও পেপ গুয়ারদিওলা। কখনও …। ওই ছেলেটা মাইকেল। তখন রোনাল্ডিনহো। তখন রাইকার্ড। তখন, হ্যাঁ তখনও বার্সিলোনা। কাপ, জয়, পাস আর পাস। আর, এসবের পরেই ওই ছেলেটা এল। তিনকাঠির ভেতর দাঁড়িয়ে গোলকিপারের সঙ্গে নাটমেগ করল। হাসি নেই। আগুন। মার খেত। তিন মাস, চার মাস বাইরে। পেপ এসে বলল, খেলাটা পাল্টাতে। তারপরেরটা…। সেভিল্লার ম্যাচটা। কোথায় আমি ওকে দিয়ে গোল করাব, ছেলেটা আমাকেই কোত্থেকে একটা ডানদিক চেরা পাস বাড়াল। ড্রিবল, গোল। কোপা ডেল রে। বার্সার হয়ে শেষ কাপ। সে ছেলে কী বলে জানো মাইকেল, বলে ফুটবলের কঠিনতম কাজ হল ফুটবলটাকে সহজ করে খেলা। আমি, একমাত্র আমিই নাকি সেসব পারি। কাঁদব না, আবেগহীন, মিতবাক আমি, কাঁদব না? কথা না, ইঙ্গিত না, চিৎকার না, লিওর দিকে আমি শুধু তাকাতাম, আর আমরা বুঝে যেতাম কে কী চাইছি। ভাল্লাগছে না মাইকেল। ছোটবেলাটাই ভালো ছিল। মারিয়া লুজান। আমার মা। কেরিয়ারে আমার একটা ম্যাচও টিভি ছাড়েননি। বাবা। ওয়েটার, বিল্ডিং ওয়ার্কার তারপর আজকের বিজনেস টাইকুন। একদিনে হয়নি মাইকেল। বার্সায় ১৩ বছর বয়সে আমার জন্য দামী বুট কিনতে গিয়ে তিনমাসের মাইনের জমানো টাকা শেষ করে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে সেই বুটটার দিকে তাকাই। মনে করতে চেষ্টা করি, কোথা থেকে আমাকে আসতে হয়েছে। আমাদের ওয়াইন ব্যবসা। গন্ধ। বাবাকে কে যেন বলেছিল, ছেলেকে ওয়াইনের মতো করে দেখলে কেমন লাগে বলুন। মানুষটা হেসে বলল, ‘it would be a wine of good quality, sincere, discreet…’। থাঙ্কস ড্যাড। সেস, আমার বন্ধু অনুজ সেস ফ্যাব্রেগাস। বলে বসল, আমি নাকি টিমের রেফারেন্স পয়েন্ট। আমার ইতিহাস, আমার বাবা আমার রেফারেন্স পয়েন্ট মাইকেল। যা না থাকলে আমি টলোমলো। আমার আসন, আমার পাস টলোমলো। পাস। আমাদের নাচ। নাচই তো। আলভেজ বলেছিল, আমার খেলা অনেকটা ড্যান্সিং লাইক এ ট্যাঙ্গো। টোরেস বলল, হোয়েন হি প্লেস, এভরিথিং এলস স্টপস। লাইক দ্য ক্যামেরা ইজ গোয়িং ইন স্লো মোশন। অথবা রয় হাডসন। বলল, আমি খেললে টুপি থেকে খরগোশ না, বরং বর্ষার পেখমমেলা ময়ূর বের হয়। কিংবা লুই মেনেত্তি। কোচ, চোখা বুদ্ধির মেনেত্তি বলেছিলেন, আন্দ্রেজ, লাইক দ্য হ্যারি পটার। one, two, three and whoosh ….। সম্মান। ধন্যবাদ। তবু, ওদেরকে বোঝাতে পারি না, এটা লা মাসিয়া শিখিয়েছে আমাকে। স্পেন শিখিয়েছে। আমাকে। আমাদের। হার্কে। আমার ড্যানি। এস্প্যানিওল। এখনও ওখানে খেললে আমাকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়। ফ্যাব্রেগাসকেও