অংশুমান দাশ
লেখক বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রস্তুতকারী সংস্থায় কর্মরত এবং খাদ্য ও কৃষি বিষয়ে দীর্ঘদিনের কর্মী
এখন আমাদের আর ক্ষিদা নাই। অই যে এক দারিদ্ররেখা ছিল— কী এক লম্বা লাইন। আমরা অই লাইনের নীচে ছিলাম, লাইন নিয়াই খুশি ছিলাম। আমাদের অই লাইন ছিল, ক্ষিদা ছিল না। এখন আসিছে বিশ্ব ক্ষিদা সূচক— সেই নিয়াই মাতামাতি। ক্ষিদা সূচক আছে— আর ক্ষিদা নাই। সকলে কয়— সূচকে আমরা কেন পাকিস্তানের নীচে, কেন বাংলাদ্যাশের নীচে, কেন নেপালেরও নীচে। তাই তো! আমাদের তো দু ট্যাকার চাল আছে। চাল খাই। সকালে চাল, রাতে চাল। কখনও অই চালেরই পচাই বানাই— তখন আর রাতে ভাত লাগে না। এমন র্যাশন তো আর কোনও দ্যাশে নাই। আমাদের সরকার বাহাদুর, সরকার দিদিমণি সারা দ্যাশে চাল দিচ্ছেন। সারা দ্যাশের মানুষ— যারা অই লাইনের নীচে— দেউল্যা হয়ে বাটি হাতে র্যাশন লাইনে দাঁড়ায়েছে— পাচ্ছে তো, বলুন তো, দু টাকার চাল তো ঘরে ঢুকছে। ছেল্যামেয়েগুলান দিনেরবেলায় অই পোকা চালের খিচুড়ি পেত— বাড়িতে খাওয়ার লেগে ঘ্যানঘ্যান তো করত না! করূণা মহামারি সেই করুণাটুকু তুলে নিল। তবুও অই লাইনের চাল আছে— এখন আমাদের আর ক্ষিদা নাই।
কী কন কর্তা! চালেই তো প্যাট ভরে— আবার তরিবত করা ডাল, ডিম, মাছ, দুধ, ফল, সবজি— এসব তো আমাগো খাবার না। এতে তো প্যাট ভরে না। মন ভরে। সবজি খাওন লাগে না। আমি তো জমিতে ধান ফলাই— বাজার থিক্যা সেই ধানের টাকায় চাল কিনি আর মাঝে মাঝে আলু কিনি। আলুর সবজি খাই। আলুর মত সবজি আছে নাকি? ডাল মাঝে মাঝে খাই। এ সব ফেন্সি— অই লুঙ্গির উপরে ফতুয়ার মত। লুঙ্গিতেই কাজ চলে যায়— ফতুয়া হল গিয়া উপরি। অই যে আমার নাতি— এক বছর নয়, তা দু বছর বয়স হবে প্রায়। হ্যাঁ, তা একটু রোগাপানা লাগে বটে। আলু আর ভাত নামায়ে দিলেই খুশি। না খেয়ে আমরা কেউ নাই। দ্যাশের নেতারা ক্ষিদা সূচক নিয়া লড়ে যাচ্ছে, ক্ষিদার কথাটা ভুলেই গেছে— অবশ্য আমাদের আর ক্ষিদাও নাই।
২.
