Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অনেক খুন এবং একজন হত্যাকারী : দুর্জনের যাবজ্জীবন

ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

 

“ন্যায়ালয় মনে করছেন, ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লি ও অন্যান্য স্থানে যে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল, তা প্রকৃতপক্ষে মানবতা-বিরোধী অপরাধ। এই গণহত্যার স্মৃতি আরও দীর্ঘ দিন সমাজের যৌথ বিবেককে পীড়িত করবে। এ-কথা ঠিকই, যে অপরাধীদের দোষী সাব্যস্ত করতে তিন দশকেরও বেশি সময় চলে গিয়েছে। আমাদের বিচারব্যবস্থাকেও যথেষ্ট পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবু, আইনের শাসন বলবৎ, এমন এক গণতন্ত্রে এমন গণহত্যায় দোষীদের চিহ্নিত করা খুবই জরুরি। খুবই জরুরি এই জঘন্য হিংসার সেইসব অগণিত শিকারদের আশ্বস্ত করা, যে শত বাধা সত্ত্বেও সত্যের জয় আর ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা হবেই।”[i]

উপরের কথাগুলো জাস্টিস মুরলীধরের। ১৯৮৪ সালে দিল্লির শিখ-নিধন যজ্ঞে সজ্জন কুমারকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দেবার সময় বলা। পাঠক জানবেন, গত সতেরো তারিখে দিল্লি হাইকোর্টে বিচারক মুরলীধরের এজলাসে চুরাশির শিখ হত্যাকাণ্ডে অন্যতম দোষী সাব্যস্ত হন সজ্জন কুমার। সজ্জনকে সাজা শোনাবার সময় আদালত এই ঘটনাকে দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা করেন।

১৯৮৪ সালের ৩১-এ অক্টোবর তারিখে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হবার পর প্রথমে দিল্লি ও পরে উত্তরের আরও বেশ কিছু অংশে যে ‘উন্মত্ত জনতা’-র ‘ঘনীভূত শোক’ ও ‘পুঞ্জীভূত আক্রোশ’-এর বলি হন তিন হাজারের বেশি শিখ, যার মধ্যে অধিকাংশের মৃত্যু হয় এক দিল্লিতেই। তবে এ-সবই সরকারি তথ্য। বেসরকারি তথ্য যা পাওয়া যায়, তাতে মৃতের সংখ্যা সারা দেশে ত্রিশ হাজারের মতন।

বাড়ির পর বাড়ি লুঠ করা হয়। চলে শিখ পরিবারের মেয়ে আর বৌদের ওপর অত্যাচার আর ধর্ষণ। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাহাত্তরটা গুরদোয়ারা। একের পর এক শিখধর্মী মানুষকে হত্যা করা হয় তাঁদের বয়স-লিঙ্গ-প্রতিপত্তি নির্বিশেষে। মাত্র চারদিন এই হত্যালীলা চলে। ক্রমশ প্রকাশ্যে আসতে থাকে এই ঘটনার মূল কাণ্ডারী হিসাবে যাদের নাম, প্রায় সকলেই কংগ্রেস (ই) দলের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী, নেতা। সেই তালিকায় অন্যতম নামটি এই সজ্জনের।

কংগ্রেস দলের তিনবারের সাংসদ ও বরিষ্ঠ নেতা তিয়াত্তর বছর বয়সী সজ্জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি চুরাশির শিখনিধনে মদত দেন। হামলাকারীদের একত্রিত করে দিল্লির রাজ নগর এলাকায় এক শিখ পরিবারের পাঁচজনকে হত্যা করার একটি নির্দিষ্ট অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। মামলার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী চমকওর আদালতকে জানান, কীভাবে সজ্জন দিল্লির সুলতানপুরী অঞ্চলে একদল লোককে ক্ষেপিয়ে তোলেন শিখেদের বিরুদ্ধে, বলেন—  “ওরা আমাদের মা-কে মেরে ফেলেছে। ওদের মার”। এমন আরও অভিযোগ সজ্জনের নামে আদালতে জমা পড়ে।

একা সজ্জন কুমারই তাহলে এত মানুষকে হত্যার, এত সম্পত্তি নষ্ট করবার মূল হোতা?

