Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মানস নাথের ফেবুদেওয়াল থেকে

মানস নাথ 

 

একই পাড়ায় আজীবন রয়ে যাবার যেমন কিছু সুবিধা আছে তেমনি অসুবিধাও আছে। অসুবিধা হল মনটা বড় কূপমণ্ডূক হয়ে যায়, উদ্যম কমে যায়, তবে সুবিধার লিস্টিটা বেশ ছড়ানো আয়েসি হয়। তিন চার জেনারেশন ধরে একই পাড়ায় থাকলে বেশ অন্যরকমের একটা ফিলিং হয়। জেনারেশন ওয়াইজ বা এজ গ্রুপ অনুযায়ী পরিচিতি তৈরি হয়। যেমন আমার জন্মের বছর খানেকের মধ্যেই আমার ঠাকুরদা মারা যান। আমার তাঁকে নিয়ে কোনও প্রত্যক্ষ স্মৃতি নেই। কিন্তু তাঁর বন্ধুবান্ধব বা সেই বয়েসীরা সকলেই আমাকে অমুকের নাতি বলেই ডাকত আর চিনত। তাদের সাথে গল্পে আলাপে আমার ঠাকুরদার ছবি আমার কাছে ফুটে উঠেছিল। সেই মানুষগুলো আজ সবাই মারা গেছেন। ফলে অমুকের নাতি বলে ডাকার আর কেউ নেই। একইভাবে দুই জ্যাঠা, কাকা, পিসি যারা আর নেই তাদের স্মৃতিও তাদের বয়েসী বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে বেশ জ্যান্ত আছে।

সেদিন পাড়ার মোড়ে এক প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী ধবধবে ছোট ছোট সাদা চুলের এক মহিলা হঠাৎ আমাকে ডাকলেন! প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়েস, মুখ চেনা, আমার জন্মের বহু আগে বিয়ে হয়ে পাড়া ছেড়েছেন। প্রবাসে থাকেন, পুজো পার্বনে বছরে একবার হয়ত আসেন, সেই সুবাদেই মুখ চেনা। আমার কাছে জানতে চাইলেন ছোড়দা কেমন আছে? আমার বাবারা পাঁচ ভাই, বাবা সেজ। এক কাকা ছাড়া আর কেউ বেঁচেও নেই, তবু কি জানি কেন পুরনো লোকেরা আজও বাবাকে ছোড়দা বলেই ডাকেন। বাবার এখন আশির কাছাকাছি বয়েস, শরীরও তেমন ভাল নয়। ভদ্রমহিলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খোঁজখবর নিলেন। তারপর বললেন ছোড়দার একটা ইয়া বড্ড সবুজ বিদেশি মটোরবাইক ছিল। আমি ওনাকে একমনে লক্ষ করছিলাম, ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থনের সময় মানুষের মুখে কেমন একটা লাজুক কৈশোর ফিরে আসে না? আমার বাবা যখন পাড়ায় বাইক হাঁকিয়ে ঘুরত তখন উনি নিশ্চয় বারো পনেরোর কিশোরী ছিলেন।

আমার বাবাকে আমি কোনওদিন বাইক চালাতে দেখিনি। না ভুল বললাম, একবার… বাইশ বছর বয়েসে আমি যখন প্রথম ব্যবসা থেকে টাকা জমিয়ে বাইক কিনি তখন। এটা কেউ জানে না, এমনকি মা’ও না। আমার আট হাজার টাকা শর্ট হচ্ছিল। বাবা ধার দিয়েছিল। তারপর যা হয় আর কি, দুজনেই ভুলে গিয়েছিলাম। বাইক কিনতে বাবাকেই নিয়ে গিয়েছিলাম। বাবা চালিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। ওই একবারই। যখন বাইক কিনি তখন বাইক চালাতে পারতাম না। মানে কোনওদিন আগে চালাইনি এমন নয়। হাতেখড়ি হয়েছিল মামার রাজদূত বাইকে। তবে সে দু তিন বারে কি আর হাত সেট হয়। জ্ঞান হওয়া থেকে বাড়িতে অনেক রকমের দু চাকা মোটর সাইকেল দেখে আসছি। কিন্তু নিজে বাইক না কেনা পর্যন্ত পেছনে বসাই ছিল কাজ। একটি বাইক ছিল এজমালি! মানে ঠেকায় পড়লে সবাই সেটাকে টেনে বের করত। রয়্যাল ইনফিল্ড কোম্পানির একটা মিনি বুলেট। এই প্রজন্মের অনেকেই বুলেটের সেই মডেলটা দেখেনি। ২০০ সিসির টু স্ট্রোক ইঞ্জিন। বিকট আওয়াজ। লাল টকটুকে রঙ। আমার জ্যাঠতুতো দাদা ওটা নিয়ে বের হলে আমাকে পিছনে বসিয়ে নিয়ে যেত। কারণ মাঝেমধ্যেই স্টার্ট বন্ধ হয়ে যেত, তখন নেমে পেছন থেকে ঠেলে চালু করাতে হত।

তবে ওই ভদ্রমহিলা যে গাড়িটার কথা বলছিলেন সেটা আমি কখনও চোখে দেখিনি। বাবা ১৯৬২ সালে গাড়িটা কেনে চাকরি পাবার মাস খানেক পরেই। সেটাই নাকি পাড়ার প্রথম মটোর সাইকেল! এই zundapp বেলা স্কুটারটি বাবা সেকেন্ড হ্যান্ড কিনেছিল এক জার্মান সাহেবের কাছ থেকে। পৈলানের কাছে ধ্যানাশ্রম বলে একটি মিশনারিদের অনাথ আশ্রম ছিল। এখন যেখানে মেট্রোরেলের ওয়ার্কশপ। তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ভলিন্টিয়ারি সার্ভিস দিতে অনেকে সেখানে আসতেন। এক জার্মান ভদ্রলোক এই ২০০ সিসি টু স্ট্রোক সেলফ স্টার্ট স্কুটারটি নিয়ে এসেছিলেন। সেই আমলে এটাই বোধহয় প্রথম সেলফ স্টার্ট দু চাকার গাড়ি। বাবা জ্যাঠাদের সাথে সেই জার্মান ভদ্রলোকের ভালোই আলাপ পরিচয় হয়ে যায়। তা দেশে চলে যাওয়ার আগে তিনি সেই স্কুটারটা বাবাকে বিক্রি করে যান। এই ধ্যানাশ্রমে আসা আর এক জার্মান মিশনারির কাছ থেকে ১৯৬৮ সালে বাবা আর একটা সেকেন্ড হ্যান্ড বাইক কিনেছিল, কিন্তু সেটা এক বছরের মধ্যেই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। বাইকটা নাকি বারবার বিগড়াচ্ছিল আর সেটাকে সারানোর মতো কোনও মিস্ত্রী এলাকায় ছিল না। সেটি হল একটি বি এম ডাব্লু বাইক!!! এটা শুনে কেমন যেন ঘোর লাগে। ছোটবেলায় বিখ্যাত সব গাড়ি কোম্পানির লোগোর স্টিকার মলাট দেওয়া স্কুলের খাতায় সাঁটতাম। রোলস রয়েস, ফেরারি, বি এম ডাব্লু, ল্যাম্বারঘিনি, বুগাত্তি, ফোর্ড। আমার সাইকেলের মডগার্ডে একটা ফেরারির স্টিকার মেরেছিলাম! বি এম ডাব্লু যে বাইকও বানায় সেটাই জানতাম না! বাবার কথা অনুযায়ী বাইকটা অনেকটা বুলেটের মতোই দেখতে ছিল আর ৫০০ সিসির ইঞ্জিন। আমি নেট ঘেঁটেঘুটে অনেক ছবি বাবাকে দেখিয়ে মোটামুটি ধারণা করলাম বাইকটা ১৯৫১ সালে তৈরি বি এম ডাব্লুর আইকনিক R51 মডেল হতে পারে! এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পরেই বি এম ডাব্লু লঞ্চ করেছিল। জার্মানি ভাগ হয়ে যাবার পরে কিছু মডেল পূর্ব জার্মানির কারখানাতেও তৈরি হয়। ইস…. বাইকটা যদি বাবা বেচে না দিত তাহলে এতদিনে ভিন্টেজ মডেল হিসেবে কোটি টাকা দাম উঠে যেত হয়ত। তবে আর এক জার্মান বেলা স্কুটারটা কিন্তু বাবার খুবই প্রিয় ছিল। ১৯৬৯-এ বাবা কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি পেয়ে যায়। ফুড কর্পোরেশনে, তার পরের দশটা বছর বিহারের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং। স্কুটার পড়ে রইল বাড়িতে। ন’কাকা চালাত। কাকা তখন কলেজে। চারিদিকে নকশাল আন্দোলনের ঝড়। তারপর বাড়ি ছাড়া, পাড়া ছাড়া। লুকিয়ে বেড়ানো। স্কুটার নিয়ে দুবার এক্সিডেন্ট করে জোর বেঁচে যাওয়া! স্কুটার ত্রিপল চাপা দিয়ে ঠাকুরদা ফেলে রাখল উঠোনে। আমার মা বিয়ের পর এসে ওই অবস্থাতেই দেখেছে। জগদ্দল হয়ে উঠোনের এক কোণে পড়ে আছে বাবার সাধের জার্মান বেলা স্কুটার। আমার জন্মের আগেই সেটা বিক্রি হয়ে যায়।

মাঝেমাঝে ভাবি এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের স্কুটার, জার্মান মিশনারি, নকশাল আন্দোলন এই সব মিলিয়ে দিয়ে বেশ একখানা জমাটি উপন্যাস লেখা যায়! যার কেন্দ্রে থাকবে বাবার প্রথম প্রেম বেলা স্কুটার! বাইশ বছর বয়েসে আমার প্রেম ছিল সদ্য কেনা সুজুকি সামুরাই। সেই সময় হোন্ডা সি ডি ১০০, ইয়াহামা আর এক্স ১০০ এই সব বাইকের খুব চল ছিল। আর ছিল আদি অকৃত্রিম ইনফিল্ড বুলেট। কিন্তু আমি আজও স্বপ্নে সেই সবুজ ধূসর সামুরাইকে দেখতে পাই। এতদিন পরেও! বাবাকে নেট ঘেঁটে বেলা স্কুটারের ছবিটা দেখাতেই চমকে উঠে বলেছিল, এই তো আমার গাড়ি!! প্রথম উপার্জনের পয়সায় কেনা প্রথম গাড়ি, তার একটা মায়া আছে।

তা যা বলছিলাম….. অনেক অসুবিধা হলেও তিন পুরুষ ধরে এক পাড়ায় থাকার কিছু সুবিধা তো আছে। এই স্মৃতির সফর কম আয়েশি নাকি! নিচে নেট ঘেঁটে খুঁজেপেতে সেই সব স্মৃতির মটোর বাইক, স্কুটারের ছবিগুলো দিলাম।