Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এতদিন কোথায় ছিলেন….?

ভবভূতি ভট্টাচার্য

 

চোখ তো আর পাখির নীড়ের মতো নয়, তাই অ-কবিভাবেই এরচে’ জুতসই শীর্ষনাম আর এল না কলমের ডগায়।

কিম্বা, লেখা যেতে পারত এক ‘খোলা চিঠি’:

শ্রী প্রীতম বসু মহোদয়,
লেখক, ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কলকাতা চুয়ান্ন।।

না, মহাশয়, দেরিটা এ’ অধমের যতটা না, কলমকারের তার চে’ অধিক অনেক। রাজশেখর বসু বা সত্যজিৎ রায়ের মতো দিকপাল চল্লিশ ছুঁয়ে প্রথম কলম ধরেছিলেন শুনে শিহরিত হলে তো আপনার উদাহরণে মুচ্ছো যেতে হয় মশায়, কারণ এ’ উপন্যাস আপনার প্রায় ষাট ছোঁয়া প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ বলে জানা গেল! তা না হলেও যে কনসার্ট শোনালেন আপনার কলমে বাজিয়ে, তার পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখতে হলে একাধারে (১) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার তথা সংস্কৃত সাহিত্যের কদরদান, (২) বাংলা ও সংস্কৃত ছান্দসিক, (৩) পুঁথি-বিশেষজ্ঞ, (৪) মধ্যযুগীয় গণিতের মাতব্বর, (৫) হাস্যরসিক, (৬) বাংলা বর্ণমালা তথা ক্যালিগ্রাফির বোঝদার ইত্যাদি ইত্যাদি হতে হয় এ’ কলমচি-কে। হ্যাঁ, কনসার্টই, কারণ এ’ সবের সমাহারে আমাদের ‘শুনিয়েছেন’ যে ঐক্যসুর, তাতে সুর-বিচ্যুতি তো কৈ একতিল পেলুম না। উপরন্তু, সব মিলেমিশে যে ঐক্যসুর উঠে এল, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা পাচ্ছি না চট করে।

‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’

লেখক ও প্রকাশক : প্রীতম বসু, Glenville, New York, USA / ৯সি শিবকৃষ্ণ দাঁ লেন, কলকাতা-৫৪

প্র প্র এপ্রিল ২০১৫

ISBN   978-0-692-58858-1  / 9-780692-588581

*

পাঠক কনফ্যুজড। কীসের বই ইটি? প্রচ্ছদের ছবি দেখে এক ‘মঙ্গলকাব্য’ ভেবে কিনেছিনু, কিন্তু ‘প্রাককথন’-এর ‘ডিসক্লেইমার’ পড়ে ঘাবড়াহাট: এইপ্রকার ‘সকল চরিত্র কাল্পনিক’ তো উপন্যাসের গোড়ায় লেকা থাকে গো। কেমন উপন্যাস এ’খানি? না, ‘রহস্য-উপন্যাস’! বলিস কী?! মধ্যযুগের বাংলার এক নাম-না-শোনা (বা, ‘আদৌ-না-লেখা’?) মঙ্গলকাব্যের পুঁথির উদ্ধার বা না-উদ্ধারের ‘কহানি’ এ’খানি। কিন্তু সেটা পড়তে গিয়ে কয়েকপৃষ্ঠা পরেই যে মধ্যযুগীয় বাংলা অক্ষরে লেখা শিলালিপির হাতে-আঁকা ছবি দেখতে পাওয়া গেল তাতেই মালুম যে এর রস সহি আস্বাদন করতে তানপুরোখানি কাঁধে ফেলতে হবে রীতিমতো, এমনি-এমনি হবে না। গ্রন্থশেষের দুই পৃষ্ঠাতেও এক সহস্রাব্দব্যাপী বাঙ্গালা বর্ণমালার বিবর্তনের যে হস্তাঙ্কিত চিত্র, ODBL-ধাঁচের গ্রন্থের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখি, কালাচাঁদ ঢপ দিয়ে কিছু গছিয়ে দিয়ে গ্যালো না ত?! পরিশিষ্টের গ্রন্থমালাও কম দীর্ঘ নয়। এবং, সে-তেইশটি বইয়ের মধ্যে কেবল রাখালদাস-দীনেশ সেন-সুকুমার সেন-ই নেই, আছেন আর্যভট্ট ব্রহ্মগুপ্ত থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর চৈনিক-মুসলিম নাবিক মা হুয়ানও! আজকের প্রতিনিধিস্থানীয় বাংলা ঔপন্যাসিকগণ কঠিন গবেষণা করে তবেই লিখছেন, ইদানীং বেশ লক্ষ করছি সেটা। সে মান যে কত উচ্চে উঠেছে, বর্তমান রহস্য-উপন্যাসখানি না পড়লে থৈ পাবেন না পাঠক তার। পুনরায় উল্লেখ থাক্‌, বাংলাভাষায় একাধারে এই মানের এই প্লটের ও এই গভীরতার উপন্যাস আর পড়িনি আগে।

*

ইটি কি তবে গবেষণাগ্রন্থ?

