Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় যাত্রা : এসো, সুসংবাদ এসো…

স্টেশন মাস্টার

 

খবরের কাগজের কাছ থেকে ঠিক কী চাই আমরা, তা নিয়ে কথা হচ্ছিল চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকীয় বৈঠকে। এ-কথা তো ঠিক যে, প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজটি হাতে না-পেলে আমাদের দিন শুরু হতে চায় না, এমনকী অধুনা টেলিভিশন ও ডিজিট্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘটে চলা অসংখ্য ঘটনার প্রায় রিয়েল-টাইম আপডেট পেতে থাকা সত্ত্বেও পরদিন সকালে ফের সেই পড়ে ফেলা খবরই আরও একবার পড়ে ফেলার অভ্যস্ততা থেকে আমরা বেরোতে পারি না। কিন্তু, সেটা তো প্রশ্ন নয়; প্রশ্ন হল, কী সেই জিনিস, যার জন্য খবরের দ্বারস্থ হতেই হয় আমাদের?

এ পর্যন্ত পড়ে কেউ কেউ বলে উঠবেন, খবরের কাগজের কাছে খবর ছাড়া আর কীই বা চাওয়ার থাকতে পারে? বলা বাহুল্য, সংবাদমাধ্যমের কাছে সংবাদই আমাদের প্রথম প্রত্যাশা। কিন্তু কেমন সেই সংবাদ, যার জন্য এই হাপিত্যেশ অপেক্ষা? কেমন সেই সংবাদ, যা পড়েই মনে হয়, বাঃ, আজকের সকালটা হঠাৎই যেন অন্যদিনের চেয়ে আলাদা হয়ে গেল? কিংবা, সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর আচমকাই হাতফোনের অ্যাপ-বাহিত কোনও খবরের ভিডিও ক্লিপ দেখে মনে হয়, এক লহমায় কেমন পালটে গেল দিনটা?

এখান থেকেই আবারও ফিরতে হয় সেই প্রথম প্রশ্নটির কাছে। ঠিক কেমন খবর চাই আমরা সংবাদমাধ্যমের কাছে? এর উত্তর খুঁজতে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে গিয়ে দেখি কাগজ ভরে আছে দেশের ও বিদেশের প্রধান রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের আপডেটে, রাজনীতিকদের তরজায়, প্রথিতযশা কলমচিদের বিশ্লেষণে, বিনোদন ও খেলাধুলোর জগতের তারকাদের অজস্র মুখরোচক মশলা-খবরে। ঠিকই যে, এর অনেকগুলিই সবিশেষ জরুরি– আমাদের দৈনন্দিনের সঙ্গে প্রত্যক্ষত সম্পর্কিত না-হলেও, নানাভাবে জড়িত। এর বাইরে থাকে আমার-আপনার প্রতিদিনের প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় হাজারো তথ্যের চাহিদা– মাধ্যমিকের রেজাল্টে এবার শহর কলকাতাকে টেক্কা দিচ্ছে কোন জেলা– কবে কোথায় রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলের জন্য কোন রাস্তা বন্ধ বা পাইপলাইনে মেরামতির জন্য জল– কোন বাজারে ল্যাংড়ার দর কত যাচ্ছে বা কোন শেয়ারের কত– কোন অভিনেতার জামার বোতাম সঙ্গোপনে সেলাই করে দাঁতে সুতো কেটে দিতে গিয়ে আচমকাই পাপারাৎজির ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাচ্ছেন কোন অভিনেত্রী… এমনই নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাগজের বা টেলিভিশনের সম্পাদকেরা আমাদের প্রয়োজন সম্যক বুঝে সেই মোতাবেক খবর সাজান, কেউ কেউ তো বিজ্ঞাপনে এমনকী এ-কথাও সহাস্যে জানান যে, দিনের সেরা বারোটি খবর তিনি নিজে হাতে বেছে দিয়েছেন, কেবল আমাদেরই জন্য, কেবল আমাদেরই প্রয়োজনের কথা ভেবে। আমাদের জন্য সম্পাদকদের এ-হেন দুশ্চিন্তা ও সহানুভূতি দেখে দু’চোখে জল এসে যায় এ-কথা যেমন সত্যি, তেমনই তাঁদের এই বদান্যতায় ধন্য হতে হতে আমরা তাঁদের পাঠকসংখ্যা ও টিআরপি সুনিশ্চিত করে চলি– সব মিলিয়ে এক সুস্বাদু পারস্পরিকতাবোধের জন্ম ও পুনর্জন্ম হতে থাকে। এবং যে কথাটি প্রায় একই নিশ্বাসে বলবার, তা হল, এসব খবরের সিংহভাগই এমন যে, পড়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই অক্লেশে ভুলে যাওয়া চলে– কেবল মনে রাখবার মতো কিছু তাতে থাকে না বলেই।