ইউ সি, ফুলকপিটাই দ্য ওনলি থিং যেটা আমার ছেলে একটু খায়। আদারওয়াইজ আমি বাবা ভীষণ হেলথ কনশাস। প্যাকেজড ফুড, দে টেক কেয়ার অফ দ্য হাইজিন সো মাচ, যে আমি তো ওতেই শিফট করে গেছি। মাই সন লাভস ইনস্ট্যান্ট নুডলস— খেতেও ভালো, আর অ্যাডেও বলে ভরপুর পুষ্টি। দ্যাট ইজ ওয়ান— তাছাড়া এমনিতে ওর সেরকম ক্ষিদেও পায় না। নানারকম আলু ফ্রাইজ পাওয়া যায়— লুকস সো নাইস— হাসিমুখ, কোনওটা অ্যানিম্যাল শেপ। ওর এত ভালো লাগে— কাজের লোককে বললেই টুকটাক ভেজে দেয়। তাছাড়া বার্গার, পিজ্জা— স্কুলে যখন যেত, তখনও আমি প্যাকেজড ফুডই দিতাম— কেন কি, সো সেফ। বলতে নেই, নজর না লগ জায়ে, স্বাস্থ্য তো আমার ছেলের ভালোই— এই তো বারো বছর বয়সেই সাতান্ন কিলো ওজন।
এই হাঙ্গার ইনডেক্স ব্যাপারটা তো আমি বুঝতেই পারি না— এই তো এত খাবার, শপিং মলে। তাছাড়া আমার ক্লাবে যাওয়ার রাস্তায় একটা বস্তি পড়ে— সেখানেও তো দোকানে দেখি নানারকম প্যাকেজড প্রোডাক্ট— চিপস, কেকস— বস্তির বাচ্চারাও তো সবসময় খায় দেখছি। আমার তো মনে হয় না হাঙ্গার এক্সিস্টস এনি মোর। কেন কি, এভরি ওয়ান নাউ হ্যাভ স্মার্ট ফোন— তো, নিশ্চয় পয়সা আছে। কিনে খেলেই পারে!
৩.
ক্ষিদে মানে, খাবার নেই। খাবার মানে কী? খাবার মানে চাল। তাই তো আমরা বরাবর বুঝে এসেছি। মাঠের পর মাঠ জুড়ে ধানের ক্ষেতে সবুজের দোলা। বর্ষার পর আবার মাটির তলার জল তুলে ধান— আহা মিনিকিট! আহা হাইব্রিড। হাইব্রিড ছিল বলে দেশের মানুষ খেতে পেয়েছেন। হাইব্রিড ছিল বলে উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন বেড়েছে বলে ধান বেচে চাল কিনে খাচ্ছে। কী চাল? আহা ফরসা সুন্দর। ভাত আর আলু— আহা মরি মরি। ওই তো হয়ে গেল দু হাজার ক্যালরি। এই সেই ক্যালরি, যা দিয়ে মাপা যায় শক্তি— কাজ করার শক্তি। শুধু ভাত আর আলু, প্যাকেট প্যাকেট আলুর চিপস, শরীরের ক্যালরি পূরণ হয়ে যাবে। তাই দিকে দিকে থালা হাতে মানুষ রেশনের দরজায় উদাসীন ভিখারি। খাদ্যের (পড়ুন চালের) নিরাপত্তা তো ওই ছুড়ে দেওয়া চালে। আচ্ছা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব— খাবার বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা— এ দুটো তো এক নয়। তাই না? মনে হচ্ছে বাজারে সাজানো হাজার হাজার খাবার, মনে হচ্ছে এই তো কত উৎপাদন বেড়েছে। ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। যে খাবার বাজার খাওয়াচ্ছে, যে খাবার সরকার খাওয়াচ্ছে— তার বাইরে কোনও পছন্দ নেই আমাদের। খোঁটায় বেঁধে দেওয়া গরু, চিনির কৌটোয় আটকে থাকা পিঁপড়ে— সীমাবদ্ধতার অভ্যাসকেই স্বাধীনতা ভাবতে শেখে। আমাদের বলা হয়েছে মিলেট নয়, ডাল নয়, বাড়ির আনাচেকানাচে ফলে থাকা জংলি শাক নয়, পিঁপড়ের ডিম নয়, চুনোমাছ নয়, মানকচু নয়— নয় নয় কিছু নয়— তোমার আরাধ্য হাইব্রিড চাল, ফসলের মাঠে আর খাবারের থালায়।
কিন্তু শরীরের প্রয়োজন বৃদ্ধি, বুদ্ধি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। তা আসে আমিষ, শাক, সবজি, ফল, দুধ— এসব থেকে। এইসব খাবার জিনিস অতি অল্পমাত্রায় হলেও দরকার। সুতরাং পেট ভরানোর গল্পটা দিয়ে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি মেটে না। ক্যালরি দিয়ে পুষ্টি মাপা যায় না। অবশ্য ক্যালরি উৎপাদন করলেও তা পৌঁছে দিতে পারিনি। সেই চাল পয়সা হয়ে কার যেন পকেটে ঢুকেছে।
৪.
