Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ওভার দ্য রেইনবো

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

কোনওদিন রামধনু রঙের আকাশ দেখেছ? কিংবা আকাশের দিকে ওড়া প্রজাপতিটাকে? উড়তে উড়তে একবারও কাছে যেতে পারছে না প্রজাপতিটা। তা’বলে ওর ওড়াটা তো থামবে না। ওর ইচ্ছেটা। চয়েসটা। চয়েস। কী? একটু যেন হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে? মল্লিকা বাহার। কমলকুমার। আঃ। তুমি আমার কে হও? — স্বামী। সেকশন ৩৭৭ চয়েসটুকু জানে। আর ওই ‘মুখনিঃসৃত লালা’? শোভনাদি? জগদীশ গুপ্তের ইন্দিরা আর রানু? সীমানা ডিঙিয়ে ‘অরূপের রাস’? এসব কোনও চয়েস মেনে হয় না। মহামান্য আদালত, ধন্যবাদ। চয়েস টয়েস নয়, ইচ্ছে, প্রবল, প্রবলতর এক ইচ্ছে। একটা রায়, একটা ভারডিক্ট সেই ইচ্ছেকে টিকিয়ে রাখল। জিতিয়ে দিল কি? বোধহয় না। কারণ, কোর্টের বাইরেও সমাজ বলে অসংখ্য ছোট ছোট সালিশি আদালত আছে। বাবা জেঠু আছেন। ছেলে মেয়ে ভুল পথে যাচ্ছে, বোঝানোর জন্য বিস্তর টালবাহানা এবং শেষমেশ লেসবন আইল্যান্ডের মতোই একঘরে স্বাভাবিক ছেলেমেয়েরা। তাই, জেতা বলে কিছু হয় না হয়ত। নাগপুরে সুইসাইড করা সতেরো বছরের ছেলেটার নাম প্রকাশ করা যায় না। বিদর্ভ, নাগপুরে ফরিস্তার মতো উঠে আসা আনন্দ চন্দ্রানির সারথি ট্রাস্ট বা নাজ ফাউন্ডেশনরা এমন আরও চলে যাওয়ার খবর রাখে। বাকি কেউ রাখুক, না রাখুক। মেডিকেল ফাইলে অবসাদ থাকে, বাই পোলার ডিসঅর্ডার থাকে। আর কষ্টটা? যার জন্য চলে যেতে হল, তার কোনও স্বপ্নসন্ধান? ধুর…। একটা ‘আগুন’ ধিকি ধিকি করে জ্বলে। সীতা, রাধা আর রাত্রির অন্ধকারে শরীরসর্বস্ব পৌরুষ এবং ক্ষমতায়ন। তুলি হাতে বেসিল হলওয়ার্ডের ক্যানভাস। সামনে ডোরিয়ান গ্রের ছবি। কোঁচকানো চুল, নরম আঙুল, ফর্সা মুখ। কে সুন্দর? একজন পুরুষের কাছে? আরেকজন পুরুষ। দ্য ভিঞ্চি। সালিওন। দ্য লিটল ডেভিল। স্মিত হাসির লা জাকোন্ডা। সৃষ্টি, সৃষ্টি, সৃষ্টি। আর পাশে পুরুষ, আরও এক পুরুষ। কিংবা উদ্ধত বুক, এক নারী, তার পাশে আরও এক নারী। সেই রানু আর ইন্দিরা। ‘তুই আর আমি এক হয়ে যাই’। ‘স্বামী আর স্ত্রী, সে আর আমি’। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর বুটকি, ছুটকি। মা’হারা সহোদরারা। বাবার গরিবি, দেরি করে বাড়ি ফেরা, অভাবের সংসারে দুই নিরাবরণ নারীর রাত্রিযাপন। একজনের চোখে অন্যের ঘাড়ের বাঁক, অন্যজনের কাছে চুড়োর অহঙ্কার। এসবের মাঝে দীর্ঘ হওয়া রাত্রির ঊষার দিকে ধাবমানতা। রাত্রি, ঊষা। দুই বোন, বন্ধু, মন, শরীর। হোমোসেক্সুয়াল? কেন হোমোফিল নয়? উত্তর নেই। তবে এলজিবিটি এই চারটে ইংরিজি অক্ষরের মাঝে কোনও হাইফেন নেই। আছে স্বপ্ন। সোশ্যাল মিডিয়ার কান্না। আনন্দ। ইন্দ্রানী পার্কের সামনে রাস্তাটা ধরে এখনও কোনও এক অন্যদেশের অন্ধকার পেরিয়ে হাঁটতে থাকা চিত্রাঙ্গদার হাসি। কৃষ্ণনগর কলেজের মানবী কোর্টের অর্ডারের সময়ে কী করছিলেন? বই পড়ছিলেন? পড়াচ্ছিলেন? রান্না? চুপচাপ শুয়ে থাকা? বন্ধুবান্ধব নিয়ে তুমুল আড্ডা? যেভাবেই থাকুন, যেখানেই থাকুন, একফোঁটা জল গড়িয়ে গেছিল ঠোঁটের পাশ দিয়ে, নাকের ভেতর জ্বালা করছিল। মানবী জানেন, তিনি জিতে গেলেন। এই কান্না মোছাতে কেউ যেন না আসে। কান্না, গিলবার্ট বেকার। রামধনু পতাকার মাস্টারমাইন্ড। লড়াই। মিলিটারি সার্ভিস থেকে হনারেবল ডিসচার্জ। একটা সময়ে বন্ধু হার্ভে মিল্কের সঙ্গে