Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ব্যাংডুবি

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

 

রাতের বুক চিরে ট্রেনটা কয়েক কদম এগোতেই বুকে একটা চাপ অনুভব করল সিরাজ। খুক করে একবার কাশল। এক ঢোক জল খেল। লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাল। ট্রেন তখনই এগোতে শুরু করেছে। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে সে নিশ্চিত হল। না, এ যাত্রায় সে বোধহয় বেঁচে গেল।

কয়েকটা স্টেশন পার হবার পর সেই কামরায় একটা লোক উঠল। সঙ্গে একটি মেয়ে। ভোর তখনও ফোটেনি। অতক্ষণ ট্রেনের একটি কোণে একাকীই বসে ছিল সেখ সিরাজ। পাখা ঘুরছে। ম্লান বাল্বের আলো। ট্রেনের ভেতরটা লাল আঁধার। গেটের পাশে হাওয়ার মুখে দাঁড়ানো লোকটা তাকে নজর করছিল না। কিন্তু ঘটনা হল মাঝবয়েসি লোকটা আর বছর কুড়ি বাইশের মেয়েটা যে পরিমাণে গা ঘষাঘষি করছে সেটা বলার কথা নয়!

সিরাজও বেরিয়ে এসেছে নিজের বাড়ি ছেড়ে। মাঝরাত তখন। বাড়ি থেকে হেঁটে স্টেশন। তারপর অপেক্ষা ফাস্ট ট্রেনের। ঘরে তার এক বিবি, এক মেয়ে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। বৌয়ের বয়স পঁয়তিরিশ। কিন্তু কিছু করার নেই। স্বামীকে হরদম এখন মেয়েরা খুন করে দিচ্ছে। সুপারি দিয়ে লোক পাঠাচ্ছে। এইতো ক’দিন আগে তাদের পাড়ার গোলামকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। গোলাম নাকি সুপারি নিয়ে মানুষ খুন করেছে। তিরিশ হাজার টাকা কোন এক মেয়েমানুষের কাছ থেকে নিয়ে তার স্বামীকে খুন করেছে। এখন মেয়েটি জেলে। প্রেমিকটি বেপাত্তা। সে খুন হয়ে যেতে পারবে না। বরং এই যে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে, এই ভালো। তার কোথাও যাবার জায়গা নেই। দেখাই যাক না সে কোথায় গিয়ে ঠেকে।

ওদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। দরজা ছেড়ে এসে বসে পড়ল সিটে। চুমুটুমু খাওয়া চলতে লাগল। সিরাজ চুপ করে বসে রইল। খানিক পর লোকটার চোখ পরল তার দিকে। মুখ ব্যাদান করে লোকটা বলল, ‘এ হে এক দাদা রয়েছে দেখছি।’ মেয়েটা বলল, ‘দূর!’ তখন আলাপ হল। লোকটার নাম নাজমুল আর মেয়েটি রেশমা। লোকটা বলল, ‘তা যাবে কই?’ সিরাজ বলল, ‘বেইরিচি। দেখি কোথায় গিয়ে ঠেকে!’

‘তা ঘর ছাড়তে হল কেন?’

‘সে অনেক কথা।’

‘শুনি না।’

‘কি আর শুনবে বলো তো।’

‘সে যদি আপত্তি থাকে তো বোলো না। তবে আমি বলি কি, আমরা একই পথের পথিক। এই মেয়েটিরও যাবার কোথাও জায়গা নেই। আমার সঙ্গে ভেসে পড়েছে। তুমি যদি আমদের নৌকায় আসো, ক্ষতি কী?’

সিরাজ ভাবল, তাই তো। কথাটা কাউকে সে বলতে পারেনি। একটা চক্ষুলজ্জার ব্যাপার আছে। কিন্তু এখানে সবাই নতুন। বললে মনটাও হালকা হবে। চাই কি একটা রফাও বেরিয়ে আসতে পারে। তাই সে বলতে থাকল নিজের কাহিনি:

