Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

টেনিদা এবং এক আশ্চর্য ইতিহাস

কৌশিক মজুমদার

 

টেনিদাও এককালে হিস্ট্রি পড়েছিল। যেমন তেমন বই না, একেবারে খোদ ল্যাটিন বই। বইয়ের নাম স্তোরিয়া দে মোগোরা পুঁদিচ্চেরি বোনাঞ্জা। লেখকের নাম সিলিনি কামুচ্চি। পাওয়া যায় ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। দারুণ রেয়ার, দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর সেই বইতেই নাকি গোপন এক রহস্যের ইতিবৃত্ত ছিল। মোঙ্গলদের এককালে বিরাট বিরাট সব দাড়িগোঁফ ছিল; এক দুর্ঘটনায় তাঁরা সব হারায়। কী করে এসব হল, তার বিস্তারিত বিবরণ নারায়ণবাবু দিয়ে গেছেন চেঙ্গিস আর হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা গল্পে। যারা পড়েছেন সবাই জানেন…

কিন্তু খুঁতখুঁতে মনে প্রশ্নটা থেকেই যায়। একেবারে আকাশ থেকে কি বইয়ের নাম বাছলেন প্রাজ্ঞ পণ্ডিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়? একেবারেই না। স্তোরিয়া দে মোগোরা বইটির বাস্তব অস্তিত্ব আছে। যদিও লেখকের নাম সিলিনি কামুচ্চি না, নিকোলা মানুচ্চি। জাতে ভেনিসের লোক। ১৬৫৩ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়েসে ঘর ছেড়ে সাত বছর পরে তাঁর জাহাজ এসে ভিড়ল সুরাতের তীরে। শাহজাহান তাঁকে মুঘল রাজদরবারে দারাশিকোর সেবায় নিয়োজিত করেন। পরের তিরিশ বছর তিনি কাটান মুঘল রাজদরবারে, খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেন রাজকার্য, আর সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কয়েক খণ্ডে লেখেন তাঁর ম্যাগনাম ওপাস, স্তোরিয়া দে মোগোরা। এই মোগোরা মানে মোগলরা। সত্যি সত্যি…! কী ছিল এই স্তোরিয়া দে মোগোরা বইতে?

নিকোলা মানুচ্চি

মানুচ্চি নিজেকে ডাক্তার হিসেবে দাবি করলেও হাতুড়ে ডাক্তারের খুব বেশি কিছু ছিলেন না তিনি। তিনি নাকি শয়তানদের বশ করে রোগের চিকিৎসা করতেন। তিনি নিজেই লিখেছেন “আমার চিকিৎসার মধ্যে জাদুটোনা, ঠগবাজি, বিচ্ছিরি সব জিনিসের গন্ধ শোঁকানো, সব ছিল। যে সব মহিলারা ভরে পড়ত, আমি কায়দা করে তাঁদের প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হবার কৌশল করেও বেশ দু পয়সা কামিয়েছি।” স্তোরিয়া দে মোগোরা-র গোটা বই জুড়েই আছে নানান ডাইনিবিদ্যা, হাত সাফাই আর কালা জাদুর কথা। এমন জাদুকরও নাকি ছিল, যারা কোনও মানুষ মুরগি চুরি করে খেলে তাঁর পেটে মোরগের ডাক ডাকাতে পারতেন। শত্রুকে মারতে আফ্রিকার মতো মুঘল দরবারেও মানুষের চুল আর নখ দিয়ে তৈরি ভুডু পুতুলের ব্যবহার ব্যাপক হারে ছিল। ছিল পরকীয়া প্রেম। রুশদির “মিডনাইট চিলড্রেন” উপন্যাসটা মনে আছে? ঠিক সেইরকম একটা বড় চাদরের মাঝে ফুটো থাকত। তা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মহিলা রুগীদের চিকিৎসা করতেন তিনি। তখন নাকি কেউ কেউ সে হাতে চুমু খেত, কেউ হাত নিয়ে রাখত নিজেদের কোমল বুকে। “ভারতের মেয়েদের মধ্যে অদ্ভুত জাদু আছে। ইউরোপীয়রা সাবধান, ভারতীয় মেয়েদের পাল্লায় পড়েছ, কি গেছ!” লিখছেন মানুচ্চি। এ নিয়ে এক কাহিনীও বলেছেন তিনি। গোয়ার এক পাদ্রীকে তাঁর ভারতীয় চাকরানি নাকি এমন জাদু করেছিল, যে সেই ভদ্রলোক সেই মেয়েটি ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতেন না। একবার তিনি ডাইরিয়ায় মরমর; সবাই দেশে ফিরতে বললেও তিনি অনড়। মেয়েটিকে ছেড়ে তিনি যাবেন না। শেষে সব বুঝতে পেরে আরও কিছু পাদ্রী নাকি মেয়েটিকে অকথ্য অত্যাচার করে। ফলে মারা যাবার আগে মেয়েটি তাঁর কালা জাদু থেকে সেই পাদ্রীকে মুক্তি দেয়। আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে এক ভারতীয় মেয়েকে ভালোবাসা সেই পাদ্রীর জন্য করুণাই হয়। কিন্তু তখন বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের জন্য এ বই একেবারে হ্যান্ডবুকের মতো ছিল। মানুচ্চি আমাদের এই বাংলাতেও এসেছিলেন!! তখন ঢাকার সুবেদার ছিলেন মীর জুমলা। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঢাকা আসতে তার সময় লেগেছিল ৪০ দিন।

হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা

তবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এই গল্পে আরও দুটো বিখ্যাত মিথ আর ইতিহাসকে একেবারে ঘেঁটে “ঘ” করে দিয়েছেন। এক তো হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা… রবিনহুড আর কিং আর্থারের গল্পের মতো এই গল্পের কতটা সত্যি আর কতটা মিথ্যে, তা নিয়ে যুগে যুগে তর্ক চলছে।

ভ্লাদ দ্য ইম্পেলার

হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার গল্প আবার নতুন করে বলতে যাবার অর্থ নেই, শুধু দু একটা কথা না বললেই নয়। জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনির হ্যামেলিন শহরে এই ঘটনা যখন ঘটে সেই সালটা ছিল ১২৮৪। আর যেদিন সে শহরের সব শিশুকে নিয়ে পাহাড়ের গুহায় ঢুকে গেল সে দিনটা ছিল জুন মাসের ২৬ তারিখ। এই গল্পকে প্রথম দেখা যায় হ্যামেলিনের গির্জার জানলায়, ১৩০০ সালের দিকে। সেখানে এই করুণ ঘটনা লেখা ছিল। জানালাটা বানাবার উদ্দেশ্যই ছিল শিশুদের স্মরণ করা। জানালাটা ধ্বংস হয়ে যায় ১৬৬০ সালে, পরে ইতিহাসবিদ হ্যান্স ডবারটিন ঐতিহাসিক লেখাপত্র থেকে তথ্য জোগাড় করে এই জানালা পুনর্নির্মাণ করেন। আমরা যেরকম ‘খ্রিস্টাব্দ’ বলি, যার মাধ্যমে খ্রিস্টের জন্ম স্মরণ করা হয়, তেমনই হ্যামেলিন শহরের সরকারি ঐতিহাসিক রেকর্ড শুরুই হয় এই ঘটনা দিয়ে। ১৩৮৪ সালের লেখা পাওয়া যায়– “১০০ বছর হতে চলেছে আমাদের শিশুদের হারিয়েছি।” কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউই এই ঘটনার নিশ্চিত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। হতে পারে, ব্ল্যাক ডেথ মহামারীতে সব শিশু মারা যাওয়াতে গ্রামবাসী এই কাহিনী বানিয়েছে। ব্ল্যাক ডেথের চেহারা অবশ্য বাঁশিওয়ালার মতো না। সে দেখতে কাকের মতো। মাথায় কালো টুপি। ১৪৪০ সালের Lüneburg পাণ্ডুলিপিতে জার্মান ভাষায় এই গল্পের হদিস পাই। সেখানে লেখা এই বাঁশিওয়ালা নাকি বাচ্চাদের নিয়ে ট্রান্সিলভেনিয়া যায়। ভয়ের গল্প পাঠকদের কাছে এই নামটা পরিচিত। এখানের এক দুর্গের কাউন্টের নাম ছিল ড্রাকুলা। অবশ্য যে মানুষকে ভেবে ড্রাকুলার জন্ম, সেই ভ্লাদ দ্য ইম্পেলারের জন্ম হতে আরও ২০০ বছর বাকি। কিন্তু তার আগেও কি বাঁশিওয়ালা বাচ্চাদের রক্ত চুষে খেয়েছিল? কে জানে? বর্তমানে আমরা যে গল্পটা পড়ি, সেটা মূলত এই  উপকথা শুনে গ্রিম ভাই-দের পুনর্লিখন। তবে যে রাস্তায় শিশুদের শেষ দেখা গিয়েছিল, সে রাস্তার নাম Bungelosenstrasse (“ড্রাম ছাড়া রাস্তা”), সেখানে কোনও সঙ্গীত বাজানো আজও নিষিদ্ধ!

