Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বস্তারে মাইনিং — তিন

বস্তারে মাইনিং

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 

(দ্বিতীয় পর্বের পর)

রাওঘাট মাইনের জন্য নির্মীয়মাণ মালগাড়িপাথে যা ঘটছে

ভানুপ্রতাপপুর ছাড়িয়ে রাওঘাটের দিকে কিছুদূর এগোলেই বিএসএফ-এর বোড়েনার ক্যাম্প, যার এক পাশ ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে সেই মালগাড়ির রেলপথ। এর কাছের দুটো গ্রাম ঘোটুলবেড়া ও সারেন্ডি থেকে ভেসে আসে চাপা ফিসফিস — কিছু একটা যেন হয়েছে, কিছু একটা ভয়ঙ্কর। আবার আরেকটা গ্রাম এটেবালকার এক মেয়ে ও সেই মেয়ের রেপচাইল্ড ও তার বাপেরবারি আপাতত পুলিশের দেওয়া রফা-প্রস্তাব অনুসারে, চুপ থাকার বদলে পাঁচ অঙ্কের একটা অফার পেয়েছেন, অনেকটা ‘…an offer they can’t refuse’-এর ধাঁচেই হয়তো। এরকমই আরেক ভয়থমথম বিএসএফ ক্যাম্প হুরে পিঞ্জোরি। আমাবেড়া যাওয়ার রাস্তায়, লিঙ্গোবাবার থান সেমারগাঁওর কাছেই একটা অদ্ভুত সুন্দর ঝর্ণা-ধোয়া বনে ঢাকা গভীর শান্ত চাররে-মাররে ভ্যালি। সেইখানে অবস্থিত এই ক্যাম্পের ফৌজিদের বিরুদ্ধে উঠেছে একের পর এক যৌন হিংসার অভিযোগ। ৪ জন মহিলা, অ্যালেজেডলি, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে, একজনের মৃত্যুও হয়েছে।

এইবার আসা রেলপথটার বিষয়ে। ২৯.০৫.২০১৪ তারিখে ছত্তিশগড় সরকার ছাড়পত্র দেয় এই রেলপথটিকে। আপাতত দল্লি রাজারার সাথে রাওঘাটকে জুড়বে এই রেলপথ। নির্মাণ চলছে। খাতায় কলমে, মানে উক্ত ছাড়পত্রে লেখা রয়েছে ৮৩.১২ হেক্টর ‘অতিরিক্ত’ বনভূমি যাবে এই রেলপথের পেটের ভিতর। সঙ্গে যাবে অজস্র গাঁ-গঞ্জ। ন্যাশানাল গ্রিন ট্রাইবিউনাল (এনজিটি)-তে চালু মোকদ্দমায় রেলওয়ে দাবি করেছে যে রেলপথের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও নাকি কোনও গ্রাম নেই। অথচ চাক্ষুষ, একটা গ্রামের শ্মশানের উপর দিয়ে চলে গেছে রেলের জন্য মাপা সীমানা। এও চাক্ষুষ — একটা বিরাট সর্পিল এলাকা জুড়ে কাতারে কাতারে গাছ মাটিতে পড়ে আছে মুখ থুবড়ে, আর তার মাঝে মাঝে ভিরকুটি মেরে তাকিয়ে আছে কিছু কাণ্ড-খোয়ানো বনস্পতির গুঁড়ি। আর তার পাশে পাশে সমতলীকৃত বিরাট জমি সর্পিল আকারে চলেছে রাওঘাট ছাপিয়ে মাতলা জঙ্গলের দিকে। জমিতে কোথাও কোথাও লোহার পাত বসছে। দল্লি থেকে শুরু ভানুপ্রতাপপুর হয়ে অন্তাগড় টাউন, টাউনের দক্ষিণ পশ্চিম সীমানা ছাড়িয়ে কুহচে গ্রাম, সেই কুহচে ছাড়িয়ে রাওঘাট খনির ‘কোর এরিয়া’-র পথ অবধি স্টেশন/লোডিং-আনলোডিং সাইটের নির্মাণকার্য পুরোদমে চলেছে।

রাওঘাটের জন্য টাউনশিপ বানাতে যেভাবে গ্রামবাসীদের রাজি করানো হয়

রাওঘাটের মাইন আর রেলপথ ছাড়াও, মাইনের অফিসারবাবুদের জন্য ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট রেসিডেনশিয়াল টাউনশিপ বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে ভানুপ্রতাপপুর টাউন থেকে কিছু দূরে অবস্থিত কলগাঁও গ্রামে। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আঞ্চলিক প্রশাসন ও ফৌজিবৃন্দ। ২০১৫ সালের দোসরা অক্টোবর গ্রামসভার আয়োজন করা হয় এই গ্রামে। পঞ্চায়েতের পদাধিকারীবৃন্দ ছাড়াও, সভায় উপস্থিত ছিলেন গ্রামের ৩০-৩৫ জন লোক। বনাধিকার পাট্টার আবেদন ও বণ্টন এবং মনরেগা-য় লভ্য কাজ নিয়ে আলোচনা চলছিল। এমন সময় সেইখানে উপস্থিত হন অন্তাগড় সাব-ডিবিশানের এসডিএম ইন্দিরা দেবহারী। তিনি বলেন যে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট টাউনশিপ বানাবে গ্রামে। সরকারি প্রকল্প, তাই যেন-তেন-প্রকারেণ প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৮ হেক্টর জমি দিতেই হবে গ্রামবাসীদের, নইলে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। এই অবধি বলে তিনি উপস্থিত পঞ্চায়ত-সচিবের হাত থেকে গ্রামসভার রেজিস্টার ছিনিয়ে নিয়ে তাতে লিখে দেন — ‘গ্রামবাসীরা ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের টাউনশিপের জন্য জমি দিতে সম্মতি প্রকাশ করেছে’।

পরিস্থিতি দেখে চরম রাগে ফেটে পড়েন উপস্থিত গ্রামবাসীরা। কাছেই প্যারামিলিটারি ক্যাম্প ছিল। এসডিএম সেইখান থেকে ফোর্স ডাকেন। বিপুল সংখ্যায় আধাসামরিক বাহিনী চড়াও হয় গ্রামে। বন্দুক তাক করে ঘিরে ধরে গ্রামবাসীদের। বন্দুকের নল ঠেকিয়ে সই নেওয়ানো হয় তাঁদের — এই মর্মে যে তাঁরা ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের জন্য জমি দিতে সম্মত। বন্দুকের নলই যে সমস্ত ক্ষমতার উৎস তা গত দশ বছর ধরে সমস্ত বস্তার সম্ভাগ জুড়ে প্রমাণ করে ফেলেছে ছত্তিশগড় সরকার। এই নিয়ে কিছু হল্লা হলে মাস দশেক চুপচাপ থাকে সরকার। তারপর ২০শে অগাস্ট ২০১৬ তহসিল অফিসে ৬ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে কোনও আপত্তি থাকলে তা জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয় গ্রামবাসীদের। ৬ দিনের নোটিস আইনে কোনওভাবেই গ্রাহ্য নয় যদিও। কিন্তু, এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা, এসডিএম বা কালেক্টর অফিসে কোনও আদিবাসী তাঁর আইনি অধিকারের কথা বললে তৎক্ষণাৎ অর্ধচন্দ্র দেওয়া হয় তাকে। ২০১৪ থেকেই ছলে বলে কৌশলে কালগাঁওয়ে প্রায় ১৮ হেক্টর ঐ জমির টুকরোটা কেড়ে নিতে মুখিয়ে ছিল ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট। ২০১৭ শেষপাদে এর বিরুদ্ধে কিছু গ্রামবাসী বিলাসপুর হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করতে না করতেই নির্মাণকাজ শুরু হয়ে গেল পুরোদমে। কোন উপায়ে জমি তারা হস্তগত করেছে, এই প্রশ্ন ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টকে রাখতে তাদের জবাব — ভিলাইতে স্টিল প্ল্যান্টের মালিকানাধীন অঞ্চলে সরকারকে জমি দিয়েছে আইআইটি বানানোর জন্য, সেই জমির বদলে কালগাঁও গ্রাম থেকে সেই অন্যূন ১৮ হেঃ জমি তাঁরা সরকারের থেকে নিচ্ছে।

আইন এই বিষয়ে যথার্থ ন্যায় আনয়নে অপারগ। কারণ, ভারতীয় সরকারি তথা প্রাশাসনিক, ভূ-রাজস্ব সম্বন্ধিত ল্যান্ড রেকর্ডস বা আইনি পরিভাষায় কোনওভাবেই গ্রামভূমি বা গ্রামের মানুষদের যৌথ মালিকানাধীন কমিউনিটি ল্যান্ড ও অন্যান্য ‘কমোন’স’-কে গ্রামের মানুষেরই সামগ্রিকভাবে আয়ত্তাধীন সম্পদ হিসেবে দেখা হয়নি, দেখেছে গোচারণভূমি, ঘাসজমি, খাসজমি তথা সকলই ‘সরকারি’ জমি হিসেবে। ভারতের মতো ‘কমোন ল্য’ শাসিত দেশে একটা নিয়ম আছে — ‘ডক্ট্রিন অফ এমিনেন্ট ডোম্যেন’ যা বলেছে যে দেশের সমস্ত জমিরই আল্টিমেট মালিক সরকার। ‘কমোন ল্য’-এ ‘কমোন’স’-এর এর কোনও জায়গা নেই।

দল্লি থেকে রাওঘাট — কোন পথে মাইন ঢুকছে

‘দেশ’ ‘স্বাধীন হল। নেহেরু আর স্তালিন হাত মিলিয়ে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট বানালেন। প্ল্যান্ট তো বানিয়েছেন, এবার স্টিলের জন্য লোহা যায়। ভিলাই থেকে বস্তার একশো মাইলেরও কম পথ। সেইখানে লোহা আনতে ভিলাই থেকে দক্ষিণ দিকে রেলপথে জুড়ে দেওয়া হল সেদিনের দুর্গ জেলা আর বস্তার জেলার সীমান্ত-অঞ্চল। দল্লি-রাজারা গ্রামে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের জন্য গড়ে উঠতে থাকল কোকান-দল্লি মাইন। দল্লি, রাজারা, কোকান নামের সে’দিনের গোণ্ড আদিবাসীদের পাড়া-গাঁ বদলে যেতে থাকল ধুলো-ওড়া, জঙ্গল-গেলা মাইন-টাউনে। এই ‘রাজারা’ নামের পিছনে ছাপ রেখে গেলেন সেই রাজা রাও। আর হিন্দুত্বের প্রভাবে তার নামাঙ্কিত থান হয়ে গেল ‘রাজারা বাবা’র মন্দির। ২০১৭ সালের কথা। ততদিনে সেইখানে দুর্গ জেলা কেটে তৈরি হয়েছে বালোদ জেলা। দেখা গেল, গোণ্ড আদিবাসীদের মাইন-কবলিত কোকান গ্রামে গোশালা উদ্বোধন করছেন উক্ত জেলার তদনীন্তন কালেক্টর-ম্যাজিস্ট্রেট।

এই রুটে মাইন একা দল্লি-রাজারা-কোকান ছাড়িয়ে দক্ষিণে পাড়ি দিয়েছে উত্তর বস্তারের ভানুপ্রতাপপুর টাউন হয়ে অন্তাগড় অঞ্চলের রাওঘাটের নির্মীয়মাণ মাইন অবধি। দল্লি থেকে রাওঘাট অবধি রেলপথ বসছে — রাওঘাট থেকে ভিলাই অবধি আকরবহন সুপ্রশস্ত করতে। ছত্রাকের মতো অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছে ছোটবড় সরকারি-বেসরকারি খনি — লোহা আর বক্সাইটের। সেই পথেই, বস্তার সম্ভাগে প্রবেশকালে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টেরই মহামায়া ও তার হালে বাড়তে থাকা দূলকি মাইন — সেও ঐ জঙ্গল কেটেই তৈরি। তারপর শুরু হয়ে গ্যাছে অজস্র মাইন — আকরিক লোহা ও বক্সাইটের। নানান প্রাইভেট মুনাফাকামীদের কামড় সেখানে — হাজির হয়েছে নিক্কো জয়সওয়ালের মতো মাঝারি ও হরি-মিনারেলস-এর মতো ছোট সাইজের মাইনিং কোম্পানিরা। তার সাথে পাল্লা দিয়ে ছত্রাকের মতো গজিয়ে উঠেছে প্যারামিলিটারি ক্যাম্প, এবং উপরোক্ত রেলপথ। বালোদ-রাজনন্দগাঁও জেলার দক্ষিণ-পা তথা কাঁকের জেলার উত্তর মাথা থেকে যদি সরাসরি অবুজমাড় পাহাড়ের তলদেশের উপত্যকা তথা কাঁকের জেলার অন্তাগড় ব্লকের সাথে যেখানে নারায়ণপুর জেলা মিশেছে সেইখান অবধি সরাসরি দাগ কাটা যায়, তাহলে সমগ্র অরণ্য উপত্যকা জুড়ে রয়েছে তিরিশের বেশি ক্যাম্প। এই সংখ্যাগুলো সব স্থানীয় জনগণের মতামত অনুসারে — এ বিষয়ে আরটিআই করলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণে তার জবাব দেওয়া হবে না এবং ঘুরে ঘুরে গুণলে গণৎকারের পরিণতি খুব একটা মধুর না হওয়াই স্বাভাবিক।

উত্তর বস্তারে যেভাবে প্রাইভেট মাইনিং কোম্পানি ও ফৌজবাহিনী হাত মিলিয়েছে

কাঙ্কের জেলার পাহাড় জঙ্গলে গায়ে গায়ে লাগা গ্রাম চারগাঁও ও মেটাবোডেলি। নিক্কো-জয়সওয়াল কোম্পানি সেইখানে আকরিক লোহার খাদান চালু করছে। কাঙ্কের জেলা ঘুরে দেখলে বোঝা যায়, মাইন আর ফৌজি ক্যাম্প একই সাথে গড়ে ওঠে গ্রামে গ্রামে। প্রথমে তৈরি হয় ক্যাম্প। তারপর শুরু হয় মাইনিং। ক্যাম্পের বদৌলতে, মাইন ও শ্রম সংক্রান্ত আইনগুলো বিশেষ পালন করতে হয় না মাইনিং কোম্পানিগুলোর। এই দুই গ্রাম জুড়ে দুটো বিএসএফ ক্যাম্প। দুটো গ্রামেই ঘরে ঘরে ভয়স্তব্ধ ফিসফিস শোনা যায় — কোনও ঘরের মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, কোনও ঘরের মরদ মার খেয়েছে ভীষণ। এই নিয়ে ২০১৬-র অগাস্ট মাসে সেখানকার কিছু মাইন-মজুরের সাথে নিক্কো-জয়সওয়ালের ম্যানেজারের বচসা হলে ম্যানেজার ক্যাম্পের দ্বারস্থ হয়। গ্রাম থেকে ৪-৫ জন গ্রামবাসীকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদেরকে মাওবাদীদের কালো পোশাক পরিয়ে ছবি তোলা হয়, যদিও এখনও তাদেরকে অফিসিয়ালি ‘সারেন্ডার্ড’ বলে ঘোষণা করা হয়নি।

এদিকে, ২০১৬-র অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ ঐখানে নাম-কা-ওয়াস্তে গণশুনানি ঠিক হল। বলা হল — মাইনের ‘কেপাসিটি এনহ্যান্সমেন্ট’ হবে, আরও বেশি লোহা তুলবে নিক্কো জয়সওয়াল। গ্রামদুটোকে সম্পুর্ণ গিলে নিয়ে ব্যাপক বিস্তার হবে তার। কাঙ্কের জেলার বিষয়ে অতটা খবর হয় না। প্রচুর মাইন মাথা তুলছে এইখানে। অবুজমাড় লাগোয়া রাওঘাট পাহাড়ে গড়ে উঠছে বিরাট আয়রন ওর মাইন। এই পাহাড়ের প্রতিটা গ্রামে বিএসএফ ক্যাম্প। বোড়েনাড়, এটেবালকা প্রভৃতি গ্রামে, গ্রামেরই লাগোয়া ক্যাম্প থেকে ফৌজিরা এসে লুটপাট করেছে, সম্ভবত ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। গ্রামবাসীরা এই বিষয়ে কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে। বললেই ভয়ঙ্কর কিছু একটা হয়ে যেতে পারে যে বলবে তার সাথে। তবে মাইনের এক্সটেনশান বিষয়ক গণশুনানিতে অক্টোবর ২০১৬-এ মেটাবোদেলির লোকজন প্রতিবাদ করার পর ২০১৭-র নতুন বছরের আরম্ভকালে মেটাবোদেলির বাসিন্দা নিক্কো-জয়সওয়ালের মাইন শ্রমিকেরা মাইন অঞ্চলে স্ট্রাইক ডেকে কোম্পানির ট্রাক লোড করা সহ অন্য কোনও কাজ করতে অস্বীকার করেছে।

উত্তর বস্তারে বেসরকারি বক্সাইট মাইনের স্বার্থে একটা গ্রামে যেভাবে শেষ হয়ে গেল 

এদিকে কাঙ্কেরের বক্সাইট-সমৃদ্ধ চাররে-মাররে ভ্যালি ও আমাবেড়া, গোণ্ড আদিবাসীদের প্রাচীন দেবতা লিঙ্গো-পেন-এর মেলার থান — এই সব অঞ্চলে থমথম করছে বড়ে পিঞ্জোরী গ্রাম সংলগ্ন হুররা পিঞ্জোরী ক্যাম্পের সন্ত্রাসে। বুধিয়ারমাড়ি নামের একটা গ্রামে বাগমার মিনারেল কোম্পানির বক্সাইট মাইনিং-এর ঠেলায় দুটো ঘর অবশিষ্ট ছিল। সমস্ত অত্যাচার প্রতিরোধ করে মাইনের অ্যাপ্রোচ রোডের উপরেই দুইখণ্ড জমি আঁকড়ে পড়ে ছিল এই দুই পরিবার। সেইখানেও গিয়ে রেপ করে এসেছে ঐ ক্যাম্পের ফৌজিরা। এই নিয়েও সবার মুখে ভীতিবিহ্বল কুলুপ।

এইভাবেই হাঁগ্রাসে এগোচ্ছে রাওঘাটের মাইনদানো ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা, গিলে নেবে আঞ্চলিক মানুষদের, তাঁদের বাড়ি, খেত-খামার-জলাশয়-পুকুর-নদী-গাছপালা সব, নেবে তাঁদের রাওরাজাকে, অন্যান্য সমস্ত আরণ্যক দেবদেবীদের, নেবা মেলা ও মেলাপ্রাঙ্গণ, খেলার মাঠ, শ্মশানঘাট, হাল-বলদ-গোরু-মোষ, গোঠান, বিবাহ-মণ্ডপ, খাদ্যশস্য, ঘোটুল, নিস্তারি, উনুনের জ্বালানি কাঠ, খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, — সর্বোপরি, কেড়ে নেবে তাঁদের প্রাগইতিহাস কাল থেকে আপন করে নেওয়া জঙ্গল — ভয়ংকরের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘেরবন্দি রাওঘাট পাহাড় জুড়ে তিনশোর বেশি গ্রামে ধূসর প্রাগইতিহাস কাল থেকে বসবাস করে আসা গোণ্ড আদিবাসীগণ।

এদিকে ছত্তিশগড়ের রাজনন্দগাঁও জেলাস্থ দল্লি-রাজারার মাইন শেষ হওয়ার মুখে। অতএব, বস্তার সম্ভাগের কাঁকের ও নারায়ণপুর জেলা জুড়ে রাওঘাটে আকরিক লোহার নতুন মাইন বানাও, দান্তেওয়াড়া জেলার খ্যাতনামা বৈলাডিলার চলতি মাইনের প্রোডাকশান ক্যাপাসিটি ২৯ মিলিয়ন টন থেকে ২০২০র মধ্যে ১০০ মিলিয়ন টন করো, রাজনন্দগাঁওর মহামায়া অঞ্চলে ও বস্তার-সংলগ্ন বালোদ জেলার দুলকিতে নতুন মাইন বানাও, প্রভৃতি উদ্যোগ। শুধুই কি ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট? আয়রন ওর মাইনের নাম করে নারায়ণপূরের অবুজমাড়ে, কাঁকেরের চারগাঁ নামের দুইটি গ্রামে এসে গিয়েছে নিক্কো-জয়সওয়াল কোম্পানি। দান্তেওয়াড়ার বাচেলি ও কিরণ্ডৌলে তৈরি হচ্ছে আয়রন ওর বেনেফ্যাকশান প্ল্যান্ট। ইতিমধ্যে বস্তারেই তৈরি হচ্ছে তিনটি স্টিল প্ল্যান্ট — ডিলমিলি, নগরনাড় ও লোহাণ্ডিগুড়াতে। অবশ্য কিছুদিন আগে টাটাবাবুরা লোহাণ্ডিগুড়া থেকে ব্যাবসা গুটিয়েছেন। ডিলমিলির প্রস্তাবিত প্ল্যান্টটি আবার ‘আল্ট্রা মেগা’।

আকরিক লোহা ও স্টিল প্ল্যান্ট ছাড়াও সমগ্র সম্ভাগ জুড়ে তৈরি হতে চলেছে হাইডেল প্ল্যান্ট, সিমেন্ট কারখানা ও তদসংলগ্ন লাইমস্টোনের খনি, তৈরি হয়ে গিয়েছে অজস্র পাথরখাদান ও ক্রাশার, স্পঞ্জ আয়রন প্ল্যান্ট, বাঁধ, রেলপথ, রাস্তা এবং অসংখ্য প্যারামিলিটারি ক্যাম্প। ইতিমধ্যে দান্তেওয়াড়ার বালুদ অঞ্চলে ভারতীয় বিমানবাহিনী পুরোদমে এয়ার-স্ট্রিপ বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। এর জন্য সাফ হয়ে যাবে মাইলের পর মাইল জঙ্গল, ভিটেমাটি হারাবে অজস্র গ্রামের অসংখ্য মানুষ। আর এর বিরুদ্ধে যাঁরা গলা তুলছেন, তুলবেন, তাঁরা চিহ্নিত হবেন উন্নয়নবিরোধী দেশদ্রোহী হিসেবে। তাই নকশালদমনের ধুয়ো তুলে আদিবাসী-উৎখাতের এই বিপুল তোড়জোড় বস্তার তথা ঝাড়গ্রাম থেকে নাগপুর মধ্যভারতের সমগ্র আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল জুড়ে।

(এর পর আগামী সপ্তাহে)