ক্ষিদে একটি জটিল ধারণা, তাকে মাপা কঠিন। পেট ভরে গেলেই যেমন ক্ষিদে মেটে না, তেমনি ক্ষিদে পাচ্ছে না মানেই পেট ভরে গেল, তা-ও নয়। এই হেঁয়ালি থেকে বাঁচার উপায় একমাত্র ক্ষিদের ফলাফল দিয়ে তাকে মাপা। নয়তো নিছক ‘রেশনে এত চাল দিয়েছি তবু কেন আপনারা বলছেন ক্ষিদে— আর খেলব না যান’ গোছের ধারণা হয়ে যায় আর কী! কীভাবে আমরা ক্ষিদে মাপব?
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে মাপা হয়েছে চারটি বিষয় দিয়ে।
১) অপরিমিত ক্যালরি: দেশের কত সংখ্যক মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার পাচ্ছেন। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী এত রেশন, আর উৎপাদন বৃদ্ধির ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও দেশে ১৫.৩ শতাংশ মানুষ এখনও প্রয়োজনীয় ক্যালরি পাচ্ছেন না। পাশাপাশি আমাদের দেশে যা খাবার নষ্ট হয় তাতে গোটা বিহারের লোককে সারা বছর পেট পুরে খাওয়ানো যায়। একটা দেশকে শুধুমাত্র দানছত্রের সরকারি খাবারে নির্ভরশীল করে, অন্য সব ধরনের স্থানীয় খাবারকে ভুলিয়ে দিলে খাদ্য নিরাপত্তা কেবল কয়েকটি স্কিমের (ও তার কর্মচারীদের) দয়ায় এসে দাঁড়ায়। আশেপাশে কোনও দেশে কিন্তু রেশন নেই— ক্ষিদে সূচকে তাদের স্থান ভারতের থেকে উপরে। এত সহজে দুয়ে দুয়ে চার করা যায় না, তবু এ এক দিকনির্দেশ বটে।
২) বাচ্চাদের ওয়েস্টিং: পাঁচ বছরের নীচে কত বাচ্চার উচ্চতার তুলনায় কম ওজন, মানে তারা ভীষণ অপুষ্টিতে ভুগছে। ভারতের ১৭.৩ শতাংশ বাচ্চার এখন এই অবস্থা, যা সারা পৃথিবীতে যে কোনও দেশের থেকে বেশি। অর্থাৎ মায়ের দুধ ছাড়ার পরে যখন বাচ্চার নানা ধরনের খাবারের দরকার হয়— কেবল ভাত নয়, যাতে শরীরের পুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বৃদ্ধিও হয়— সেই সময়ে বৈচিত্রপূর্ণ খাবার পাচ্ছে না আমাদের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ, শুধু ক্যালরি নয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টও। শুধু পেট ভরা নয়, পুষ্টিও।
৩) বাচ্চাদের স্টান্টিং: পাঁচ বছরের নীচে কত বাচ্চার বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম, মানে বংশপরম্পরায় তাদের পরিবারে অপুষ্টি আছে। ৩৪.৭ শতাংশ বাচ্চা এই অবস্থায় এখন। অর্থাৎ শুধু বাচ্চারা নয়, তাদের মায়েরাও অপুষ্টির শিকার, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাবে শীর্ণ। এর পিছনে রয়েছে বৈষম্যেরও হাত। জাতি, লিঙ্গ— সবরকম বৈষম্য।
৪) বাচ্চাদের মৃত্যুর হার: পাঁচ বছরের নীচে কত বাচ্চা মারা যাচ্ছে, মানে অপুষ্টি আর অপরিষ্কার পরিবেশের শিকার হচ্ছে। ভারতে তার মান ৩.৪ শতাংশ এখন।
এই সব কিছু মিলে বানানো হয়েছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক। ১১৬টা দেশের ভারত এখন ১০১। আমরা আমাদের স্থান নিয়ে চিন্তিত— কিন্তু অবস্থান নিয়ে কী ভাবছি? আমরা কি ক্ষুধা সূচক নিয়ে তর্ক করে যাব না ক্ষিদে নিয়ে? ওদিকে আমাদের দেশে এখন ১৪০ জন বিলিয়নেয়ার!
চিয়ার্স!