Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মুণ্ডুকাটা মুরগি

হোরেসিও কিরোগা

বাংলায়ন : রহমান হেনরী 

মাৎজিনি-বের্তাদম্পতির নির্বোধ পুত্র চারটে সারাদিন বাইরবাড়ির একটা বেঞ্চিতে বসে থাকলো। ওদের জিহ্বাগুলো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ঝোলানো; চোখগুলো নিষ্প্রভ; কাঁধের দিকে বাঁকানো মাথায় মুখগুলো হা হয়ে ছিলো।

বাইরবাড়িটার মেঝে মাটির আর ওটা পশ্চিমপাশের ইটের দেয়ালের লাগোয়া। দেয়াল থেকে পাঁচফুট দূরে, দেয়ালের সমান্তরাল বেঞ্চটা, আর ওখানেই ওরা বসে থাকলো, নিশ্চল, দেয়ালের ইটে ওদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। যেই না সূর্য ডুবতে শুরু করলো, চলে গেল দেয়ালের ওপাশে, গাধাগুলো উল্লসিত হয়ে উঠলো। সূর্যের ম্রিয়মান আলোটাই হলো সেই ব্যাপার সর্বপ্রথম যেটা ওদের চোখ কাড়লো; তারপর একটু একটু একটু করে চোখগুলো চিকচিক করে উঠলো; শেষ অব্দি, হাসির হুল্লোড় তুললো ওরা, পাশবিক আনন্দে সূর্যের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে, প্রত্যেকের মধ্যে সঞ্চালিত হলো সেই অস্বস্তিকর আনন্দ, যেনবা সূর্যটাই একটা খাদ্যবস্তু।

অন্য সময়গুলোতে, সারিবদ্ধভাবে বেঞ্চিতে বসে প্রহর শেষ হবার আশায় ট্রলিবাসের আওয়াজ নকল করে কোরাস তুলতো। হৈ হট্টগোল, ওদের নিষ্ক্রিয়তাকে ঝাঁকিয়ে দিতো, আর সেসময় ওরা বাইরবাড়িতে ঘুরে ঘুরে দৌড়াতো, এবং মুখের মধ্যে জিহ্বা ভাঁজ করে বিড়ালের মতো মিঁউ মিঁউ শব্দ করতো। তবে বেশিরভাগ সময়ই নিজেদের নির্বোধ নিশ্চলতার মধ্যে মগ্ন থাকতো, বেঞ্চে বসেই কাটিয়ে দিতো সারাটা দিন, ওদের পাগুলো ঝুলে থাকতো নিশ্চল, লালায় ভিজে যেতো প্যান্টগুলো।

বড়টা ছিল বারো বছরের আর ছোটটা আট। ওদের নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন চেহারা মাতৃযন্ত্রহীনতার সাক্ষ্য বহন করতো।

এই নির্বোধ চারটে, কখনও, একবারের জন্যেও ওদের বাবা-মার জীবনে আনন্দের কারণ হয়ে ওঠেনি। যখন ওদের বিয়ের তিনমাস, মাৎজিনি এবং বের্তা পুরুষ ও স্ত্রীর আত্মকেন্দ্রিক প্রণয়ের সাথে পরিচিত হয়, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আরও প্রাণবন্ত একটা ভবিষ্যতের কথা ভাবে: সন্তান। দুটি মানুষের ভালোবাসার ভেতর থেকে যা কিনা অধিকতর আশীর্বাদ রূপে আবির্ভূত হয়– না হলে তো প্রেম হয়ে পড়ে উদ্দেশ্যহীন– আশা ও নবায়নের মাধ্যমেই অর্থপূর্ণ হয় প্রেম।