দেয় কি? ওই তো শুরু করেছিল। আর্সেনালের জার্সি। গোল করে টানটান ধরে রাখা আরেকটা জার্সি। ২১ নম্বর। ড্যানি। আমার গোলটা মনে আছে। ফ্যাব্রেগাসের পাস থেকে শটটা করার পর মনে হল পায়ের ব্যথাটার কথা। তারপর উচ্ছ্বাস। ফাইনাল। দেশ। কাপ। কিন্তু ড্যানি? ড্যানি ফিরবে না। তবু, হি’স অলওয়েজ উইথ আস। বাচ্চাটাকে দেখতে পেল না। শুনেছি ওর প্রেয়সী, ওর স্ত্রী ওকে ফোন করতে করতেই একটা সময় আর কিছু শুনতে পায় না। ড্যানির হৃদয় ড্যানিকে ছেড়ে গেছিল মাইকেল। স্মৃতি? তার সাধ্য কি, ছাড়ে? অনেক, অনেক কিছু মনে পড়ছে মাইকেল। চেলসির সঙ্গে ওই গোলটা। দ্যাট গোল। দ্যাট প্রেসিয়াস গোল। কিংবা ২০১০। অন্যদিকে রেসিং স্যান্তান্দার। ৩০ গজ দূর থেকে ওই ভলিটা। বার্নাবিউতে ৪-০-র পর স্ট্যান্ডিং ওভেশন। রিয়েল। রিয়েলের বার্নাবিউ। জিনেদিন। যে বলেছিল, আন্দ্রেজ, হি রিমাইন্ডস মি অফ মাইসেলফ। অ্যানা। ওর সঙ্গে প্রথম দেখা। বিয়ের সিদ্ধান্ত। টামারিকের ক্যাসল। হানিমুনে মেক্সিকান বিচ। ক্লাব ফুট। বার্সায় আমার প্রিয় ক্যাসিবিয়ান মিউজিক ব্যান্ডের সেই গানটা। চুমু। আদর। ওয়াইন। আঃ। আমার ভ্যালেরিয়া। আমার পাওলো। ও যেন কোনওদিন ফুটবল না খেলে মাইকেল। আর খেললেও বার্সায় না। টিকিটাকা না। এ বড় বিষাক্ত ভালবাসা। পাস, পাস আর পাস। জিতলে কান্না, হারলে কান্না। ড্রিবল, ওয়ান টাচ, রিসিভ, পাস, আবার…। মাইকেল, ও পারবে এই কান্না নিতে? এই ভালবাসা নিতে? সেই ক্লাব ফুট মাইকেল। বারবার একই কথা চলে আসে। ‘অল আই গট ইজ আ ডার্টি ট্রিক আই অ্যাম চেসিং’। এত পাস, এত ভালবাসা, এত কান্না, এত হার, রোমা, জুভেন্টাস, অ্যাটলেটিকো। বাইরের ম্যাচগুলো। আমাদের কিছুই কি আর আছে মাইকেল? কোনওদিন কি ফিরবে কিছু? নাকি সব পাস্ট? ভ্যানিশ? তাহলে কেন ওরা আমাকে ইলিউশনিস্ট বলল? কেন বলল ডস আন্দ্রেজ? কেন এল সেরেব্রো (দ্য ব্রেইন)? কেন ‘দ্য পেল নাইট’। এত নাম, এত মায়া নিয়ে কী হবে মাইকেল, যদি সব ইতিহাস হয়ে যায়? কুটিনহো, ডাম্বেলে, র‍্যাকিটিচ। বিশ্বাস করো মাইকেল, আমি দেখছি ফিরে আসছে আট নম্বর জার্সি। ফিরে আসছে জেভির কাঁধ। ফিরে আসছে টিকিটাকা। কাঁদছি, হাউ হাউ করে কাঁদছি, কাঁদতে কাঁদতে বলছি আমি দেখতে পাচ্ছি ফিরে আসছে আমার বার্সা। এক একটা গোলের পর আমাদের তিনজনের ওই জড়িয়ে ধরা ফিরে আসছে। সাইডলাইনে পেপ, ফ্র্যাঙ্ক, এনরিকেদের মুষ্টিবদ্ধ হাত ফিরে আসছে। ফিরে আসছে ঝড়, ঝড়, ঝড়ের মতো ধ্বংসকারী নিখুঁত লা ব্লাউগ্রেনা। বার্সা। আমার বার্সা। মোর, মোর, মোর দ্যান আ ক্লাব …

ইতি

আন্দ্রেজ