Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সুলতান মনসুরের ‘মুজিব কোট’ ও নরেন মোদির ‘সুভাষ টুপি’

হাসান মোরশেদ

 

গতকাল রাতে সিলেট শহরে সুলতান মনসুরের গা থেকে জোর করে মুজিব কোট খুলে নেয়া হয়েছে। না, এটা আওয়ামী লিগ বা এর অঙ্গ সংগঠনের সাংগঠনিক কাজ নয়— ছাত্রলিগ থেকে বহিষ্কৃত এক ব্যক্তির একক মিশন। হতেই পারে, বহিষ্কৃত সে ব্যক্তি দলে নিজের অবস্থান করে নেয়ার জন্য এমন চরম সুযোগ নিতে চেয়েছে। হয়ই তো এরকম।

সুলতান মনসুর আওয়ামী লিগ নেতা বা ছাত্রলিগ সভাপতি কিংবা ডাকসুর ভিপি হিসাবে যতটুকু, আমার কাছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্য একটা ভূমিকার জন্য। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে আবেগী তরুণেরা অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়েছিলেন সুলতান তাঁদের একজন। ’৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা এবং ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সমস্ত মানবিক স্খলনের পরও তাদেরকে প্রত্যেককে আমি অনন্য সম্মানের মানুষ বলেই মনে করি।

তাকে ঘিরে সিলেট অঞ্চলের আওয়ামী লিগের নেতাকর্মীদের একটা গভীর আবেগ ছিল। দীর্ঘদেহী সুলতান দেখতে অনেকটা বঙ্গবন্ধুর মতো, এই অঞ্চলের বহু নেতাকর্মীর রাজনৈতিক গুরু তিনি। আব্দুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র মতো জাতীয় নেতাদের পর সুলতান মনসুরেরই কথা ছিল জাতীয় রাজনীতিতে সিলেট অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করার। আওয়ামী লিগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লিগের সংসদ সদস্য হওয়ায় সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিহ্নও দেখা যাচ্ছিল।

কিন্তু ১/১১-এ শেখ হাসিনা যখন কারাগারে তখন আওয়ামী লিগের যে নেতারা তাঁর প্রতি অবিশ্বস্ত হয়েছিলেন সুলতান হয়ে গেলেন তাদের একজন। অবিশ্বস্ত প্রায় সকলকেই শেখ হাসিনা দলে ফিরিয়ে নিলেও সুলতানের সেই সুযোগ আর হয়নি, অনেক অনুনয়ের পরও। সুলতানের অবিশ্বস্ততা কতটা গভীর সে কেবল শেখ হাসিনাই জানেন।

সুলতান চুপ ছিলেন দীর্ঘদিন, তারপর আস্তে আস্তে ডঃ কামাল, মাহমুদুর রহমান মান্না’র সাথে ভিড়তে থাকলেন কিন্তু মুজিব কোট ছাড়লেন না। একবার সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণাও দিলেন— আওয়ামী লিগ তাকে ফিরিয়ে না নিলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক থাকবেন, মুজিব কোট ছাড়বেন না।

সেই মুজিব কোট তার গা থেকে খুলে নিল সিলেট ছাত্রলিগের এক বহিষ্কৃত কর্মী!

অবশ্য এর মধ্যে আরও বহু ঘটনাই ঘটে গেছে। ডঃ কামাল, মান্নার সঙ্গী হয়ে সম্প্রতি ‘ঐক্য প্রক্রিয়া’ নামে বিএনপি জামাতের সাথী হয়েছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুরও। মঞ্চে তাকে দেখা গেছে একই সাথে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সহ বিএনপির মহাসচিবের পাশে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ধরা হয় সেই ‘জিনিয়াস ডেভিল’দের একজন হিসাবে— যারা ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার বুদ্ধিবৃত্তিক ইন্ধন জুগিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পর এই ব্যারিস্টার খুনী মুশতাকের সাথে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিল এবং ১/১১-তে শেখ হাসিনাকে কারাগারে পাঠিয়েছিল।