চেঙ্গিস খান

মুশকিল হল, নারায়ণবাবু এই ল্যাটিন বই লিখিয়েছেন ইতালীয় লেখককে দিয়ে। ঢুকিয়েছেন জার্মানির লোককথা। সঙ্গে এসেছেন চেঙ্গিস খান। ১২০৬ সালে সম্রাট তেমুজিন এই উপাধি ধারণ করেন, যার মানে “মহান” বা “ সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি”। মজাটা দেখুন, জার্মানির ঘটনা ঘটছে ১২৮৪তে, আর চেঙ্গিস মারা যাচ্ছেন ১২২৭ সালে। মানে একটাই দাঁড়ায়, হ্যামেলিনে বাচ্চাদের কিডন্যাপ করার অনেক আগে মোঙ্গলদের রাজ্যে হানা দিয়েছিল সেই বাঁশিওয়ালা। সালটা ১২১০-এর পরে হবে না, কারণ গল্প অনুযায়ী দাড়ি গোঁফ হারানোর পরেই নাকি তেমুজিন উত্তেজিত হয়ে মানুষ খুন শুরু করেন। তখন বাঁশিওয়ালার বয়স ১৮ (মানে প্রাপ্তবয়স্ক) ধরলেও ১২৮৪তে সে ৯২ বছরের বৃদ্ধ। ভাগ্য ভালো হ্যামেলিনের গল্পে বাঁশিওয়ালার বয়সের কথা নেই; কিন্তু ছবিতে যুবক একজনকেই দেখা যায়। হতে পারে সে আসল বাঁশিওয়ালার ছেলে। চেঙ্গিসের ভয়ে আসল বাঁশিওয়ালা পালিয়েছিল জার্মানিতে। এটা ঐতিহাসিক সত্যি, যে চেঙ্গিস খান ক্রমাগত রাজ্য বিস্তার করতে করতে জার্মানির সীমান্তে আসেন। আরও এগোতেন হয়তো, কিন্তু কী করবেন, হঠাৎই মারা গেলেন দুম করে। হতেই পারে তিনি আসছিলেন সেই বাঁশিওয়ালার খোঁজে। বাঁশিওয়ালা জার্মানিতে থেকে গেলেন। বিয়ে করলেন। তাঁদের এক ছেলে হল। মারা যাবার আগে সেই ছেলেকে নিজের বিদ্যা শিখিয়ে গেলেন তিনি। সে ছেলে ছিল প্রচণ্ড নিষ্ঠুর। হয়তো বা শিশুকামী। হত্যাকারী। সেও বাঁশিওয়ালার ছদ্মবেশে হ্যামেলিন থেকে শিশুদের চুরি করে নিয়ে এল পাহাড়ের অন্য পাড়ে, ট্রান্সিলভেনিয়াতে। বাচ্চাদের কী হল, না ভাবাই ভালো। কেটে গেল ২০০ বছর। এর মধ্যে সেই ছেলের পরিবার সমৃদ্ধ হয়েছে। সেই পরিবারেই একজন ছিলেন শূলে বিদ্ধকারী ভ্লাদ। যিনি জ্যান্ত অবস্থায় চামড়া খুলে নিতেন প্রেয়সীর গা থেকে, পান করতেন শিশুদের রক্ত, একবার তিনি খেতে খেতে ২০,০০০ মানুষকে শূলে চড়িয়ে তা উপভোগ করতেন মজাসে। তিনি মনে করতেন এই রক্তপানই তাঁকে এনে দেবে সুখ আর সমৃদ্ধি…..

দাঁড়ান, দাঁড়ান…. সমৃদ্ধির ইংরাজিটা কী যেন? বোনাঞ্জা…. এটাই ছিল না বইয়ের নামে? তবে কি… বিশ্বাস করুন গোটা ব্যাপারটা খুব ঘোরালো মানে টেনিদার ভাষায় পুঁদিচ্চেরি হয়ে যাচ্ছে। কালই ন্যাশনাল লাইব্রেরি ঘেঁটে দেখতে হচ্ছে; কে বলতে পারে, বিশ্বের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হতে পারে কি না!!