Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কান্ননডস দশধরনের কথা — জোগো বনিতো…

কান্ননডস দশধরন

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

অন্ধকার। গলি। তস্য গলি। মদ্যপ বাবা। মার। ভেলোরের ভানিয়াম্বাদির কান্ননডস দশরধনের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু …। সাহসগুলো আকাশ থেকে পড়ে। কেউ কেউ লুফে নেয়। বাড়ি থেকে পালিয়ে। না, কান্ননডসের গল্পটায় কোনও ছবি হয়নি। তবে হতেই পারত। ৭ বছরে হঠাৎ একদিন পালানো, বিনা টিকিটে ট্রেন, প্যান্ট্রি কারে এঁটোকাঁটা, সেখান থেকে একলা নিরাশ্রয় চেন্নাই স্টেশন চত্বর। পুলিশের মার। বেঁচে থাকা। টানা ৬ মাস। কান্ননডস পালাতে ভালোবাসেন। কারণ, কখনও কখনও বাঁচতে গেলে পালাতে জানতে হয়। চেন্নাই থেকে আরাক্কোনাম জংশন। বলে কয়ে একটা চায়ের দোকানের কাপ ডিশ ধোয়ার কাজ, দিনে ১০ টাকা। কান্ননডস চারদিনে চল্লিশ টাকা জমিয়ে জোনারপট পৌঁছলেন। দেখা হল প্রতাপ, বালাজি, রবিদের সঙ্গে। ঘর নেই, হাতে ফল, জলের বোতল, চিপস। ওরা খায় না, বিক্রি করে। সঙ্গে লোহা চুরির একটা দল। কান্ননডস জানত কাজটা ভালো না। উপায় কী? যেটুকু জোটে, জুটুক। ছেড়ে দেবে একদিন। কান্ননডস আবার পালাল। চেন্নাই। বন্যা। একহাঁটু জলে স্টেশনে কান্ননডসের চোখ, নাক, ঠান্ডা ভেজা হাত পা। ট্রেন বন্ধ। কিন্তু, কান্ননডস দশরধনের গল্পটা বন্ধ হয়নি, বলা ভালো, এখানেই শুরু। করুণালয় এনজিও। একজন প্রতিনিধি দেখা করলেন। কান্ননডস কী করবে? উপায় আছে কিছু? প্রথম দিনটা ছেলেটা ঘুমিয়ে কাটাল। মাথার ওপর ছাদ। চোখ জুড়োল। কাউন্সেলিং। স্কুল। আশ্রয়হীন আরও অনেক কান্ননডসের সঙ্গে বেঞ্চ, টিফিন, ব্ল্যাকবোর্ড, চক ভাগ করে নেওয়া। স্যারের হাতে মার। ধুর, কে পড়বে! বাদ সাধল করুণালয়। বোঝানো। কান্ননডস ফিরে এল। মদ্যপ বাবা, ভেলোরের অন্ধ গলির চেয়ে এই মার অনেক বেশি গ্রাহ্য। আলো ক্রমে আসিতেছে। আস্তে আস্তে আগ্রহ তৈরি। ছোট থেকে বড় ক্লাস। ক্লাশ টুয়েলভের গণ্ডি পেরোনো। তারপর রেডিওলজির কোর্স। স্টেশনে চুরি করতে দুবার ভাবেনি ছেলেটা। আজ, পকেটে ডিগ্রি। কান্ননডস বিশ্বাস করতে পারেন না। হ্যাঁ, এই লড়াইয়ে ব্যবহার পাল্টায়। সম্বোধনও। রাস্তার তুই থেকে আপনি হয়ে ওঠা কান্ননডস দশরধনের জীবনে ঢুকে পড়ে সেই সুন্দর খেলাটা। ২০১৩ সালে করুণালয় স্পোর্টস ফর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি। দিনভর অনুশীলন। বিরক্তি। তবু ভরসা হারায়নি। খেলাটাকে ভালোবাসতে শেখা। ২০১৪-র রিওতে স্ট্রিট চিল্ড্রেন বিশ্বকাপে সিলেকশন। কোচ মিস্টার অ্যালড্রয়ের হাতে তৈরি হওয়া। টিভিতে আইএসএল। দেল পিয়েরো, আনেলকা, রবি কিন…। এদের খেলাটাই কান্ননডস খেলবেন? বিশ্বাস করতে পারছেন না। রিওতে বিশ্বকাপ দলের ক্যাপ্টেন। তেরঙার সম্মান। রিও। ব্রাজিল। কালো মানুষের সুন্দরতম খেলার ব্রাজিল। কান্ননডস জানেন ওখানে গিলবার্তো থাকেন। গিলবার্তো সিলভা। বস্তি থেকে উঠে এসে ব্রাজিলের বিশ্বজয়ী দলের ছেলে। একদিন দেখা হল। কথাও। আলো, আরও আলো। ২০১৮-র মস্কো বিশ্বকাপে ব্রিটেনের স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেডের কাছ থেকে অ্যালুমনি হিসেবে আমন্ত্রণ। গোটা গ্রহের আরও অনেক রাস্তার ছেলে। স্ট্রিট চাইল্ড। ফুটবলার। কান্ননডস দশরধনের গল্পটা থামেনি। একদিন মস্ত বড় একটা ক্লাবে ডাক পাবেন। খেলা ছেড়ে দিয়ে ডি লাইসেন্সড কোচ হবেন। স্বপ্ন বলতে এটুকুই। এটুকুও যে অনেক। আপাতত করুণালয়ের শিশু উদ্ধার দলের সদস্য। চেন্নাই সেন্ট্রাল রেল স্টেশন থেকে প্রায় ৩০০টি ছেলেমেয়েকে করুণালয়ে আনলেন। নিজের ছোট ভাইকেও। বাবা মা চলে গেছেন অনেকদিন। ছোট বোন ঠাকুমার কাছে বড় হচ্ছে। ওরা জানে কান্ননডসের স্বপ্নের উত্থান। মস্কোর স্ট্রিট চাইল্ড বিশ্বকাপের ভারতের মেয়েদের দলের কোচিং করাতে মস্কো যাচ্ছেন কান্ননডস। জেতা হারা পরের কথা। টিকে থাকা। লড়া। অসম্ভব অবর্ণনীয় এক লড়াই। খিদে। জেদ। ইচ্ছে। খেলা। পায়ে বল। তেকাঠি। ড্রিবল। গোল। জোগো বনিতো। মস্কোয় লিওনেল মেসি গেছেন। চেনেন কি কান্ননডস দশরধনকে? চিনলে জানতে পারতেন, একের পর এক ফাইনাল হারলেও লেজেন্ডের কোনও কোনও কথা মিথ্যে হয় না। ‘দেয়ার আর মোর ইম্পরট্যান্ট থিংস ইন লাইফ দ্যান উইনিং অর লুসিং আ গেম…’