Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এক উজ্জ্বল সূর্যালোকের খোঁজে ফরাসি জনতা

সুশোভন ধর

 

আবার প্যারিসের রাস্তা। আবার বিদ্রোহের খোশবাই। এবং আবার সেই আশার আলোকবর্তিকা, যা এই প্রগাঢ় শীতের মধ্যেও উজ্জ্বল সূর্যরশ্মির মতো। প্রতিবাদ, ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে রাস্তায়। প্রতিদিনই দলে দলে মানুষ যোগ দিচ্ছেন এই প্রতিরোধ আন্দোলনে। আন্দোলনের পোশাকি নাম ‘ম্যুভমঁ জিলে জোন’ বা ‘হলুদ পোশাকের আন্দোলন’। হলুদ হাতকাটা জ্যাকেট— মোটরচালকেরা পথসুরক্ষার জন্য যা পরেন— এই আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এতে সামিল আপাতত হাজার হাজার জনতা। তাঁরা ক্ষুব্ধ, তাঁরা ক্রুদ্ধ। ক্ষুব্ধ তাঁদের ক্রয়ক্ষমতার ক্রমাগত পতন দেখে, ক্রুদ্ধ অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে। তবে কি ১৯৬৮-র ভূত আবার তাড়া করল প্যারিসকে? অনেক বিশ্লেষকের মতেই কিন্তু গত ৫০ বছরে ফ্রান্স এই ধরনের জঙ্গি আন্দোলন দেখেনি। মোদ্দা কথায়, ফরাসি জনগণের জীবনযাত্রার মান ক্রমশ নিম্নমুখী হওয়ার ফলে সমাজে যে এক বিপুল ক্ষোভ জমে উঠেছে, এই সত্যকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা কেউই দেখাতে পারছে না।

আন্দোলনের প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, বিতর্ক থাকতে পারে এর দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করে ফেলতে পারার ক্ষমতা নিয়েও। এসব সত্ত্বেও ঐতিহাসিক মে ৬৮-র একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক আল্যাঁ ক্রিভিন কিন্তু তাঁদের আন্দোলনের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁর মতে, শাসক দলের কর্তাব্যক্তিদের এই গণপ্রত্যাখ্যান সেই আন্দোলনেরও অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। মিল আরও আছে। যেমন রাজনৈতিক পার্টি এবং ইউনিয়নগুলিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান, যেমন আন্দোলনের পেছনে কোনও সংগঠিত শক্তি না থাকা। অন্যদিকে, ১৯৬৮-র আন্দোলনের যা চরিত্র-নির্দেশক— পরিবর্তনের দাবিতে এক দুর্বার যুব আন্দোলন— তা এই আন্দোলনে এখনও সেভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে না। দেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্রোধকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে এই রাস্তায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে।

ক্ষোভের বিস্ফোরণ

শুরু ২০১৭-র নভেম্বরে। পেট্রোল-ডিজেলের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে তখন থেকেই রাস্তায় নামতে শুরু করে ফরাসি জনগণ। কার্বন নিঃসরণ কমানোর অজুহাত দেখিয়ে ফরাসি সরকার তেলের ওপর একদফা কর বসায় গত অক্টোবরে। এটা ইন্ধনের কাজ করলেও মানুষের ক্ষোভ কেবল এই মূল্যবৃদ্ধিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, একদিকে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ভাড়া, স্বাস্থ্যবীমা, গ্যাস সমস্ত কিছুরই দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে; আর অন্যদিকে বেতনবৃদ্ধি দীর্ঘদিন বন্ধ, কমিয়ে দেওয়া হয়েছে অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন এবং প্রাপ্য অন্যান্য সুযোগসুবিধাও।

সরকার যতই তোতাপাখির মতো আউড়ে যাক না কেন যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, তা শুনতে আর প্রায় কেউই রাজি ছিলেন না। গত মে মাসে জ্বালানির দাম কমানোর দাবিতে সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব ছাড়াই একটি অনলাইন পিটিশন ছাড়া হয়, এবং শুধু সোশাল মিডিয়াতেই অক্টোবরের মাঝামাঝি নাগাদ তাতে ৩ লক্ষ মানুষ স্বাক্ষর করেন। প্রথম বিক্ষোভ প্রদর্শনেই গোটা ফ্রান্সে তিন লাখ মানুষ পথে নেমেছিলেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় যথারীতি, এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন হিংসাত্মক চেহারা নিতে থাকে। এবার বাজারে নামে শাসকের পেটোয়া সংবাদমাধ্যম। আন্দোলনকারীদের নামে কুৎসা ছড়িয়ে জনগণের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা সহ, যেমন হয় আর কী!

আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশি হামলার একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। দেখা যায়, গত ১লা ডিসেম্বরের বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশ কীভাবে এক নিরীহ পথচারীকে নির্দয়ভাবে পেটাচ্ছে। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় এবং চোখে অস্ত্রোপচার হয়। এই ধরনের দৃশ্য উপেক্ষা করে সরকারি মিডিয়া যথারীতি কয়েকজন আন্দোলনকারীর হাতে একজন পুলিশকর্মীর আক্রান্ত হওয়ার ছবি ছড়াতে থাকে। সরকারও সেই ছবিটিকে ঢাল বানিয়ে প্রচারে নামে যে আন্দোলনকারীরা হিংসার আশ্রয় নিচ্ছে।

হিংসা না ছাড়?

ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাস্তানের গোঁয়ারের মতো আন্দোলনকে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিলেন। কিন্তু লাভ হল না। না তিনি, না সরকারের পেটোয়া সংবাদমাধ্যম কেউই এই আন্দোলনকে কলঙ্কিত করতে পারল না। নত হতে হল সরকারকেই। তাদের যাবতীয় হম্বিতম্বি ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার ঘোষণা করল আগামী অন্তত ৬ মাস কোনও জ্বালানির দাম আর বাড়বে না। এ যাবৎ দেড় বছরের মেয়াদকালে রাষ্ট্রপতি এমান্যুয়েল মাক্রঁর সরকারের এটাই প্রথম বড় মাপের পিছু হটা। জানুয়ারিতে যে করবৃদ্ধি প্রস্তাবিত ছিল সেটিও রদ করা হয়েছে। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী শ্রমজীবী দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত জনতাকে সহযোগিতা করার কথাও ঘোষণা করেছেন।

ফরাসি সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে ঘোষণা করেছে যে তারা উচ্চবিত্তদের থেকে কর আদায় পুনরায় চালু করার কথাও বিবেচনা করছে। এই কর এমান্যুয়েল মাক্রঁ ২০১৭-তে জিতে ক্ষমতায় আসার পর মকুব করে দিয়েছিলেন। এটিও আন্দোলনের অন্যতম দাবি। আগেই বলেছি, আন্দোলন কেবলমাত্র জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবিতেই আর নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। উচ্চবিত্তদের থেকে এই আইএসএফ (ISF) সম্পত্তি কর রদ করা মাক্রঁর ভোট প্রচারের একটি প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল, এর মাধ্যমেই তিনি পুঁজিপতি এবং অন্যান্য এলিটদের প্রতি তাঁর বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছিলেন। এই করটির বৈশিষ্ট্য হল, এটি অন্যান্য করের মতো উপার্জনের ওপর ধার্য না হয়ে সম্পত্তির ওপর ধার্য হয় এবং ১,৩১০,০০০ ইউরোর বেশি সম্পত্তি যাদের আছে তারাই এর আওতায় আসে।

আন্দোলন পাশের দেশ বেলজিয়ামেও ছড়িয়েছে। ৩০শে নভেম্বর ব্রাসেলসে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জলকামান ব্যবহার করেছে, ব্যাপক ধরপাকড়ও চালিয়েছে। সার্বিয়ার এক বিরোধী সাংসদ সংসদে বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়লে হলুদ জামা আন্দোলন বেলগ্রেডের রাস্তাতেও আছড়ে পড়বে। নেদারল্যান্ডসেও আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। আগামী মাসে ২০১১-র তাহরির স্কোয়ার অভ্যুত্থান বার্ষিকীতে যেন আবার ফরাসি কায়দায় হলুদ পোশাকের প্রতিবাদ না শুরু হয়ে যায় এই আশঙ্কায় মিশর সরকার এই পোশাক বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে।

যাইহোক, আন্দোলনের ভরকেন্দ্র এখনও ফ্রান্স, এবং ফরাসি প্রধানমন্ত্রী এদ্যুয়ার্দ ফিলিপ স্পষ্টতই এই আন্দোলনে জল ঢালতে সময় কেনার খেলায় নেমেছেন। ছ’ মাসের জন্য জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি স্থগিত রাখার ঘোষণা তারই ইঙ্গিত। কিন্তু এসব দিয়ে আন্দোলনকে প্রশম করা যাবে তার লক্ষণ এখনও অবধি দেখা যাচ্ছে না। আন্দোলনের দাবির পরিধি ক্রমশই বাড়ছে এবং রাজনৈতিক হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রপতি মাক্রঁর পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান দিয়েছেন। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, এইসব সীমিত এবং তাৎক্ষণিক ছেলেভুলানো ঘোষণায় তাঁরা পড়ছেন না।

আসরে নেমেছেন মাক্রঁও। ১০ই ডিসেম্বর তিনিও একগুচ্ছ ঘোষণা করেছেন। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, করমুক্ত ওভারটাইম, যেসব অবসরপ্রাপ্তদের আয় মাসে ২,০০০ ইউরোর কম তাদের কিছু নিরাপত্তা কর থেকে অব্যাহতি…। কিন্তু মানুষের ক্ষোভের ওপর লাগাম পরানো এখনও তাঁর সাধ্যের বাইরে।

করব্যবস্থার অন্যায্য বিস্তার

২০০৮-এর সংকটের পর থেকে বিশ্বজুড়েই পরোক্ষ করের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। আমাদের দেশে যেমন ভ্যাট বা জিএসটি। ইওরোপীয় ইউনিয়ন এবং অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা OECD-র দেশগুলিতে এই পরোক্ষ করের গড় বৃদ্ধির মাত্রা যথাক্রমে ২১.৫ শতাংশ এবং ১৫ শতাংশ [[১]]। এই করগুলি প্রযুক্ত হয় গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস বা জিনিসপত্র কেনা এবং পরিষেবা গ্রহণের ওপর। স্বভাবতই এই কর জনসাধারণের দরিদ্রতর অংশকে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করে, ধনীতর অংশকে ততটা নয়। ফলে অর্থনৈতিক অসাম্য বাড়তেই থাকে। কেবলমাত্র ফ্রান্স বা ইওরোপ নয়, বরং সারা বিশ্বব্যাপী এই অর্থনৈতিক অসাম্য, বেকারত্ব এবং দারিদ্র বৃদ্ধি বুঝতে চাইলে, এই করব্যবস্থার শ্রেণিচরিত্র এবং তৎসূত্রে পরোক্ষ করের ব্যাপ্তিকে বুঝতে হবে। সামাজিক চুক্তি রাষ্ট্র পরিচালকদের সামাজিক ন্যায়, একটি ক্রিয়াশীল অর্থনীতি, নাগরিক নিরাপত্তা ইত্যাদি সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রকে একটি সক্ষম নীতিমালা প্রণয়ন করতে হয় এবং রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদ আহরণ করতে হয়। এখন এমনিতেই বর্তমান সময়ে বেকারত্ব ও অসাম্য বৃদ্ধি নজিরবিহীন, সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতিও লাগামছাড়া। এই প্রেক্ষিতে প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রই কোথায় একটি সুষম এবং প্রগতিশীল করব্যবস্থা লাগু করে সেগুলির মোকাবিলা করবে, তা নয় তারা প্রতিক্রিয়াশীল করব্যবস্থার দিকে বেশি বেশি করে ঝুঁকছে। অসাম্য দূর করতে গেলে কিন্তু সর্বাগ্রে একটি প্রগতিশীল এবং যথাযথ রাজস্ব ব্যবস্থা লাগু করতে হবে। ল্য মঁদ দিপ্লোমাতিক বলছে, “বিগত কয়েক বছর ধরেই রাষ্ট্রের কঠোর নীতির বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের মুখ্য লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে চালু করব্যবস্থার ইতিবাচক সংস্কার। ২০১০-এর মে মাসে পর্তুগালে কর বৃদ্ধি এবং সামাজিক খাতে ব্যয়সঙ্কোচের বিরুদ্ধে হাজার হাজার জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। দু’ বছর পর স্পেনে একই চিত্র দেখা যায়। সেখানেও জনগণের ক্ষোভের কেন্দ্রে ছিল সামাজিক খাতে ব্যয়সঙ্কোচ, বেসরকারিকরণ এবং ভ্যাটবৃদ্ধি (উদাহরণস্বরূপ, স্কুল সামগ্রীর ওপর, যা ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২১ শতাংশ হয়েছিল)। গ্রিসে জনগণ রাস্তায় নেমেছিলেন বেতন কমানো এবং অন্যায্য করের প্রতিবাদে। এবং ২০১৩-তে ফ্রান্সে কৃষক এবং ছোট ব্যবসায়ীরা মাল পরিবহনকারী বড় গাড়ির ওপর যে ইকো-ট্যাক্স চাপানো হয়েছিল তার বিরুদ্ধে ‘বনে র‍্যুজ’ (লাল টুপি) আন্দোলন শুরু করেন। তাতে সামিল হয়েছিলেন ফুড প্ল্যান্ট শ্রমিকরাও।” [[২]] বর্তমান আন্দোলনকে এই ধারাবাহিকতাতেই দেখতে হবে।

ভবিষ্যৎ?

‘ম্যুভমঁ জিলে জোন’ আন্দোলনের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। ফরাসি যুব সম্প্রদায় আন্দোলনে সামিল হচ্ছে তারুণ্যের স্পর্ধা নিয়ে এবং আগামী দিনের জন্য অনেক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এই আন্দোলনই এখন সমস্ত অসন্তোষের ধারক হয়ে উঠেছে। এর ভবিষ্যৎ সময়ই বলবে। হয়তো আমরা ফ্রান্স জুড়ে ব্যারিকেড দেখতে পাব। বা হয়তো সাধারণ ধর্মঘট। যাই হোক না কেন এটা স্পষ্ট যে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা ফরাসি জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে তাঁরা একজোট হয়ে মাক্রঁকে টেনে নামাতে পারবেন, পারবেন অন্যায্য কর বন্ধ করতে, বাধ্য করতে পারবেন ধনীদের কর দিতে, বাড়াতে পারবেন নিজেদের মজুরি এবং বেতন।

পাদটীকা :

[[১]] https://www.bna.com/indirect-tax-five-b57982086617/

[[২]] https://mondediplo.com/2018/12/the-anger-of-the-gilets-jaunes