মাৎজিনি আর বের্তা, এমনটাই ভাবলো, এবং তাদের বিয়ের চৌদ্দমাস পর যখন ওদের পুত্র এলো, সুখে পরিপূর্ণতা পেলো ওরা। পরবর্তী দেড় বছরের মধ্যে বেড়ে উঠতে উঠতে উজ্জ্বল ও সুন্দর হয়ে উঠলো শিশুটা। কিন্তু ওর বয়সের কুড়িতম মাসে, এক রাত্রিতে সে ভয়ানক খিঁচুনি দিতে লাগলো এবং পরদিন সকাল থেকে সে আর তার মা-বাবাকে চিনতে পারছিলো না। বিচলিত হয়ে ওঠা মা-বাবার ভেঙ্গে পড়া মনোবল ফিরিয়ে আনতে ডাক্তার পেশাগত মনোযোগ দিয়ে তাকে পরীক্ষা করতে থাকলো যাতে রোগের কারণ নির্ণয় করা যায়।

কিছুদিনের মধ্যেই শিশুটির পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল হয়ে উঠলো, কিন্তু তার মানসিক অনুভূতি, বুদ্ধিমত্তা আর সহজাত প্রবৃত্তি বিলীন হয়ে গেল। সে তার মায়ের কোলে শুয়ে রইলো, এক নির্বোধ, নিস্তেজ, নিশ্চল, সর্বার্থে মৃত।

‘‘সোনা, আমার সোনা!’’ মা তার প্রথম সন্তানের ভয়াবহ ধ্বংসস্তুপের ওপর সবিলাপ নুয়ে পড়লো।

বাবা, সঙ্গহীনের মতো, ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে বাইরে চলে গেল।

‘‘বলে দিতে পারি। আমার মন বলছে এটা এক নৈরাশ্যজনক ঘটনা। হয়তো উন্নতি হবে, ওর নির্বুদ্ধিতা যতদূর সম্মতি দেয় শিক্ষাও গ্রহণ করতে পারবে, কিন্তু এর বেশি কিছু হবে না।’’

‘‘আচ্ছা! আচ্ছা…!” সম্মতি জানাল মাৎজিনি। কিন্তু আমাকে বলো: তোমার কি মনে হয় এটা বংশগতির কারণে, যে…?”

‘‘যতদূর মনে হয়, পৈতৃক বংশগতির কারণে, তোমার পুত্রকে দেখে যা মনে হয়েছিলো সেটাই বলছি তোমাকে। মায়ের ব্যাপারে বলা যায়, তার ফুসফুস আছে বটে কিন্তু সেটার আওয়াজ আমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে না। এ ছাড়া আর তেমন কিছু লক্ষ করিনি, কিন্তু ওর শ্বাস-প্রশ্বাস ছেঁড়াছেঁড়া মনে হয়। পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করাও তাকে।’’

অনুশোচনাগ্রস্ত হৃদয়ে, মাৎজিনির মনে সেই পুত্রের জন্য দ্বিগুণ ভালোবাসা জেগে উঠলো, যে নির্বোধ পুত্রটি দাদার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছে। একই সাথে তার মনে সান্ত্বনাও জেগে উঠলো বেচারি বের্তার জন্য যে কিনা তার প্রথম জন্মদানের ব্যর্থতায় একদম ভেতর থেকে ভেঙ্গে পড়েছে। সেই আহত মাতৃত্বের জন্য ব্যথিত হলো সে।

যেমনটা স্বাভাবিক, এই দম্পতি তাদের সমুদয় ভালোবাসার নিবিড়তাকে চালিত করলো আরেকটি পুত্রসন্তান প্রাপ্তির আশায়। জন্ম নিলো আরেকটা পুত্র, এবং তার সুস্বাস্থ্য ও হাসির স্বচ্ছতা তাদের নির্বাপিত আশাকে পুনরায় আলোকিত করলো। কিন্তু আঠারোতম মাসের একরাতে, প্রথমটার মতোই খিঁচুনি উঠলো ওর শরীরের আর পরদিন সকালে তারও ঘুম ভাঙলো এক নির্বোধ হিসেবে।

