Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

খাবার ব্যাপার……

সৌমিক দাশগুপ্ত

 

দশ টাকায় তিন আঁটি কলমী শাক পেলাম। বেশ রসুন শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে গুছিয়ে ভাজা ভাজা করে শুকনো ভাতে মেখে … আঃ!!!

তখন মনে হয় ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়ি। ৮৮-৮৯ সাল হবে। আমাদের ঠিক পাশের পাড়াতে থাকত বটা। আসল নাম বটুকেশ্বর অথবা নিরারণ কিছু একটা হবে। তার মা বাবা বোন টোন ছিল বলেই জানতাম। কিন্তু সে আলাদা থাকত বাড়ীর পাশেই একটা দর্মার দেওয়াল টালির চাল ওয়ালা ঘরে। আর তার ছিল এক পুকুর, সেটি সম্ভবত এজমালী ছিল। মালিকানা ছাড়া অমন অনেক পুকুর দেখা যেত তখন। কে মালিক কে জানে। আমরাও অত মাথা ঘামাতাম না। বটার বাড়ীর পাশের পুকুর মানে বটার পুকুর। বটা পুরো সেপারেট হয়ে গেসল আর কি। সে ভারী আমুদে মানুষ। খালি গায়ে গামছা জড়িয়ে দাওয়ায় বসে গুন গুন করে গান গাইত। বিড়ি টিড়ি খেত চেয়ে চিন্তে।

বটা সম্ভবতঃ মাধ্যমিক পাশ ছিল। ক্লাস টু থ্রী-র বাচ্চাদের টিউশন পড়াত দেখতাম। আর শোনা কথা, বহুত ক্যালাত নাকি পড়াতে পড়াতে। ফলে যা হয়। বছর কয়েকের মধ্যে মার্কেটে এমন রেপু বানাল, কোন বাচ্চার বাপ মা আর বটাকে ডাকে না পড়াবার জন্য।

এবার সমস্যা হল বটা খাবে কী? পয়সা কড়ি তেমন নেই। তেমন ঘটি বাটিও নেই যে বেচে দিন চালাবে। তা সেই সময়ে মানুষ বেশ ধম্মোকম্মো করত। বাড়ীতে পুজোটা আচ্চাটা হত। সত্যনারায়ণ শেতলা ইতুপুজো কোদালে অমাবস্যা এসব হত টত। বটা কোথা থেকে একটা বাংলা ক্যালেন্ডার জোগাড় করেছিল। হয়ত পয়লা বৈশাখ কোনও দোকানে গিয়ে ম্যানেজ করেছিল। এবার খুব রিলিজিয়াসলি সেই ক্যালেন্ডার ফলো করতে শুরু করে দিল। আজ গন্ধেশ্বরী পুজো, বণিক বাড়ীতে ভোজ। কাল সত্যনারায়ণের সিন্নি কুন্ডু বাড়ীতে। পরশু মনসা পুজো চক্কোত্তি বাড়ীতে। ফলমূলের সাথে দুটি ময়দার লুচি আর হালুয়া।

এসব ছাড়াও, পাড়ায় যে কটা বিয়েবাড়ী, অন্নপ্রাশন, পৈতে, শ্রাদ্ধ, মায় সাধভক্ষণ কিচ্ছু বাদ দিত না। তখন ক্যাটারারের এত রমরমা হয়নি। আর হলেও কাজের বাড়ীতে গায়ে গতরে খাটার লোকের দরকার পড়েই। আর সবাই বটাকে চিনত। কাজেই এন্ট্রি পেতে খুব একটা অসুবিধা হত না। আর কেই বা অত ভীড়ের মধ্যে কোনও রবাহূতকে নজর করে। তবে বটা খাটত ঘোড়ার ডিম। সবকটা কাজের বাড়ীতে গিয়ে যেন খুব ব্যস্ত এরকম ভাবভঙ্গী ফুটিয়ে ফেলত চোখেমুখে। বেজায় হাঁকডাকও করত। তারপর “হ্যাঁ মেসোমশাই, আমি কলাপাতা কাটার ব্যবস্থা করে ফেলেছি” অথবা “ওরে নিমে, দিদিমাকে জল দে, মাসীমা কে বসার চেয়ার দে” ইত্যাদি করে যেত সমানে।

এ হেন বটাও কিন্তু চাকরীর অফার পেয়েছিল। কিন্তু খুব বুক ফুলিয়ে বলেছিল, আমি শিক্ষক মানুষ। আমার কি অমন গোলামী করা মানায়? যাকে বলেছিল, সে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেছিল সন্দেহ নেই।

এভাবে আমরা বড় হতে থাকলাম। মানুষের চরিত্র বদলাতে লাগল। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙ্গেচুরে বাহান্নবর্তী হয়ে গেল। পুজোফুজোর ধুম নকুলদানা বাতাসাতে গিয়ে ঠেকল। বটাকে স্নেহ করার মানুষ কমতে শুরু করল। তাও বটা চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু ব্যাপারটা রেগুলার রইল না। মানে নৈশভোজের পাত থেকে ঘাড় ধরে “বেরো শালা!!” বলে তুলে দেওয়া হচ্ছে বটাকে, এমন দৃশ্যও দেখা যেতে লাগল। কিন্তু মানুষের তো খিদে পায়। বটাও মোটামুটি মানুষই। তাই বটারও খুব খিদে পেত। আর বলতে নেই, বটা এসব ব্যাপারে সেলসম্যানসুলভ নির্লিপ্তি অর্জন করেছিল। কী আর করবে, বড়জোর তাড়িয়ে দেবে। ওসবে ওর কিছু এসে যেত না। মোটামুটি কোনও বাড়ীতে লোকসমাগম হলেই বটা সকাল থেকে ঘুরঘুর শুরু করে দিত। টিউবওয়েল থেকে জল তুলে দেওয়া, উঠোনটা ঝাঁট দিয়ে দেওয়া, গাছের শুকনো পাতা সাফ করে দেওয়া। সব সময় যে খেতে দিত তা না, তবে পাড়ার ছেলে তো, মাঝে মধ্যে জুটেও যেত।

তখন আমরা কলেজ টলেজে পড়ি। বটা আমাদের থেকে কখনও সখনও বিড়ি টিড়ি চাইত। খোঁজ নিত, আশেপাশে কাজের বাড়ী আছে কিনা।

কিন্তু কারুর দুঃখ চিরকাল থাকে না। বটা প্রায় কলম্বাসের মতো আবিষ্কার করল তার পুকুর কলমীশাকে ছেয়ে গেছে। বটার সামনে খুলে গেল বিশাল এক খাদ্যভাণ্ডার। কোনওমতে চালটা জোগাড় করার ওয়াস্তা। দিনের পর দিন কলমীশাকের ঝাঁক আধসাট করে বটা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখল। রোজই দেখতাম এক হাঁটু জলে নেমে কলমী তুলছে। আমাদের দেখলে হেসে বলত, বুঝেছিস, একটু নুন আর লঙ্কা দিয়ে ভেজে যা লাগে না। আঃ!!!

তা এভাবেই দিন চলতে থাকে। পৃথিবী ঘুরতে থাকে। সময় ছাপ ফেলতে থাকে আমাদের কোষে কোষে। আমাদের খিদে বাড়তে বাড়তে অবশেষে কমতে থাকে।

তারপর কেটে গেছে অনেকদিন। আমিও কলকাতা ছেড়ে বাইরে চলে গেলাম। কেটে গেল অনেকগুলো বছর।

অবশেষে আবার ফিরলাম কলকাতায়। অন্য অঞ্চল, আপাত অপরিচিত, বহুদিন পর পরিচিত মানুষই কিরকম অচেনা লাগে, এ তো শহর। সেই ছোটবেলার কলকাতার স্বাদ নেব বলে চলে গেলাম পুরনো পাড়াতে।

সেই দর্মার দেওয়াল ওয়ালা বটার ঘর। একমাথা ধবধবে সাদা চুল নিয়ে বটা বসেছিল দাওয়ায়। হাড় জিরজিরে চেহারা। পাড়াটা অবশ্য একই আছে। হয়ত আমিও একই ছিলাম, বটা চিনে ফেলল এক দেখাতেই।

জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছো বটাদা?”

এক মুখ হেসে পুকুরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল “অনেক দিন কলমীশাক খাইনি রে…”

বেহালার আরও অনেক পুকুরের মতোই, কোনও এক জাদুমন্ত্রে পুকুর উধাও হয়ে সেখানে চারতলা সাতশো আশি স্কোয়্যার ফিট টু বি এইচ কে।

বটার খাবার শেষ…