Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র নিয়ে কিছু কথা যা বলা দরকার

কৌশিক দত্ত

 

মাত্র ক’মাস আগে মহারাষ্ট্র পুলিশের বুদ্ধিজীবী পাকড়াও অভিযান নিয়ে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। রাজ্যস্তরে সাম্প্রতিক একটি (বলা ভালো এক জোড়া) পুলিশি অভিযানের ঘটনা খানিক শোরগোল তুলেও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আমবাঙালির (অ)রাজনৈতিক অশোভন কৌতূহলের অকালবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেল। কিন্তু উড়ে গেলেও সবকিছু বিলীন হয়ে যায় না। যাঁরা মানবাধিকার আন্দোলন অথবা বাম রাজনীতির মধ্যে কোনও একটার (বা দুটোর) সঙ্গে জড়িত, তাঁরা আলোচনা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন এসব ঝোড়ো শব্দের মধ্যেই, কিন্তু সংবাদমাধ্যম ব্যস্ত থাকায় বিশেষ ফুটেজ পেল না গোয়ালতোড় থেকে চারজন এবং রবীন্দ্রসদন চত্বর থেকে আরও কয়েকজনের গ্রেপ্তার হবার খবর বা তদবিষয়ক আলোচনা। যেহেতু কবি-বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তারের প্রেক্ষিতে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মেই একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল এই রাজ্যে ঘটা একইরকম এই ঘটনায় আমার প্রতিক্রিয়া কী?

প্রশ্নটি সঙ্গত এবং উত্তর দেবার দায়ও থাকে। কিন্তু প্রশ্ন সহজ হলেও উত্তর দেবার কাজটি কঠিন। সেই চেষ্টা শুরু করার আগে কিছু প্রাককথন প্রয়োজন।

১) বৃহৎ প্রেক্ষিতে দেখলে এই দুটি ঘটনা চরিত্রগতভাবে অনেকটা একইরকম হলেও অনুপুঙ্খ বিচারে কিছু পার্থক্য আছে, যেমন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কাজকর্মের সঙ্গে রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষের বা কবি-অধ্যাপকদের কাজকর্মের অভিমুখ, পদ্ধতি, উদ্দেশ্য, ইত্যাদির পার্থক্য থাকে, যার দরুণ প্রশাসকের কাছ থেকে তাঁরা আলাদা ধরনের সুবিধা বা নিষেধ পেয়ে থাকেন। উভয়েরই কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার আছে, যা তাঁরা দাবি করতে পারেন। উভয়েই রাষ্ট্রের (বা ক্ষমতাবানের) দমনের শিকার হতে পারেন। তেমন হলে উভয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন, যদিও তার ধরন কিছুটা আলাদা হয়, যে তফাৎ সংগঠিত হওয়া বা না হওয়ার দ্বারা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। সন্দেহ নেই, আলোচ্য দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই শাসকের তরফে ক্ষমতার আস্ফালন ছিল এবং একটি বিশেষ ধরনের বামপন্থী রাজনীতির প্রতি রাষ্টের ভীতি প্রকাশ পেয়েছে দুটি ঘটনাতেই, আলোচনার বদলে অবদমনে আস্থাও প্রকাশ পেয়েছে, তবু এই মিলগুলির ভিত্তিতে সমীকরণে পৌঁছনোর সময় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে এক্ষেত্রে এক এবং দুই বেশ খানিকটা একরকম হলেও সর্বসম নয়।

২) লজ্জাজনক সত্যি হল, গোয়ালতোড় বা রবীন্দ্রসদন থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্র ও অন্যান্য ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে আমি প্রায় কিছুই জানি না এবং ঘটনা দুটি সম্বন্ধে আমার জানার পরিধি খুবই ছোট। ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত কিছু খবরের কাগজের রিপোর্ট এবং ফেসবুকে দু’-একজনের পোস্ট থেকে সামান্য কিছু কথা জানতে পেরেছি। গোয়ালতোড় থেকে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সব্যসাচী গোস্বামীর বয়স পঞ্চাশ। বাকি তিনজন তরুণ। তেইশ বছর বয়সী দুজন, অর্কদীপ গোস্বামী বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, টিপু সুলতান (স্বপন) সংস্কৃত কলেজে গবেষণারত। চতুর্থজন সঞ্জীব মজুমদার এক চব্বিশ বছর বয়সী তরুণ, যিনি নিজেকে মানবাধিকার কর্মী বলেছেন। দুজন ইউডিএসএফ-এর কর্মী বা প্রাক্তন কর্মী বলে পরিচিত। এঁদের মুক্তির দাবিতে রবীন্দ্রসদনের সামনে প্রতিবাদ সভা এবং লিফলেট বিলি হয়। সেখান থেকেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে কোলকাতা পুলিশ। এই অব্দি জানতে পেরেছি। রবীন্দ্রসদনের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া ছাত্রদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁদের শুধুমাত্র ডিটেইন করা হয়েছিল নাকি কেস দিয়ে জামিনে ছাড়া হয়েছে, সেই বিষয়েও পরস্পরবিরোধী খবর পেয়েছি।

এত কম জেনে এই বিষয়টিতে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সঙ্গত বা সম্ভব না। সুতরাং এই ঘটনা উপলক্ষে কয়েকটা সাধারণ ভাবনার কথা বলব সংক্ষেপে।

প্রথম প্রশ্ন হল, পুলিশ কি এভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে বুঝতে হবে পুলিশের কাছে (বা রাষ্ট্রের কাছে) আমরা কী চাই? মোটের ওপর আমরা চাই আমাদের স্বার্থরক্ষায় রাষ্ট্র আমাদের পাশে থাকুক। তার মধ্যে একটা অংশ হল আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের প্রতি রাষ্ট্র ও পুলিশ সম্মান বজায় রাখুক, আর একটা অংশ হল এই প্রত্যাশা যে রাষ্ট্র আমাদের শরীর, সম্পদ (সে সামান্য একটা তোরঙ্গ বা কম্বল বিছানা হলেও) ইত্যাদির নিরাপত্তা বিধান করবে। প্রথমটির জন্য পুলিশ না হলেও চলে (বস্তুত না হলেই সুবিধে), দ্বিতীয়টির জন্য পুলিশের প্রয়োজন। চরম বামপন্থী, রাষ্ট্রের সমালোচক ব্যক্তিদেরও দেখেছি “ল অ্যান্ড অর্ডার”-এর দুরবস্থা নিয়ে রাষ্ট্রকে বেশ বকে দেন। অ্যানার্কিস্টরাও দুর্বল মুহূর্তে বিশুদ্ধ অ্যানার্কিতে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ধনী ও শাসকের স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য পুলিশ ও মিলিটারির সৃষ্টি হলেও সাধারণ প্রজার মনে নিরাপত্তার এই চাহিদা এই বাহিনীগুলির টিকে থাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। পুলিশ ব্যবস্থাটি শুধুই কোয়ার্শন নয়, তার মধ্যে নিহিত আছে আমাদের কনসেন্টও।

বহু বছর আগে দেখা কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের সামনের রাস্তায় একটি জমায়েতের কথা মনে পড়ছে। সোনি সোরির ওপর অত্যাচারকারীদের বিরুদ্ধে পথসভা হচ্ছিল। একটি পোস্টার মনে গেঁথে আছে, যাতে লেখা ছিল, “অঙ্কিত গর্গের ফাঁসি চাই, রাষ্ট্র তুমি ধর্ষক।” এই একটি পোস্টার রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের বহুমাত্রিক গতিশীল সম্পর্কটিকে সামনে এনে দেয়। রাষ্ট্রকে অবদমনকারী, ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা হচ্ছে, আবার তার কাছেই জনৈক অত্যাচারকারীর শাস্তি দাবি করা হচ্ছে, বিচারের জন্য সেই রাষ্ট্রের ওপরেই ভরসা রাখা হচ্ছে, এমনকি অপরাধীর শাস্তির তথা অত্যাচারিতার সুবিচারপ্রাপ্তির জন্য রাষ্ট্রের অবদমনকারী শক্তিকেই অস্ত্র করা হচ্ছে, চাওয়া হচ্ছে সেই শক্তির চরমতম প্রকাশ (জুডিশিয়াল কিলিং)। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক এরকমই। এটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌন্দর্য।

সুতরাং রাষ্ট্র এই বিচার, সুরক্ষা ইত্যাদি দেবার জন্য কাগজে-কলমে দায়বদ্ধ এবং তার জন্য কোর্ট, পুলিশ, সেনাবাহিনী জাতীয় কিছু প্রতিষ্ঠান থাকবে, সে তারা কর্ম-অকর্ম-বিকর্ম যাই করুক না কেন। যেহেতু শুধুমাত্র অপরাধ সংঘটিত হবার পর বিচার ও শাস্তি চাওয়া হয় না, অপরাধের আগেই আগাম নিরাপত্তা আমরা প্রত্যাশা করি, সুতরাং গোয়েন্দা সংস্থার (ইন্টেলিজেন্স) কাজ এবং আগাম খবরের ভিত্তিতে অপরাধ আটকানোর বা সম্ভাব্য অপরাধীকে গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়াকে আমরা আসলে স্বীকৃতি দিয়েই রেখেছি। একথা অস্বীকার করলে শঠতা হবে এবং এই সুযোগ পুলিশকে না দিয়ে রাখলে নিরাপত্তার অনেক দাবিই ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এহেন ক্ষমতাসম্পন্ন পুলিশ বাহিনীর কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণে রাখাও প্রয়োজন আইনসভা, আদালত এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কারণ অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা পুলিশ বাহিনীকেই সবচেয়ে বড় গুণ্ডা বাহিনীতে পরিণত করতে পারে। এই ভারসাম্য রক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু পুলিশের জন্য নয়, সব শক্তিধরের জন্যই অবশ্য একথা প্রযোজ্য, এমনকি সমাজ বদলানোর বিপ্লবে সামিল যোদ্ধাদের জন্যও। নীৎশে বলেছিলেন, যে দানবের সাথে লড়ে, তাকে বিশেষ যত্নবান হতে হবে যাতে সে নিজেই দানব না হয়ে ওঠে। ডাকাত-খুনি-ধর্ষকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো পিস্তলধারী খাকি উর্দি পুলিশ থেকে জমিদার-জমি মাফিয়া-মহাজনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বন্দুকধারী বিপ্লবী, সকলেই সৎভাবে একথা খেয়াল রাখলে ভালো হয়।

সুতরাং পুলিশ সন্দেহজনক মানুষকে গ্রেপ্তার করতে পারে, কিন্তু তার একটা গ্রহণযোগ্য নিয়ম থাকা উচিত। কাকে কখন কেন সন্দেহ করা হল, কেন কীভাবে গ্রেপ্তার করা হল, গ্রেপ্তারের পর তাদের সঙ্গে কী ব্যবহার করা হল, সেসব ব্যাপারে মানুষ এবং আদালতকে কৈফিয়ত দেবার দায় পুলিশের থাকা উচিত। এই পুরো পদ্ধতিটার মধ্যে গুরুতর অন্যায় করলে তা শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। এই ঔচিত্যগুলো মিলেই গণতন্ত্রের ধর্মগ্রন্থ তৈরি হয়। জাতীয় সুরক্ষার ধুয়ো তুলে এই নীতিগুলোকে ক্রমাগত অবহেলা করতে থাকলে সংবিধানের অপমান করা হয়।

আইজ়ি (ওয়েস্টার্ন রেঞ্জ) রাজীব মিশ্র চারজনকে গ্রেপ্তার করার কারণ হিসেবে বলেছেন যে তাঁরা গোয়ালতোড়ে উপস্থিত হবার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারেননি। ধরেই নিচ্ছি, চারজন রাজনৈতিক ব্যক্তি সেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলেন, বেড়াতে যাননি। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কেউ কোথাও গেলেই কি তাকে গ্রেপ্তার করা যায়? কোথাও যাবার গ্রহণযোগ্য কারণের কি কোনও তালিকা আছে সংবিধানে? মনোমতো কারণ দেখাতে না পারা কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ? রাজনৈতিক বক্তব্য রাখা বা লিফলেট বিলি করাও কি শাস্তিযোগ্য?

ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নং অনুচ্ছেদ বলছে:

(1) All citizens shall have the right –

  • To freedom of speech and expression;
  • To assemble peaceably and without arms;
  • To form associations or unions [or co-operative societies];
  • To move freely throughout the territory of India;
  • To reside and settle in any part of India; and
  • To practice any profession, or to carry on any occupation, trade or business.

অতএব আইজির বক্তব্য সংবিধানের ১৯ নং অনুচ্ছেদের ১-র ক, খ ও ঘ ধারার অবমাননা করছে। এর মধ্যে অবশ্য কিছু “কিন্তু” আছে। শান্তিপূর্ণ জমায়েত অনুমোদিত হলেও হিংসাত্মক জমায়েত অনুমোদিত নয়। হিংসাত্মক ঘটনা এঁরা ঘটিয়েছেন, এমন কথা পুলিশ প্রকাশ্যে বলেনি। এঁদের কাছে অস্ত্র থেকে থাকলে, এঁরা অবশ্যই গ্রেপ্তারযোগ্য। কিন্তু অস্ত্র পাওয়া যায়নি, পাওয়া গিয়েছে নাকি মাওবাদী সাহিত্য। কোলকাতা থেকে জঙ্গলে অত সাহিত্য এঁরা কেন বয়ে নিয়ে গেলেন, সেই প্রশ্ন তুলছি না। গুরুতর প্রশ্ন হল, সাহিত্য কি অস্ত্র? কোনও নির্দিষ্ট সাহিত্য পাঠ কি বেআইনি? মাও-এর বই পড়ার সঙ্গে অস্ত্রসঞ্চালনার কি কোনও সরাসরি সম্পর্ক আছে? আমার পরিচিত এক কঠোর বামপন্থীর বাড়িতে আমি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত চার-পাঁচটি বই দেখেছি, আবার নিষ্ঠ দক্ষিণপন্থী অর্থনীতিবিদের বাড়িতে দেখেছি “ক্যাপিটাল” এবং মার্ক্স-এঙ্গেলস রচনাবলি শোভা পাচ্ছে। আমি অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক হলেও আমার বাড়িতে আয়ুর্বেদ, আকুপাংচার, ইত্যাদির বই আছে। অর্থাৎ বিভিন্ন চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়া জ্ঞান আহরণের একটি সুস্থ প্রক্রিয়া।

না, আমি প্রমাণ করতে চাইছি না যে ধৃত ব্যক্তিরা মাওবাদী নন। এঁদের চিনি না, রাজনৈতিক আলোচনা হয়নি কখনও। সোশাল মিডিয়ায় গত কয়েকদিনে এঁদের রাজনীতি সম্বন্ধে যেটুকু দেখেছি, তাতে মাওবাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাই সম্ভব। আমার আপত্তি পুলিশের যুক্তি দেখানোর ধরন নিয়ে। ঠিক যেমন এঁরা নিজেদের গোয়ালতোড় যাত্রার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি, তেমনি পুলিশ অধিকর্তারাও নিজেদের কাজের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে খুবই কম নম্বর পেলেন। ভারতের কোনও একটি জায়গায় (নিষিদ্ধ জায়গা ছাড়া), নির্দিষ্ট সাহিত্য পাঠ, বা কিছু কথাবার্তা বলা, মানুষের সঙ্গে দেখা করা বা মেশা, ইত্যাদি সংবিধানসম্মতভাবে শাস্তিযোগ্য হতে পারে না। এগুলোকে কারণ বলে মেনে নিলে বহু জ্ঞানান্বেষী, ভ্রমণকারী, সার্ভে দলের সদস্য, মানবাধিকার কর্মী, উন্নয়ন কর্মী ভবিষ্যতে গ্রেপ্তার হতে থাকবেন অকারণে বা অসৎ কারণে। পুলিশ এঁদের যে গ্রেপ্তার করেছেন, তা ন্যায়সঙ্গত হতেই পারে, কিন্তু পুলিশের উচিত সংবিধানসম্মত কারণ দেখানো অভ্যাস করা, কারণ সেটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে স্বাস্থ্যকর। “যা করেছি, বেশ করেছি” ধরনের মনোভাব গুণ্ডাদের মানায়, শান্তিরক্ষকদের মানায় না।

ঘটনা হল, সংবিধানের ১৯ নং অনুচ্ছেদের সবটা বলা হয়নি।

(2) Nothing in sub-clause (a) of clause (1) shall affect the operation of any existing law, or prevent the state from making a law, in so far as such law imposes reasonable restrictions on the exercise of the right conferred by the said sub-clause in the interests of the sovereignty and integrity of India, the security of the State, friendly relations with foreign states, public order, decency or morality, or in relation to contempt of court, defamation or incitement of an offence.

এভাবে ক্রমান্বয়ে অন্য অংশগুলির ক্ষেত্রেও রেস্ট্রিকশন আরোপ করার কথা বলা আছে নানা কারণে, যেমন sub-clause “d” আর “e” এর ক্ষেত্রে তফসিলি উপজাতিদের স্বার্থরক্ষা একটি কারণ হিসেবে এসেছে। অর্থাৎ উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্র ব্যক্তির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে, কিন্তু উপযুক্ত কারণ দেখানো গুরুত্বপূর্ণ।

লিফলেট বিলি করা কোনও বক্তব্য রাখা অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে কিনা, সেই বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বাকস্বাধীনতার ধারণা। গণতন্ত্রে বাকস্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ বললে কম বলা হয়। প্রশ্ন করার, মত প্রকাশ করার, সমালোচনা করার স্বাধীনতা সকলের থাকা চাই। আপনার সঙ্গে আমার মতের আমূল অমিল থাকতে পারে, আপনার মতকে আমি যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করব, কিন্তু আপনার মত প্রকাশের অধিকারকে আমি সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করব। এটাই গণতন্ত্রের দর্শন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে রাষ্ট্র এবং বেশ কিছু বিপ্লবী সংগঠন এই দর্শন মানেন না, যদিও ভারতীয় সংবিধান শর্তসাপেক্ষে এই অধিকার স্বীকার করেছেন এবং রাষ্টের দায়িত্ব সংবিধান-অনুগ হওয়া।

“শর্তসাপেক্ষে” ব্যাপারটা নিয়েও অনেকের আপত্তি আছে। কিছু বুদ্ধিজীবী যেকোনও পরিস্থিতিতে যেকোনও কথা বলার অধিকারে বিশ্বাসী। তাঁরা ধরে নেন, কথার নিজস্ব কোনও শক্তি নেই, অতএব কথা কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করে না, সুতরাং ক্ষতি করে না। তাই কথায় লাগাম দেবার প্রয়োজন নেই। এঁরা শরীর তথা নিউটনীয় বলবিদ্যায় বড় বেশি আস্থাশীল। একমাত্র শারীরিকভাবে আঘাত করেই ক্ষতি করা যায়, এই বিশ্বাস। কথার দ্বারা শারীরিক ক্ষতি ঘটানো যায়, এই সত্যটাও বিশ্বাস করেন না। তাহলে যে পুলিশ অফিসার নিরস্ত্র মিছিলের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন, বা বন্দিনীর যৌনাঙ্গে পাথর ঢোকানোর নির্দেশ দিলেন কিন্তু নিজে হাতে কিছু করলেন না, তাঁদের কি বাকস্বাধীনতার অজুহাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। কাউকে গ্রেপ্তার করে হাবিজাবি কারণ দেখানোও কি পুলিশের বাকস্বাধীনতা তাহলে? অত সরল নয় ব্যাপারটা। বক্তৃতার মাধ্যমে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করলে, বা লিফলেটে খুনে হুমকি দিলে, তা নিশ্চয় শাস্তিযোগ্য। এঁদের লিফলেটে কি ছিল জানার সুযোগ পাইনি, কিন্তু সরাসরি হিংস্রতার উস্কানি যদি না থেকে থাকে, তবে শুধুমাত্র লিফলেট বিলি করা অপরাধ হতে পারে না।

এছাড়া আছে কিছু পদ্ধতিগত সমস্যা। পুলিশ কারও বাড়িতে তল্লাশি করতেই পারে, কিন্তু কোন সময় কীভাবে তল্লাশি হবে, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হবে, তার কিছু নিয়ম আছে। পুলিশকর্মীরা নিজেদের শরীর আগে তল্লাশি করিয়ে তারপর প্রবেশ করবেন, এটাই নিয়ম। নইলে তাঁরা পকেটে করে কোকেন নিয়ে গিয়ে ববি হাকিমের বাড়িতে সেটা রেখে নতুন মেয়রকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যে মামলায় ফাঁসাতে পারেন। আবার আগামীকাল মুকুল রায়কে থানায় ডেকে নিয়ে যতেই পারেন, কিন্তু সেখানে তাঁর মুখে ঘুষি মেরে চোখ ফুলিয়ে দিতে পারেন না। শোনা যাচ্ছে এই ক্ষেত্রে এই নিয়মগুলো পালিত হয়নি। আশ্চর্য হবার মতো কিছু নয়, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ এসব নিয়মের তোয়াক্কা করে না।

আমরা দেশে শান্তি চাই, নাশকতা চাই না। কেন এরকম চাই বা চাই না? আমাদের দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে চাই বলে। সেই গণতান্ত্রিক পরিবেশটাই যদি নিষ্ঠা সহকারে নষ্ট করে দেওয়া হয়, তবে শান্তিপ্রিয় জনগণের ভরসার মূলোচ্ছেদ করা হয়। শান্তিরক্ষার জন্য শান্তিরক্ষা বাহিনী নিশ্চয় সক্রিয় থাকবেন, কিন্তু সৌদি সুলতানের ব্যক্তিগত বরকন্দাজ বাহিনীর সঙ্গে আমাদের দেশের পুলিশের কিছু মৌলিক তফাৎ তো থাকতেই হবে? গুপ্তহত্যা বা জবরদস্তির দ্বারা নয়, সভ্য পৃথিবীর পুলিশ কাজ করুক গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে। তবেই রাজনীতিও হতে পারবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। সেখানেও বন্দুকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে।