Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ব্যান্ড বাজা বারাত : সঞ্জয় যাতবের বিবাহ অভিযান

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

আজ থেকে প্রায় একশো বছরেরও বেশি আগের এক খর গ্রীষ্মের দুপুর। আজকের মধ্যপ্রদেশ তখন সেন্ট্রাল প্রভিন্স। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বালক প্রবল পিপাসায় জল খেতে না পেয়ে অসুস্থ বোধ করতে লাগল। স্কুলে যে জল নেই, তা নয়। জল আছে, তবে এই অস্পৃশ্য মাহারকে একমাত্র স্কুলের পিওন ছাড়া অন্য কেউ জল গড়িয়ে দেবে না। পিওনটি জলের পাত্র উঁচু করে ধরে তা থেকে বালকটির হাতে জল ঢেলে দেবে, সেই জল সে পান করবে। আজ পিওনটি কোনও কারণে অনুপস্থিত। স্কুলের অন্য কোনও কর্মচারী, শিক্ষক বা উচ্চবর্ণের ছাত্ররা ভুলেও এই জল ঢালার কাজটি করবে না, পাছে কোনওভাবে মাহার ছেলেটির সঙ্গে ছোঁয়া লেগে যায়। তৃষ্ণার্ত বালকটি অপেক্ষা করে, কখন স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজবে, কখন সে বাড়ি যাবে আর বাড়ি গিয়ে প্রাণভরে এক গেলাস জল খেতে পাবে।

ছেলেটি বাড়ি গিয়ে নিশ্চয়ই জল খেয়েছিল। কিন্তু ভারতবর্ষের অস্পৃশ্য অর্থাৎ দলিতদের অপেক্ষা আজও শেষ হল না। স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও গ্রামের দলিত মেয়েটি বাবার কষ্ট করে কিনে দেওয়া সাইকেল চেপে দূরের স্কুলে যেতে পারে না, কারণ গ্রামের রাস্তা দিয়ে এক দলিতের সাইকেল চালিয়ে যাওয়া সমাজের মাথা উচ্চবর্ণরা কিছুতেই মেনে নেবে না। গুজরাতে ঘোড়া কেনার ‘অপরাধে’ আজও খুন হয়ে যান একজন নীচু বর্ণের মানুষ। এমন একদিনও যায় না যেদিন খবরের কাগজের এক কোণে দলিত নিগ্রহের কোনও না কোনও খবর থাকে না। কার্ল মার্ক্স বর্ণিত ‘ক্লাস’ যে আমাদের দেশে ‘কাস্ট’-এর নামান্তর তা প্রতিদিন মর্মে মর্মে টের পাই আমরা।

দলিত সংক্রান্ত খবরের এই আদলটাকেই একা হাতে বদলে দিলেন উত্তর প্রদেশের কাসগঞ্জ জেলার নিজামপুর গ্রামের যুবক সঞ্জয় যাতব, মাত্র একদিনের জন্য হলেও। দলিত নিগ্রহ নয়, বিপরীতে আমরা পেলাম এক স্পর্ধিত সন্দেশ, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার মন-খুশি-করা বার্তা।

উপলক্ষটা আর কিছুই নয়, নিজের বিয়েতে বরযাত্রী নিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে ব্যান্ডপার্টি সহকারে নাচতে নাচতে কনের বাড়িতে পৌঁছতে চেয়েছিলেন সঞ্জয়। কিন্তু তিনি যে দলিত, আর এইসব আনন্দ অনুষ্ঠান শোভাযাত্রায় তো গ্রামের ঠাকুরদের একচেটিয়া অধিকার। প্রসঙ্গত, গত এক দশকে বিভিন্ন সময়ে অঞ্চলের দলিতরা বারতিনেক নিজের নিজের বারাত নিয়ে রাস্তায় বেরোতে চেয়েছিলেন, প্রতিবারই ঠাকুরদের হুমকিতে আক্রমণে সেইসব শোভাযাত্রা ভেস্তে যায়। এবারও সঞ্জয়ের পরিকল্পনায় তীব্র আপত্তি জানায় ঠাকুর সম্প্রদায়। আর তাদের আপত্তির ভিত্তিতেই সঞ্জয়ের আবেদন খারিজ করে দেয় জেলা প্রশাসন। সেটা এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস। না, দমে যাননি সঞ্জয়। বিয়ে যদি তিনি করেন তো বারাত ও শোভাযাত্রা সহযোগেই করবেন, নচেৎ নয়। টালবাহানা চলে, সঞ্জয় জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে ছুটে যান, এলাহাবাদ হাইকোর্টের কাছে আবেদন জানান, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর অনলাইন পোর্টালেও দরবার করেন। এত কিছুর পরে প্রশাসন অবশ্য আর সঞ্জয়কে আটকে রাখতে পারেনি।