এবার, এই বাবা-মা সম্পূর্ণ হতাশায় ডুবলো। তা হলে, তাদের রক্ত, তাদের ভালোবাসা, অভিশপ্ত। বিশেষত, ভালোবাসা। পুরুষটি আঠাশ; নারীটি বাইশ; আর তাদের আবেগী প্রণয় স্বাভাবিক মানবজীবনের একটা সফল পরমাণুও সৃষ্টি করতে পারছে না। প্রথম সন্তানের আকাঙ্ক্ষার মতো তারা আর সুন্দর ও মেধাবি কিছু কামনা করছে না— একটা পুত্র চাইছে, যে কোনও পুত্রের মতো স্বাভাবিক একজন।

দ্বিতীয় দুর্যোগ তাদের ভালোবাসার মধ্যে দুর্দমনীয় ও পাগলাটে আগুন ধরিয়ে দিলো, একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদের প্রেমকোমলতাকে তছনছ করে দিলো। এবার জন্ম নিলো যমজ; আর ধাপে ধাপে পুরনো ভাই দুটোর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালো।

তা সত্ত্বেও, অপরিমেয় তিক্ততা পেরিয়েও, মাৎজিনি ও বের্তা তাদের চার পুত্রকে গভীর সমবেদনাসহ দেখভাল করতে লাগলো। তাদেরকে অবশ্যই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভেতরের পশুত্বকে জয় করতে হবে; ওদের অনুভূতি ভোতা হয়ে গিয়েছিলো, কেবল তাই নয়, সহজাত প্রবৃত্তিও পুরো নষ্ট ছিলো। বাচ্চাগুলো খাবার গিলতে পারতো না, হাঁটাহাঁটি নয়, এমনকি বসা থেকে উঠতেও পারতো না। শেষ পর্যন্ত, হাঁটতে শিখেছিলো, কিন্তু ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতো, কেননা, নিজের হাঁটা ছাড়া অন্য কোনও কিছুর দিকেও ওরা নজর দিতো না। যখন ওরা পড়ে যেতো, গড়াগড়ি খেয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতো, যতক্ষণ না ওদের চোখেমুখে রক্ত চলে আসছে। ওরা কেবল প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো খাবার দেখলে, বা খুব উজ্জ্বল রং পেলে বা বজ্রপাতের আওয়াজ শুনলে। ওসব পেলে ওরা হাসতো, জ্বলে উঠতো পাশবিক উন্মত্ততায় আর জিহ্বাগুলো ঠেলে বের করে লালার নহর বইয়ে দিতো। এর বাইরে, ওরা অনুকরণের দক্ষতাই শুধু অর্জন করেছিলো, কিন্তু আর কিছু নয়।

মানানসই আচরণের সীমা ভয়ানকভাবে ভেঙ্গে ফেলেছিলো যমজ দুটো। তা সত্ত্বেও, ওদের জন্মের তিন বছর পরেই মাৎজিনি আর বের্তা প্রকটভাবে আরেকটি সন্তানের জন্য লালায়িত হয়ে উঠলো এই ভেবে যে, দীর্ঘ বিরতি তাদের আকাঙ্ক্ষাকে হয়তো পূর্ণতা দেবে। তারা পৌঁছে যাবে জীবনের কোনও গন্তব্যে।

ওদের আশা পূর্ণ হল না। তাদের লেলিহান বাসনা ও তার অপূর্ণতা, এই দম্পতির জীবনকে দুর্বিষহ করে তুললো। তাদের সন্তানেরা যেসব দুর্ঘটনার ও দুর্দশার জন্ম দিতো সেগুলোর দায়দায়িত্ব দুজনের মধ্যে ভাগাভাগি করতে না পারা পর্যন্ত তাদের সম্পর্কের তিক্ততা চরম আকার ধারণ করতে লাগলো, কিন্তু তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া এই চারটি পশুর ক্রমাগত নৈরাশ্যকর আচরণ তো কারও পৈতৃক ব্যাপার নয় যে তাতে দুজনেরই সমান সমান ভাগ থাকবে, বরং দায়িত্ব ও দোষ ভাগাভাগির প্রশ্নটাই একটা নিকৃষ্টতম হৃদয় থেকে জন্ম নিচ্ছে।

ফলে, দুজনের সম্বোধন সর্বনামে পরিবর্তিত হলো: তোমার পুত্র। আর তখন থেকে একে অপরকে প্যাঁচে ফেলতে লাগলো, অপমান করা শুরু করলো। দোষারোপের এক উত্তপ্ত পরিবেশ গড়ে উঠলো।

‘‘আমার মনে হয়,’’ মাত্র বাহির থেকে আসা মাৎজিনি হাত ধুতে ধুতে, বের্তাকে উদ্দেশ করে বললো যে, “তুমি ছেলেগুলোকে পয়পরিষ্কার রাখতে পারো।”

বের্তা বই পড়ছিলো, যেন ওর কথা শুনতেই পায়নি, এমন ভঙ্গিতে পড়তেই থাকলো।

‘‘প্রথমবারের মতো,’’ একটু বিরতির পর বের্তা জবাব দিলো, ‘‘বাচ্চাদের অবস্থা নিয়ে তোমার হুঁশ ফিরলো দেখছি!’’

মাৎজিনি মুখ ঘোরালো ওর দিকে, একটু জোর করেই হাসলো।

‘‘আমাদের ছেলে, আমি মনে করি।’’

‘‘মানলাম, আমাদের পুত্র। এভাবেই কি দেখতে ভালোবাসো ওদের?’’ পড়া থেকে চোখ ওঠালো বের্তা।

মাৎজিনি এবার পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করলো নিজেকে।

“নিশ্চয় ওদের এ অবস্থার জন্য আমাকে দোষ দিচ্ছো না! দিচ্ছো নাকি?”

‘‘ওহ, না!’’ বের্তা নিজে নিজেই হাসলো, খুব ম্লান সেই হাসি। ‘‘আমিও দায়ী নই, এটা বলতে পারি। এটুকুই দরকার ছিলো আমার….’’ বিড়বিড় করলো বের্তা।

‘‘কী? কী চেয়েছিলে তুমি?’’

‘‘ওটাই, কাউকে যদি দায়ী করতে হয়, সেটা আমি নই, মনে করে দেখো, কী বলতে চাইছি আমি!’’

আহত করার নির্মম বাসনা নিয়ে মুহূর্তের জন্য ওর দিকে তাকালো ওর স্বামী।

হাত মুছতে মুছতে শেষতক সে বললো, ‘‘চলো, রাখো এসব আলোচনা!’’

‘‘তোমার যেমন ইচ্ছে। কিন্তু তুমি যদি বোঝাতে চেয়ে থাকো…’’

‘‘বের্তা!’’

‘‘তোমার খুশি!’’

এটাই ছিলো প্রথম ঝগড়াঝাঁটি, এরপর আরও কিছু খ্যাচম্যাচ যুক্ত হলো। কিন্তু এইসব মনোমালিন্য ও দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও দুজনেরই মনে দ্বিগুণ ও অনিবার্য যে আকাঙ্ক্ষা দানা পাকাতে লাগলো, তা হলো আরেকটি সন্তান।

কাজেই একটা কন্যা জন্মালো। মাৎজিনি ও বের্তা পরবর্তী দুবছর টানটান উত্তেজনা শঙ্কা নিয়ে বেঁচে রইলো যে, কখন আবার সেই বিপর্যয় না নেমে আসে। সেটা ঘটলো না, সে যা-ই হোক, বাবা-মার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হলো কন্যাটির ওপর, যে তাদের প্রশ্রয়ের সুবিধা নিয়ে খুব বাজে রকমের আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো।

