Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পূর্ব কলকাতা জলাভূমি : একটা ইস্তাহার

পূর্ব কলকাতা জলাভূমি

কাজল সেনগুপ্ত

 

একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কোনও লেখা যদি একটা সামাজিক প্রয়োজনীয়তা পূরণের দিকে এগোতে সাহায্য করে, সেটা একটা বড় পাওনা। এর আগে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নিয়ে, Kolkata Commons’ Centre For Interdisciplinary Research And Analytics (CIRA)-র কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম লিখিয়ে ছেড়েছিল। সেটা পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নিয়ে লেখা ছিল না। লেখাটা ছিল পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে কাজ করতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে। ঠিক লেখাও নয়, বরং একটা কথোপকথন গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল। সম্পাদক বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, দুই কিস্তির লেখা আর ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ-এর স্মৃতিচারণ নাকি পাঠকদের আগ্রহ তৈরি করেছে। কিন্তু কথোপকথনটা তেমন করে তৈরি হচ্ছিল না বলে, আমরা লেখাটার বদলে অন্য কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলাম। এই জ্যৈষ্ঠের পচা গরমে, সম্পাদক আবার ফিরে এসেছেন, পরিবেশ সংক্রান্ত বিশেষ সংখ্যার জন্য লেখার আর্জি নিয়ে।

এসময়ে জলাভূমি অঞ্চলে গরমটা অনেক কম। তবে, ইলেকট্রিসিটি ইন্টারনেট এগুলো খানিক মর্জিমাফিক আসে যায়। আর গত কয়েক মাস ধরে, আমরা কলকাতা কমন্স সিরা-র পক্ষ থেকে একটা পাপস্খালন-এর জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। ২০১৭-র মার্চে, কলকাতা কমন্স সিরার উদ্যোগে, এবং রাজ্য পরিবেশ দফতর ও ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটি-র সক্রিয় সহযোগিতায়, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নিয়ে একটি পলিসি ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে রামসার সেক্রেটারিয়েট-এর প্রতিনিধি ছিলেন, জলাভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ডজনখানেক রাজ্য সরকারি দফতর ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা ছিলেন, জলাভূমি নিয়ে কাজ করেন এরকম বেশ কিছু অসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধিরা ছিলেন, জলাভূমি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। পলিসি ওয়ার্কশপের উদ্যোগটা যেহেতু আমরা নিয়েছিলাম, উপস্থিত প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে আমাদের আরও দুটি প্রস্তাব ছিল। এক, জলাভূমি অঞ্চলে অধিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব (শুধু পঞ্চায়েত নয়, জলাভূমি অঞ্চলের বাসিন্দা, মৎস্যজীবী, কৃষিজীবীদের প্রতিনিধিত্ব), আর দুই, প্রমোটার-ডেভলপার-জমি ব্যবসায়ী, অহরহ যাঁদের প্রসঙ্গ উঠে আসে, জলাভূমির স্বার্থের ও স্বাস্থ্যের পরিপন্থী বলে, তাঁদের সাংগঠনিক (আমরা ক্রেডাই-এর কথা বলেছিলাম) প্রতিনিধিত্ব। আমাদের যুক্তি ছিল, প্রথম পক্ষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই জলাভূমিকে আগলে রেখেছেন। আজ তাঁদের সুবিধে অসুবিধেগুলো সরাসরি তাঁদের কাছ থেকেই জানা দরকার। কিন্তু জলাভূমি অঞ্চলের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাবে কেউ রাজি হলেন না। আর অন্যদিকে, নগরায়নের অজুহাতে, জলাভূমির নিয়ম নীতি লঙ্ঘনের অভিযোগের আঙুলটা সবসময় দ্বিতীয় পক্ষের দিকে ওঠে। রেস্ত, ক্ষমতা প্রভৃতির দৌলতে এই দ্বিতীয় পক্ষ, হামেশাই প্রথম পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কখনও কখনও পেয়েও যান। অথচ দুই পক্ষের কার্যকারণ সম্পর্ক বেশ আলাদা। আমাদের মনে হয়েছিল এঁদের সঙ্গেও বাকি সকলের কথা হওয়া দরকার। প্রথম পক্ষ এখানে থাকুন এমনটা বাকিরা চাননি। আর দ্বিতীয় পক্ষকে হাজির করা মানে, আমাদের মনে হয়েছে, যেন নিষ্কলুষ থাকা গেল না। সমস্যাটা আছে, সে নিয়ে দ্বিমত নেই, সমস্যাটা কোথা থেকে তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই, অথচ, সামনাসামনি — ‘আপনারা মশাই গোল বাধাচ্ছেন কেন? এখানে সবার সামনে একটা বোঝাপড়ায় আসুন, যাতে, এর পরে আর গোলমাল করতে না পারেন, জলাজমি বুজিয়ে ফেলে, তারপরে, এবাবা, জানতাম না তো, বাচ্চে কা জান লেগা কেয়া, বা, বেশ করেছি, ক্ষমতা আছে তাই বুজিয়ে দিয়েছি — এই ধরনের কোনও বদ অজুহাত দিতে না পারেন’ — এরকম একটা মোলাকাতের বন্দোবস্ত করা গেল না। পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে জলাভূমি হিসেবেই কলকাতা শহরের অংশ হিসেবে রেখে নগরায়ন পরিকল্পনার কোনও রূপরেখা তৈরি হতে পারত, হল না।

এদিকে পলিসি ওয়ার্কশপে ঠিক হল, ২০০২-এ রামসার স্বীকৃতি পাওয়ার পরে, একটা ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরির জন্য ১৫ বছর যথেষ্ট বড় সময়, তাও যখন সেটা করা যায়নি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেটা তৈরি করা যাক। ২০১৭-র ৩ মার্চ-এর এই রেজলিউশনের পরে, এটা ২০১৮-র মে মাসের শেষ দিন। এখনও ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের কোনও উদ্যোগ চোখে দেখতে পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। গত এক দশকেরও বেশি সময়ের সম্পর্কের কারণে, প্রথম পক্ষ অর্থাৎ, পূর্ব কলকাতা জলাভূমির অধিবাসীদের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আমরা ঠিক করেছিলাম, জলাভূমি অঞ্চলের মানুষ, তাঁদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সূত্রে সমস্যাগুলোকে নিজেরা এক জায়গায় জড়ো করুন। তাঁরা সমাধানগুলো কীভাবে ভাবছেন, সেই প্রস্তাবগুলোও একজায়গায় করুন।

প্রয়োজনে, এই সমস্যা ও তার সমাধানের প্রস্তাবগুলি নিয়ে, আমরা বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সঙ্গে একটা মতামত আদানপ্রদানের বন্দোবস্ত করতে পারি। যদি আর্থিক সঙ্গতিতে পোষায় তাহলে একটা জনস্বার্থ মামলার কথাও ভাবতে পারি।

২০১৮-র ৫ জুন, পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে, জলাভূমির মানুষেরা তাঁদের দাবিসনদের একটা খসড়া তৈরি করছেন। আমরা একটু তাড়া দিয়ে সেটা পয়লা জুন-এর বিশেষ পরিবেশ সংখ্যার জন্য চেয়ে নিয়েছি। যদি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকেই, জলাভূমির মানুষদের দাবিসনদ নিয়ে, নাগরিক সমাজের মধ্যে মতামতের আদানপ্রদান তৈরি করার কাজটা শুরু করা যায়, ভালো হয়। এখানে কমেন্ট থ্রেড-এ মতামত জানাতে পারেন, বা সরাসরি মেল করতে পারেন, commonscira@gmail.com বা kajolsengupta@gmail.com-এ।

সহনাগরিকদের সঙ্গে আলোচনার জন্য” পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ” (Commons of East Kolkata Wetland) -এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত ইস্তাহার :