‘খেপচুরিয়াস বুড়োর’-র কথা, বা ‘ক্লাস টেনের অঙ্ক পরীক্ষায় টুকতে গিয়ে ধরা পড়া কর্তামশাই’, বা, ‘চণ্ডীদাসের কাছে আদরের গাল-টিপুনি খাওয়া’ বা ‘ফেউ-কে বাঘের হাগার গন্ধ চেনানো’-র মতো বাক্যবন্ধ পড়তে পড়তে মুখ রামগড়ুরের ছানা করে রাখবে এমন পাঠক হতে পারে না। এমন এমন পরিমিত রসভাণ্ড সারা বইটিই (ভয়ে কাৎ করছি না), শেষ যার কুমোরটুলিতে চোরাই শিবমূর্তি আনতে গিয়ে রাত বারোটা ছাপ্পান্ন বাজিয়ে। প্রীতম-দা, আপনি যদি কেবল চিত্রনাট্য লিখেই খেতেন, ঝাম-ঘষা পড়ত কিরণ রাও-এর মুকে।

উপন্যাসের গ্র. স. লেখা দুরূহ কাজ, আগেই বারেবারে বলেছি (তাতে গল্পখানি ফাঁস হয়ে যাবার শঙ্কা থাকে), উপরন্তু তা যদি এমন এক রহস্য-উপন্যাস হয়। তবু, কী পড়তে পাঠক online order দেবেন বইখানির? ত্রয়োদশ শতকে ক্ষুব্ধ তুর্ক-হানাদার বখতিয়ার খিলজি কোরানশরীফ না খুঁজে পেয়ে দাউ দাউ জ্বালিয়ে দিল নালন্দা মহাবিহারের লাইব্রেরি। কিছু সংখ্যক ছাত্র বুকে ধরে কিছু পুঁথি নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। না, তার মধ্যে এই ‘পঞ্চানন মঙ্গলকাব্য’ ছিল না। মঙ্গলকাব্যগুলি তার পরে পরে লেখা শুরু হয় বঙ্গদেশে। তেমনই এই এক কাব্যের মূল পুঁথি লুঠতে আজকের দিনে সুদূর আরবদেশ থেকে উড়ে এসেছে এক পয়সাওয়ালা খুনে। কেন সে একে ‘মাখতুতাত শায়তানে’ (শয়তানের পাণ্ডুলিপি) বলে [এটি আরবি অক্ষরে লেখাটা বেশ এক স্টান্ট!]? তা কি এ’ কাব্যের দ্ব্যর্থবোধক পংক্তিতে পংক্তিতে ‘এলগোরিদম’-এর সূত্র লুকিয়ে আছে বলে, যা আজকের কম্পুটর-ব্রেনের নিউরোন?

তা বলে একে এক অঙ্ক-কষকষে গোয়েন্দাকাহিনি ভেবো না যেন। এতে আছে ভানুমতী-বলরামের পেলব প্রেমোপাখ্যান (অনেকটা সূরা-স্পার্টাকাসের ঢঙে) যেখানে নায়িকার অন্তর্বাসের কাঁচুলি উঁকি মারে, তোটক-চৌপাই-পয়ারের মতো বাঙলা-সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্র সেঁচে আনা মুক্তারাজি, বালাম-গোধা-সারেঙ্গার মতো প্রাচীন বঙ্গীয় জলযানের গপ্প, স্থানে স্থানে প্রাচীনবঙ্গের অপূর্ব প্রাকৃতিক বর্ণনা, ইউরিয়াস্টিবামিন ও কালাজ্বরের নিদান — সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি একখানি অখণ্ড ‘পঞ্চাননমঙ্গলকাব্য’। উপন্যাসের বাইপ্রডাক্ট হিসেবে একখানি মনোমুগ্ধকর কাব্য পড়তে পাওয়া যায় এমন নমুনা তো কৈ আগে কক্ষনো কোনও উপন্যাসে পাইনি? সাধু সাধু! আর, কী সে কাব্যের মান! দ্ব্যর্থবোধক পংক্তির পরতে পরতে তার লুকিয়ে আছে এলজেব্রা থেকে শুল্বশাস্ত্র (জ্যামিতি)!

*

এ’ বইয়ের সমালোচনা করি ঘটে বুদ্ধি নেই এমন। কেবল দুটি বিষয়ে একটু কিন্তু কিন্তু। আল খাওয়ারিজমি-কে বারবার ‘আরব’ বলা হয়েছে, কিন্তু উনি পারসিক-মুসলিম ছিলেন না? আর, উপ-নায়ক নন্দীধন যখন নালন্দায় চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠ নেন, তদ্দিনে তো নালন্দা ধ্বংস হয়ে গেছে। লেখক-মহাশয় বা অন্য পাঠক যদি কিঞ্চিৎ আলোকপাত করে দেন….।

*

দ্বাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ফরাসি বৈয়াকরণ ও গণিতজ্ঞ আলেক্সান্দার ডি ভিল্‌ডিউ তাঁর ‘এলগোরিদম-কাব্যনাট্যে’ (Carmen de Algorismo) লিখে গিয়েছিলেন ‘…..ভারতের পাঁচ-দুগুণের সংখ্যাতেই বাঁধি এই গাথা….’! পড়িনি। এলেম নেই। প্রীতম বসুর লেখা এই ‘পঞ্চানননমঙ্গল’ কাব্য পড়ে সে দুঃখু গেল।

রেটিং? তারও এলেম নেই হে। দিলে দশে বারো হয়ে যাবে।