পরের বছরগুলোতে বের্তা যদিও তার পুত্র চারটের সেবাযত্ন করতো, কিন্তু বের্তিতার জন্মের পর থেকে সে তার পুত্রদের যত্ন নেওয়া কার্যত ছেড়ে দিলো। ওদের কথা ভাবলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়তো বের্তা, দুঃসহ স্মৃতি ঘাঁটার মতো করে অনিচ্ছায় ও বাধ্য হয়ে তাদের দেখভাল করতো। স্বল্প মাত্রায় হলেও, একই রকমের ব্যাপার ঘটলো মাৎজিনির মধ্যেও।

ওদের দুজনের মনে কোনও শান্তি ছিলো না। কন্যাটিকে হারানোর ভয়ে— এক মুহূর্তের জন্যও তার চোখের আড়াল হওয়াটা আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠতো— তাদেরই অসুস্থ বংশধরেরা এই ভীতির ব্যাপারটাকে আরও প্রকট ও তিক্ত করে তুললো। মনের ভেতরে জমতে থাকা পিত্ত এমন বিষেল রূপ নিলো যে সামান্য স্পর্শেই তা ঝরতে লাগলো। মাৎজিনি ও বের্তার প্রথম বিষোদ্গারমূলক ঝগড়ার দিন থেকেই সেটা অঙ্কুরিত হচ্ছিলো। দুজনই দুজনের জন্য সমীহ হারিয়ে ফেলেছিলো। বের্তার মনে হতো পুরুষ তার নিজেকে চিত্রিত করার জন্য জোর করে হলেও, নারীকে দিয়ে পুত্র জন্মিয়ে নিতে চায়। পরবর্তীতে এসব তাদের দুজনকেই সমঝোতা থেকে দূরে ছিটকে দিলো; এখন যখন একটা সাফল্য এসেছে, মাৎজিনি সেটাকে নিজের কৃতিত্ব ভাবছে, অথচ ওর জোরাজুরিতেই তো চার চারটে অস্বাভাবিক পুত্রের জন্ম হলো; একই কথা মাৎজিনি ও বের্তা পরস্পরকে দোষারোপ করে ভাবতে লাগলো। এসব ভাবনা উভয়দিক থেকেই দুজনকে বিষিয়ে তুললো।

এসব আবেগ, দ্বন্দ্ব ও ভাবনার পরিণতিতে বালক চারটের স্নেহ প্রাপ্তির আর কোনও সম্ভাবনা টিকে রইলো না। পরিচারিকাই বর্বরতার সাথে ওদের খাওয়াতো, পরাতো, বিছানায় নিয়ে যেতো। বের্তা ছেলেগুলোকে স্নান পর্যন্ত করাতো না। ওরা সারাদিন একটা দেয়ালের দিকে মুখ রেখে তার ওপারে রয়েছে স্নেহমমতা এমনটা ভাবতে ভাবতে কাটিয়ে দিতো।

এভাবে বের্তিতার চতুর্থ জন্মদিন এলো, আর সেই রাতে, যেহেতু তার মা তাকে নিষেধ করতে পারলো না, মিষ্টি ও আইসক্রিমের আতিশয্যে বাচ্চাটার একটু জ্বর এলো। আর তাকে মৃত দেখা বা সেই চিরায়ত পুরাতন ক্ষত কোনও নির্বোধ এসে আবার জাগিয়ে তোলে কিনা, সেই ভয়ে টানা তিন ঘণ্টা ওরা মা-মেয়ে কেউ কারও সাথে কথা বলতে পারলো না। তখন মাৎজিনির দ্রুত ঘরে ফেরাটা একটা তাৎপর্যের কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

‘‘হা ঈশ্বর, আরেকটু আস্তে হাঁটতে পারো না তুমি? কতক্ষণ….’’

‘‘ঠিক আছে, ভুলে গিয়েছিলাম। আর হবে না। ইচ্ছে করে আর এমন করবো না।’’

বের্তা ক্রূর হাসি হাসলো।

‘‘না, না, নিশ্চয় তোমার ব্যাপারে তেমনটা ভাবছি না!’’

‘‘আর আমি বিশ্বাসও করবো না যে তুমি তেমন ভাবতে পারো… অপব্যয়ী!’’

‘‘কী! কী বললে তুমি?’’

‘‘কিছু বলিনি!’’

‘‘আ রে, হ্যাঁ, শুনেছি, কিছু একটা বলেছো তুমি! দেখ, তুমি কি বলেছো জানি না, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি তোমার মতো মেয়ের বাবার চেয়ে অন্যকিছুই পছন্দ করবো আমি।’’

মাৎজিনিকে বিবর্ণ দেখালো।

‘‘অবশেষে,’’ দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড় করলো মাৎজিনি, ‘‘অবশেষে, নাগিনী, বলে ফেলেছো কী চাইছো তুমি!’’

‘‘হ্যাঁ, নাগিনী, হ্যাঁ! কিন্তু আমার ছিলো সুস্থ মা-বাবা, শুনছো তুমি? সুস্বাস্থ্যের অধিকারী! আমার বাবা প্রলাপ বকতে বকতে মরেনি! অন্যদের মতোই সুস্থ পুত্রগণ থাকতে পারতো আমার! ওগুলো তোমার ছেলে! ওই চারজন!’’

নিজের পালায় বিস্ফোরণ ঘটালো মাৎজিনি।

‘‘ভোগবাদী নাগিনী! তোমাকে এটাই ডাকবো আমি! যা বলতে চাইছি, ওকে জিজ্ঞেস করো, জিজ্ঞেস করো ডাক্তারকে, ওদের মনোবিকলনের জন্য কে দায়ী, আমার বাবা নাকি তোমার পচে যাওয়া ফুসফুস? হ্যাঁ, জিজ্ঞেস কর, নাগিনী!’’

ঝগড়া ও তর্ক ক্রমশ সহিংসতার রূপ নিতে শুরু করলো, যতক্ষণ না বের্তিতার আর্তনাদ তাদের ঠোঁটগুলোতে তালা লাগিয়ে দিলো। রাত একটার মধ্যে ওরা কন্যার বদহজমজনিত দাস্তবমির সবটুকু মুছে পয়পরিষ্কার করলো, আর, নবদম্পতিদের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে যেটা ঘটে, ঝগড়াঝাটি ও মনোমালিন্যের অবসান, স্বল্পস্থায়ী হলেও একটা মিলনের মাধ্যমে ঘটিয়ে ফেলা, ওরাও সেটাই করলো।

চমৎকার একটা ভোর এলো, আর বের্তা জেগে উঠে থুথু ফেললে তাতে তাজা রক্ত উঠলো। তার অতিআবেগ আর ভয়ানক গত রাতটা, নিশ্চয়, প্রথমত এর জন্য দায়ী। মাৎজিনি ওকে শক্তভাবে আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখলো, আর বের্তা অসহায়ের মত কাঁদতে লাগলো, কিন্তু ওদের দুজনের কেউই কোনও কথা বলার সাহস পেলো না।

সকাল দশটায়, ওরা সিদ্ধান্ত নিলো যে লাঞ্চের পরে বাইরে বেড়াতে যাবে। সময়ের নিষ্পেষণে পিষ্ট ওরা, কাজেই পরিচারিকাকে বললো একটু মুরগি জবাই করতে।

উজ্জ্বল দিনটি নির্বোধদের তাদের বেঞ্চ থেকে সরালো। তো, পরিচারিকা যখন রান্নাঘরে মুরগির গলা কেটে ফিনকি দেওয়া রক্ত ছোটাচ্ছিলো (বের্তা মাংস টাটকা রাখার এই মোক্ষম পদ্ধতিটি তার মা’র কাছে শিখেছিলো), তার মনে হলো পেছনে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে, সে মুখ ফেরালো, দেখতে পেলো চার নির্বোধ, কাঁধে কাঁধ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, অনড় খুঁটির মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে এই অপারেশন। লাল… লাল…

‘‘গিন্নি মা! ছেলেরা এখানে রান্নাঘরে।’’