যেমন —

এমতাবস্থায়, পূর্ব কলকাতা জলাভূমির অধিবাসীদের একাংশ, “পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ” (“Commons of East Kolkata Wetland”) নিম্নলিখিত দাবিগুলির ওপর, দলমত নির্বিশেষে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির সমস্ত অধিবাসী ও কলকাতার মানুষদের মতামত ও পরামর্শ চাইছে। যদি অর্থকরী বন্দোবস্ত করা যায় তবে, এই দাবিগুলোর ভিত্তিতে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার কথাও ভাবা হচ্ছে। যদি কোনও সহনাগরিক এ ব্যাপারে আইনি পরামর্শ দিতে পারেন তাহলেও খুব উপকার হবে। কোনও সহনাগরিক যদি এই খসড়াটি ইংরিজিতে অনুবাদ করে দেন তাহলেও খানিক উপকার হয়।

দাবিসনদ —

“পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ” (“Commons of East Kolkata Wetland”)-এর পক্ষে,
পলাশ মণ্ডল,
গ্রাম — দেয়ারা, খেয়াদহ ২ গ্রাম পঞ্চায়েত, পোস্ট — খেয়াদহ, থানা — সোনারপুর, কলকাতা — ৭০০১৫০, খেয়াদহ ২ গ্রাম পঞ্চায়েত

উপরের ইস্তাহারের খসড়াটি গোটাটাই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চলের আধিবাসীদের তৈরি। এটা কলকাতা কমন্স সিরা-র বক্তব্য নয়। আসলে এব্যাপারে কোনও বক্তব্য না রাখাটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। কারণ সেটা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। জলাভূমির এই জীবন, আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নয়। এর সমস্যাগুলোর মধ্য দিয়ে রোজ আমাদেরকে যেতে হয় না। এবং আমরা কোনও রাজনৈতিক দল নই (আমদের কোনও রাজনীতি নেই বলিনি কিন্তু)। ইস্যুগুলোকে একজায়গায় নিয়ে আসাটা আমাদের কাজ ছিল, ওটুকুই আমরা করতে চেয়েছিলাম। যদি প্রয়োজন মনে করেন, আপনাদের মতামত জানাবেন। আর এই প্রসঙ্গে আরও দু-এক কথা জানিয়ে রাখি।

