Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঝুকা বাউরি-র গল্প — আপন হতে বাহির হয়ে

ঝুকা বাউরি

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

‘গঙ্গার পারে এক অপরূপ দেশ আছে’। বস্তুত, এক নয়, একাধিক দেশ আছে। এখানে একটি দেশের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেকগুলি দেশ। এর মধ্যে এক দেশে বুলেট ট্রেন চলে, নিলাম ডেকে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয় খেলোয়ারের হাত-পা-মাথা, বৈভবের কুৎসিত প্রদর্শনী হয়ে ‘অ্যাটিলা’ দাঁড়িয়ে থাকে মহানগরের আকাশ ফুঁড়ে। আবার আরেক দেশে শাসক আর শাসিতের মধ্যেকার ব্যবধান প্রতিদিন একটু একটু বেড়ে যায়। একঘেয়ে ধারাবাহিকতায় মানুষ মরে, মারে, কর্মহীন হয়, অসুস্থ গর্ভবতী স্ত্রীকে পিঠে নিয়ে পাহাড় জঙ্গলের রাস্তা ধরে বহুদূরের ‘নিকটতম’ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে দৌড় শুরু করে সেই দেশের কোনও এক প্রান্তিক নাগরিক। এই নানা দেশের মানুষগুলোর একে অপরের সাথে কোনও যোগাযোগ নেই, কেউ কাউকে ভালো করে চেনে না, শুধুমাত্র রোজ সকালে খবরের কাগজের পাতায় একে অন্যের সঙ্গে ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়ে যায়। কখনও রাগে, অনুকম্পায়, শ্রেণিভেদে… কখনও বা হতাশা, অসহায়তায়।

অবশ্য এই দেখা হওয়াটা যে সবসময় বেদনার, তা কিন্তু নয়। গ্রীষ্মদিনের পশলা বৃষ্টির মতো এক মুঠো শুশ্রূষাও ছড়িয়ে দিয়ে যায় কিছু কিছু খবর। যেমন ২১ জুনে প্রকাশিত এই খবরটা। এই সুসংবাদের নায়ক ৫৫ বছর বয়সি এক দিনমজুর, নাম ঝুকা বাউরি। পুরুলিয়া জেলার বিন্দুইদি গ্রামের এই শ্রমিক দিনভর খেটে শ’দুয়েক টাকা রোজগার করেন, যা দিয়ে কোনওমতে তাঁর পরিবারের চারজন সদস্যের পেট চলে। অবশ্য প্রতিদিন যে দিনমজুরির কাজ জোটে, এমনও নয়। খোলার চালের একটিমাত্র অকুলান ঘরে স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে বেশ কষ্টেসৃষ্টে তাঁদের দিন কাটে। রাত হয়।

এটা অবশ্য কোনও খবর নয়। ঝুকা আমাদের দেশের অগণিত খেটেখাওয়া মানুষের এক সামান্য ‘প্রোটোটাইপ’, রাষ্ট্রের কাগজে ‘একটি ভোট’ ছাড়া যাঁর আর কোনও পরিচয় নেই। তিনি বেঁচে আছেন, এটুকুই, না থাকলেও তাঁর পরিবার ছাড়া আর কারও কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। এহেন ঝুকা বাউরি, পঞ্চান্ন বছরের এক প্রান্তিক দিনমজুর, জুন মাসের এক সকালে দেশজোড়া খবর হয়ে উঠলেন। কীভাবে?

