চৈতি মৈত্র
রূপকথা নয়, বাস্তবে সত্যিই এক আশ্চর্য দেশ দেখে এলাম, যেখানে অপার প্রকৃতি আর শান্তি হাতধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে মানবসম্পদের এই ব্যতিক্রমী যুগলবন্দি চাক্ষুষ করতে গেলে আমাদের যেতেই হবে ‘এশিয়ার সুখীতম দেশ’–এর তকমা পাওয়া এই ছোট্ট দেশটিতে।
২০১৭-র ১৪ মার্চ কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বিমানবন্দর থেকে রাত ৩টে ৫০ মিনিটে রওনা দিলাম চিনের কুন্মিঙের উদ্দেশে। গন্তব্য সমুদ্রঘেরা পূর্ব এশিয়ার একটা ছোট্ট দ্বীপবিন্দু— তাইওয়ান। মোট আয়তন ৩৬,১৯৩ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৩,৮০৮,২৭৯ জন। স্বশাসিত এই দ্বীপটির সরকারি নাম চুং-হুয়া মিন-কুও বা রিপাবলিক অফ চায়না। জনসংখ্যার নিরিখে সুইজারল্যান্ড বা বেলজিয়ামের সমগোত্রীয় আর আয়তনে পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেকেরও কম। উত্তরদিকে রয়েছে চিনসাগর, দক্ষিণে বাশি প্রণালী, পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর আর পশ্চিমে তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে ঘেরা এক অপূর্ব শান্ত সমাহিত ভূখণ্ড এই তাইওয়ান দেশটি।
যাইহোক, কুনমিঙে পৌঁছানোর কথা ৫টা ৪৫ মিনিটে, কিন্তু দেরিতে বিমান ছাড়ার কারণে আমরা হাজির হলাম সকাল ৯টা নাগাদ। যাত্রা শুরু করেছিলাম গভীর তমসাচ্ছন্ন নিশীথে, মাঝ আকাশে দেখলাম অনির্বচনীয় সূর্যোদয় আর মাটিতে পা রেখেই অনুভব করলাম হিমশীতল বাতাসের তীব্র ঝাপটা। ইতিমধ্যে এয়ারপোর্টের ঘড়ির সঙ্গে নিজেদের ঘড়ি মিলিয়ে বুঝলাম আমরা আড়াই ঘন্টা সময় হারিয়ে ফেলেছি মহাকালের বুকে। কনকনে ঝোড়ো বাতাসের ঝাপটাকে আত্মস্থ করতে করতেই মুখোমুখি হতে হল ইমিগ্রেশনের ঝঞ্ঝাটের। তখনও বুঝিনি আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করে রয়েছে আমাদের জন্য। দেরির কারণে তাইওয়ানগামী বিমান আগে ছেড়ে চলে গেছে। অগত্যা চায়না ইস্টার্ন এয়ারওয়েজ-এর বদান্যতায় আমাদের মতো বেশ কিছু দেশিবিদেশি যাত্রীকে একটা গোটা দিন কুনমিঙের সেরান হোটেলে অবস্থান করতে হল। পরদিন বেলা ৩টেয় তাইওয়ানের বিমান ছাড়বে অথচ ট্রানজিট ভিসা নিয়ে চিনের যত্রতত্র ঘোরা যাবে কিনা জানি না, তাই একরকম বাধ্য হয়ে হোটেলবন্দি হলাম। সন্ধে ৬টায় রাতের খাবার খেতে একবার মাত্র হোটেলের পক্ষ থেকে নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান সকল আবাসিককে নিয়ে যাওয়া হল কাছের একটা রেস্টুরেন্টে। সেখানে একই টেবিলে নানা দেশের মানুষের সঙ্গে বসে এলোপাথাড়ি অজানা সব পদ চাখতে চাখতে মহান কিছু মিলনবোধ না জাগলেও সকলেই সকলের দিকে তাকিয়ে বারকয়েক মিষ্টি হাসি বিনিময় করলাম। বিদেশের মাটিতে স্বদেশের মানুষমাত্রকেই কেমন যেন আপন মনে হয়। তাই সহজেই আলাপ হয়ে গেল ছত্তিশগড়ের বাসিন্দা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। যিনি কর্মসূত্রে দীর্ঘ ১০ বছর তাইওয়ানে থাকছেন, জীবনসঙ্গীকেও বেছে নিয়েছেন সেখান থেকেই। অসম্ভব কর্মঠ ও স্বল্পবাক্ সেই তরুণী একাই অবলীলাক্রমে তাঁর দুই শিশুসন্তানকে সামলাচ্ছেন। তখনও বুঝিনি এ শুধু নারীশক্তির সামান্য ট্রেলার মাত্র। নারীস্বাধীনতার যে রূপ আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবো, তার সঙ্গে আগে কখনো আমার পরিচয় হয়নি।
১৫ই মার্চ বেলা তিনটেয় সিচুয়ান এয়ারলাইনস–এর বিমানে চড়ে কুন্মিং ছাড়লাম, রওনা দিলাম সমুদ্রকন্যা তাইওয়ানের উদ্দেশে। পৌঁছালাম ৬টা নাগাদ, তাইপেই এয়ারপোর্ট। ভারতবর্ষ থেকে বিমানপথে তাইপেই আসতে ঘন্টাছয়েক লাগে, তবে দুবার বিমান বদল করে আসতে হয়। চিন বা ব্যাঙ্কক দু জায়গা থেকেই আসা যায় তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেইতে। আমাদের গন্তব্য তাইওয়ানের পশ্চিম উপকূলের ছাঙ্গুয়া শহর, তাইপেই থেকে যার দূরতে ১৯০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। লাগেজ সংগ্রহ করে, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে প্রথমে চড়ে বসলাম ইউ বাসে, পরে লোকাল ট্রেনে। দীর্ঘ ১৭ বছর শিয়ালদহ মেন লাইনের নিত্যযাত্রী আমি, বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা তারও দ্বিগুণ বেশি, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রার সূত্রে। কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এত আরামদায়ক, এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিষেবাযুক্ত হতে পারে। একশো শতাংশ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কথা ছেড়েই দিলাম, টয়লেট, ডাস্টবিন, ডিজিটাল বোর্ড, পর্দা টানা সুবিশাল জানলা, প্রশস্ত সিট, সাধারণ মানুষের জন্য এত বিলাসবহুল যাত্রাব্যবস্থা! ভুল বললাম, এটা হয়তো সাধারণ মানুষের প্রাপ্য ব্যবস্থা, যেটা আমরা ভারতীয়রা কল্পনাও করতে পারি না। দুশ্চিন্তায় জর্জরিত হই এই ভেবে যে আদৌ ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এই পরিবহনব্যবস্থায় আমরা নিত্য যাতায়াত করে চাকরি করতে পারব তো? আরও একটা বিষয় আমায় আশ্চর্য করল, বাসে ট্রেনে কোনও লেডিস সিট চিহ্নিত করা নেই। তার বদলে সর্বত্র রয়েছে প্রায়োরিটি সিট। যেখানে শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী মহিলা যে কেউ বসতে পারে। অর্থাৎ নারীপুরুষের শারীরিক সক্ষমতার যে প্রচলিত তুলনা তা এখানে গোড়াতেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।
ছাঙ্গুয়া স্টেশনে পৌঁছালাম রাত প্রায় সাড়ে দশটায়। এক তাইওয়ানি বন্ধু এরিকের বদান্যতায় মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের অস্থায়ী বাসস্থানে। এক আশ্চর্য মানুষ এরিক, বয়স ৬৫ বছর। নয় পুরুষ ধরে তাইওয়ানের বাসিন্দা। এই বয়সে ভর্তি হয়েছে ইংরেজি ভাষা শেখার কোর্সে। পথ দুর্ঘটনায় দীর্ঘদিন আগে স্ত্রীকে হারিয়েছে। একমাত্র ছেলে, ভাই ভাইঝি আর অসমবয়সি একদল বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই জীবনটাকে চুটিয়ে উপভোগ করছে। ইংরেজি শেখা ছাড়া নিজের গাড়ি চালিয়ে বন্ধুবান্ধবদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার শখ রয়েছে এরিকের। সবচেয়ে অবাক হলাম এরিকের বিশ্ব-ইতিহাসের জ্ঞান দেখে। সুদূর তাইওয়ানে বসে এরিক একের পর এক বলে চলল প্রাচীন সিন্ধু-সভ্যতা, গঙ্গা নদী, আগ্রার তাজমহল প্রভৃতির কথা। লজ্জা পেলাম আমরা, যারা এরিকের দেশের ইতিহাস প্রায় কিছুই জানি না। মনে পড়ল ভারতীয়রা চিরকালই ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন, তা সে নিজের হোক বা অন্য দেশেরই হোক। বেশিরভাগ সময়েই বিদেশি ইতিহাসবিদদের লেখা পড়ে আমাদের স্বদেশকে জানতে হয়। কাব্য ও দর্শন আমাদের যতটা ভাবায়, ইতিহাস বোধহয় ততটা নাড়ায় না।
এই আত্মগ্লানি থেকে পরদিন থেকেই তাইওয়ানের ইতিহাস জানার প্রচেষ্টা শুরু করলাম। যেটুকু জানতে পারলাম তাতে বুঝলাম তাইওয়ানও ভারতবর্ষের মতই “মন দেওয়া নেওয়া অনেক করেছে, মরেছে হাজার মরণে/ নূপুরের মতো বেজেছে চরণে চরণে”। তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে চিনের মানুষ প্রথম জানতে পারে এই দেশের কথা। ১৫৯০ সালে পর্তুগিজরা এই দেশে এলে, এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নাম রাখে ‘ফরমোজা’, যার অর্থ Beautiful Island। এরপর একে একে ডাচ ও স্পেনীয়রা পা রেখেছে ফরমোজায়। তখনও পর্যন্ত ফরমোজার অধিবাসীরা প্রায় সকলেই ছিল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বসবাস করে আসা পাহাড়ি আদিবাসী। যাদের সঙ্গে চিনের মূল ভূখণ্ডের জীবনচর্যার তখনও পর্যন্ত খুব একটা সাদৃশ্য ছিল না। ১৬৬০-১৮৯৫ পর্যন্ত চিন মূল ভূখণ্ডের শাসনাধীন থাকে এই দেশ। পরবর্তীকালে জাপান উপনিবেশ গড়ে তোলে তাইওয়ানে, ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানি শাসন, যার অবসান হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। জাপান আবার চিনকে তাইওয়ান হস্তান্তর করলে ১৯৪৯ সালে তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় চিনের জাতীয়তাবাদী সরকার অর্থাৎ চিয়াং কাই শেক-এর নেতৃত্বাধীনে। বর্তমানে তাইওয়ান রিপাবলিক অফ চায়না— এই রাজনৈতিক স্থিতিতে উপনীত হয়েছে।
যাইহোক্ এবার ফিরে আসি ভ্রমণবৃত্তান্তে। ১৬ আর ১৭ মার্চ ছাঙ্গুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় দোকান বাজার ঘুরে বেশ কেটে গেল। রাস্তাঘাটে গাড়ি চললেও হর্নের কোনও শব্দ শুনতে পেলাম না। চারপাশে অদ্ভুত শান্তি আর নীরবতা। জানতে পারলাম খুব প্রয়োজন ছাড়া এখানে গাড়ির হর্ন কেউ বাজায় না। লক্ষ করলাম রিক্সা, অটো জাতীয় কোনও স্বল্পদূরত্বের যানবাহন নেই। পুরুষ-নারী বয়সনির্বিশেষে সকলেই সাইকেল, স্কুটি, ইউবাইক বা চারচাকা গাড়ি চালাচ্ছে। প্রয়োজনে ট্যাক্সি রয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিক পরিবহনের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল। বাড়ির কাজকর্ম করে দেওয়ার জন্য পরিচারক বা পরিচারিকার কোনও চিহ্নও দেখতে পেলাম না। গৃহকর্ম, বাজারহাট, বাগান করা, পোষ্য বা শিশুদের লালনপালন, বৃদ্ধবৃদ্ধার সেবাযত্ন সমস্তই নিজেদের করতে হয়। ফলে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বঙ্গদেশজ কোনও অলস আড্ডা বা দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার মৌতাত লক্ষ করা গেল না। সকালে ৭টা-৮টা, দুপুরে ১১টা-১২টা আর রাতের খাওয়া ৬টা-৭টার মধ্যে শেষ। রান্না-খাওয়ারও বিশেষ ঝামেলা নেই। চারিদিকে প্রচুর স্বাস্থ্যকর, ন্যায্যমূল্যের ছোট-বড় খাবার দোকান রয়েছে, যেখানে হরেকরকমের মোমো, বাউচি, সসেজ, সসেমী, সুশি, ফ্লাইং ফিস, নুডলস, রাইস, সামুদ্রিক প্রাণী যেমন ঝিনুক, অক্টোপাস, কাঁকড়া, স্কুইড, প্রন পাওয়া যাচ্ছে। লোভনীয় কেকের দোকান, নানা ধরনের ডেয়ারি প্রডাক্ট যেমন দই, পুডিং, সয়ামিল্ক, সয়ামিল্ক দিয়ে তৈরি টোফু অঢেল পাওয়া যাচ্ছে। ভরপেট লাঞ্চবক্সের দাম ভারতীয় টাকায় ১২০ টাকা। যাতে ভাতের সঙ্গে তিন ধরনের সবজি, ডিম বা পর্ক বা চিকেনের খণ্ড থাকছে। হাইজিন রক্ষার প্রয়োজনে প্রতিটি ছোটবড় খাবার দোকানের কর্মচারীর মুখে মাস্ক, মাথায় হেয়ার ক্যাপ, এবং হাতে গ্লাভস। প্লাস্টিকের বিবিধ ব্যবহার সত্ত্বেও যেখানে সেখানে প্লাস্টিক ফেলে পরিবেশ দূষণ ঘটায় না কোনও নাগরিক।
খাবারের গুণগত মান অনুযায়ী দাম খুব বেশি মনে হল না। শাকসবজির মধ্যে দেখলাম বাঁধাকপি, মুলো, গাজর, একধরনের ঝালহীন বড় বড় সবুজ লঙ্কা, সাদা করলা, ক্যাপসিকাম, সী উইড, অ্যালগি, কুমড়ো, সুইট কর্ন, বেগুন, লেটুস পাতা, নানা ধরনের মাশরুম, চেরি টমেটো রয়েছে। দু এক জায়গায় ভেন্ডিও দেখলাম, একেবারেই দেখা পেলাম না পটলের। “প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা যদি খসে” কথাটা কদিন ধরেই মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে অযথা অশান্তির সৃষ্টি করছিল, এখন বুঝলাম দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই, কারণ এদেশে পটল তোলার কোনও সুযোগ হবে না। শুনলাম এখানকার প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যবিমা পুরোপুরি সরকারি পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত, যার জন্য তাঁদের নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত টাকা দিতে হয় এবং ওষুধ সহ ছোট বড় চিকিৎসার সব খরচ পাওয়া যায়।
ন্যাশনাল ছাঙ্গুয়া ইউনিভার্সিটি অফ এডুকেশন দর্শন আর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ১৯৭১-এর আগস্টে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। স্বল্প পরিসরে অত্যন্ত পেশাদার স্থপতির সাহায্যে বানানো হয়েছে সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য নিজস্ব অডিটোরিয়াম, রয়েছে পর্যাপ্ত খেলাধূলার ব্যবস্থা। আশ্চর্য হলাম ইউনিভার্সিটির মধ্যে ৪০০ (400) মিটারের সুবিশাল আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম দেখে, যেটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম ম্যাট্রেসে সজ্জিত, সযত্নে লালিত বাগানে রংবেরঙের ফুলের সমারোহ, মাছ ও কচ্ছপে পরিপূর্ণ নীল জলের লেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। লেকের চারপাশটি ভারি সুন্দর, বক, পায়রা, ব্ল্যাকসোয়ান আর রাজহাঁস খেলে বেড়াচ্ছে। একদিকে আধুনিকতা অন্যদিকে প্রকৃতি যেন এখানে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতবর্ষের এককালের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মত সুমহান ঐতিহ্য না থাকুক, শিক্ষার আদর্শ পরিবেশ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক, শিক্ষার্থীর আচরণ, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা তথা বিদ্যাশিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ দেখে একজন শিক্ষিকা হিসেবে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে পারলাম না। ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পড়াশুনো, শরীরচর্চা, সংস্কৃতিচর্চার অতিরিক্ত কোনও বিষয়ে মগ্ন নেই। শিক্ষাঙ্গনে কোনও রাজনৈতিক দাপাদাপি নেই। Paradise Lost-এর যন্ত্রণার চেয়ে কোনও অংশে কম নয় শিক্ষার পরিবেশকে নিত্যদিন একটু করে ভেঙে পড়তে দেখা। বর্তমানে প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে এমনি একটা সুস্থ, শান্ত, সমাহিত শিক্ষার পরিবেশ আমরা কি পেতে পারি না— মনের ভেতর থেকে তীব্র হতে থাকে এই আকাঙ্ক্ষা।
ছাঙ্গুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির আকার ও ছাত্রসংখ্যা দেখে মনে হল এদেশে পুথিগত জ্ঞান অর্জনের চেয়ে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক বিষয়ে দক্ষতার চাহিদা বেশি। এদের সারা দেশ জুড়ে প্রযুক্তিবিদ্যার যে জয়জয়কার, তার বীজ হয়তো এখানেই নিহিত। সমাজের সব শ্রেণির, সব পেশার এবং সব বয়সের মানুষ প্রযুক্তিবিদ্যায় স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সব সমস্যার সমাধানে সদা হাজির। একটিমাত্র স্মার্ট কার্ড বা ইজি কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা, সাইকেল বাইক চড়া, এমনকি ট্রেনযাত্রা কোনওকিছুই অসম্ভব নয়। যে ডিজিটাল ইন্ডিয়া গড়ার স্বপ্ন আমরা এখনও দেখে চলেছি, তার একটুকরো মডেল দেখলাম তাইওয়ানে।
১৮ই মার্চ ভোরবেলা আমরা বাস ধরে রওনা দিলাম তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেইর উদ্দেশে। ছাঙ্গুয়া থেকে যার দূরত্ব ১৯০ কিমি, ইউ বাসে সময় লাগল আড়াই ঘন্টা, ভাড়া মাথাপিছু ৩০০ NTD করে, অর্থাৎ ভারতীয় টাকায় ৬০০/-। তাইপেই বাসস্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি করে পৌঁছানো গেল ডেয়ারি অফ তাইপেই-তে। হোটেলটি তাইপেই মেট্রো স্টেশনের খুব কাছে। হোটেলে মালপত্র রেখে পেটভরে রাজসিক ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা রওনা দিলাম শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার উদ্দেশ্যে। মেট্রো ধরে প্রথমেই পৌঁছালাম চিয়াং-কাই-শেক মেনোরিয়াল হলে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই-শেকের স্মরণে এই সৌধটি বানানো শুরু হয়েছিল ৩১শে অক্টোবর, ১৯৭৬-এ, শেষ হয় ৫ই এপ্রিল, ১৯৮০-তে। দৃষ্টি আকর্ষণ করল চিয়াং-কাই-শেকের মূর্তির দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জীবন্ত অথচ অনড়, অটল প্রস্তরবৎ দুই রক্ষী। খুব ভালো করে খালি চোখে তাকিয়েও যাদের মূর্তি ছাড়া আর কিছু বলে বিশ্বাস হয় না।
এরপর মেট্রো ধরে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পরবর্তী গন্তব্য তাইপেই ১০১-এর সুউচ্চ স্কাইস্ক্র্যাপারের নিচে। জিন-ই জেলার এই অর্থনৈতিক কেন্দ্রটির উচ্চতা ৫০৯.২ মিটার। ১০১ তলা এই বাড়িটির নির্মাণ শেষ হয় ৩১শে ডিসেম্বর, ২০০৪ সালে। ১০১-এর বেশ কয়েকটি তলা জুড়ে বিলাসবহুল শপিং মল, নিচের তলায় সারি সারি নামী দামি ফুড কোর্ট, দেশ বিদেশের রকমারি সুস্বাদু খাবার রান্না হচ্ছে সেখানে। তাইওয়ানিজ বন্ধু ইচার পরামর্শে খাদ্যরসিক বঙ্গসন্তানরা ঢুকে পড়লাম দিন তাই ফুং নামের একটি রেস্তোরাঁয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ পৃথিবীর সেরা দশটি রেস্তোরাঁর মধ্যে দিন তাই ফুং–কে রাখা হয়েছে। ১৯৭২ সালে তাইপেইতে প্রথম পত্তন হয় এই রেস্তোরাঁর। তাইওয়ান ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, চিন, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, ম্যাকাও এবং তাইল্যান্ডে এদের শাখা রয়েছে। এখানকার বিশেষত্ব নানা ধরনের ডাম্পলিং, আমরা যাকে বলি মোমো। অপূর্ব স্বাদের নানারকম ডাম্পলিং বানানো হয় এখানে। কোনওটা পর্ক শ্রিম্প, কোনওটা ফিশ, কোনওটা শুধুই পর্ক ডাম্পলিং। দামও আহামরি নয়। বিশেষত যেভাবে হাইজিন মেনে খাবার বানানো হচ্ছে, এবং খাবারের গুণগত মান এত ভালো, তার প্রেক্ষিতেই তিন প্লেট ফ্রায়েড রাইস, তিন প্লেট মোমো ভারতীয় মুদ্রায় ২৪০০ টাকা। আহারের পর আবার মন দেওয়া গেল বিহারে।
তাইপেই থেকে ট্রেন ধরে শিলিন (Shilin), সেখান থেকে বাসে মিনিট কুড়ি গিয়ে ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়াম। এটি বিশ্বের সুবৃহৎ যাদুশালাগুলির মধ্যে একটি। যার সংগ্রহে আছে প্রাচিন চিন সাম্রাজ্যের প্রায় ৭,০০,০০০ হস্তশিল্পের নমুনা। ১৯৬৫ সালের ১২ই নভেম্বর মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে ৮০০০ বছরের চৈনিক শিল্পকলা ও রাজপরিবারের ব্যবহৃত সামগ্রী রাখা হয়েছে। এশীয় শিল্পকলার এক বৃহৎ চমৎকার সংগ্রহশালা এই ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়াম। যাদুশালা দেখে এই দিনের মতো ঘোরা শেষ হল। তাইপেইতে ফিরে হোটেলে বিশ্রাম আর অপেক্ষা আগামীদিনের অজানা সফরের।
১৯শে মার্চ খুব সকালে এমআরটি স্টেশন থেকে রওনা দিলাম। তাইওয়ানের পূর্ব উপকূল বরাবর হোয়ালিয়েন-এর উদ্দেশে। শহর ছাড়িয়ে সুপ্রশস্ত আরামদায়ক ট্রেন এঁকে বেঁকে অজস্র পাহাড়ি টানেলের মধ্যে দিয়ে রওনা দিল গন্তব্যের দিকে। মনে পড়ে গেল ভাইজ্যাগ থেকে তিরন্ডুল এক্সপ্রেসে চড়ে আরাকু যাত্রার কথা। এখানে কামরার অনেকটাই কাঁচের তৈরি হওয়ায় বাইরের প্রকৃতিকে আরও বেশি উপভোগ করতে করতে চললাম। হঠাৎই বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে দেখলাম ট্রেনের পাশে পাশে চলেছে নীলচে সবুজ, আদিগন্ত বিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগর। বিভোর হয়ে তাকিয়ে আছি, পিছন থেকে সুপরিচিত বঙ্গ কণ্ঠে শুনলাম—
সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কত,
কখনও তো হই নাই ক্লান্ত,
তথাপি মনে মোর
প্রশান্ত সাগরের ঊর্মিমালা অশান্ত।
মানবমনের অশান্ত চিন্তাতরঙ্গকে যেন সেদিন দুচোখ ভরে প্রত্যক্ষ করলাম। হোয়ালিয়েন পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় আড়াই ঘন্টা। ট্রেন ভাড়া লাগল মাথাপিছু ৮৮০ এনটিডি। হোয়ালিয়েন পৌঁছে আমাদের গাইডের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে ভাষার সমস্যায় পড়তে হল। বস্তুত তাইওয়ান সফরে পদে পদে এই ভাষার সমস্যায় বিপাকে পড়তে হবে। অধিকাংশ মানুষজন কথা বলে তাইওয়ানিজ হক্কিয়েন, তাইওয়ানিজ হাক্কা, তাইওয়ানিজ মান্দারিন-এ। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ লোক কথা বলে হক্কিয়েন–এ। অফিসিয়াল কাজকর্ম হয় স্ট্যান্ডার্ড মান্দারিন চাইনিজ–এ। উচশিক্ষা, প্রযুক্তি সর্বত্র মাতৃভাষার জয়জয়কার। মাইক্রোওয়েভ, ওয়াশিং মেশিনে পর্যন্ত মাতৃভাষায় নির্দেশ লেখা। সুতরাং চাইনিজ ভাষা না জানা বিদেশিদের পক্ষে পদে পদে ঠোক্কর খাওয়ার সম্ভাবনা। ট্রেনে, বাসে চাইনিজ ভাষায় ঘোষণা বোঝা, দোকানে বাজারে জিনিসের দাম জানতে চাওয়া— বেশ দুষ্কর। ভারতবর্ষের বহু মানুষ যেমন ইংরেজি ভাষা জানেন বা শব্দগুলোর সাহে খানিকটা পরিচিত, ওখানে তা মনে হল না। কেবলমাত্র মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ যেখানে পেশাগত কারণে বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়, সেখানে ইংরেজি জানা কিছু মানুষ পাওয়া যেতে পারে। এরই মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম আমাদের বন্ধু এরিক। যিনি ৬৫ বছর বয়সে নিতান্ত শখে ইংরেজি শেখার ক্লাসে ভর্তি হয়েছেন। তবে তাইওয়ানের নতুন প্রজন্ম এই ভাষা-সঙ্কট ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠবে বলে মনে হয়।
যাইহোক, হোয়ালিয়েনে অতিকষ্টে আমাদের মহিলা গাইড এমির সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলে তা গাড়িতে চড়েই আমরা রওনা দিলাম স্টেশনে অনতিদূরে হোটেল চান তাই–তে। তিন বেডরুমের ঘর ভাড়া ১৩০০ নিউ তাইওয়ান ডলার আর দুই বেডরুম হল ১০০০ এনটিডি। ভারতের টাকায় ২৬০০ আর ২০০০। ঘর যথেষ্ট প্রশস্ত, সর্বসুবিধাযুক্ত হোটেলে জিনিসপত্র রেখে আমরা সদলবলে এমির ৯ সিটের গাড়িতে চড়ে রওনা দিলাম অষ্টম আশ্চর্যের অন্যতম চিং সুই ক্লিফ (Qingshui Cliff) দেখতে। সমুদ্রতল থেকে ৮০০ মিটার উঁচু এবং প্রায় ২১ কিমি লম্বা এই দুরারোহ পর্বতগাত্র, যার প্রায় ৫ কিমি অংশ রয়েছে সমুদ্রের বক্ষলগ্ন হয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের নীলচে সবুজ গভীর জলরাশির পাশে যে ধূসর পর্বতগাত্র নিঃসন্দেহে এক সার্থক যুগলবন্দি তৈরি করেছে।
পরবর্তী গন্তব্য শাকাদং ট্রেল (Shakadang Trail), পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুলে থাকা পাথুরে পথে নদীর পাশাপাশি পথ চলা। এই ট্রেল-টি পরিচিত মিস্টিরিয়াস ভ্যালি ট্রেল নামে। বাংলায় ট্রেল শব্দটির অর্থ শিকারিদের অনুসরণীয় পথ বা দুর্গম দেশের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পথ। শাকাদং নদীর স্ফটিকস্বচ্ছ টারকোয়াইজ বর্ণের ধীর জলধারার জন্য এই ট্রেল-টি বিখ্যাত। নদীর মাঝে বিভিন্ন ধরণের মার্বেল বোল্ডার স্থানটির শোভা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক মনোহর সৌন্দর্য এই ধীরগতির পার্বত্য নদী ও তার চারপাশের অনুপম প্রকৃতি। তারোকো ন্যাশনাল পার্ক-এর অন্তর্গত এই স্থানটি হাইকিং ও ট্রেকিং–এর জন্য উপযুক্ত। এই পার্বত্য পথে চলার সময় একটি ট্রুকু উপজাতিদের গ্রাম পড়বে, যদিও সেখানে প্রবেশ অনুমতিসাপেক্ষ। হাঁটাপথে কমবেশি দু ঘন্টা লাগবে ট্রেল-টি ঘুরতে। সাধারণত গ্রীষ্ম ও শরৎ এখানে আসার উপযুক্ত সময়।
শাকাদং ছেড়ে এমি তার ড্রাইভার আর্জানের গাড়ি ছুটিয়ে চলল আর এক অচিন দেশে। দুচোখে তখনও শান্ত স্বচ্ছতোয়া স্রোতস্বিনী সুন্দরী শাকাদং। অজস্র পাহাড়ি সেতু আর টানেল অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালাম তারোকো গিরিসঙ্কট (Gorge)-এর মুখে। যেখান থেকে শুরু হচ্ছে টানেল অফ নাইন ট্রুনসি। সেন্ট্রাল ক্রস ইসলান হাইওয়ের ওপর প্রতিটি পাহাড়ি বাঁকে লুকিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্য। গাইডের নির্দেশে প্রত্যেককে মাথায় পরে নিতে হল হেলমেট, ল্যান্ডস্লাইডের আশঙ্কায়। ১৯ কিমি লম্বা এই গিরিখাতটি তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। মূলত মেটামরফিক পাথর যেমন মার্বেল, নীস, শিস্ট দিয়ে তৈরি খাড়া পাহাড়ের গা। নিচে প্রবাহিত খরস্রোতা লিউই নদী। ট্রুকু উপজাতিদের ভাষায় তারোকো কথার অর্থ ‘অসাধারণ এবং অপূর্ব’। স্বাভাবিক প্রকৃতি, বন্যজীবন ও ইতিহাস্ম এই সবকিছুকে রক্ষা করার তাগিদে ১৯৮৬ সালের ২৮শে নভেম্বর তারোকো জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠা হয়। এখানে সর্বমোট ১৪৪ প্রজাতির পাখি রয়েছে। যার মধ্যে ১০ শতাংশ তাইওয়ানের দেশীয়। ৩০ ধরনের বৃহৎ স্তন্যপায়ী, ২৫১ রকমের প্রজাপতি, ৩২ ধরনের সরীসৃপ এবং ১৮ রকমের মাছ রয়েছে। তারোকোতে সোয়ালো গ্রোটো এক অনবদ্য প্রাকৃতিক পাখিরালয় যেখানে পাহাড়ের গায়ে সোয়ালো পাখির কলস্বর, গর্জনশীল লিউই নদীর মুখরতাকেও ছাপিয়ে যায়।
এদিনের সর্বশেষ গন্তব্য চিজিংতান (Qixintan) বিচ। সেখানে পৌঁছে মনে হল “সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে”। যেন বহুদিনের পথ চলার শেষে পরম আকাঙ্ক্ষিতের দর্শন। রংবেরঙের নুড়িপাথর বিছানো সমুদ্রতট (Pebble Beach) দেখলাম প্রথম আর সেই বর্ণময় তটের প্রান্তরেখা ধরে অভিবাদনরত সুগভীর নীল জলরাশি। যাকে এতদিন চলমান গাড়ি বা ট্রেন থেকে অতৃপ্তের মতো ঝলক দর্শন করেছি এখন সে আমার দু নয়নের মাঝে। সমুদ্রের তটরেখা বরাবর সারি সারি পাহাড়, মাথায় মেঘের মুকুট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিচ প্যাভিলিয়ন থেকে সন্ধ্যা নামার সেই মুহূর্তে ভেসে এল অজানা ভাষায় লেখা গানের সুর আর সুরেলা বাদ্যধ্বনি। অস্তমিত সূর্যের আভায় চারপাশের পৃথিবীকে অসম্ভব মায়াময় এক সুন্দরীর রূপ ধারণ করতে দেখলাম, মনে হল তরুণী ঊষার চেয়ে মাধুর্যে কোনও অংশে কম নয় এই প্রৌঢ়া সন্ধ্যা। ফেরার পথে দেখে নিলাম হোয়ালিয়েনের বর্ণময় নাইট মার্কেট, রকমারি দেশি বিদেশি খাবারে, সুরায় ও সংগীতে প্রাণোচ্ছ্বল অথচ সংযত পরিবেশ।
২০শে মার্চ হোয়ালিয়েন থেকে সকাল সকাল এমি আর আর্জানের সঙ্গে গাড়ি চড়ে রওনা হওয়া গেল তাইতুং (Taitung)-এর উদ্দেশে। হোয়ালিয়েন থেকে যার দূরত্ব ১৬৭.৫ কিমি। পথে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্র দেখব আমরা, যার প্রথমেই রয়েছে খাদো পাহাড়ের উপকণ্ঠে নিওসান হুতি বিচ (Niushan Huti Beach)। খাড়া পাহড়ি রাস্তা দিয়ে নিচে নেমে এল গাড়ি। বনজ ও প্রাণীজ সম্পদ দিয়ে সাজানো বিচ লাগোয়া অঞ্চলটি বাস্তুতন্ত্রের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা, সেই সঙ্গে অবারিত সমুদ্রতট, হাইকিং, পাখি বা প্রজাপতি দেখার জন্যে উপযুক্ত।
তাইতুং যাবার পথে আরও এক প্রাকৃতিক বিস্ময়ের সামনে মাথা নত করে দাঁড়াতে হল, যার নাম শিটিপিং কোরাল রীফ (Shitiping Coral Reefs)। প্রবাল প্রাচীর ও আগ্নেয় পাথর দিয়ে তৈরি এই ওয়েভ কাটিং বিচ দর্শন সত্যিই এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। সুউচ্চ পাথুরে বিচের গায়ে অজস্র পট হোল যার মধ্যে খেলা করছে নানা ধরনের মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী। স্নোরকেলিং (Snorkelling)-এর স্বর্গ এই Shitiping। পাথরের খাঁজে খাঁজে সমুদ্রের জল এসে প্রতিমুহূর্তে সজোরে আছড়ে পড়ছে আর লক্ষ হীরের মতো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। নিরন্তর এই ভাঙা-গড়া দেখতে দেখতে প্রবালপ্রাচীরের আরও খানিকটা ওপরে উঠলেই দুচোখের সামনে ধরা দেবে সমুদ্র। এখানে সে একেবারেই শান্ত সমাহিত নয়, বরং কিশোরীর চপলতা থেকে যৌবনের উন্মত্ততা পর্যন্ত তার অবাধ যাতায়াত। এর কারণ হয়তো প্রবাল প্রাচীর ও আগ্নেয় পাথর, যে প্রতিবন্ধকতা প্রশান্ত মহাসাগরকেও অশান্ত করে তুলেছে আর সৃষ্টি করেছে এক ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য।
তাইতুং-এর চেংগং টাউনশিপের উপকূলে ছোট ছোট অনেকগুলো দ্বীপের সমাহার জিংজিয়াংতাই (Sanxiangtai)। জিংজিয়াংতাই বিচের দৈর্ঘ্য ১০ কিমি। এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ একটি সুদীর্ঘ ফুটব্রিজ, যেটি সমুদ্রের ওপর দিয়ে সর্বাপেক্ষা বড় দ্বীপটির সঙ্গে উপকূলের সংযোগ রক্ষা করেছে। ফুটব্রিজটিতে মোট ৮টি বাম্প রয়েছে, যার শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি পাহাড়ি গুহা। জিংজিয়াংতাই দেখে সন্ধে নাগাদ এমি আমাদের তাইতুং-এর হোটেল শাং জিয়াং বি অ্যান্ড বি–তে ছেড়ে গেল। গত দুদিনের গাড়িভাড়া বাবদ এমিকে দিতে হল ১২০০০ নিউ তাইওয়ান ডলার অর্থাৎ ২৪০০০ টাকা। হোটেলের ডবল বেড ঘর ভাড়া লাগল ১৩০০ নিউ তাইওয়ান ডলার।
২১শে মার্চ তাইতুং থেকে ট্রেন ধরে যাওয়া হল এক অন্য ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে। জায়গাটির নাম চি-সাং (Chi sang)। ছবির মতো সাজানো একটা ছোট স্টেশন চি-সাং, প্ল্যাটফর্মের দুপাশে ছোট ছোট পাহাড় আর সতেজ সবুজ ধানক্ষেত। তাইওয়ান ভ্রমণে সর্বত্র স্থানীয় মানুষের সাইকেলপ্রীতির যে পরিচয় পেয়েছি, চি-সাঙে নিঃসন্দেহে তার সবচেয়ে শিল্পিত প্রকাশ লক্ষ করলাম। স্টেশনের বাইরে থেকে অসংখ্য সাইকেল এবং ব্যাটারিচালিত চারচাকার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় চি-সাং ঘোরার জন্য। আমরা নিলাম ব্যাটারি গাড়ি। কিছুদূর এগোতে প্রথমে চোখে পড়ল লাঞ্চ বক্স মিউজিয়াম। ১৯৫০-৮০ অর্থাৎ বিশ শতকের মধ্যভাগে অ্যালেন উডলার জুনিয়রের মেটাল লাঞ্চ বক্স এবং ট্র্যাডিশনাল জাপানিজ উডেন লাঞ্চ বক্স-এর সংগ্রহ দেখার মত, সেই সঙ্গে লাগোয়া রেস্টুরেন্টের খাবার।
চি-সাঙে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মিস্টার ব্রাউন এভিনিউ। ব্যাটারিচালিত ছোট হালকা গাড়ি চেপে সেখানে পৌঁছনোমাত্র হাওয়ার দাপটে গাড়ি উলটে যাওয়ার উপক্রম হল। আশেপাশে কোনও ঘরবাড়ি বা বড় গাছপালা না থাকায় সমস্ত এলাকা জুড়ে দুরন্ত বাতাস এখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাময়িক বিপর্যয়ের ঘোর কাটতেই বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম আদিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেতের বুক চিরে দৃষ্টির অগোচর পর্যন্ত চলে যাওয়া পিচ ঢালা রাস্তার সামনে। মনে হল পৃথিবীর একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এরপর থেকে এক নতুন বিশ্বের শুরু। যতদূর চোখ চলে ততদূর এখানে সবুজ আর সবুজ। আর এই সবুজের প্রেক্ষাপটে আঁকা সারি সারি পাহাড়। শহুরে সভ্যতার মেকি পলেস্তারা খসিয়ে ফেলে একবার কয়েকটা মুহূর্তের জন্য এই সবুজ বিপ্লবের মাঝখানে দুহাত ছড়িয়ে, এক বুক বাতাস টেনে নিয়ে দুচোখ বন্ধ করতেই অনুভব করলাম আমার প্রাকৃতিক সত্তাকে। প্রকৃতি মায়ের থেকে সভ্যতার যান্ত্রিক আকর্ষণ আমাদের যতদূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ততই মানসিক পূর্ণতা ও শান্তি থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল— “দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর”। একসময় মি. ব্রাউন কোম্পানির কফির বিজ্ঞাপন হয়েছিল এই অনবদ্য জায়গাটিতে, সেই থেকে এর নাম মি. ব্রাউন এভিনিউ। প্রবল হাওয়ার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছনো গেল তাকে শি কানেশিরো স্ট্রিট–এ একটি বিশেষ বৃক্ষের সামনে, যেটি বিখ্যাত তাইওয়ানিজ অভিনেতার নামে নামাঙ্কিত। যদিও টাইফুনে ক্ষতিগ্রস্ত মূল গাছটির বদলে এখন লাগানো হয়েছে নতুন একটি গাছ। ছবি শিকারিদের জন্য মি. ব্রাউন এভিনিউ একটি চমৎকার কর্মশালা। প্রতিটি দৃশ্যই ক্যামেরাকে মোহিত করবে— এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশেষত জুলাই ও নভেম্বর মাস দুটিতে জমির ধান পেকে সোনালি হলে এখানকার সৌন্দর্য আরও খোলতাই হবে।
নিতান্ত অনিচ্ছায় এই অপরূপা প্রকৃতিকে ছেড়ে রওনা হতে হল শহুরে সভ্যতার দিকে। আজীবন তাকে না ভোলার শপথ করে উন্মত্ত বাতাসের ঝাপটা সহ্য করতে করতে চি-সাং স্টেশন থেকে ভারাক্রান্ত মনে রওনা দিলাম তাইতুং-এর দিকে।
২২ মার্চ সকাল সকাল তাইতুং থেকে ট্যাক্সি চড়ে রওনা হলাম ফুগাং ফিশারি বন্দরের দিকে, গন্তব্য প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে গ্রিন আইল্যান্ড নামের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ, যার স্থানীয় নাম লুইদাও (Luidao)। তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত এই দ্বীপটির তাইতুং থেকে দূরত্ব ৩৩ কিমির মত। প্রকৃতিগত দিক দিয়ে এটি একটি আগ্নেয় দ্বীপ। আগে এই দ্বীপটি রাজনৈতিক বন্দিদের দ্বীপান্তরের কাজে ব্যবহার করা হত। তাইওয়ানিজ ইতিহাসে সেই মিলিটারি শাসনের নাম ছিল হোয়াইট টেরর। বর্তমানে তাইওয়ানের কুখ্যাত আসামীদের কারাবাসে পাঠানো হয়। দ্বীপটির আদি বাসিন্দা এমি উপজাতি। ১৯৯৫ সালের গণনা অনুযায়ী এখানকার অধিবাসীদের সংখ্যা ২৬৩৪ জন, আয়তন ১৫ বর্গকিমি।
মাত্র এই কটা তথ্য সম্বল করে জীবনে প্রথমবার জাহাজে চড়ে বসলাম, নামব গ্রিন আইল্যান্ডের নানলিয়াও (Nanliao) বন্দরে, সময় লাগবে ৫০ মিনিট। যদিও জাহাজ বললাম, তবুও ২৫০ জন যাত্রীর এই নৌযানকে ফেরির তকমা দিলেও ভুল হবে না। জাহাজের একদম নিচের তলায় মাঝবরাবর জানলার ধার ঘেঁষে যখন বসছি তখন কল্পনাও করতে পারিনি, সমুদ্রযাত্রা কী জিনিস। যথারীতি সাইরেন বাজিয়ে নির্ধারিত সময়ে আমাদের জাহাজ গ্রিন আইল্যান্ড অভিমুখে যাত্রা শুরু করল। ৫০ মিনিটের মধ্যে মিনিট দশেক কাটতেই শুরু হল তোলপাড় ঢেউ আর ততোধিক দোলানি। সিটবেল্ট বেঁধেও সে দোলানিকে অগ্রাহ্য করা গেল না। জাহাজের জানলার প্রবল ঝাপটা মারতে শুরু করল ঘন স্লেট বর্ণের জল। তবু সেদিকে তাকানোর উপায় নেই। দুচোখ খুললেই মাথা ঘুরতে শুরু করছে, সেই সঙ্গে অনবরত দোলানিতে পেট গুলিয়ে ওঠা। অগত্যা চোখ বুজে নিস্তেজ শরীরে ইষ্টমন্ত্র জপ করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকল না। ঐ অবসন্ন অবস্থাতেই টের পেলাম আসেপাশে নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষ অধিকাংশই প্রাণপণে বমি করে চলেছে, এতক্ষণে জাহাজে থরে থরে সাজানো প্লাস্টিক প্যাকেট ও ডাস্টবিনের রহস্যটা বুঝলাম। আড়চোখে কোনওমতে ঘড়ির দিকে তাকাতেই বুঝলাম ৫০ মিনিট পার হতে এখনো বহু দেরি। দুঃখের দিন কাটতে সময় বেশি লাগে— এই চরম সত্যিটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করলাম। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় মিনিট ৫০ পড়ে (যদিও মনে হল অনন্তকাল) যখন গ্রিন আইল্যান্ডের মাটিতে পা রাখলাম, তখন মনের নিভৃত কোণ থেকে সমুদ্রজীবী বিভিন্ন পেশার মানুষদের প্রতি শতকোটি বিনম্র প্রণাম ও শ্রদ্ধা ঝরে পড়ল। বুঝলাম যেসব পেশা আমার পক্ষে একান্তই দুঃসাধ্য তার মধ্যে একটি হল জাহাজীর পেশা।
যাইহোক বন্দরে নামতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণী এক দীর্ঘকায় নারী। অনতিবিলম্বেই বুঝতে পারলাম সে এসেছে আমাদের হোটেলে নিয়ে যেতে। নাম জানলাম ইন। হাসিখুশি ইন নিজেই গাড়ি চালিয়ে বিধ্বস্ত বঙ্গসন্তানদের নিয়ে এল বন্দরের খুব কাছে এক সুন্দর রিসোর্টে, নাম সানা সাই ইন (Sana Sai Inn)। ছোট ছোট নীল সাদা একতলা কটেজ দিয়ে সাজানো রিসোর্ট, মাঝে ছোট ফুলের বাগান, সামনে অবারিত মহাসাগর, পিছনে জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়। সবচেয়ে ভাল লাগল কিচেনে অপর্যাপ্ত চা কফি আর গরম জলের জোগাড় দেখে। শুধু উদ্যোগী হয়ে নিজেকে বানিয়ে নিতে হবে। কারণ প্রচলিত রুম সার্ভিসের কোনও ব্যবস্থা নেই এখানে। তবে প্রয়োজনীয় জিনিস যেভাবে জোগাড় করে রাখা হয়েছে তাতে সার্ভিসের কোনও প্রয়োজনও পড়ে না। বড় এক কাপ গ্রিন টি নিয়ে বাগানের দোলনায় আরাম করে বসতেই শুরু হল ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, মুহূর্তে রূপ পাল্টালো সমুদ্র, সঙ্গে হু হু হাওয়া। মনে পড়ল সুনীল গাঙ্গুলীর ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’-র কথা।
যাত্রার ধকল কাটিয়ে দ্বিপ্রাহরিক খাওয়া দাওয়ার পর বিকেলে হোটেলের বাইক ভাড়া করে গোটা দ্বীপে একটা চক্কর দিতেই বোঝা গেল গ্রিন আইল্যান্ডের প্রতি পর্যটকদের আগ্রহের কারণ। স্কুবা ডাইভ এবং স্নরকেলিং–এর স্বর্গ এই গ্রিন আইল্যান্ড। এছাড়া ঝাওরি উষ্ণ প্রস্রবণ (zhaori Hot Spring), লুইদাও লাইট হাউস (Lyudao Light House), হিউম্যান রাইটস মেমোরিয়াল পার্ক, স্লিপিং বিউটি রক, সত্যিই দেখার মতো ছিল। দ্বীপ প্রদক্ষিণ করতে করতে এসে পৌঁছলাম হিউম্যান রাইটস মেমোরিয়াল পার্ক–এ। জায়গাটির ধ্যানগম্ভীর সৌন্দর্য মনকে মুগ্ধ করল। উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের মাঝে দুটি সুবিশাল প্রস্তরখণ্ড যেন হাজার প্রতিকূলতা সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে অনন্তকাল ধরে। সাগরের তটরেখা বরাবর সুদৃশ্য আর কচি সবুজ ঘাসে ঢাকা নাতিদীর্ঘ পার্ক, প্রায় জনমানবশূন্য। অস্তগামী সূর্যের আলোয় সবুজ, নীল, সাদা আর ধূসরের অপূর্ব কোলাজ যেন সমুদ্রের একটানা আছড়ে পড়ার শব্দের মধ্যে অসংখ্য মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস প্রতিমুহূর্তে ধ্বনিত হয়ে চলেছে।
ফেরার পথে বন্দরের কাছে রাতের খাবারের জন্য ছোট বড় নানা রেস্টুরেন্টে বাঙালিসুলভ কৌতূহলে ঢুঁ মেরেই বোঝা গেল আজকের ডিনারটা বেশ অ্যাডভেঞ্চারাসভাবেই গ্রহণ করতে হবে। যাই হোক না কেন, যেকোনও মেনুকেই স্পোর্টিংলি নেব, একথা ভাবতেই পাতে এল একটা কাঁচা মাছের খণ্ড, সঙ্গে ঝাল শস্, নাম শুনলাম সসেমী। খেতে পারব কি পারব না এই ভেবে আশে পাশে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, বিদেশি পর্যটকেরা তারিয়ে তারিয়েই সসেমী উপভোগ করছে।
ওরা যখন পারছে তখন আমরাও পারব— এই দেখিয়ে দেওয়ার এনার্জেটিক মনোভাব থেকে একখণ্ড সসেমী তুলে মুখে দিলাম। কাঁচা মাছের কোনও গন্ধ নেই, কিন্তু স্বাদ এতটাই নতুন যে প্রথমে শরীর পরে মন কোনওটাই তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করল না। তবু অন্যদের দিকে তাকিয়ে নাছোড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলাম। খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়ে রাতের খাওয়া একরকম সেরে ঢুকে পড়লাম সানা সাই ইন-এ। রিসোর্টের মুখে রিসেপশনে তখন তখন আমাদের সকালবেলার পরিচিত ইন ও তার পরিবারের লোকেরা আকুপাংচার-এ ব্যস্ত।
পরদিন অর্থাৎ ২৩শে মার্চ বন্দরের কাছ থেকে নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ল ট্র্যাভেলার বাস। সরকারি উদ্যোগে কয়েক ঘন্টা অন্তরই এই বাস দ্বীপ পরিক্রমায় নিয়ে যায় পর্যটকদের। ফাঁকা বাসে শুধুই সপরিবার আমরা। বিদেশি পর্যটকরা বাসের চেয়ে ভাড়া করা দু চাকার স্কুটিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ, বোঝা গেল। গ্রিন আইল্যান্ডের লাইট হাউস দিয়ে যাত্রা শুরু, তারপর স্লিপিং বিউটি রক; সমুদ্রের কিনারে শায়িতা নারীর প্রাকৃতিক প্রস্তর প্রতিমা, নির্জন রোম্যান্টিকতায় ঘেরা। সেখান থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে কিছুটা উঠতেই পৌঁছে গেলাম ঝাওরি উষ্ণ প্রস্রবণ— বিশ্বের কতিপয় লবণাক্ত জলের উষ্ণ প্রস্রবণের মধ্যে একটি। উষ্ণ প্রস্রবণের গা দিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠতে লাগল মিনিট পনেরো, কিন্তু প্রবল হাওয়া উপেক্ষা করে সবুজ ঘাসে ঢাকা সুবিস্তীর্ণ জমিতে পা রেখেই বুঝলাম কষ্ট করে এখানে না এলে কী ভীষণ ভুল করতাম। ঢেউ খেলানো উজ্জ্বল সবুজ গালিচার ওপর অসংখ্য গোলাপি ঘাসফুল মাথা দোলাচ্ছে আর পাহাড়ের নিচে আছড়ে পড়ছে প্রশান্ত মহাসাগরের নীলচে সবুজ জলরাশি। ফেরার পথে হিউম্যান রাইটস মেমোরিয়াল পার্ক–এ শেষবারের মতো দুচোখ ভরে মনের ফ্রেমে বন্দি করে হোটেলের পথ ধরলাম। নিঃসন্দেহে গ্রিন আইল্যান্ডের সেরা আকর্ষণ এই পার্কটি। রাতে যথারীতি ফ্লাইং ফিশ অর্থাৎ উড়ুক্কু মাছ দিয়ে ডিনার সেরে জমিয়ে বাঙালিসুলভ আড্ডা দিতে বারবারই মনে হতে লাগল আর হয়তো কোনওদিন এই দ্বীপে, পৃথিবীর এক প্রান্তের এই ছোট্ট বিন্দুটিতে আমার আসা হবে না, কিন্তু স্মৃতিপটে চিরজাগরুক হয়ে থাকবে এই সামান্য দিন কটা।
পরদিন অর্থাৎ ২৪শে মার্চ দুপুরবেলা আমাদের নিয়ে জাহাজ রওনা দিল তাইতুং-এর দিকে। আসার দিনের অভিজ্ঞতা সুবিধের ছিল না, বলাই বাহুল্য। তাই এবারে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে জাহাজে পা রাখলাম। সবচেয়ে কাজ দিল গ্রিন আইল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা টাইগার বাস নামক মলমটি। জাহাজে আরও অনেকেই নাকে কপালে মলমটি লাগাচ্ছে দেখে আমরাও ব্যবহার করতে শুরু করলাম এবং আশ্চর্য, এবার বিনা বিঘ্নে, শারীরিক অস্বস্তি ছাড়াই বন্দরে পা রাখলাম। তাইতুং থেকে এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে প্রায় পুরো তাইওয়ান প্রদক্ষিণ করে ছাঙ্গুয়া পৌঁছতে লাগল পাঁচ ঘন্টা।
দিনকতক বিশ্রাম করে স্থানীয় বাগুয়া মাউন্টেন, স্কাইওয়াকে ঘুরে আর মর্নিং মার্কেটে চুটিয়ে বাঙালিসুলভ কেনাকাটা করে যখন নিজেদের স্বভূমিতে ফিরে আসার অপেক্ষা করছি, তখনই অভাবিতভাবে এরিকের কাছ থেকে প্রস্তাব এল— “চলো কাল তোমাদের Sun Moon Lake থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।” শুনলাম এই লেকটি তাইওয়ানের আরেক দ্রষ্টব্য, তাই মুহূর্তমাত্র না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম।
২রা এপ্রিল, ২০১৭, গন্তব্য নানতাও প্রদেশের Sun Moon Lake। গাড়ির ড্রাইভারের আসনে স্বয়ং এরিক, বিদেশে আমাদের পরমবন্ধু ও পথপ্রদর্শক। মাত্র ঘন্টাদুয়েকের পথ পেরিয়ে যেখানে উপস্থিত হলাম সেখানকার পান্নাসবুজ বিস্তৃত জলরাশি আর উত্তাল হাওয়া কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা করে দিল সকলকে। সঙ্গীদের মধ্যে একজনের মৃদু মন্তব্য কানে এল— নিঃসন্দেহে এই লেক কাশ্মিরের ডাল লেক কিংবা সুইজারল্যান্ডের জুরিখ লেকের চেয়ে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে কোনও অংশে কম নয়।
লেকের একপাশে প্রাচীন তাও ধর্মের অপূর্ব কারুকার্যময় উন্য়ু্ (Wenwu) টেম্পল প্রথমেই মন কেড়ে নিল। এরিককে প্রশ্ন করে জানলাম আগে লেকের দুপাশে দুটো মন্দির ছিল। ১৯১৯ সালে জাপানি ঔপনিবেশিক শাসনে লেকে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়। যার ফলে জলস্তর ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং মন্দির দুটি বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় স্থানান্তরিত হয় লেকের উত্তর উপকূলে। সেই সময়ই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মন্দির দুটিকে একত্রিত করা হবে। পরবর্তীকালে জাপান তাইওয়ানকে প্রজাতান্ত্রিক চিনের কাছে হস্তান্তর করলে ১৯৬৯ সালে উন্য়ু্ মন্দির নবকলবরে সেজে ওঠে। মন্দিরের স্থাপত্যরীতিতে উত্তর চিনের প্রাসাদ বা অট্টালিকার গঠনরীতির প্রভাব রয়েছে। তিনটে পৃথক বৃহৎ মহলে বিভক্ত মন্দিরের তৃতীয় তলের সবচেয়ে সামনের ঘরে রয়েছেন সাহিত্যের দেবতা কাইজি (kaiji), মাঝের ঘরে যুদ্ধের দেবতা গয়ান গং (Guan Gong), এবং সৈনিক দেবতা য়-ফেই (Yue Fei)। আর সর্বাপেক্ষা পেছনের ঘরে মহামানব কনফুসিয়াস। মন্দির দেখে সুসজ্জিত জলযানে চড়ে চলে এলাম লেকের অপর প্রান্তে হিউয়েন সাং-এর মন্দিরে। হ্যাঁ, শুনতে অয়াক লাগলেও এই বৌদ্ধ শিক্ষানুরাগী পর্যটকটি তাইওয়ানে ঈশ্বরপ্রতিম এক পুরুষ— ‘Great National Scholar’। তাং শাসনকালে যিনি রাজ আদেশে ভারতবর্ষে এসেছিলেন বৌদ্ধধর্মের সার সংগ্রহ করার জন্য। পরবর্তীকালে চিনে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারে তাঁর বিপুল অবদান আজও স্মরণীয়। এই জুয়ান জাং মন্দিরের আড়াই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জুয়াঙ্গুয়াং মন্দির, যেখানে চিন থেকে আনা হিউয়েন সাং-এর শরীরের অস্থি সংরক্ষিত আছে।
সূর্যাস্তের পড়ন্ত আভায়, পাখির ডাকে পৃথিবীর এক নির্জন প্রান্তে শান্ত সমাহিত বৌদ্ধ জ্ঞানতপস্বীর মূর্তিটিকে ছেড়ে এগিয়ে চললাম বোটে করে। অতীতের অন্ধকার থেকে আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত এক জ্যোতির্ময় পুরুষ নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে থাকলেন আমাদের দিকে।
এবারের মতো সমাপ্ত হল তাইওয়ান সফর। দেশে ফেরার দিন এগিয়ে এল। আমাকে এক গভীর প্রত্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। একটা আপাদমস্তক প্রযুক্তিনির্ভর, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লড়াকু জনজাতি যারা মাতৃশক্তির আরাধনা করে না, তবে নারীকে তার যোগ্যতার শেষবিন্দু পর্যন্ত বিকশিত হতে দেয়, মাতৃভাষাকে জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে রাখে, সর্বোপরি খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতায় সুস্থ, নীরোগ, কর্মক্ষম শরীরে স্বাবলম্বীভাবে বাঁচতে চায়। কেবলমাত্র আত্মবিশ্বাস ও শৃঙ্খলা একটা ক্ষুদ্র জাতিকে, একটা স্বল্পায়তনের দ্বীপভূমিকে গোটা বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছে; ধর্ম বা রাজনীতির সেখানে কোনও স্থান নেই, ধর্ম সেখানে একান্তই ব্যক্তিগত আচরণ। নেই জাতপাত, নারীপুরুষে ভেদ, নেই দিনযাপনে কোনও বিলাসিতা, শুধুই রয়েছে অক্লান্ত শ্রম আর কর্মযোগের বিপুলতরঙ্গ।
৮ এপ্রিল ভারতে ফেরার টিকিট কাটা, ব্যাগপত্র গোছানোর কাজ চলছে জোরকদমে। শুধু মাঝে মাঝে একটা অপূর্ণ ইচ্ছে মনটাকে বিচলিত করে তুলছে। ইতিহাসের পাতায় নয়, হৃদয়ের একেবারে গভীরে নিবিড় শ্রদ্ধায় ঘিরে রাখা এক আগ্নেয় পুরুষ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস, যাঁর রহস্যময় অন্তর্ধানের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই ফরমোজা তথা তাইওয়ান দ্বীপটি। আরও একটু সময় পেলে তাঁর স্মৃতিধন্য স্থানগুলো নিজের চোখে দেখে আসতাম। সত্যিই কি এখানে এই মহামানবের জীবনাবসান ঘটেছিল? নাকি এখান থেকেই তাঁর দ্বিতীয় জীবনের সূচনা— মনটাকে কুরে কুরে খেতে থাকল এই প্রশ্ন। ফেরার পথে অসীম বিস্ময়ে চেয়ে দেখলাম অনেক নিচে অশান্ত পান্নাসবুজ জলরাশি আর উত্তাল হাওয়া ছোট্ট দ্বীপভূমির গায়ে আছড়ে পড়ে কিছু না জানা কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।
শেষ হয়ে হইল না শেষ……
ঠিক তিন বছর আগে ২০১৭-র এক এপ্রিল মাসে তাইওয়ান সফরের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেছিলাম। সেই কাজ শেষ হল ২০২০-র আরেক এপ্রিলে। অবশ্যই যার কৃতিত্ব কিছুটা হলেও করোনা-আক্রান্ত বিশ্বের লকডাউন ব্যবস্থাকে দিতেই হবে। এই অখণ্ড অবসর, দূষণহীন পৃথিবী শেষ কবে উপভোগ করেছি বলা মুশকিল। যাই হোক্, আরেকটা কথা না বললেই নয় যে বিশ্বব্যাপী ত্রাস সৃষ্টিকারী এই মহামারিকে বুদ্ধি, সদিচ্ছা ও সময়োচিত পদক্ষেপ দিয়ে ছোট্ট দেশ তাইওয়ান অল্প সময়ের মধ্যে কব্জা করে ফেলেছে। অথচ কোনও অজ্ঞাত কারণে তাইওয়ানকে আজও হু (WHO)–র সদস্য করা হয়নি। তবে জাপানি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী এই দ্বীপবাসীদের কাছে কোনও প্রতিকূলতাই চিরস্থায়ী হবে না, কারণ “শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ ’পরে,/ ওরা কাজ করে।” আর এই বিপুল কর্মতরঙ্গই ওদের পৌঁছে দেবে কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ-ঊষার দ্বারে।