Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর কথা : রাজ্য ক্ষুধারই, কিন্তু সবই গদ্যময় নয়

চন্দ্রশেখর কুণ্ডু

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

চন্দ্রশেখর আজাদ হয়, ভাগবৎ হয়, রাও হয়, এমনকি দেবাদিদেব বা প্রধানমন্ত্রীও হয়, কিন্তু কুণ্ডু? চন্দ্রশেখর কুণ্ডু? নাঃ, হয় না। বা হলেও সে পাড়ার যদুর মুদির দোকানের মালিক যদু পোদ্দারের মতো কেউ একটা। আমাদের আজকের এই ভার্চুয়াল পরিপাটি জীবনে তার নাম শোনার কোনও দায় নেই, না শুনলে দোষও নেই। এমনকি এই যদুর পেছনে যে পোদ্দার আছে, সেও তো দশ বারো বছরের সহাবস্থানের পর আমি এই হালে জেনেছি। সেদিন মুসুর ডাল কিনতে গিয়ে দেখি জোরে জোরে পড়ে পড়ে কী একটা ফর্ম ফিলাপ করছে, তাই।

কিন্তু এখন এই চন্দ্রশেখর কুণ্ডুর কথাই বলব। শুনুন।

বাড়ি আসানসোল। একটা বেসরকারি কলেজে পড়ান। যেমন আমরা সবাই করি কিছু না কিছু। ছাপোষা। স্বাভাবিক সব কিছু। বাড়ি কলেজ সংসার। সমস্যা হল ২০১৫তে। ছেলের আট বছরের জন্মদিনে। কিছু লোকজনকে নেমন্তন্ন। খাওয়াদাওয়া। আর উদ্বৃত্তগুলো ফেলে দেওয়া। স্বাভাবিকই। তারপরই ঘটল ঘটনাটা। মানে আমার আপনার কাছে এমন কিছু নয়। চন্দ্রশেখরের কাছে সেটাই বিরাট হয়ে গেল। পাগল বোধহয়! পাগলই।

পরদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় চন্দ্রশেখর দেখে ফেলেছিলেন দুটো বাচ্চাকে। ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবারগুলো থেকে কিছু আহার্য খুঁজতে।

চোখটা লজ্জায় কি অস্বস্তিতে ঘুরিয়ে নেওয়া যায়, মোবাইলে একটা ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্টানো যায়, বিজনবাবুকে উদ্ধৃত করা যায়, আরও একটু এগোলে নিজে আর সেদিন রাতে কিছু না খাওয়া যায়। তারপর আবার স্বাভাবিক জীবন। চন্দ্রশেখরও ফিরলেন স্বাভাবিক জীবনে। জীবনের স্বাভাবিকত্বটাকে একটু পালটে নিয়ে।

কিছু ছাত্রকে পাওয়া গেল। প্রথমে তৈরি হল একটি শর্ট ফিল্ম। ‘স্টপ ফুড ওয়েস্টেজ’। অবাক ব্যাপার, ভাইরাল হল সেটা। খাবার নষ্ট করা প্রচুর কমিয়ে ফেলা গেল কলেজের ক্যান্টিনে। বাড়িতে তো শুরুই হয়ে গেছিল। এবার হাতে এল রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্ট। ১৯ মিলিয়নেরও বেশি ভারতবাসী পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছেন, একই সময়ে প্রচুর খাদ্যশস্য নষ্ট হচ্ছে এফসিআই গোডাউনে। ২০১৬-র মে মাসে এফসিআইতে আরটিআই করলেন চন্দ্রশেখর। তারা জানাল গত দু বছরে তাদের হেফাজত থেকে ২২০০০ কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। এবার চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে। দ্বিবিধ প্রস্তাব। এফসিআই গোডাউনে খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়া বন্ধ করতে হবে, এবং রান্না করা খাবার অপচয় রোধে প্রচার চালু করতে হবে। এফসিআই জানাল তারা কিছু ব্যবস্থা নেবে। দ্বিতীয়টি নিয়ে এখনও পর্যন্ত কিছু হয়নি।