বের্তা সহসাই ঢুকে পড়লো রান্নাঘরে; সে কখনই চাইতো না ওরা রান্নাঘরে পা রাখুক। অন্তত এখন তো নয়ই, যখন এটা সম্পূর্ণ ক্ষমা, বিস্মৃতি ও শান্তি পুনরুদ্ধারের মুহূর্ত, এখনও কি সে এই বিচ্যুতি থেকে মুক্তি পাবে না! কেননা, স্বামী ও কন্যার জন্য তার মনে যতটাই নিবেদন ও ভক্তি, ততটাই বিরক্তি এই দৈত্যগুলোর জন্য।

‘‘এখান থেকে বের করে দাও ওদের, মারিয়া! বাইরে ছুঁড়ে ফেলো, ছুঁড়ে ফেলো, আমি বলছি!’’

সেই চার বেচারি জন্তুকে নৃশংসভাবে চেপে ধরে ধাক্কিয়ে ঝাঁকিয়ে, ফেরত পাঠানো হলো বেঞ্চে।

মধ্যাহ্নভোজের পর সবাই বাইরে গেল; পরিচারিকা গেল বুয়েনেস আইরসে আর সেই দম্পতি ও তাদের শিশুকন্যা গ্রামাঞ্চলের দিকে হাঁটতে। সূর্য যখন ডুবু ডুবু ওরা ফিরে এলো, কিন্তু বের্তা রাস্তায় তার প্রতিবেশীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাইছিলো। কন্যাটি দৌড়ে এসে বাড়িতে ঢুকলো।

ইতোমধ্যে, সেই নির্বোধেরা গোটা দিন বেঞ্চ থেকে নড়েনি। সূর্য এখন দেয়ালের ওপাশে চলে গেছে, ডুবতে শুরু করেছে, ওরা ইটের দিকে তাকিয়ে আছে, আগের যে কোনও দিনের চেয়ে আরও অলসভঙ্গিমায়।

হঠাত ওদের দৃষ্টিরেখা ও দেয়ালের মাঝখানে কিছু একটা এলো। ওদের বোন, বাবা-মার সাথে ক্লান্তিকর পাঁচ ঘণ্টা কাটানো বোন, নিজের মতো করে এদিক ওদিক কিছু দেখতে চাইছিলো। দেওয়ালের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে ওটার ওপরটা পর্যন্ত তাকালো। দেয়ালে উঠতে চাইছিলো সে; সন্দেহ নেই। শেষপর্যন্ত সিট উঠে যাওয়া একটা চেয়ার নিয়ে চেষ্টা করলো, কিন্তু দেয়ালের ওপরে উঠতে পারলো না। তারপর সে একটা কেরোসিনের টিন আনলো, আর, ভারসাম্যের সুন্দর একটা আন্দাজ কাজে লাগিয়ে ওটাকে চেয়ারের ওপর রাখলো— এভাবেই ওর সাফল্য এলো।

সেই চার নির্বোধ, যাদের অভিন্ন দৃষ্টি, লক্ষ করলো কীভাবে ধৈর্যের সাথে তার বোন সফল হলো ভারসাম্য সৃষ্টিতে আর গোড়ালিতে ভর দিয়ে কীভাবে দেয়ালে গলা রেখে জিরিয়ে নিলো। ওরা আরও দেখলো, বোন পা রাখার জায়গা খুঁজে খুঁজে কীভাবে আরও ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে।

নির্বোধেরা চিত্রার্পিতের মতো লক্ষ রাখলো; আবিষ্কারের একই আলো তাদের চোখের মণিগুলোতে জ্বলে উঠলো। পাশবিক প্রলোভন যখন ওদের মুখের প্রতিটি রেখাকে বদলে দিতে লাগলো, সবারই চোখ একযোগে নিবদ্ধ হলো বোনের ওপর। ধীরে ধীরে ওরা সবাই এগিয়ে গেল দেয়ালটার দিকে। ছোট্ট কন্যাশিশুটি পা রাখার জায়গা পেয়ে গেল আর দেয়ালের ওপরে প্রায় উঠেই গিয়েছিলো, আর নিশ্চিতভাবেই সে ওপাশে পড়ে যেতে লাগলো, আর অনুভব করলো তার একটা পা অবশ হয়ে গেছে। তার নিচেই আটটা চোখ তার দিকে তাকিয়ে ভয় দেখাচ্ছে তাকে।

