Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ধারা-বিবরণী

হিন্দোল ভট্টাচার্য

 

বৃষ্টিটা যে এত জোরে নেমে আসবে, ভাবতেই পারিনি। বেরিয়েছিলাম যখন, তখন টিপটিপ। কালিন্দী থেকে একটু পিছনের দিকে এগোলেই চাষির মাঠ, তার ডানদিকে শেঠবাগানের রাস্তা, যা এঁকেবেঁকে চলে গেছে দমদম পর্যন্ত। আমি চিরকাল মেট্রোয় যাতায়াত পছন্দ করি বলে, কালিন্দীর পিছন দিক থেকে ওই হাঁটা রাস্তাটাই ধরি। কিন্তু মনে হচ্ছিল না পৌঁছতে পারব। দৌড়ে আশ্রয় নিলাম একটা টিনের চালের তলায়। এ সপ্তাহে শেষ দু তিন দিন বেশ ভালোই বৃষ্টি হয়েছে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা অগভীর নালা। তাতে জল থই থই। আগ্রাসী পাইথনের মতো নোংরা জল ছুটে যাচ্ছে বাগজোলা খালের দিকে। কিন্তু এত জল বাগজোলা খাল বইতে পারলে হয়! আহ কী সুন্দর বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ থেকে যেন নেমে আসছে কিশোরীদের উচ্ছ্বাস। ধুয়ে যাচ্ছে সব। টিনের চালার উপর বৃষ্টি। কচুরিপানা ভিজছে। রাস্তার কুকুরগুলো ভিজতে ভিজতে দৌড়ে যাচ্ছে। কার্নিসে বসে আছে শালিখ। ঘাড়ের রোঁ উঠে গেছে। ভেজা কাক আড়চোখে মেপে যাচ্ছে আমাকে। আমিও যে তাকে আড়চোখে দেখছি না তা নয়। আর একটু দূরে একটা তিনতলার ফ্ল্যাট। চেতনার শীর্ষে যেন। এই যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার থেকে বেশি দূরে নয়, কিন্তু অনেক দূরে মনে হচ্ছে এখন। বৃষ্টির জলরঙের ভিতর ঝাপসা হয়ে এসেছে সেই দীর্ঘ বারান্দা। সেখানে বসে আছে এক পাতলা কিশোরী। বারান্দা থেকে বাইরের দিকে হাত মেলে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার হাতদুটো। যেন বৃষ্টির জলরঙের ভিতর সে নিজেকেও মিশিয়ে দিতে চাইছে। বৃষ্টিটা আর একটু বাড়ল বলে মনে হল। মেঘে মাঝে মাঝে অসহিষ্ণু গর্জন শোনা যাচ্ছে। মনে পড়ল এমন দিনেই তোমার সঙ্গে প্রথম কথা হয়েছিল আমার। যত দূরেই থাকো তুমি। হয়ত তোমার ইস্পাতকঠিন শহরে এ সময়ে কোনও বৃষ্টিও পড়েনি। কিন্তু তুমি কথা বলে উঠলেই আমার শহরে বৃষ্টি নামে। তোমার গলার স্বর শুনলেই মনে হয় মাটির উপর থেকে প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে আমার জীবনে। তোমার চোখের জল কি এমন স্বরলিপির মতো নেমে আসে? আমি তোমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি। আর দেখি দূরে বা কাছে এই সব স্ক্রাইস্ক্রাপারগুলি কেমন মেঘের ভিতরে মাথা উঁচু করে আছে। এরা ঠিক কোথায় যেতে চায়? আর সেই সব মানুষ, যারা সেই সব বারান্দায় থাকে, যারা হাত বাড়ালেই খুঁজে পায় মেঘের সদর দরজা? বৃষ্টি আরও জোরে এসেছে। তোমার ফোন পাচ্ছি না। আমার মাথার উপরে টিনের কার্নিস। পিছনে পলকা একটা বাড়ি। বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসছে থালাবাসনের শব্দ। ভেসে আসছে একটা সদ্যোজাত বাচ্চার কান্না। কেউ যেন কাউকে বকছে কোথাও। এই তো দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন এক চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা। চোখে মুখে আশঙ্কা। আর দেখো তিনতলার মেয়েটি কেমন বারান্দায় নাচছে। হয়ত বুকের ভিতরে তার ময়ূর নেচে উঠেছে। হয়ত গান বাজছে তার ঘরে। ঠিক তার উল্টোদিকে জলরঙের মফস্বলে একটি বারান্দায় বসে আছেন এক বুড়ি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাঁর চোখে মুখে কোনও ভাষা নেই। ভাষা নেই কেন দিদিমা? এই তো দেখছেন, কত দিন ধরে পুড়িয়ে জ্বালিয়ে এসেছে বৃষ্টি। আমাদের নবধারাজলে স্নান করিয়ে দিচ্ছে নির্লজ্জ বর্ষা। কিন্তু তিনি এত উদাসীন কেন? বয়স? মৃত্যুর ভয়? চলে যাওয়ার আশঙ্কা? এই যে বৃষ্টির পৃথিবী, একে কি সত্যি ছেড়ে চলে যেতে মন চায়? এই যে সুন্দর কৃষ্ণচূড়া গাছের ভিতর দিয়ে নেমে আসছে বৃষ্টি, একে ছেড়ে যেতে মন চায়? তাই কি তাঁর মনে যন্ত্রণা? না কি তিনি কিছুই দেখছেন না? কত জন্ম হচ্ছে এই বৃষ্টির মধ্যে? কত মৃত্যু হচ্ছে বৃষ্টির মধ্যে? কত অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে শুয়ে আছেন এখন? জানলা দিয়ে চোখে পড়ছে হয়ত বৃষ্টির পৃথিবী। নালা দিয়ে হুড়মুড় করে বয়ে যাচ্ছে জল। তিনতলার মেয়েটির আনন্দ আর ধরে না! শালিখপাখিগুলো কার্নিসেই বসে আছে। কাকটি ভিজছে। তার পাশে উড়ে এসে বসেছে আরও একটি কাক। আমি না যেতে পারছি না ফিরতে পারছি। খুব মাঝপথে পড়ে গেছি। জল বাড়ছে। এমন বৃষ্টি যদি আর একঘণ্টা হয়, তবে একগলা জল দাঁড়িয়ে যাবে এখানে। কী হবে এই টিনের চালার বাড়িটার? কী হবে ওই বাচ্চাটার? আর পনের মিনিটের মধ্যে আমার হাঁটু পর্যন্ত না জল উঠে আসে! এখানে এমন হয়। বাগজোলা খাল উপচে পড়ে। আশেপাশের সব টিনের চালার বাড়ি থেকে লোকজন উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করে দিয়েছে। আকাশের দিকে শাপশাপান্ত করে গালি দিতে দিতে চলেছে এক বুড়ো। বৃষ্টি থামছে না। একটু দূরে ওই আকাশছোঁয়া অট্টালিকা মেঘের ভিতরে কোথায় হারিয়ে গেছে। জলরঙে মিশে গেছে তার চেতনা। তিনতলার বাড়িটার বারান্দায় দর্শকের মতো এসে দাঁড়িয়েছে গোটা পরিবার। মুখে তাদের অপরিসীম আনন্দ। রিক্সাগুলি ভিজতে ভিজতে চলেছে। একটা গোরু সেই থেকে দাঁড়িয়ে আছে এই জলরঙের বৃষ্টিতে। আশঙ্কায় বাচ্চার কান্না থামাতে ভুলে গেছে টিনের চালার গৃহিণী। শাঁখ বাজছে। যেন বলছে– থামো, থামো থামো। তুমি কি এখন ঘুম থেকে উঠলে? তোমাদের আকাশেও কি মেঘ? একটু ফোন করব, তার জো নেই। এত বাজ পড়ছে। আমি খুব মাঝপথে পড়ে গেছি। না পারছি যেতে, না পারছি ফিরতে। তুমি শুনতে পাচ্ছ?

কচুরিপানা ভিজছে। বাঁশপাতারা ভিজছে। কৃষ্ণচূড়া ভিজছে। জল বাড়ছে। জল বেড়ে যাচ্ছে আমাদের।