কিন্তু এর বাইরেও কি খবর থাকে না কোনও? এমন কোনও খবর, কাগজ ঠোঙা হয়ে যাওয়ার পরেও যা আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে চলতে থাকে, চলতেই থাকে? এমন কোনও খবর, যা হয়তো আমাদের নতুন তথ্য জানায় না তেমন, কিন্তু পরোক্ষে গভীরতর কোনও আবিষ্কারের মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করায়? দেশের প্রত্যন্ত কোনও প্রান্তে কোনও হতদরিদ্র স্কুলশিক্ষককে যখন শুনি গ্রামের স্কুলবাড়ি গড়ে তোলার জন্য নিজের যথাসর্বস্ব দান করে দিতে, কিংবা কোনও সহায়সম্বলহীন মহিলা যখন শুনি একার হাতে গাছের চারা লাগিয়ে চলেছেন হাইওয়ের ধারে মাইলের পর মাইল কেবল পথিককে একটু ছায়া দেবেন পাখিদের একটু ফল খাওয়ার সুযোগ করে দেবেন বলে, কিংবা একজন একা মানুষ গাঁইতি হাতে সারাজীবন ধরে একটা পাহাড় ভেঙে চলেছেন যাতে গ্রামের লোকদের রাজ্য ঘুরে শহরে যেতে না-হয়– মনে না-হয়ে পারে না যে, এইই হল সেই খবর, যা আমাকে মানুষ হিসেবে আরও একটু এগিয়ে দিল কোথাও– এইই সেই খবর, যা আমাকে হয়তো আবারও একটু বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মাঠে ঠেলে দিল।

এইসব ভাবতে-ভাবতেই আমরা স্থির করি, এমনই নানা ভালো খবর একসুতোয় গেঁথেই তৈরি হবে আমাদের দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যার মূল ভাবনা, যাকে– এতদিনে আপনারা নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছেন– আমরা ডাকি ‘রিজার্ভ্‌ড বগি’ নামে। মূল বিষয়-ভাবনার নাম কী হবে, ভাবতে গিয়ে প্রথমেই মনে আসে ‘ভালো খবর’ শব্দবন্ধটি… তার টানে মনে পড়ে যায় ‘সন্দেশ’, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আসলে ‘সুসংবাদ’… আর সুসংবাদের প্রায় হাত ধরেই আমাদের সামনে এসে হাজির হয় ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা থেকে প্রায় অমরত্বে উত্তীর্ণ ‘এসো, সুসংবাদ এসো’ বাক্যবন্ধটি… আমরা যে আশ্চর্য বাঙ্ময় ও যথার্থ একটি নাম পেয়ে গিয়েছি আমাদের ভালো খবরের বিভাগের জন্য, তা নিয়ে আর কোনও সংশয়ই থাকে না মনে।

প্রথমে ভাবা গিয়েছিল একডজন ভালো খবর খুঁজে বের করা হবে… কিন্তু তারপর মনে হল, সব ভালো জিনিসের সঙ্গেই যেমন, তেমনই এখানেও একটি ফাউ আপনাদের অবশ্যপ্রাপ্য। তাই, বারোর সঙ্গে আরও এক, মোট তেরোটি ভালো খবরকে একসঙ্গে গেঁথে তৈরি হল এবারের রিজার্ভ্‌ড বগি। বিষয়ের দিক থেকে এই বিভাগটি যদি আপনাদের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় মনে হয় তবে ভবিষ্যতে আমরা এটিকে নিয়মিত বিভাগে পরিণত করার চেষ্টা করব, এমন প্রতিশ্রুতিও রইল।

রিজার্ভ্‌ড বগির বাইরে, এবারের স্মরণ বিভাগে রইল ইন্দ্র মিত্র ছদ্মনামের আড়ালে থাকা কথাসাহিত্যিক অরবিন্দ গুহর প্রয়াণে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সেই সঙ্গে থাকল রাইজিং কাশ্মির-এর সদ্যপ্রয়াত সম্পাদক, সাংবাদিক শুজাত বুখারির একটি নিবন্ধ, নিজের পত্রিকার জন্য যেটি তিনি লিখেছিলেন মারা যাওয়ার মাত্রই কয়েকদিন আগে। এ ছাড়া রইল অন্যান্য সব নিয়মিত বিভাগ– গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অণুগল্প, অন্যগদ্য, হুইলার্স স্টল ও ধারাবাহিক রচনাগুলিও – প্রতি সংখ্যায় যেমন থাকে।

পরিশেষে জানাই, গত পনেরো মাসের অভিযাত্রায় আমরা যে লক্ষাধিক পাঠককে (আক্ষরিক অর্থেই লক্ষাধিক, তথ্য গুগ্‌ল অ্যানালিটিক্‌স-এর সৌজন্যে) আমাদের সঙ্গে পেয়েছি, তাঁদের প্রতি দায়বদ্ধতা ও নিষ্ঠাই আমাদের একমাত্র মূলধন। আমরা এমন দাবি করি না যে, আপনাদের প্রয়োজন নির্ধারণ করে দেব আমরাই, বরং বলি, আপনাদের প্রত্যাশা আমাদের যেন ঠিক পথটি চিনে নিতে সাহায্য করে ভবিষ্যতেও।

ভালো থাকুন সকলে…