দেখা। ১৯৭৬। সান ফ্রান্সিস্কো প্রাইড। খোলা আকাশ। রং। পতাকা। রামধনু। আঃ। যেন কিথ জ্যারেটের সেই কবিতাটা। ‘অ্যান্ড দে আস্কড মি, ইফ আই হ্যাড আ গে পোয়েম, সো আই সেইড, ইয়েস’। কোথাও কেন বাধা নেই। লেপের ভেতর আচমকা উঠে যাওয়া আলো-অন্ধকারের খেলা নেই। উর্দু পত্রিকা আদাব-ই-লতিফের ভেতর কবরের বেড়ালের মতো শোক খুঁজে খুঁজে বেড়ানো ইসমাত চুঘতাই, আপনি নেই? সত্যিই নেই? আপনার বেগমজান, রব্বো নেই? বেরিয়ে আসুন কবর থেকে? কোথাও কোনও বাধা নেই। শুধু একটু লড়াই। আজীবন, আমৃত্যু, ওই একটু লড়াই। গানিমিদের পিতাকে দেওয়া গিফট অফ হর্সের মালিক দেবতা জিউস। এক ঈগলের ছদ্মবেশে ইডা পাহাড় থেকে তাকে ছিনিয়ে নেওয়া। সে…। গানিমিদ। দ্য লাভলিয়েস্ট ম্যান। অলিম্পাস পাহাড়ে কে ধরাবে জিউসকে স্বর্গীয় পেয়ালা? কে ছোঁয়াবে স্পর্শসুখ? ঘরে ঈর্ষায় ছটফট করা দেবী হেরা। বাকি দেবতাদের তৃপ্তি, কখনও অজ্ঞানতা, অথবা ছোটখাটো অসূয়া। আর এসবের মাঝে নির্বেদ, বজ্রকঠিন জিউস। আর তার লড়াই। যে একটু লড়াইয়ের কথা বলছিলাম, তার মিথিকাল অ্যালিউশন। আছে, এলজিবিটি শব্দ নতুন হলেও বোধটা তো নতুন না। চেতনাটাও। বিষ্ণুর মোহিনী, কিংবা অর্ধনারীশ্বর। যৌনতা বদল শুধুমাত্র কৌশলের জন্য না, এক তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো খিদের জন্যেও। চাঁদের গায়ে লেগে থাকা চাঁদে চলকে পড়া আনন্দের জন্যেও। জীবন, বেঁচে থাকা, জাস্ট একটা বেঁচে থাকার জন্যেও। ১৮৬০ সালের ব্রিটিশ আইনে যার অসহনীয় ব্যাখ্যা। আগেইন্সট দ্য নেচার। প্রকৃতি? থুঃ…? তাহলে তো বিজ্ঞান, প্রযুক্তিও প্রকৃতিবিরুদ্ধ? আধুনিকতা প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণেই বড় হচ্ছে। লালিত হচ্ছে। কে ঠিক করবে প্রকৃতি? একটা আর্কেইক ইন্ডিয়ান পেনাল কোড? নাকি মানুষ? চুলে রেইনবো পতাকা ওড়ানো যুবতী। খোলা প্যাডি ফিল্ডের পাশ দিয়ে একছুটে চলে যাওয়া ‘ওভার দ্য রেইনবো’-র জুডি গারল্যান্ড। আপনমনে কবিতার ইতিহাসচর্চায় নিমগ্ন অ্যালেন। অ্যালেন গিন্সবার্গ। ‘হু জাম্পড ইন লিমুসিন উইথ দ্য চায়নাম্যান অফ ওকলাহোমা অন দ্য ইম্পালস অফ উইন্টার মিডনাইট স্ত্রিটলাইট স্মলটাউন রেইন’। কে ঝাঁপ দিল শীতের লিমুসিনে। সে কি পুরুষ? আরেকজন পুরুষ। প্রেম, প্রবল এক প্রেমের দিকে উচ্চারিত ‘হাউল’। আঃ। তিনশ সাতাত্তর, ও তিনশ সাতাত্তর, তুমি এসব কিছুই বুঝবে না। কার্নাল প্লিজার, অ্যানাল, ওরাল — এসব শব্দবন্ধের বাইরেও জাস্ট ভালোবাসা বলে শব্দের নির্মাণ জানলে না তুমি। তাই, সমকাম থেকে গেল। সমপ্রেম হল না। আর তাতেও আপত্তি। ফ্রান্সিস মউড মনে পড়ছে। ‘তোমার সমপ্রেমে আপত্তি আছে? তাহলে নিশ্চয়ই তোমার বৃষ্টিতেও আপত্তি আছে।’ ধিক সেই দেশ যেখানে প্রেমের সংজ্ঞা চেনাতে বীরের প্রয়োজন হয়। প্রিয় পাঠক, বীরের জায়গায় কোর্ট পড়ুন। কোর্টকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে মেজরিটি কখনও ব্যক্তিগত অধিকার ঠিক করে দেবে না। মনে পড়ছে মার্ক টোয়েন। মাইনরিটি কখনও কখনও ভুল কথা বলতে পারে। কিন্তু মেজরিটি কখনওই ঠিক কথা বলে না। বলতে পারে না। কোর্টকেই উচ্চারণ করতে হয় সামাজিক নৈতিকতা একজন মানুষেরও অধিকারে যেন থাবা না বসায়। বলতে হয়, আইন বদলের প্রয়োজন, কারণ আইন মানুষের প্রয়োজন।

বাকিটুকু আগামী বলবে। আপাতত, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ধন্যবাদ। মহামান্য আদালত, ধন্যবাদ।