এমনিতে সাম্প্রতিক অতীতে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমির ওপর বিভিন্নরকম আক্রমণ নেমে এসেছে। সেটা নতুন নয়। যাঁরা সরাসরি বলছেন, কলকাতা শহরের বাড়বার আর কোনও জায়গা নেই। এই দিকে এই জলাভূমিকে অধিগ্রহণ করেই বাড়তে হবে — তাঁদেরকে সহজে চেনা যায়। মোকাবিলাও করা যায়, কারণ এঁদের পুরোটাই কুযুক্তি। তবে হ্যাঁ, এর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে, একটা অংশকে আমরা চিনেছি, যাঁরা শুধুই পরিবেশের কথা বলেন, জলাভূমির সাপ-ব্যাঙ-মাছ-কেঁচো-কপি নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু জলাভূমিতে বসবাসকারী মানুষদের কথা এড়িয়ে যান। এই জলাভূমি অঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাস, যেটা শহর কলকাতার থেকেও অনেক পুরনো, সেগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না। অনুচ্চারিত রকমে যেটা থাকে, এই অঞ্চলের মানুষ, গেঁড়ি-গুগলি-শাকপাতা-র বাইরে কোনও জীবন দেখতে চাইলে সেটা পরিবেশবিরোধিতার অপরাধে দুষ্ট।  আমরা মনে করি, কলকাতার উপকণ্ঠে, যেখান থেকে ঘাড় সোজা করে তাকালেই সেক্টর ফাইভ আর বাইপাস চোখে পড়ে, উন্নত আমুদে শহরজীবনের ঝলমলে সব চিহ্ন, তারা কেন অল্পেই সন্তুষ্ট থাকছেন না, এরকম অভিযোগ করার বদলে, জলাভূমির মানুষদের পার্থিব উন্নয়নের আকাঙ্খাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। মানুষকে বাদ দিয়ে, বিশেষ করে সেই মানুষ, যাঁরা এই জলাভূমিকে এতদিন ধরে আগলে রেখেছেন বলেই এটা নিয়ে এখনও কথা বলার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তাঁদেরকে বাদ দিয়ে, ‘ইকোসিস্টেম’ অ্যাপ্রোচের দাবি করা যায় না। এর বাইরে অধুনা আর একটা অংশ তৈরি হচ্ছে। তৈরি ঠিক হচ্ছে না, ছিলই, তবে বেশি বেশি করে নজরে আসছে। এঁরা পরিবেশ আর স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়েই, প্রকারান্তরে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির বিরোধিতা করছেন। ‘পূর্ব কলকাতা জলাভূমির মাছ, সব্জি, এগুলো স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ তো!’ এরকম একটা বিজ্ঞান বিজ্ঞান শুনতে ব্যাপার নিয়ে এঁরা এঁদের কথা শুরু করছেন। এমন নয়, যে এটা নতুন। এর আগেও বহুবার এনিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে। প্রত্যেকবারই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে এই সন্দেহ মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তারপরেও ঘুরে ফিরে আসে। কিছু অর্ধসত্যের আড়ালে নতুন নতুন ফিকিরে। সম্প্রতি অ্যাকাডেমিয়ার থেকে একদল আবার বলতে শুরু করেছেন, পূর্ব কলকাতা জলাভূমির উৎপন্নে নাকি ট্যানারির ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশছে। প্রথমত, ট্যানারি মানে বানতলা লেদার কমপ্লেক্স রয়েছে, ডাউনস্ট্রিমে। লেদার কমপ্লেক্স-এর পাঁচিলে শেষ হচ্ছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির সীমানা। সুতরাং খাল বয়ে আপস্ট্রিমে এসে, ভেড়ির জলে রাসায়নিক মেশা সম্ভব নয়। বানতলা লেদার কমপ্লেক্সের সমস্যা অন্যত্র। প্রথমেই যেটা বলে রাখা দরকার, লেদার কমপ্লেক্স এখানে হবে, এই সিদ্ধান্তটা জলাভূমির মানুষ নেননি। এটা কোনও এক আজব নগর পরিকল্পনার ফল। দ্বিতীয়ত, লেদার কমপ্লেক্সের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সময়ে নাকি কথা ছিল এটা জিরো ডিসচার্জ ইউনিট হবে। মানে, লেদার কমপ্লেক্সের পুরো বর্জ্যটাই লেদার কমপ্লেক্সের মধ্যে, পরিশোধিত হয়ে পুনর্ব্যবহার হবে। না, সেটা হয় না। কেই বা কথা রাখে! তার ফলে লেদার কমপ্লেক্সের বর্জ্য গিয়ে মেশে খালে, সেখান থেকে কুলটি গাঙ হয়ে, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমে। তার ওপর এত বছর ধরে মাটির তলার জল তুলে তুলে যা অবস্থা হয়েছে, তাতে আশেপাশের গ্রামগুলোতে পানীয় জলের জন্য বাড়িতে সাবমার্সিবল বসাতে হয়। যাঁদের সে সঙ্গতি নেই, সেরকমটা স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাঁদের ভরসা করতে হয় স্বচ্ছল প্রতিবেশীর ওপর। গ্রামসমাজে নতুন ক্ষমতার বিন্যাস তৈরি হয়, পানীয় জলের যোগান ঘিরে। এর সঙ্গে আছে, বিকট রকমের চর্মরোগ। লেদার কমপ্লেক্স সংলগ্ন অঞ্চলে কোনওরকম পশুপালনও করা যায় না। এগুলো সবই, খুব খারাপ ব্যাপার। কিন্তু এই অ্যাকাডেমিক চর্চায় এসবের কোনও উল্লেখ নেই। আছে, খাল বয়ে জলের ওপরের দিকে এসে ভেড়ির মাছ বা ক্ষেতের সব্জিকে দূষিত করার গল্প। এবং এর পেছনে কোনও তথ্য নেই, আছে কিছু হিয়ারসে। ‘না, মানে ট্যানারি তো খুবই খারাপ ব্যাপার, জলাভূমির আশেপাশেই তো আছে। কিছু কি এসে মেশে না? নিশ্চিত করে কি বলা যায়?’– এরকম সব বেয়াদব রকমের হাস্যকর যুক্তি। হ্যাঁ, সমস্যা একটা আছে। আপস্ট্রিমে যে বেআইনি ট্যানারি এবং প্লাস্টিক ইউনিটগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো। ইস্তাহারটিতেও সেগুলোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কথা এই অ্যাকাডেমিশিয়নরা বলছেন না। আর এগুলো হঠাৎ করে তৈরি হয়নি, বেশ কয়েক বছর ধরে আছে। তারপরে একাধিকবার, জলের, খাদ্যদ্রব্যের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা হয়েছে, এবং ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি। এই অবৈধ প্লাস্টিক ও ট্যানারি ইউনিটগুলোর কারণে এলাকার মানুষ বেশ পর্যুদস্ত, শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এগুলো পুলিশ-প্রশাসন, ওয়েটল্যান্ড অথরিটির চোখের সামনেই আছে, কিন্তু কেউই কোনও ব্যবস্থা নেয় না। এবং যতদিন পর্যন্ত, এটা শুধুই জলাভূমি অঞ্চলের মানুষের সমস্যা, কলকাতাকেন্দ্রিক পরিবেশ আন্দোলনের সেদিকে নজর পড়ে কম (ব্যতিক্রম আছে, তবে সেটা নিয়মকেই প্রতিষ্ঠা করে)। মোদ্দা যে কথাটা বলতে চাইছি, সেটা হল, পরিবেশের পক্ষে কথা বলার ছুতোয় জলাভূমির স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলার একটা শৈলী আছে। এটা সব থেকে বিরক্তিকর ও বিপজ্জনক।

এতটা বিস্তারিতভাবে এগুলো বলার একটা কারণ আছে। পরিবেশের পক্ষে কথা বলার অছিলায়, পরিবেশের সব থেকে বড় ক্ষতিটা করে দেওয়া সম্ভব। যেমন ধ্রুবদার মৃত্যুর পরে, ধ্রুবদা কত ভাল, কত মহান ছিলেন, এই নিয়ে বাড়াবাড়ি রকম কথা হয়েছে। ধ্রুবদার যেটা হাতে কলমে কাজের জায়গা, জলাভূমি নিয়ে কথা হয়েছে খুব কম। ব্যতিক্রম আছে। ধ্রুবার কথা এর আগেও লিখেছিলাম। ধ্রুবদার ছাত্রী, সহযোদ্ধা, সেনাপতি। এই পরিবেশ ইস্যু-র চারনম্বর প্ল্যাটফর্মেই, ধ্রুবা, ধ্রুবদার শেষ প্রকাশিত লেখাটার অনুবাদ করছেন। ধ্রুবা দাশগুপ্তদের উদ্যোগে, একমাত্র SCOPE, জলাভূমির মধ্যে, জলাভূমির মানুষদের নিয়ে ধ্রুবদার স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন। এছাড়া যা হয়েছে সবই, শহর কলকাতায়। যাই হোক, যা বলছিলাম। কলকাতা কমন্স সিরা-র পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব আছে। অ্যাকাডেমিক এই ধ্যাষ্টামোগুলো বন্ধ করতে, একটু অ্যাকাডেমিক রকমেই, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের নামে একটা লেকচার সিরিজের আয়োজন করা যায় কি? পাঠকদের মধ্যে এব্যাপারে কেউ আগ্রহী হলে, বা এটা ঘটিয়ে তোলার মতন অ্যাকাডেমিক যোগাযোগ থাকলে, এব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হলে কোন সাহায্য করতে পারবেন কি?

যদি আগ্রহী হন, জানাবেন।