ঝুকা ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু অভাবের তাড়নায় স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। ঝুকার ছেলেরও একই পরিণতি, তাকেও বেশিদূর পড়াতে পারেননি ঝুকা। কিন্তু বিন্দুইদি গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে তাঁর নিজের ছোট্ট একখণ্ড জমিতে দাঁড়িয়ে ঝুকা দেখতে পেতেন, ঐ যে একঝাঁক ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পড়ছে, খেলছে, দৌড়চ্ছে। দুপুরে বাচ্চারা এক সাথে খেতে বসছে, মিড ডে মিল স্কিমে দুপুরে এই ভাত-ডাল-খিচুড়ির ব্যবস্থাটুকু করা হয়েছে বলে আরও বেশি সংখ্যক বাচ্চা স্কুলে পড়তে আসে। ঝুকা মাঝে মাঝে ভাবেন, তাঁদের ছোটবেলায় এরকম কোনও সুযোগসুবিধা ছিল না, স্কুলে পড়তে আসার চেয়ে দুপুরের ভাতটুকু জোগাড় করা বেশি জরুরি হয়ে পড়ত তাঁদের কাছে। ঝুকা খুশি হতেন এখনকার এইসব বাচ্চাদের দেখে, আবার কষ্টও পেতেন। বাচ্চাগুলো যখন খেতে বসে, তাদের খাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনও জায়গা নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই, দুপুরের চড়া রোদে দাঁড়িয়ে থালা থেকে গরম ভাত খেতে হয় তাদের। অথবা বৃষ্টির দিনে আচমকা বর্ষণ শুরু হলে থালা হাতে সবাইকে দৌড়তে হয় স্কুলের একফালি বারান্দাটার দিকে। কচি অপটু হাতে ধরা থালা বেঁকে যায়, ভাত ছড়িয়ে পড়ে, ডাল গড়িয়ে যায়।

এসব দেখতে দেখতে ঝুকা বাউরি একদিন ঠিক করে ফেললেন স্কুল সংলগ্ন তাঁর এই যে একখণ্ড জমি, তা তিনি স্কুলকে দান করে দেবেন- যাতে স্কুলের বাচ্চারা দুপুরের খাবারটুকু শান্তিতে বসে খেতে পারে, রোদজল থেকে মাথা বাঁচাতে পারে। জমিটুকু ঝুকা দেবেন, জমিতে শেড তৈরি খরচ দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই, তা স্কুলকে জোগাড় করে নিতে হবে অন্য কোনওভাবে।

স্কুল কর্তৃপক্ষ ঝুকার এই প্রস্তাব শুনে আপ্লুত। অতঃপর এক শুভদিনে ঝুকা বাউরি কাগজে কলমে লেখাপড়া করে তাঁর এই তেরোশো বর্গফুট জমি স্কুলের হাতে তুলে দিলেন। এই জমির ন্যূনতম বাজার মূল্য আজকের দিনে এক লক্ষ টাকার কম হবে না। ঝুকা যদি প্রতিদিন নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ পান, সমপরিমাণ অর্থ রোজগার করতে ঝুকার সময় লাগবে কমপক্ষে ১৬ মাস। গ্রামের বাচ্চাদের খানিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, গ্রামেরই এক দরিদ্র প্রৌঢ় দিনমজুর, কলমের এক আঁচড়ে তাঁর প্রায় দেড় বছরের কষ্টার্জিত আয় এক লহমায় দান করে দিলেন।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৌমেন্দ্রনাথ মণ্ডল জানালেন, ঝুকার দেওয়া জমির একাংশে মিড ডে মিলের জন্য শেড তৈরি হবে। বাকি জমিতে অল্পবিস্তর সবজির চাষ হবে, যা বাচ্চাদের দুপুরের খাবার রান্নার জন্যই ব্যবহার করা হবে। আরও জানা গেল, রাজ্যসভার এক সদস্য নাকি শেড করার টাকা অনুদান হিসেবে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই শেড তৈরির কাজ শুরু হবে।

কিছুদিন পর থেকে বিন্দুইদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাচ্চারা দুপুরবেলায় খিদে পেটে ছায়ার নীচে বসে গরম গরম ভাত খেতে পারবে, তাদের কলরোল শোনা যাবে বিন্দুইদির পল্লীতে পল্লীতে। হয়তো সেই মুহূর্তে অদূরে মাঠে বা রাস্তায় কাজ করতে থাকা ঝুকা বাউরির কানে পৌঁছে যাবে সেই হাসিখেলার আওয়াজ। কাজ করতে করতে তিনিও নিঃশব্দে হাসবেন। কচিকাঁচাদের ছোঁয়াচে উচ্ছাস আর ঝুকা বাউরির নিঃস্বার্থ ত্যাগের তৃপ্তি ছড়িয়ে যাবে এই জীর্ণ অসম নানা ভারতবর্ষের খণ্ড খণ্ড আকাশসীমায়।