অভিযোগের তীর যে গোড়া থেকেই কংগ্রেসের কিছু নেতার দিকে, এ-কথা নতুন করে বলার মতন কিছু নয়। এই ঘটনার একেবারে শুরু থেকেই সজ্জন কুমার ছাড়াও উঠে আসে ‘বগুলা’ এইচ কে এল ভগত, জগদীশ টাইটলার, মধ্যপ্রদেশের অধুনা-মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ, ললিত মাকেন-প্রমুখ কংগ্রেসি নেতার নাম। অভিযোগ ওঠে, তাঁদের ইন্ধনে ও সক্রিয় পরিচালনায় সংঘটিত হয়েছে এই হত্যাকাণ্ড। এঁদের সকলের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, স্থানবিশেষে এঁরা এঁদের গোষ্ঠী নিয়ে হামলা চালিয়েছেন। ত্রিলোকপুরীর সেই হত্যাকাণ্ডের ছবি, যেখানে এক বয়স্ক শিখের হাত-পা বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যবহৃত টায়ার, আর তারপর তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে— এর হোতা হিসাবে উঠে আসে ভগতের নাম। কমল নাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি লোকজন জড়ো করে ভাঙচুর করেন রকাবগঞ্জ গুরদোয়ারায়, এবং তাঁরই সামনে জীবন্ত জ্বালিয়ে মারা হয় এক বৃদ্ধকে। টাইটলারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ, শুধু হাঙ্গামার স্থান পৃথক।

তবে এই বিপুল হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হল কি কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু নেতার দ্বারা? ১৯৮৪ থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন কমিশন বা আদালতের বিভিন্ন ভাষ্যের থেকে এই কথাটা মোটামুটি পরিষ্কার। এই ঘটনার পিছনে ছিল একটা গ্র্যান্ড প্ল্যান, এবং সেই প্ল্যানের অংশ ছিলেন— নিন্দুকের মতে— তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার তথা কংগ্রেস দলের মাথারা, পুলিশ এবং দিল্লির তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নরও। হামলার জন্য রীতিমত চিহ্নিতকরণ হয়েছিল শিখ পরিবারগুলোর— ইলেক্টোরাল রোলের সাহায্যে। সেই মর্জিনা-আবদাল্লা গপ্পের মতন বাড়ির গায়ে ঢ্যাঁড়া দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সহজেই হামলাকারীরা বুঝে যায় তাদের গন্তব্য। কোথাও লাগু করা হয়নি কারফিউ, বা ১৪৪ ধারা— যা করলে কিছু প্রাণ হয়ত বাঁচত।

এই বিপুল নিষ্ক্রিয়তার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি বলেন— মহীরুহের পতন হলে চারপাশের মাটি তো কেঁপে উঠবেই! টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় গিরিলাল জৈন লেখেন— শিখেদের বোঝা উচিত ছিল কী অপেক্ষায় আছে তাদের জন্য। হিন্দুস্তান টাইমস-এর সম্পাদক এন সি মেনন লেখেন— শিখেরা কেমন করে “clawed their way to prosperity”, এবং কেন এই পরিণতিই তাঁদের ভবিতব্য।[ii]