ইতিহাসের অনেক ধুলো সরিয়ে এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি শুধু নয়— খুনী মেজরদের প্রশ্রয়দাতা এবং অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। এই ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম কুশীলব ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকেই আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র এজেন্ট বলে বহুল প্রচারিত।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জেনোসাইডে সিআইএ’র ভূমিকা ছিল— জেনোসাইড এক্সিকিউশনে। ২৫ মার্চ রাতে ইত্তেফাক পত্রিকা পাকিস্তান আর্মি জ্বালিয়ে দিলেও, যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ক্ষতিপূরণ দেয়— এ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যারিস্টার মইনুল একমাত্র সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি পাকিস্তানের দেয়া ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন। লক্ষ লক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ কিন্তু পায়নি। যুদ্ধের বাকি সময়ে মইনুল হোসেন কই ছিলেন, কী করেছেন? ধারণা করার যথেষ্ট যুক্তি আছে— বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রেস্ক্রিপশন ছিল সিআইএ’র। এর আগেও পৃথিবীর নানা দেশে তারা এটা করেছে। সিআইএ’র কোন দেশীয় এজেন্ট’রা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাথে ছিল? সম্প্রতি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের হত্যাকাণ্ডে কিন্তু একটা নাম পাওয়া যাচ্ছে।

মানিক মিয়ার প্রতি বন্ধুবাৎসল্যে বঙ্গবন্ধু, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদে নির্বাচিত সাংসদ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে মইনুল হোসেন প্রতিবাদ করে বের হয়ে যান, শোনা যায় সিআইএ’র নির্দেশেই এটা করেছিলেন— সিআইএ বাকশাল-এর বিরোধী ছিল। এখনকার গবেষণায় বের হয়ে আসছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সিআইএ পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাঁর বাকশাল ভাবনা থেকেই ১৯৭৪-এর মার্কিন ষড়যন্ত্রে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের সময়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিআইএ’র কোন বা কোন কোন দেশীয় এজেন্ট যুক্ত ছিল?

বঙ্গবন্ধুর খুনী মুশতাকের সাথে মিলে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন— এটা ঐতিহাসিক সত্য। খন্দকার মুশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রোধে যে ইনডেমনিটি আইন করেছিল তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও আইনি সাপোর্টে কোনও ব্যারিস্টার কি ছিল?

এই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমান আদালতের রায়ে একুশে আগস্ট শেখ হাসিনা হত্যা-প্রচেষ্টা মামলার দণ্ডিত অপরাধী। একদিকে ১৫ আগস্টের খুনী ও একুশে আগস্টের খুনী, সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের জেনোসাইডের প্রধান অপরাধী জামাতে ইসলামির রাজনৈতিক সহযোগী বিএনপির ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ডঃ কামাল হোসেন এবং তার সাথে সুলতাম মোহাম্মদ মনসুর। সুলতান তার প্রৌঢ়ত্বে সেই খুনীদের সাথে এক মঞ্চে, যে খুনীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন তারুণ্যে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রায়শই ওঠে— বঙ্গবন্ধু কি শুধুই আওয়ামী লিগের? অবশ্যই না!

আওয়ামী লিগ কখনও সে দাবি করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু নিজে সমন্বয়বাদী নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার পরের সরকার শুধু আওয়ামী লিগকে নিয়ে করেননি, তার জোট ছিল ন্যাপ ও সিপিবির সাথে। বাকশাল করেছিলেন, আওয়ামী লিগকে বিলুপ্ত করে দিয়ে সকল দলকে নিয়ে।

সমন্বয়বাদী বঙ্গবন্ধু কিন্তু জামাতে ইসলামকে নেননি বরং নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেই জামাতে ইসলামকে কোনও অবস্থাতেই ছাড়বে না বলে ঘোষণা দিল যারা, যারা ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট খুনের প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ দায়ী— বঙ্গবন্ধু কি তাদেরও? তাদের সহযোগী হয় যারা তাদের কি নৈতিক অধিকার থাকে বঙ্গবন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুর চিহ্নকে ধারণ করার?

প্রত্যক্ষভাবে বিএনপি, পরোক্ষভাবে জামাতের সাথে মিলে মুজিব কোট গায়ে দিয়ে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে সুলতান মনসুররা ঘোষণা দেন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে বিএনপি জামাতকে সঙ্গে নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। হা সেলুকাস!

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কী ছিল? রাজনৈতিক স্বাধীনতা— যা তিনি নিজে অর্জন করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আদর্শিক স্বপ্নে ছিল তার জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত হয় ১৯৭৬ সালে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করেছিলেন ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাই শুধু মুছে দেননি, মুছে দিয়েছে বাঙালির হাজার বছরের জাতিসত্তার পরিচয় ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। মহামান্য উচ্চ আদালত জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানে তাদের সব কাটাছেঁড়াও অবৈধ বলেছেন। আওয়ামী লিগ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও আরেক সামরিক শাসক এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাতিল করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের যে উলটো যাত্রা শুরু করেছিল বিএনপি সেটা এই রাষ্ট্রকে কত দীর্ঘ অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে সেই হিসাব কি করেন বিজ্ঞ ডঃ কামাল হোসেন, সুলতান মনসুরেরা?

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশকে যারা কাঁটাছেড়া করে রাষ্ট্র ও সমাজে ‘পাকিস্তানিজম’-এর বিষ ঢেলে দিয়েছে তাদেরকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথাবার্তা বলা, শুধু বঙ্গবন্ধু নয় বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি উপহাস, অপমান।

এদিকে গত ২১ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, নেতাজি সুভাষ বসুকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। ২৩ আগস্ট সুভাষ বসু দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদি সুভাষ বসু’র বিখ্যাত টুপি মাথায় চড়িয়ে সুভাষ বন্দনায় মেতেছেন।

সুভাষ মূলত কংগ্রেস নেতা ছিলেন। নেহেরু-প্যাটেলের সাথে দ্বন্দ্বে গান্ধীজি তার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন, সুভাষকে বহিষ্কার করা হয়েছিল কংগ্রেস থেকে। ভারতের কমিউনিস্টরা সুভাষ বসু’র রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। ভারত থেকে আফগানিস্তান গিয়ে প্রথমে সোভিয়েত দূতাবাসে ধর্না দিয়েছিলেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য। সোভিয়েত পাত্তা দেয়নি বলে তিনি জার্মানি গিয়ে হিটলারের সাথে দেখা করেছিলেন, তারপর জাপানিদের সাথে নিয়ে সিঙ্গাপুরে বন্দি বৃটিশ ভারতীয় সৈনিকদের ন্যাশনাল আর্মি গঠন করে ভারত আক্রমণ করেছিলেন ইংরেজ তাড়াতে।

কংগ্রেস তো বটেই, কমিউনিস্ট পার্টিও তার সমালোচনায় মুখর ছিল দীর্ঘদিন। সেই সমালোচনা ছিল ফ্যাসিস্ট জার্মান-জাপানের সহযোগী হবার। তার উদ্দেশ্য যত মহৎই থাকুক তিনি ফ্যাসিস্টদের সহযোগী হয়েছিলেন। তাকে তোজোর কুকুর বলেও গালিগালাজ করতেন কমিউনিস্টরা। আর কংগ্রেসিদের বিশেষ করে নেহেরু পরিবারের প্রতি অভিযোগ, তারা তাদের দীর্ঘ শাসনামলে সুভাষ বসুকে প্রাপ্য সম্মান তো দেয়ইনি বরং সুভাষ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য গোপন করে রেখেছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে প্রক্রিয়ায় ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সেটা আদৌ স্বাধীনতা কিনা সেই যৌক্তিক প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত সুভাষের উদ্ভাসনে। সুভাষ বসু যেখানে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন, কংগ্রেস সেখানে বৃটিশের সাথে চুক্তি করে ভারত স্বাধীন করেছে। চুক্তি করে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, স্বাধীনতা অর্জন হয় না।

তবু জনমানস থেকে, বিশেষ করে সাধারণ বাঙালিদের আবেগ থেকে সুভাষ হারিয়ে যাননি বলে, ধীরে ধীরে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টি সুভাষ বসুকে মেনে নিয়েছে, শ্রদ্ধার জায়গায় ফিরিয়ে এনেছে।

কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের সাথে সুভাষের রাজনৈতিক মতবিরোধ ছিল— শত্রুতা ছিল না, শত্রুতা ছিল বিজেপির আদি সংগঠন আরএসএস-এর সাথে। কলকাতায় আরএসএস-এর নেতা শ্যামাপ্রসাদকে পিটিয়েছেন সুভাষ বসু। হিন্দুত্ববাদকে ভারতের মানুষের স্বাধীনতার প্রধান শত্রু বলে গণ্য করতেন সুভাষ। আরএসএস-এর প্রকাশনায় সুভাষকে রাবণ বানিয়ে কার্টুন আঁকা হয়েছে যেখানে শ্যাম্যাপ্রসাদ আর সাভারকার তার মুখে তীর ছুঁড়ছে।

