Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বৃষ্টি পড়ছে….

বুবুন চট্টোপাধ্যায়

 

ডাক্তার এসেছিলেন। ধুম জ্বর। বুকে স্টেথো লাগিয়ে বললেন বুকে মেঘ জমেছে। কোনও অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না। এক একজনের হয়। সকলের নয়। কোনও কোনও বর্ষায় মেঘ জমে শরীরের আনাচে কানাচে। তখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। গাঁটে গাঁটে ব্যথা হয়। অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। অনেকটা ভেলভেট মোড়া স্মৃতির মতো। তখন ঝড়ে পুরনো অ্যালবামের পাতারা উড়ে আসে। স্মৃতির একটা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ আছে। কেউ পায় কেউ পায় না। কিন্তু বুকে মেঘ জমলে সে গন্ধ তাড়িয়ে বেড়ায়। শুতে দেয় না, ঘুমোতে দেয় না। শুধু বুকের মধ্যে একটা কুলকুল শব্দ স্মৃতির আসা যাওয়ার। ডাক্তার বললেন রোদ উঠলে রোগ সারবে। সারাদিন রোদে পিঠ সেঁকতে হবে, বুক সেঁকতে হবে। আঙুলগুলোকে রোদের জাফরিতে নিয়ে গিয়ে আলোছায়া তৈরি করতে হবে। তবে যদি মেঘ সরে। তবে যদি রোদ আসে। স্মৃতিরা মাঝে মাঝে ময়ূরপঙ্খী হয়ে যায়। কবেকার কাদা-মাটি, ডালপালা নিয়ে আসে। তেঁতুলগাছের একটা ডাল চিনতে পারছি। ছেলেবেলায় একদিন ইস্কুলে যাইনি বলে এই ডাল দিয়ে বাবা খুব মেরেছিলেন। ডান গালে এখনও আবছা দাগ। বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। বই, খাতা, জামা, কাপড় উপুড়চুপুর করে বাড়ি ফিরেছিলাম। বাবার অত মারের পরও ডানহাতের মুঠো খুলিনি। যদি বৃষ্টিতে ভিজে যায়। মুঠোতে ওর স্পর্শ লেগে ছিল। একদিন সব স্পর্শ লেবুপাতার গন্ধের মতো হয়ে যায়। দূর থেকে ভেসে আসে। সেদিন খুব মেঘ করে। আর বুকের মধ্যে…

একদিন খুব বৃষ্টি হল। কোলকাতা শহর ভেসে গেল। কিন্তু সেদিনই যে আমাদের দিগন্তে যাওয়ার কথা। সেদিনই তো! এক হাঁটু জল পেরিয়ে স্টেশনে গিয়ে জানলাম দিগন্তের ট্রেন ক্যান্সেল হয়ে গেছে। কে যেন বুকের ভেতরে ফিসফিস করে বলল দিগন্ত পায়ে হেঁটে যেতে হয়। পায়ে দুব্বোঘাস না লাগলে কী আর দিগন্তকে ছোঁয়া যায়? দিগন্তে দারোয়ান থাকে। তারা ঠিক মাটির গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারে মাটিতে কতটা মৃত্তিকা আছে। সেদিন সারা শহর ভেসে যাচ্ছে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে। কিন্তু আমাকে যে দিগন্তে পৌঁছাতেই হবে। ওখানে জমি, ঘাস, একটা শালিখ, একটা বক আমার জন্য অপেক্ষায়। আমি দেখতে পাচ্ছি শালিখের হলুদ ঠোঁটে সেই পুরনো চুম্বনের দাগ। এবারে আরও গাঢ় চুম্বনে মুছে দেবে যাবতীয় অতীত। বকের ডানায় আমাকে দেখার আকুলতা। কোনও জ্যোৎস্না রাতে আমরা বেরিয়ে পড়ব। তুলসীতলায় সন্ধে দিতে আসা বৌ আমাদের দেখে লজ্জা পাবে। আমি বলব, এই, এখন কোরো না। তার আগে একটু কথাবার্তা হোক। হাবিজাবির খাতায় গাছের পাতারা ঝরে পড়ুক, পৃথিবীর সব অস্ত্রকারখানা ধ্বংস হয়ে যাক। যুদ্ধজাহাজগুলো ফিরে যাক কোনও দ্বীপে, যে দ্বীপ থেকে আর ফিরে আসা যায় না। চারদিকে ছায়া শান্তি, শূন্য ক্ষেত তখন কোরো। তখন ঝোলায় থাকা মেঘ দিয়ে ঢেকে দেব আমাদের রতি। প্রতিটি রোপণের গায়ে জেগে উঠবে ফুল। শাঁখ বেজে উঠবে। যেকোনও পাখির যৌনমিলনের সময় আকাশ থেকে শাঁখ বাজে… উলুধ্বনি হয়। দিগন্ত ঢেকে যায় ফুলের চাঁদোয়ায়। তখন আমরা নৌকো করে চলেছি আরও দূরে। আসলে প্রতিটি রোপণের পর হাতের পাতারা নৌকো হয়ে যায়। তোমার হাতের পাতায় বসে আমি পেরিয়ে যাচ্ছি ধানক্ষেত, পোড়োমন্দির, শ্যাওলাঘন দিঘী। সঙ্গে যাচ্ছে মেঘ, বৃষ্টি, রামধনু। ওরা আমার ছেলেবেলার বন্ধু। ওরা আমার আত্মার জল। ওরা জানে কতটা ছায়া পড়লে আমার মনখারাপ হয়। মনখারাপ হলে শুধু তোমাকে পেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় বিছানা জুড়ে চাঁদের আলো। আর সেই অলৌকিক আলোয় আমরা জড়িয়ে বসে আছি। হাতে হাত, কপালে কপাল। এক একদিন ঝগড়া হয় খুব সেদিন আমাদের করোটি দেখা যায়। শিরায় শিরায় রক্ত আমাদের রিক্ত করে দেয়। এই সবই বর্ষার দিনে, পাশের বাড়ি দেবব্রত চলে, আর আমি বুকে চাপ চাপ মেঘ নিয়ে তোমাকে খুঁজি। সারাটা জীবন শুধু তোমাকেই খুঁজে গেলাম। তোমাকে না পেলে তোমার ঠোঁটের কোণে তিল আমাকে বাঘের থাবার মতো ছিঁড়ে খায়। একটা রক্তাক্ত হৃদপিণ্ড নিয়ে যেতেই হয় আমার মাঠের কাছে, পাখিদের কাছে, রেললাইন পেরিয়ে পুরনো দিঘীর কাছে। ওদের কাছে সূর্যালোক থাকে, ওদের কাছে দুব্বোঘাস থাকে, ওদের কাছে শীতকাল থাকে। তারপর জ্বর নিয়ে ফিরে আসি। ধুম জ্বর। চাঁদের আলো পড়া বিছানা তখন শুকিয়ে কাঠ। কাঠ আমাকে খায়। আমার আয়ুকে খায়, আমার গলার কাছে মেঘ থকথক করে। জমাট বাঁধে না। তারপর শিরা উপশিরা বেয়ে ডাক্তার আপনি তো জানেন এছাড়া আমার কোনও অসুখ নেই। ছেলেবেলায় ঠাকুমা বলেছিল খুব ভালবেসে কাউকে যদি না পাস ভুগবি। সারাজীবন মেঘের অসুখে ভুগবি। এ অসুখ কোনও ডাক্তার বদ্যি সারাতে পারে না। আমার আছে। তোর দাদু জানে না। এক একটা অসুখ ভালবেসে থেকে যায়। এই যেমন ঠাকুমা আমাকে দিয়ে গেল আমৃত্যু মেঘের অসুখ। তখন আমার ডানাগুলোও নেতিয়ে পড়ে। নেতিয়ে মরা গাছ হয়ে যায়। তবু স্বপ্ন দেখি। তোমার চানঘরে সাবান হতে ইচ্ছে করে। আমাকে ঘষবে। ঘষে ঘষে নরম করে দেবে। আমি তখন তোমার সঙ্গে স্নানঘরে একা। আমি তোমার বুকের রেখায় আঁকিবুঁকি কাটতে কাটতে নিচে নামব। আরও নিচে নামব রোজ। ফেনার ধর্মই তো পিছলে পড়া। যদি না বৃষ্টি আসে খুব। সারাদিন তোমাকে ছেয়ে থাকবে স্নানঘরের সাবান।

মেঘে মেঘে বৃষ্টি হয়ে পড়া। এমন জলের জীবনই তো চেয়েছিলাম অথবা গাছে গাছে ফুল ফোটার জীবন, পাখিদের উড়ে যাওয়া জীবন। বর্ষাকাল এলেই আমার এইসব জীবনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে শালিখের ঠোঁটে তীব্র চুম্বন। ঘুমের মধ্যেও সঙ্গমের আরাম। আ!! সেদিন মাঠ ঘাট ভেসে যায় জীবনের শীৎকারে। গভীর সুড়ঙ্গ থেকে উঠে আসা সাপ আমার জীবৎকালের উপর বসে। আমার আয়ু চেটে চেটে খায়। সব বিষ চেটে নেয়, সব মেঘ চেটে নেয়। বৃষ্টি পড়ে পাখিদের ডানায়। ভিজে ডানায় ওম জমে। তখন পাখিরা প্রেমিক চায়। অথবা প্রেমিকা। যে তার ডানার জলবিন্দু চুমুতে চুমুতে পান করে নেবে। ওই চুমুতে পান করা জীবনও একটা চেয়েছিলাম। এই ঘোর বর্ষায় আর কী চাওয়ার আছে বলো! এইভাবে একে একে যৌনতা সম্পর্কিত সমস্ত ধারণা আমি মুছে ফেলছি প্রতিদিন। আজকাল একটা ম্যাকাও পাখি দেখলেও অনিবার্য যৌনতার পর তাকে সুন্দর মনে হয়। একতারাকেও কী রোম্যান্টিক লাগে বাউলের কাঁধে। বাউলের কাঁধে বসা ওই একতারা আমাকে নিয়ে চলে বাউলের ঘরে। মাটির ঘরের সোঁদা গন্ধে আমার নেশা হয়। জীবনের নেশা, যৌবনের নেশা। তারপর সন্ধে হয়। গোধূলির অন্ধকারে স্বপ্ন ভাসে। তুলোর মতো স্বপ্নরা তোমার জানলার কার্নিশে আটকে থাকে। আমি দূর থেকে দেখি। দূরবীন দিয়ে দেখি তুমি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছ সমস্ত উড়ে আসা স্বপ্নবীজ। তুমি কী করে জানবে ওই এক একটি স্বপ্নবীজের মধ্যে আমাদের প্রেম, অবিশ্বাস, ঝগড়া, গোপনে তোমার হাত চেপে ধরা সমস্ত ভরা আছে অদৃশ্য মায়ার মতো। ও মা, মা গো এবার মরে যাব। গলার কাছে ঘন মেঘ আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে আদর করার সময়ও আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু তারপর তো বৃষ্টি নামে অঝোরে। তারপর তো ফুল ফোটে, মৌমাছিরা গুনগুন করে। মেঘ করে থাকে সারাদিন বাইরে, ভিতরে, ভিতরে, বাইরে। খাটের পাশে এক আশ্চর্য নদী বয়ে যায়। আমি নদীর ধারে বসে থাকি যতক্ষণ না পাখিরা ঘরে ফেরে। ওদের জন্যই আমার যত প্রতীক্ষা। ওদের জন্যই আমার যত সাধ আহ্লাদ। ওদের জন্যই আমার মেঘময় জীবন সারা দিনমান প্রতীক্ষায় কখন বৃষ্টি এসে জাপ্টে ধরবে।

মেঘ সরিয়ে চাঁদের মায়া নামছে পৃথিবীর গায়ে। ডালপালা চুইয়ে চাঁদ নেমেছে আমার হা-ঘরের উঠোনে। কী করব আমি? চাঁদের আলো খাব? মদের গেলাসে মিশিয়ে দেব একটু একটু জ্যোৎস্না, একটু একটু মেঘ। তাহলে আরও নেশা হবে। যে তোমার অপমানগুলো সব ভুলে যাব। আমাকে নিয়ে গত তিরিশ বছর ধরে তোমার অবিশ্বাস, অন্ধকার, ভুল ঠিকানায় চিঠি ফেলে আসা সব ভুলে যাব? হ্যাঁ আমি দেখেছি চাঁদ গুলে গেলে সব ক্ষতস্থান সেরে যায়। তাই আজকাল ঘোর জ্যোৎস্না ছাড়া আমি মদ খাই না। কারণ তিরিশ বছরের পোড়া দাগ নিয়ে কখনও পাখিদের জন্য অপেক্ষা করা যায় না। তিরিশ বছরের পোড়া দাগে কোনও সঙ্গমই সফল হয় না। সব মেঘলা মনে হয়। তবু এক একদিন একটা বৃষ্টি দিন হয়ে আমি পড়ে থাকি ধানক্ষেতে, পাখিরা আমার পিঠের উপর খেলা করে। মুনিয়াগুলো সুযোগ পেলেই পরস্পরকে আদর করে। আমার সুড়সুড়ি লাগে। তবু আমি নড়ি না। বকগুলো ওদের ছুঁচলো ঠোঁট দিয়ে আমার গলায় জমে থাকা মেঘ খুঁটে খুঁটে খায়। আমি হাঁ করে থাকি। যতক্ষণ না সব মেঘ ওরা খেয়ে ফেলে। আমার গলা পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি সহজেই নিঃশ্বাস নিতে পারি। তখন রোদ্দুর ওঠে। আহ! আমি পিঠ সেঁকে নিই, বুক সেঁকে নিই। পাড়ায় পাড়ায় বেড়াতে যাই। পোড়ো মন্দিরের দাওয়ায় খানিক বসি। রাত্রি হলে তোমাদের ভাঙা বাড়ির পেছনের চাঁদ হয়ে যাই। আমার চারপাশ দিয়ে মেঘ বয়ে যায়।