পায়ে ঝাঁকি দিয়ে চিৎকার করলো সে, ‘ছেড়ে দাও! যেতে দাও আমাকে!’’ কিন্তু সে আটকে গেল।

‘‘মা, ও মা, মা, বাবা!’’ সজোরে হাঁক দিলো।

হাঁচড়ে পাঁচড়ে দেয়ালের ওপরে ওঠার চেষ্টা করলো কিন্তু টান অনুভব করলো আর পড়ে গেল।

‘‘মা, ও মা…’’ আর চেঁচাতে পারলো না। বালকদের একজন ওর টুঁটি চেপে ধরলো; ওর কোঁকরানো চুলগুলো টেনে তুলতে লাগলো, যেন পালক ওগুলো; অন্য তিনজন ওর এক পা ধরে টেনে হিঁচড়ে রান্নাঘরে নিয়ে যেতে লাগলো যেখানে ওইদিন সকালে মুরগি জবাই করা হয়েছিলো; ওকে শক্তভাবে চেপে ধরে, সেকেন্ডে সেকেন্ডে প্রাণবায়ু বের করা হচ্ছিলো।

মাৎজিনি ভাবলো, বাড়ির রাস্তায় সে তার মেয়ের দূরাগত কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে।

বের্তাকে বললো, ‘‘আমার মনে হয়, মেয়েটা তোমাকে ডাকছে।’’

ওরা শুনতে পেলো, কিছু একটা অস্বস্তিকর শব্দ, কিন্তু তারপর আর কোনও আওয়াজ নেই। অমনটা শুনেও, একটু পর ওরা বললো ‘বাদ দাও’, এবং, বের্তা যখন মাথার টোপরটা রাখতে গেল, মাৎজিনি বাইরবাড়িতে আগালো।

‘‘বের্তিতা!’’

কেউ জবাব দিলো না।

‘‘বের্তিতা!’’ এরই মধ্যে বদলে যাওয়া কণ্ঠস্বরটাকে সে আরেকটু চড়ালো।

নীরবতাটাকে তার চিরায়ত আতঙ্কগ্রস্ত মনে এতটাই সুনসান ও শ্মশানীয় মনে হলো যে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমশীতল অনুভূতি নিম্নগামী হলো।

‘‘মেয়ে আমার, মা আমার!’’ উন্মাদের মতো দৌড়ে বাড়ির পেছন দিকে গেল। কিন্তু রান্নাঘরটা পেরোনোর সময় মেঝেতে এক সমুদ্র রক্ত দেখতে পেলো। সজোরে আধখোলা দরোজা খুলেই আর্তচিৎকার করে উঠলো। বের্তা, মাৎজিনির ভয়ার্ত চিৎকার শুনে যে এরই মধ্যে দৌড় শুরু করেছিলো, সেও আর্তনাদ করে উঠলো। কিন্তু ঝড়ের গতিতে যখন রান্নাঘরে ঢুকতে গেল, দেখলো: মৃতমানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে মাৎজিনি।

‘‘যেয়ো না। ভেতরে যেয়ো না!’’

কিন্তু বের্তা দেখতে পেলো রক্তনিমজ্জিত মেঝেটা। সে কেবল তার হাত দুটো মাথার ওপরে তুলে একটা গগনভেদী আর্তনাদ করতে পারলো আর ঢলে পড়লো স্বামীর গায়ে; ধীরে ধীরে ওরা দুজনেই ডুবে গেল মেঝের রক্তসমুদ্রে।

 

হোরেসিও কিরোগা (১৮৭৮১৯৩৭):

উরুগুয়ের কবি, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক।