Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ট্রান্সজেন্ডার বিল, ২০১৮ : একটি জাতীয় লজ্জা

পাঞ্চালী কর

 

বর্তমানে আমরা এক ভয়াবহ ইতিহাস রচনা করে চলেছি ক্রমাগত, রাজনৈতিক হিংসা এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির নিরিখে, যেখানে বিভেদের রাজনীতিকে হাতিয়ার বানিয়ে দেশ শাসন করছে এক সাম্প্রদায়িক শক্তি। এই পরিস্থিতিতে প্রান্তিক মানুষের অবস্থা প্রতিদিন করুণ থেকে করুণতর হয়ে চলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অবসাদগ্রস্ত সময়ের মধ্যে আশার আলো দেখায় সুপ্রিম কোর্টের রায়, যা IPC 377 এবং IPC 497-র মতো প্রাগৈতিহাসিক আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। মানুষ খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বহু দশক ধরে চলে আসা লিঙ্গ-সাম্যের রাজনীতি অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করার পর খানিক জয়যুক্ত হয়। কিন্তু উৎসবের ঘোর কাটার আগেই এই লিঙ্গসাম্যের রাজনীতিকে বেশ কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিয়ে গত ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮-তে লোকসভায় পাশ হয়ে যায় ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস্ (প্রটেকশন অফ্ রাইটস্) বিল, ২০১৮। এই বিলটি প্রথম নথিভুক্ত হয় ২০১৬ সালে এবং গোড়া থেকেই প্রান্তিক লিঙ্গ-রাজনীতির সাথে যুক্ত অসংখ্য মানুষ এবং সংগঠন এই বিলটির কঠোর বিরোধিতায় সোচ্চার হন। কারণ নামে অধিকার সংরক্ষণের কথা বললেও এই বিলটি ট্রান্সজেন্ডার, ইন্টারসেক্স, এবং হিজড়া কম্যুনিটির মানুষের এই সমাজে সমানাধিকারের পরিপন্থী।

প্রাথমিক খসড়ায় নতুন বিল অনুযায়ী ট্রান্সজেন্ডার মানুষের সংজ্ঞা ছিল : “neither wholly female or wholly male”, অর্থাৎ যে কিনা সম্পূর্ণ রূপে নারী বা পুরুষ নন। এই মুদ্রিত সংজ্ঞাটি ছিল অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ। তা শুরুতেই একজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষের ‘সেল্ফ আইডেন্টিফিকেশন অফ জেন্ডার’-এর অধিকারকে খর্ব করে। বর্তমানে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির সংজ্ঞা : যে ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয় তার জন্মের সময়কালের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে পৃথক। এই সংজ্ঞাটি অনেক বেশি ব্যাপ্ত, কারণ এই সংজ্ঞা অনুযায়ী ট্রান্স-ম্যান বা ট্রান্স-উওম্যানদের সাথে সাথে বিভিন্ন প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষ, যথা জেন্ডার-কুইয়ার, হিজড়া, কিন্নর ইত্যাদি পরিচয়ের মানুষদেরও সামিল করে নেয়। বর্তমান বিলে আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে সংজ্ঞাটি পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে এসেছে আরও অনেক বিধিনিষেধ।

২০১৪ সালে NALSA (ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিস অথরিটি) এবং রাষ্ট্রের মধ্যে হওয়া মামলায় যুগান্তকারী রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট, যেখানে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং আরও বলা হয় যে তাঁরা সমস্ত সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের অধিকারী। NALSA রায়ের আর এক প্রগতিশীল দিক হল এই রায়ে ট্রান্সজেন্ডার কম্যুনিটিকে প্রান্তিক সম্প্রদায় হিসেবে নথিভুক্ত করা হয় এবং শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ ওবিসি কোটার ২৭% সংরক্ষণের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলা হয়। নথিপত্রে এই সংরক্ষণের কথা বলা হলেও কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের জন্য চাকরি সংরক্ষিত করার পরও পরিকাঠামো এবং সুরক্ষিত পরিবেশের অভাবে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করা যায়নি। সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে লিঙ্গ এবং যৌনশিক্ষার অভাবে মানুষের মনে ভয়, ভীতি, ঘৃণা এবং অযাচিত কৌতূহল রয়ে গিয়েছে যা প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের বারবার বিবিধ বৈষম্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এবং এই মানুষগুলো সমাজের মূল স্রোতের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের প্রথাগত উপার্জনের রাস্তা বন্ধ করে তাকে বেআইনি ঘোষণা করা একটি অসাংবিধানিক পদক্ষেপ। ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস্ বিল 2018 NALSA রায়ের প্রগতিশীলতাকে নস্যাৎ করে অনেকাংশে, এবং অনেকাংশে তা NALSA রায়ের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করে, যা কিনা সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের অবমাননার সমান।

প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের সাথে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বৈষম্য আজও একই রকম প্রকট, একই রকম ভয়াবহ, তাই আজও রূপান্তরকামী, উভলিঙ্গ, এবং হিজড়াদের বৃহদাংশ মূল স্রোতে মিশতে কুণ্ঠিত বোধ করেন। অতএব ভিক্ষা করা এবং দেহব্যবসার মাধ্যমে তাঁরা রোজগার করে থাকেন। ট্রান্সজেন্ডর পার্সনস্ (প্রটেকশন অফ্ রাইটস্) বিল, ২০১৮, ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের ভিক্ষাবৃত্তি এবং দেহব্যবসাকে বেআইনি ঘোষণা করে। আপাতদৃষ্টিতে এই পদক্ষেপ প্রগতিশীল মনে হলেও, আসলে এই বিল এই প্রান্তিক মানুষগুলোর রুজিরোজগার এবং জীবনযাত্রাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়, কারণ এই মানুষগুলোর চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জন করার পরিকাঠামো, শিক্ষা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, কোনওটাই নেই। এই বিল প্রান্তিক মানুষদের আরও কোণঠাসা করে দেয়, জাতিগত আধিপত্যবাদ এবং ট্রান্সফোবিয়ায় উস্কানি দেয়, এবং ট্রান্স ও হিজড়া কম্যুনিটির ওপর পুলিশ এবং রাষ্ট্রের নির্যাতনের রাস্তা পরিষ্কার করে দেয়।

NALSA রায়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য “সেল্ফ আইডেন্টিফিকেশন অফ জেন্ডার”। অর্থাৎ নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিজে সনাক্ত করার অধিকার, যার দ্বারা একজন মানুষ নিজেকে নারী, পুরুষ, অথবা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সনাক্ত করতে পারে, যা জন্মকালে নথিভুক্ত লিঙ্গের সাথে সমান হওয়া আবশ্যিক নয়। ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস্ বিল ২০১৮ অনুযায়ী জেলায় জেলায় জেন্ডার স্ক্রিনিং কমিটি থাকবে। কেউ নিজেকে ট্রান্সজেন্ডার দাবি করলে সেই কমিটি নির্ধারণ করবে এবং সার্টিফিকেট দেবে সেই ব্যক্তি সহি ট্রান্স কি না। অর্থাৎ জেন্ডার রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি যাঁরা করেননি, যাঁদের যৌনাঙ্গ জন্মের সময়ে নথিভুক্ত লিঙ্গের সমানুপাতিক, তাঁরা নিজেদের ট্রান্স প্রমাণ করার সুযোগ পাবেন না। ‘সেল্ফ আইডেন্টিফিকেশন অফ জেন্ডার’ তার গ্রহণযোগ্যতা হারাবে, এই বিল কার্যকর হলে। উভলিঙ্গ এবং হিজড়া কম্যুনিটির মানুষও এই স্ক্রিনিং-এর কারণে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হবেন, তা বলাই বাহুল্য।

এই বিলে আরও বলা হয়েছে যে কোনও রূপান্তরকামী মানুষকে তাঁর নিকটাত্মীয়রা পরিবার থেকে বের করে দিলে সরকার তাঁর পুনর্বাসনের ভার নেবে। আপাতদৃষ্টিতে এই পদক্ষেপ গঠনমূলক মনে হলেও এই মীমাংসার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে বৈষম্যের বীজ। সরকারের কাজ উন্নততর সমাজ তৈরির জন্য মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও সংবেদনশীলতার প্রসার ঘটানো। সেই পথে না হেঁটে সরকার শর্টকাট রাস্তায় নেমেছে সহানুভূতিশীল মুখোশের পিছনে। পুনর্বাসন দেওয়াকে স্বাভাবিকতার স্তরে নিয়ে আসা মানে ট্রান্সজেন্ডার মানুষেদের ওপর হওয়া গৃহহিংসাকেও স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া, প্রান্তিক মানুষদের সমানাধিকার দেওয়া নয়। এই গূঢ় সত্যটি প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের জন্য অপমানজনক।

ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস্ বিলে ২৭টি নতুন সংযোজন করা হয়, যার বেশিরভাগই ট্রান্স কম্যুনিটির উপকারের চাইতে অপকারের পথ প্রসারিত করতে চলেছে। গত দুই বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, পিটিশনের মধ্যে দিয়ে প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের, এবং লিঙ্গসাম্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন মানুষ ও সংস্থা লাগাতার এই বিলের বিরোধিতা করে এসেছে। সাধারণ মানুষের তরফে লাখে লাখে পোস্টকার্ড পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে, এই বিলকে রুখে দেওয়ার জন্য। দুঃখজনকভাবে, ট্রান্স কম্যুনিটির ন্যূনতম প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই তাঁদের ভালো মন্দ বিচারের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে সেইসব মানুষ যাঁদের ট্রান্স কম্যুনিটির লড়াইয়ের সাথে দূর দূর পর্যন্ত কোনও সম্পর্ক নেই।

লোকসভায় এই বিল পাশ হওয়ার পর দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবাদের ঢল নেমে এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এই বিলে বর্ণিত ট্রান্সজেন্ডারের প্রাথমিক সংজ্ঞা থেকে শুরু করে নানা সংযোজনে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে যাঁরা এই বিলের মুদ্রণ করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের সম্পর্কে ন্যূনতম সচেতনতা বা সহমর্মিতা নেই।  উপরন্তু তাঁর স্ট্যান্ডিং কমিটিতে এমন মানুষদের রাখার প্রয়োজন মনে করেননি যারা নিজেদের জীবন দিয়ে প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের লড়াই লড়ছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। সারা দেশের ট্রান্সজেন্ডার মানুষ এই হঠকারী সিদ্ধান্তের কড়া ভাষায় নিন্দা করছেন। কলকাতায় প্রান্তিক লিঙ্গ এবং যৌন পরিচয়ের সাথে যুক্ত মানুষজন একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন, কলকাতা প্রেস ক্লাবে। সেখানে বক্তব্য রাখেন অপর্ণা, মালবিকা, রাইনা প্রভৃতিরা, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে লিঙ্গসাম্যের লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে এসেছেন। বক্তারা শানিত যুক্তি দিয়ে লোকসভায় সদ্য পাস হওয়া ট্রান্সজেন্ডার বিলের বিরোধিতা করেন এবং সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ডাক দেন।

ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস্ বিল ২০১৮ মানবিকতার দরবারে আমাদের প্রগতিশীল ভাবমূর্তিকে অনেক ধাপ পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করার ক্ষমতা রাখে। এই নঞর্থক রাজনীতিকে রুখে দিতে দিকে দিকে মানুষ সোচ্চার হয়েছেন। সমস্ত আশা নিয়ে এখন মানুষ তাকিয়ে রাজ্যসভার আগামী অধিবেশনের দিকে। রাজ্যসভায় এই বিল নাকচ হয়ে গেলে আমাদের নিজেদের সামনে নিজেদের মান বাঁচবে। নচেৎ একবিংশ শতাব্দীতে এসে যে দেশে লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের রুজি রুটি বন্ধ হয়, সেই দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা লজ্জা ঢাকব কীসে?