সঞ্জয়ের সঙ্গে বসে বারাতিদের যাত্রাপথের রুটম্যাপ তৈরি করে পুলিশ। এই সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার কথা ঠাকুর সম্প্রদায়কে জানিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে সেই শুভদিন আসে। ১৬ই জুন, ২০১৮, রবিবার। নিজের বাড়ি থেকে ঘোড়ায় টানা গাড়ি চড়ে বিয়ের বর সঞ্জয় ও বরযাত্রীদের শোভাযাত্রা বেরোয়। সেদিন নিজামপুরে আইনরক্ষকদের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। দশজন পুলিশ ইন্সপেক্টর, বাইশজন সাব-ইন্সপেক্টর, পঁয়ত্রিশজন হেড কনস্টেবল, শতাধিক পুলিশ কনস্টেবল ও এক প্ল্যাটুন প্রভিন্সিয়াল আর্মড কনস্টেবুলারির সেপাই গোটা যাত্রাপথ জুড়ে তৎপর ছিল, যাতে রাস্তায় কোনও রকম গোলমাল না হয়। সামান্য এক দলিতের এই ‘ঔদ্ধত্যের উৎসব’ দেখতে আশেপাশের গ্রামের মানুষ রাস্তার দু’পাশে ভিড় জমিয়ে ছিলেন। গ্রামের ঠাকুররা অবশ্য নিজেদের গোঁ ছাড়েননি। প্রবল গোঁসা হয়েছে তাদের। তাদেরই একজন, রুপেন্দ্র চৌহান, সংবাদমাধ্যমকে জানালেন, ‘এলাকার কোনও ঠাকুর এ বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেবে না। দু’দিন পরে হোক কি দু’বছর — এর যোগ্য জবাব অবশ্যই দেওয়া হবে।’ সঞ্জয় অবশ্য আর এসবে পাত্তা দিচ্ছেন না। প্রশাসন তাঁকে অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার পরেও সুরক্ষা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। সঞ্জয় যাতব খুশি কারণ এই মুহূর্তে তিনিই স্বাধীন ভারতের একমাত্র দলিত পুরুষ যিনি প্রকাশ্যে নিজের বারাত নিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে প্রেয়সীর বাড়ি পৌঁছতে পারলেন।

মিছিলের শেষে বিজয়ী বীরের মতো সঞ্জয় মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন — ‘একটু সম্মান, মর্যাদা ও সমান অধিকারের জন্য আমাদের অনেক লড়াই করতে হচ্ছে। তবে আমি বা আমাদের সম্প্রদায় স্থানীয় ঠাকুরদের বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু জাতপাতের ভিত্তিতে করা যেকোনও বৈষম্যের বিরুদ্ধে।’ সঞ্জয় যখন এসব বলছেন, সেদিনের সেই তৃষ্ণার্ত মাহার বালক, বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর, ইতিহাসের পাতা থেকে মুখ তুলে একবার মুচকি হাসলেন। মুচকিই হাসলেন, দরাজ প্রাণখোলা হাসি হাসবার সময় এখনও আসেনি। যতদিন না ভারতবর্ষের প্রতিটি সঞ্জয় যাতব ইচ্ছে হলেই প্রশাসনের বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ ছাড়াই মহাসমারোহে ও নির্বিঘ্নে কনের বাড়ি পৌঁছতে পারছেন, তাঁর এই অনন্ত অপেক্ষারও শেষ হবে না।