আরএসএস সরাসরিই বৃটিশের দালালি করেছিল। সদ্য প্রয়াত ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি ১৯৪২ সালে ”ভারত ছাড়ো আন্দোলন” চলাকালীন উত্তর প্রদেশের ‘বটেশ্বর’ গ্রামে গুপ্তচরবৃত্তি করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরিয়ে দেন। সাভারকার আন্দামান জেল থেকে নিজের মুক্তির স্বার্থে মুচলেকা দিয়ে রাজসাক্ষী হয়ে তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দেন। এম এস গোলওয়ালকরও বৃটিশদের দালালি করতেন। ইনি বলেছিলেন যে, হিন্দুদের বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শক্তি অপচয় না করে সেই শক্তি সঞ্চয় করা উচিত, ভারতের প্রধান শত্রু মুসলমান, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। নাথুরাম গডসে তো মহাত্মা গান্ধীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাই করল। এরা প্রত্যেকেই হিন্দুত্ববাদী আরএসএস তথা বিজেপির আত্মা।

সুভাষ বসু যখন ভারতীয় হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ সবাইকে নিয়ে দখলদার ইংরেজের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করছেন হিন্দুত্ববাদী নেতা সাভারকার তখন হিন্দু যুবকদের আহ্বান জানিয়েছে ইংরেজদের দলে ঢুকে সুভাষকে প্রতিহত করতে।

কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা যখন সুভাষকে গ্রহণ করে তখন সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু আরএসএস-এর সহযোগী, হিন্দুত্ববাদের অ্যাজেন্ডাধারী বিজেপি যখন সুভাষ বন্দনায় মাতে— গুজরাট গণহত্যার খুনী নরেন্দ্র মোদি যখন সুভাষ টুপি মাথায় তোলে তখন বুঝে নিতে হয়, এরা সুভাষকে সম্মান করছে না, সুভাষকে ব্যবহার করছে নিজেদের ধান্দায়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মহাত্মা গান্ধীকে সম্মান জানিয়ে তার মতো চরকা কাটেন, গান্ধীর খুনী নাথুরাম আর তার হিন্দুত্ববাদকেও সাথে রাখেন।

বিজেপির সাম্প্রতিক ‘সুভাষ বিক্রি’র ধান্দা বুঝতে পারা খুব জটিল না। হিন্দুত্ববাদ বিক্রি করে একসময়ের অসাম্প্রদায়িক ত্রিপুরায় ক্ষমতায় তারা এসেছে, অসমে আবার ধর্মীয় বিভাজনের চেয়ে জাতিগত বিভাজনের বাজার ভালো তাই সেখানে উগ্র অহমিয়া জাতীয়তাবাদীদের খুশি করতে ৪০ লক্ষ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করেছে।  বাংলার সাধারণ মানুষের আবেগে এখনও সুভাষ বসু রয়ে গেছেন। তাই এখানে আগামী নির্বাচনে যেমন হিন্দুত্ববাদ বিক্রি হবে আইটেম হিসাবে, তার সাথে সাথে আইটেম হিসাবে বিক্রি হবেন সুভাষ বসু।

নরেন্দ্র মোদিও নিশ্চয় বিজেপি আরএসএস-এর মঞ্চ থেকে সুভাষ বসুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের বক্তৃতা দিয়েছেন।

সুভাষের স্বপ্ন কী ছিল?

তাঁর স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অন্যতম কমান্ডাররা ছিলেন— মেজর জেনারেল মুহম্মদ জামান কিয়ানি, মেজর জেনারেল শাহ নওয়াজ খান, মেজর আবিদ হাসান সাফরানি, কর্নেল শওকত মালিক, কর্নেল প্রেম শেহগাল। সুভাষের স্বপ্নে হিন্দুত্ববাদ ছিল না, গুজরাট ছিল না, মুসলমান বলে স্বয়ং রাজধানী দিল্লিতে আটবছরের কিশোরকে পিটিয়ে মারা ছিল না, অসমে ৪০ লক্ষ বাঙালি নির্যাতন ছিল না।

মুজিব কোট গায়ে দিয়ে সুলতান মনসুরেরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে না বরং তাকে আইটেম হিসাবে বিক্রি করতে চায়। নরেন্দ্র মোদি ‘সুভাষ টুপি’ মাথায় দিয়ে সুভাষ বসুকে সম্মান জানায় না, তাকে বিক্রির ধান্দা করে।

কেউ যদি এই ধান্দার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নরেন মোদির মাথা থেকে সুভাষ টুপি ছিনিয়ে নেয়, আমি একে অঘটন ভাবব না।

হয়তো তাই হওয়া উচিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাঁর রাজনৈতিক আদর্শদের একজন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু’র স্বপ্নের বাঙালি দালাল নয়, মানুষ। সাহসী মানুষ।