একদিকে এসব চিঠিচাপাটি, অন্যদিকে হাতেকলমে কাজ। চন্দ্রশেখর তার দুই ছাত্রকে নিয়ে হোস্টেল ম্যানেজারকে বুঝিয়ে হোস্টেলের অতিরিক্ত খাবার তাদেরকে দেওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। এবং তারা সেগুলি বিতরণ করা শুরু করলেন গরীব বাচ্চাদের মধ্যে। এই কাজের কিছু ছবি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হল। এবং আবারও অবাক, ভাইরাল হল সেগুলিও, এগিয়ে এল প্রচুর সাহায্যের হাত।

এবার গড়ে উঠল ‘ফিড’। ফুড এডুকেশন অ্যান্ড ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট। ১৩৫ জন ছাত্র, শিক্ষক এবং সমাজকর্মী দৌড়তে লাগলেন আসানসোলের বিভিন্ন অফিসে, ক্যান্টিনে, হোস্টেলে, পুলিশ এবং সিআইএসএফ ব্যারাকে। এসব জায়গাগুলিতে প্রতিদিনই প্রচুর ভালো খাবার উদ্বৃত্ত হয়। খাবার পরখ, সংগ্রহ এবং বিতরণের কাজগুলি যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় নিশ্চিত করা হল।

এর মধ্যেই, অর্থাৎ এই ২০১৬-তেই চন্দ্রশেখর তাদের কাজ সম্পর্কে জানিয়ে ফাও (রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন)-কে চিঠি লিখলেন, এবং ফাও তাদের ‘সেভ ফুড’ উদ্যোগে ফিড-কে অংশীদার করে নিল।

আজ ফিডের ২০০ জন কর্মী, তারা শুধু ওইসব অফিস, পুলিশ ব্যারাকই নয়, বিভিন্ন পার্টি থেকেও উদ্বৃত্ত খাবার সংগ্রহ করে পৌঁছে দেয় ক্ষুধার্তদের কাছে, যাতে সময়ে খাবার পৌঁছানো যায় সেজন্য তারা বিভিন্ন ফুড ডেলিভারি ভ্যান এবং ওলা ক্যাবের সঙ্গে পার্টনারশিপ করেছে, গত বছর এইভাবে এক লক্ষ… হ্যাঁ এক লক্ষ প্লেট উদ্বৃত্ত খাবার তারা অপচয় হতে দেয়নি, এ বছর সেটার লক্ষ্যমাত্রা দেড় লক্ষ প্লেট, এবং… আসানসোল এবং কলকাতা মিলিয়ে তারা প্রতিদিন দেড়শো জন ক্ষুধার্ত বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেয়।

কী ভাবছেন? শেষ? দাঁড়ান…

এ বছর এপ্রিল মাস থেকে ফিড ‘ফুড ফর গড’ প্রোজেক্ট শুরু করেছে। এই কলকাতার গড়িয়াহাটে বসানো হয়েছে একটি ফুড র‍্যাক। মানুষের কাছে আবেদন রাখা হচ্ছে যে তারা তাদের যে সমস্ত শুকনো খাবার আর খেতে চাইছে না, কিন্তু ভালো অবস্থায় রয়েছে, যেমন প্যাকেজড নুডল, কেক, বিস্কুট সে সমস্ত তাদের এই ফুড র‍্যাকে দিতে। চন্দ্রশেখরের পরিকল্পনা আগামী ৬ মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ১০ জায়গায় এমন ফুড র‍্যাক বসানো।

যথারীতি এই এত কাজের কোনও কিছুই সরকারের স্বীকৃতি বা সহযোগিতা পায়নি। থোড়াই কেয়ার! সেই দুটো বাচ্চা, খুঁটে খাচ্ছিল ডাস্টবিন থেকে, তারাই তো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে চন্দ্রশেখরকে। তার পাথেয় এখন অগুনতি বাচ্চার ভরা পেটে হাসিমুখ দেখা। তিনি এগোবেনই। নিশ্চিত।

আমরা? চলুন না, এগোই…