সিরাজ বাইরে টাইরে খুব একটা বেরোয় না। নিজের জমি আছে। চাষ করে। তার চার মেয়ে। তিনজনের বিয়ে দিয়েছে।  গোল পাকায় তার বউ মিনি বিবি। সে কিছুতেই সিরাজের অক্ষমতাকে মেনে নিয়ে পারে না। সিরাজ বাজারচলতি নানা ওষুধপালা খেয়েছে। প্রথমদিকে কাজ হয়েছে। পরে যে কে সেই। দশটা একসাথে খেলেও আর ওঠে না। বউ নিত্য তাকে গালমন্দ করে। সিরাজ বোঝায়, আমাদের কুড়ি বছর বিয়ে হয়েছে। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। তাদের নাতিনাতনি হবার টাইম এসে গেল। এখনও তুমি এমন বায়না করো কেন। প্রথম থেকেই যে আমি এমন অক্ষম ছিলাম তা তো নয়। কত দম ছিল। এদ্দিন পর আলগা ভাব আসতেই পারে।

মিনি বিবি গজগজ করে। বলে, এই জন্য বেশি বয়সের পুরুষকে বিয়ে করতে নেই। বয়স হলে তারা অচল আধুলি হয়ে যায়। মেয়েদের সময় সাধে কি আর জামাইদের বয়স নিয়ে অত হাঁকপাঁক করেছিলুম? পিঠোপিঠি বয়সের ছেলের সাথে বিয়ে না দিলে মেয়েদের যে বয়সকালে আমার মতো জ্বলতে হবে তা আমার চেয়ে আর কে ভালো বোঝে। তাই পাঁচ বছরের বেশি তফাত আমি রাখিনি। আর তোমার সঙ্গে দেখো? আমার তফাত বারো বছরের। গরিবের মেয়ে ছিলুম। পনেরো বছরে মা বিয়ে দিয়ে দিলে। ষোলোতে বড় মেয়ে হল। কত আমার বয়স এখন? জীবনে শখ আহ্লাদ কি এখুনি শেষ করে দু’ হাত গুট্যে বসে থাকব? তুমি যদি না পারো আমি ঘরে অন্য লোক তুলব, এই আমি সাফ বলে দিলুম!

সিরাজ ভেবেছিল, এ হল কথার কথা। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের এমন কত হুমকিই দেয়, সব কি আর কার্যকরী হয়। ও হল কথার কথা। মিনি এমনতর কিছু করবে না।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তার উলটো। পাশের পাড়ার সোহারাবের সঙ্গে জড়িয়ে গেল সে। হয়তো আগে থেকেই ছিল। সে কিছু টের পায়নি। দুপুরে সে মাঠ থেকে ফেরার আগে তার ঘর থেকে কুড়ি বছরের জোয়ান সোহারাব বেরিয়ে যাচ্ছে চুপিসাড়ে এমন সে ক’দিন দেখেছে। তারপরও সে চুপ ছিল। জানে মিনি বিবিকে কিছু বলে কোনও লাভ নেই। কিন্তু গোলাম বাইরের এক ঘটনায় ধরা পড়ার পর তার মনে এই ভয় বাসা বাঁধতে থাকে যে মিনি বিবিও লোক লাগিয়ে তাকে খুন করতে পারে।  সিরাজ ঠিক করে আর নয়। এবার পালাতে হবে। বউয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে পালাতে হবে দূরে।

সিরাজ চুপ করে রইল। লোকটা বলল, ‘দেখো আমার একটা ঘর আছে। সেখানে আমার প্রথম পক্ষের বিবি থাকে। যদিও তাকে আমি তালাক দিয়ে দিয়েছি।’

‘কীরকম?’

সিরাজ এই প্রশ্ন করায় লোকটা তাকে সেই তালাকের ঘটনা বলতে শুরু করল:

একবার ঘুমের ঘোরে লোকটা তালাক বলে ফেলেছিল। তা শুনে তার বউ পুকুরঘাটে গিয়ে মেয়েদের মাঝে গল্প করে। মেয়েদের মধ্যে কানাকানি হতে হতে সেই খবব পুরুষদের ভেতর যায়। তখন তাকে ছাড়তে বাধ্য হয় নাজমুল। পরে আর একটি বিয়ে করে। দেখা যায় আধপাগলি। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। বাইরের লোক তার পেট করে দেয়। সংসার করার ইচ্ছে নাই। তাকেও ত্যাগ দেয় নাজমুল। পরে সে আরও একটা বিয়ে করে। এই শেষজনই টিকে যায় তার জীবনে। তিনটি ছেলেও হয়েছে তার।

প্রথম পক্ষের বউকে ছাড়তে ইচ্ছে ছিল না লোকটার। কিন্তু অবস্থার বিপাকে সে তা করতে বাধ্য হয়। তাই বলে সে তাকে একেবারে ত্যাগ দেয় না। তার নাম ছিল মীরাতুন বেগম। কালোর উপর দেখতে বেশ। নাজমুল ঠিক করে ওকে নিজের কাছেই রেখে দেবে। কারণ ওর আর যাবার জায়গা নেই। বাপের বাড়িতে বাপ মা নাই যে তাকে ভাত দেবে। তাই নাজমুল ঠিক করে, তার যে জমি আছে মাঠের মাঝে, সেখানে এক টুকরো জমি তাকে দেবে। তাই সেই মাঠের মাঝে তৈরি করে দেয় দরমার ঘর। মাথায় টিন। চারপাশে নানান গাছপালা। সে নানা গাছপালা পুঁতে দেয়। মাঠের ভেতর সর্বক্ষণ জল বাতাস সার পেয়ে তরতর বেড়ে ওঠে গাছ। নারকেল, জাম, আম, সবেদা, লিচু। মীরাতুন সেখানে থাকে। মাঠে কাজ করতে থাকা চাষিরা আসে তার কাছে। মাঠের কাজে এসে একবার করে কেউ না কেউ ঘুরে যায় তার ঘরে। আসে পুব খাটতে আসা মিতারা। আর আসে নাজমুল নিজে। জংলা বাতাসে, ধানের গন্ধের ভেতর ছায়া ছায়া এক পরনারীর বুকে হারিয়ে যেতে তার বেশ লাগে! নাজমুল তাকে বসত করে দিলেও তাকে খোরাকি দিতে পারেনি। শুনে অবাক সিরাজ। বলে, ‘তুমি কী করে পারো?’

‘না পারার কী আছে। সে তো আর এখন আমার মেয়েছেলে না, সে এখান সবার। আমি যেতেই পারি তার ঘরে।’ নাজমুল খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে।

সিরাজ ফিসফিস করে বলে,‘দাঁড়ায়?’

ট্রেন থেকে নেমে নাজমুল সবুজ ধানখেতের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকে। রেশমার এমন পথে চলা অভ্যেস নাই। কাদামাখা পথে সে বারবার আছাড় খাচ্ছিল। নাজমুল সেই মাঠের মাঝে বাড়িতে গিয়ে হাঁক দিল, ‘এই মীরা, মীরা! খোল।’ ঘর থেকে ফুল আঁকা ছাপা শাড়ি পরা এক মহিলা বেরিয়ে এসে বলল, ‘কী ব্যাপার তুমি, এখন?’

‘এরা আজ থেকে এখানে থাকবে।’

‘এরা কারা?’

‘এরা স্বামী-স্ত্রী।’

‘তা নিজেদের ঘর ছেড়ে এখানে কেন?’

‘এদেশে এদের ঘর নেই। যা ছিল সব বাংলাদেশে।’

‘চলে এল কেন?’

‘কেন আবার, যেমন করে সবাই আসে, কামের ধান্দায়।’

‘হিন্দু?’

‘না। আমাদের জাতের। তোর কোনও অসুবিধা হবে না।’

চোখ সরু করে সে বললে, ‘এই ডাঁসা মাগীটাকেও কি লাইনে নামাবে?’

‘চুপ যা! এরা ভদ্দলোক।’

সিরাজ দেখে রাত হলেই শনশন হাওয়া বইছে আর গাটা কেমন যেন ছমছম করে উঠছে। এমন হবার কথা নয়। সে মাঠে ঘাটে রাত কাটানো মানুষ। তার এমন হবে কেন? কিন্তু এখানে যেন কিছু আছে! দমচাপা এক ভাব অনুভূত হয়। মনে হয় সব সময় কারা যেন নজর রাখছে! সন্ধের পর অন্ধকারে বাইরে পেচ্ছাপ বসতে গিয়ে সে দেখে ধানখেত থেকে যেন হাজার হাজার চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভেবেছিল মনের ভুল। পরে রেশমা এসেও দেখে একই ব্যাপার। এমন করে কে? কাদের চোখ? ওরা কারা? কী চায়?

মীরাতুনের ঘর থেকে এক হিসহিস শব্দ আসছে। প্রতি রাতেই আসে। কে এখন তার ঘরে এসেছে যে এমন মিলন সম্ভব? তারা করে কী ঘরের ভেতর দরমার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখতে চেষ্টা করে। ভেতর পুরো অন্ধকার! কিছুই দেখা যায় না। সিরাজের শরীর গরম হতে শুরু করে। তিনদিন পর রেশমা তাকে নিয়ে উঠে পড়ল বিছানায়!

সিরাজ কোনওদিনই ভাবেনি এমন করে একজন বেশ্যার সঙ্গে রাত্রিযাপনের কথা। সে আগে ভাবত, বেশ্যারা সব খারাপ মেয়েছেলে। তারা ছেলেদের বিপথে চালিত করে। কিন্তু সে এখন বোঝে এরা সাধারণ ঘরের আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সুখদুখের মিশেলে তৈরি। বেশ্যার বুকে মাথা গুঁজে নাক দিয়ে টেনে নেয় ধানের ঘ্রাণ! বাইরের দুনিয়াটা দেখা হল এখন। এমন রঙিন আর এমন মোহময় যে তার কোনও ধারণা ছিল না। সে আবেশে বুঁদ হয়ে যেতে থাকে। আর মনে করতে থাকে, এখানে এত বড় আকাশ, অথচ তারা দেখা হল না! কেবলই কেটে গেল সময়! এতদিন সে রমণীযাপন করেছে, কিন্তু কোনওদিন এমন করে যে কোনও নারীকে আবিষ্কার করা যায় বুঝতেই পারেনি! সে তেড়েফুঁড়ে উঠল। দেখা যাক, এই বেশ্যার দেহে কোনও ছায়াপথ আছে কিনা। বদলে এক উষ্ণপ্রস্রবণের কাছে সে নতজানু হয়ে বসে পড়ে। এই নারী কিন্তু তার অক্ষমতায় ক্ষেপে যায় না। সে ফিসফিস করে বলে, ‘আবার পারবে তুমি, হতাশ হোয়ো না। আমি ভোরের শিশির ধানের পাতা থেকে নিয়ে এসে মালিশ করে দোব।’

সারারাত্রি জাগরণের পর সবে তারা দু’ চোখের পাতা এক করেছে। তার বুকের উপর লুটিয়ে ছিল বেশ্যাটা। আবেশে এমন ঘুম এসেছিল ভোররাতে সিরাজের যেন মনে হল কতদিন সে ভালো করে ঘুমায়নি। এমন সময় মীরাতুন হামলা করল। বলল, ‘তোমাদের জন্য আমার কাল রাতে খুব অসুবিধা হয়েছে। তোমরা চলে যাও।’

‘কী অসুবিধা?’ রেশমা জানতে চাইল।

‘তোমাদের ঘর থেকে মিলনের শব্দ আসছিল, তাতে ভারি লজ্জা করছিল।’

‘এতে তোমার লজ্জা পাবার কী আছে?’

‘পাব নাই বা কেন? যে তোমাদের রেখে গেল, সে বলে গেল, এ মিনসে ঢোঁড়া সাপ। কিন্তু এ যে দেখি জাত সাপ! সারারাত হিসহিস করে কেবল। অমন শব্দ করে করা চলবে না এই বলে গেলুম।’

‘কিন্তু আমরা তো জানি তুমি কেমন মিলন কর।’

‘কী বাজে কথা বলছ!’

‘আমি শুনেছি তেমন শব্দ যেমন হল কোনও গর্তে যখন অনেক উচু থেকে জল ফেলা হয় তেমনি।’

‘মিথ্যে কথা!’

‘যা শুনেছি তাই বলি।’

কেন যে তাকে ও এক বেশ্যাকে একসঙ্গে পুরে দিয়ে গেল লোকটা তা জানে না সিরাজ। এভাবে তার নিজের নারীকে সে অপর এক পুরুষের হাতে তুলে দিয়ে গেল! কেন তাকে বাইরে নিয়ে এল, বেশ্যাটাই বা কেন এল, এর কোনও কিছুই পরিষ্কার নয় তার কাছে। আর কেনই বা সে সিরাজের নিত্যমিলনপ্রত্যাশী, তাও বোঝে না। বেশ্যাকে নিয়ে ভাগল একজন, বেশ্যাটা নিজেকে তুলে দেয় অপরজনের হাতে, এ বড় রহস্য যাদু!

বাইরে বসে আছে তারা। মাথার উপর গাছ। হালকা ছায়া। বড় চাঁদ। রেশমা বলল, ‘তোমার এ রোগ যখন ভালো হয়ে যাবে, তখন আবার ঘরে ফিরে যাবে?’

‘না। আর ফিরব না। তোমার কাছেই থেকে যাব। আমি তোমাকে ভালোবাসি। বোঝো না?’

‘ভয় হয়। বেশ্যাকে তেমন ভালো যে কেউ বাসে না।’

সে তাই করে। ধানের পাতার ডগা থেকে সে তুলে নেয় শিশিরের কণা। এক হাতে তোলে এক হাতে জমাতে থাকে। তারপর সে মালিশ করে দেয়। এক দিন দু দিন তিনদিন…। সিরাজের মনে হয়, জাগছে! রেশমাও বলে, ‘হবে হবে। পুরুষের তো এমন করেই হয়।’

সে যখন মালিশ করে, সিরাজের মনে হয় ওই দূরের গাছটায় কোনও পুরুষ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল এক প্রবল অশান্তিতে। এমনও হয়েছে সে ছুটে গেছে আর দেখেছে কেউ কোথাও নেই। সে বলে, হল কী? কেন এমন হয়? কিছুই যে দেখা যায় না। মনে হয় কিছুই ঘটেনি। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখলুম! এত ভুল হবার কথা নয়! আর এটা স্বপ্ন নয় যে জেগে জেগে দেখব। তাহলে এমন কেন হচ্ছে! এটা ঠিক, যা সে দেখছে সেটা আগেই দেখেছে। পরপর দেখে গেছে। নারী পুরুষ ঝুলে যাচ্ছে দড়ি দিয়ে। যখনই রেশমা হাত লাগায়, তখনি সেটা ঘটে। সিরাজ বুঝতে পারে না কিছু। সেই যখন সে দুধমিশ্রিত ওষুধ খেয়েও আর নিজেকে সক্ষম করতে পারছিল না, তখন প্রতিটি ব্যর্থ মিলনের শেষে সে এমনই স্বপ্ন দেখত। কোনওদিন দেখত কোনও পুরুষকে ঝুলন্ত অবস্থায় কোনওদিন দেখত কোনও নারী একইভাবে ঝুলছে।

সিরাজ সাপটাকে ফলো করতে থাকে। সাপটা যায় কোথা? সারারাত সাপ মীরাতুনের ঘরে থাকে। আর সেই বা তাকে কেন পাত্তা দেয়? কী পায় মেয়েটির কাছে? যে সুখ সে এক নারীকে দিতে পারে না, এক সাপ এসে তা দিয়ে যাচ্ছে এটা ভাবলেই তার মন সরে যায়। দেখে এ পথ সে পথ করে সাপটা নেমে গেল এক ডোবায়। মাঠের মাঝেই ডোবা। সেখানে কত যে সাপের বাস! কেউ জলে সাঁতার দিচ্ছে, কেউ বা মুখ উঁচিয়ে বাকি গা জলে ডুবিয়ে আছে। কেউ আছে আড়ায়। পাড়ের গাব গাছের নিচে এক বালক বসে ছিল। বছর বারো বয়স হবে। তার নাম রাখাল। সে বলল, ‘তুমি এখানে নতুন এসেছ?’

‘হ্যাঁ। জায়গাটার নাম কী রে?’

‘ব্যাংডুবি।’

‘এখানে প্রচুর সাপ থাকে।’

‘হ্যাঁ।’

‘তুই কী করিস?’

‘গরু চরাই।’

‘ভয় পাস না?’

‘বললাম যে, ওরা খুব ভালো। তুমি কোথায় থাকো?’

‘হুই যে’ বলে মাঠের মাঝে ঘরটা দেখানোর চেষ্টা করল সে। ছেলেটা জানে। দেখেই বলল, ‘ও। তোমার কি রোগ? তাহলে এক কাজ করতে পারো। ওই ডোবার মাটি মাখতে পারো। রোগ সেরে যাবে।’

‘যে কোনও রোগই সারে?’

‘যে কোনও। এ সব ওই সাপেদেরই গুণ।’

‘কিন্তু নামব কী করে? এত খাড়াই। এত সাপ!’

ছেলেটা একটা ঘটি দেয়। দড়িবাঁধা। সিরাজ সেটিকে ডোবার ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে এক ঘটি কাদামাটি তুলে নেয়। ঝোপের পিছনে আসে। যা হবার হবে, স্বপ্নের আত্মহত্যাকারী চরিত্ররা যদি আবার এই গাছটায় ঝুলে পড়তে চায় তো পড়ুক; ভেবে সিরাজ করে কী… চোখ বুজে মালিশের জন্য মাটি ঠেকাতেই এক তীব্র শিসধ্বনি তার কানে আসে। পিছন ফিরে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে যায়। দেখে গাব গাছের ডালে লেজ লাগিয়ে নিচের দিকে মুখ করে ঝুলছে হাজার হাজার সাপ! সবাই একত্রে শিস দিয়ে উঠছে। গাটা হিম হয়ে গেল তার। মুখ ঘুরিয়ে নিল। আবার পিছন ফিরল। ভেবেছিল আগের মতো আর কিছু থাকবে না। সে কিছু আর দেখতে পাবে না। কিন্তু না! তারা আছে। লেজের পাকে গাব গাছের ডাল পূর্ণ করে তারা ঝুলছে আর পরপর শিস টেনে যাচ্ছে। রাখাল বলে, ‘এত ভয় পাচ্ছ কেন, কিছু করবে না ওরা।’

‘সে তোকে না করতে পারে, রোজ দেখছে। কিন্তু আমি ওদের কাছে অচেনা।’

‘কে বলেছে অচেনা। তোমাকেও ওরা ভালোমতন চেনে।’

‘কী করে চিনল?’

‘ওরা তোমাকে প্রতিনিয়ত লক্ষ করে। পিছনে তাকাও।’

সে তাকিয়ে দেখে সত্যিই তো। তিনটি সাপ ঝোপের বাইরে থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সিরাজ অবাক। এরা তাকে ফলো করছে কেন? রাখাল মৃদু হেসে বলে, ‘ভয় পেলে? ভয় পেও না। ওরা কিছু করবে না।’

‘ওদের বিশ্বাস কী? যে কোনও সময়ে—’

‘তেমন কিছু ব্যাপার নয়। তাহলে প্রথম রাতেই করে দিত। ওরা তোমায় রাতেও পাহারা দেয়।’

‘কিন্তু কেন?’

‘যাতে তুমি ঠিকঠিকভাবে এক আত্মা হয়ে উঠতে পারো।’

‘আত্মা! মানে?’

‘ওদের তুমি সাপ ভেবো না। ওরা সকলেই এক একটি করে আত্মা। আত্মা তুমিও। কিন্তু এখনও তুমি ভূমার স্তরে উঠতে পারোনি। তাই সাপরূপ নিতে পারোনি। অবশ্য কেবল সাপরূপই বা কেন, যে কোনও রূপই নিতে পারো।’

‘তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না, রাখাল!’

‘তুমি যেখানে আছ, সেটি আত্মার স্থান। এখানে আত্মা ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই। গাছ পাখি ফুল ফল জড় সকলই আত্মা। তুমি রোজ মাটি মেখো। নইলে ভূমা অবধি যেতে পারবে না।’

এই বলে সে পাখি হয়ে উড়ে গেল।

সাপেদের সেই চিৎকার শুনতে শুনতে স্তম্ভিত সিরাজের মনে হল, এরা সকলে কেবল আত্মা নয়, অতৃপ্ত পুরুষদের আত্মা! নাজমুলের কাজ সেই সব মৃত আত্মাদের এক জায়গায় এনে তাদের জন্য জীবনপরবর্তী জীবনের সুখ দেওয়া। এখানে এসে তারা প্রত্যেকে ডোবার মাটি মাখে। এরা মৃত্যুর পর সেরে ওঠে। তখন তাদের প্রত্যেকের যৌনতৃপ্তির জায়গা মীরাতুন। আর এই সব ঝুলে পড়া মানুষদের মতো এই মেয়েটিও মৃত! স্বপ্নে এক নারীকে সে ঝুলে পড়তে দেখত, সে হল এই রেশমা! আর সেই পুরুষ? সেটা তবে সে নিজেই! সে তাহলে কখন ঝুলে পড়ল? নিজেকে মনে করতে থাকল সিরাজ। কখন শেষ হল তার প্রাণ?

তারপর ট্রেন থেকে যখন সে নামে পিছনে কারা যেন বলছিল: ব্যাংডুবি হল মৃতদের জায়গা।