হিংসা এক মহান সমতাসাধক! দিল্লি ও হরিয়ানার সাধারণ মানুষ যেমন প্রাণ দিলেন, প্রাণ সংশয় হয়েছিল শিখসমাজের পুরোধা সেলিব্রিটিদেরও। ২০০১ সালের মে মাসে নানাবতী কমিশনকে দেওয়া বক্তব্যে বিশিষ্ট সাংবাদিক অধুনা-প্রয়াত খুশওয়ন্ত সিং জানাচ্ছেন, ইন্দিরা-হত্যার ঠিক পরের দিন, অর্থাৎ পয়লা নভেম্বরের সকালে তাঁকে ফোনে তাঁরই এক বন্ধু জানান, তিনি হতে পারেন উন্মত্ত জনতার আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য। কারণ অপারেশন ব্লুস্টারের প্রতিবাদে তাঁর পদ্মভূষণ খেতাবের প্রত্যাখ্যান। এই খবর পেয়ে নিরুপায় হয়ে সিং ফোন করেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং-কে। না, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে তাঁকে দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপতির সচিব তাঁকে জানান, বিপদের আশঙ্কা করে থাকলে খুশওয়ন্ত বরং কোনও হিন্দুর বাড়িতে আশ্রয় নিন। কমিশনকে খুশওয়ন্ত বলেন, তাঁর মনে হয়েছিল নিজের দেশে তিনি এক উদ্বাস্তু। নাৎসি জার্মানিতে যেমন একজন ইহুদি।[iii] রাষ্ট্রপতির ক্যাভালকেডেও— তিনি তখন বিদেশসফর সেরে দেশে ফিরছেন— পাথর ছোঁড়া হয় সেই সময়।

তুমি হাকিম হয়ে হুকুম করো, পুলিশ হয়ে ধরো। সেই চুরাশির নভেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত গঠিত হয়েছে বহু কমিশন। সকলেরই উদ্দেশ্য ছিল দোষীদের চিহ্নিত করা। তবে এর মধ্যে প্রথম গঠিত হয়েছিল যে কমিশন— বেদ মারওয়ার নেতৃত্বে— গঠনের কিছুদিন পরেই তা ভেঙে দেওয়া হয়, এবং যেসব তথ্য তাঁরা একজোট করেন নিয়ে নেওয়া হয় সবই। এর পর মিশ্র কমিশন, কাপুরমিত্তল কমিটি, জৈন ব্যানার্জি কমিটি, পোতিরোশা কমিটি, জৈন আগরওয়াল কমিটি, আহুজা কমিটি, ধিল্লোঁ কমিটি, নারুলা কমিটি ও নানাবতী কমিশন। সব শেষে এই বছরের গোড়ায় তৈরি হল স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম, সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে। নো ওয়ান কিল্ড দ্য সিখস— এই কথা আমরা যখন প্রায় বিশ্বাস করতে বসেছি, তখন এক অপরাধীর এই শাস্তিবিধান আমাদের একটু স্বস্তি দিল মনে হয়।

কিন্তু দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরে এ-হেন একটা বর্বর হত্যাকাণ্ডে মাত্র একজন দোষী সাব্যস্ত হল, এ-ও তো সত্য। মাকেন আগেই খুন হয়েছিলেন। ভগতও চোখ বুজেছেন অনেকদিন হল। তবু আক্রান্তেরা মনে করেন, যারা আছেন, তাঁরা বহাল তবিয়তেই আছেন, এবং ক্ষমতার সুখভোগ করছেন। আক্রান্তদের কাছে তাই বিলম্বিত ন্যায়বিচার আর অন্যায় প্রায় সমার্থক। হাজার হাজার মানুষ খুন হয়েও কেস দাখিল হয় মাত্র একশো ছিয়াশিটি, আর তার মধ্যে দোষ প্রমাণ হয় মাত্র একজনের, এই পরিসংখ্যান আদৌ আক্রান্তদের স্বস্তি দেবার মতন কি? খুশওয়ন্তের মতন তাঁদেরও যদি মনে হয়, তাঁরা নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের মতন বাস করছেন— তাতে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় কি? সর্বোপরি, সজ্জনের হাতে এখনও রয়েছে উচ্চ ন্যায়ালয়ে আপিলের সুযোগ, যে সুযোগের তিনি সদ্ব্যবহার করবেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। আপাতত তিনি ব্যস্ত যদিও, নিজের সম্পত্তি সন্তানসন্ততিদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারায়। খবরের কাগজে যেন সেইরকমই দেখলাম।

শেষ করা যাক একটা ছোট কথা বলে। দেশের মানুষের মনে এ-সম্বন্ধে আর যা-ই প্রশ্ন থাক, এ-বিষয়ে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই, এ-বিষয়ে সম্ভবত অনেকেই নিঃসংশয়। তা-ছাড়া দেখছিও তো সকলে, কীভাবে সজ্জনের দোষনির্ধারণকে সাফল্য হিসাবে প্রচার করছে ক্ষমতাসীন দলটি। এবং বলাই বাহুল্য, এর সঙ্গে নিন্দা হচ্ছে কংগ্রেসের ভূমিকা। বেশ হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি আন্তর্জালে যা খুঁজে পেলাম, তাতে এই হা-হুতাশ ও নিন্দেমন্দর মধ্যে একটা অন্য মুখও দেখতে পেলাম যেন।

শিখনিধন বন্ধ হবার কিছুদিন পরেই— ১৯৮৪ সালের আটই নভেম্বর তারিখে— এ-বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন নানাজি দেশমুখ নামে এক হিন্দু চিন্তক। নানাজি ছিলেন ভারতীয় জনসংঘ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও ভারতীয় জনতা পার্টির বিশিষ্ট কর্মী। ২০০৫ সালে তিনি সোশ্যাল ওয়ার্কের জন্য পদ্মবিভূষণও পান। তাঁর নামে একটি ডাকটিকিটও রয়েছে। এ-হেন নানাজি, ১৯৮৪ সালে, ‘প্রতিপক্ষ’ নামের একটি পত্রিকায় শিখনিধন নিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। হিন্দিভাষায় প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ। সেই নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘আত্মদর্শন কে ক্ষণ’, অর্থাৎ আত্মদর্শনের মুহূর্ত। বলে রাখি, আত্মদর্শনের এই আহ্বান হিন্দু বা কংগ্রেসিদের জন্য নয়, ছিল শিখদের জন্য। ইন্দিরাকে ‘মহান শহিদ’ (ব্লুস্টার ও নেহরু পরিবারের সমালোচক হিন্দুত্ববাদী ভগিনী ও ভ্রাতাগণ, স্মরণ রাখবেন) হিসাবে বর্ণনা করে তিনি লিখছেন— দেশজুড়ে হিংসার এই বিস্ফোরণ, তা ঠিক হোক বা ভুল (লক্ষ্য করুন) ছিল তাঁর অনুগামীদের আঘাত, ক্রোধ ও শোকের অভিব্যক্তি, হোক না তা বিপথগামী। হিংস্র রক্তলোভী জনতাকে তিনি বলছেন নিরীহ, অজ্ঞ। আর তাঁর ‘শিখ ভাইদের’ এই কঠিন সময়ে তিনি বলছেন অবিচল ও সহিষ্ণু থাকতে। গোটা রচনাতে এমন একটা শব্দও ব্যবহার করা হয়নি যা সরকারের বা শাসকদলের ভূমিকার নিন্দাসূচক। বরং গোটা ঘটনাটাকেই একটা স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে।[iv]

এইসব যে বলছি, এতে কিছুই হবে না, জানি। তবে গুজরাট কারিগরদের এই কান্না যে আসলে কুম্ভীরাশ্রু, এই সত্যটা বুঝে নেবার ক্ষেত্রে কিছুটা সাহায্য হলেও হতে পারে।

 

[i]https://www.firstpost.com/india/sajjan-kumar-convicted-delhi-high-court-says-perpetrators-of-1984-anti-sikh-riots-enjoyed-political-patronage-read-full-judgment-5742921.html

[ii]https://www.outlookindia.com/magazine/story/victory-to-the-mob/228338

[iii]https://www.rediff.com/news/2001/may/09sikh.htm

[iv]https://sikhsiyasat.net/tag/nana-deshmukh/