প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
অ্যাঞ্জেলার জ্ঞান ফিরেছিল হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে বেরিয়ে ডিসি পুলিশের কাছে গিয়েছিল অ্যাঞ্জেলা। দুজন ডিটেকটিভ ওকে সাহায্যও করে বেশ খানিকটা। অ্যাঞ্জেলাকে আগেই রিচার্ড রডরিগেজের কথা বলেছিল মৌলিনাথ। ওই লোকটাই সরিতের সঙ্গে ষড় করে কিডন্যাপ করেছে শাহিদকে, হয়তো মৌলিনাথও এখন ওর কবলে। জানা যায়, রডরিগেজ গুণধর লোক। আমাজন, আফ্রিকা থেকে বেআইনি জন্তুজানোয়ার পাচার করা, ‘স্যাংশন’ ছাড়াই চালাচ্ছিল নানা বেআইনি গবেষণা। সিআইএ-র কিঞ্চিৎ মদত ছিল সেসবে, কারণ সিআইএ-র ফরমাশ মেনে একের পর এক ছোট কমিউনিস্ট দেশ, যেখানে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, সেসব দেশে তখন অস্ত্রপাচার করত রডরিগেজ। মেক্সিকো বা কলম্বিয়ার ড্রাগমাফিয়াদের সঙ্গেও তার ওঠাবসা।
মৌলিনাথ কোথায়? শাহিদই বা কোথায়? পুলিশ খুঁজছে। কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য, রডরিগেজকে পাকড়াও করা।
অ্যাঞ্জেলা যদিও এখনও ভেবে পায়নি, ও হাসপাতালে পৌঁছল কী করে? কে নিয়ে এল ওকে? ও এখন শুধুই মৌলিনাথ আর শাহিদকে নিয়ে ভাবিত।
নিজের বিশাল চেম্বারে থম মেরে বসে ছিল রডরিগেজ। পাশে দাঁড়িয়ে স্যামুয়েল।
দাঁত কিড়মিড় করে গজগজ করে চলল রডরিগেজ।
—ধেড়ে ইঁদুর। আমি জানতাম। ধেড়ে ইঁদুর। ডার্টি ইন্ডিয়ান! আমাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেল! ও পালিয়েছে মানে ও জানে আসল ব্যাপারটা। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে ও কী করবে? কোথা থেকে পাবে স্পেসে যাওয়ার ফান্ডিং? আর ওই মেয়েটাকে হাসপাতালে রেখে গেল কেন? আমাকে ফাঁসাবে! আমাকে! ইতর ছোটলোক! পৃথিবীর যে কোনও কোণ থেকে ওকে খুঁজে বের করে আমি মারব। ইঁদুরের মতোই মারব। তিলে তিলে…
—আর বাকি দুজন?
স্যামুয়েলের হঠাৎ প্রশ্নটা শুনে একটু থমকাল রডরিগেজ। গম্ভীর মুখে একটা চুরুট ধরাল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
—আর রাস্তা নেই। এই দুজনকে ফিরিয়ে দেওয়া তো যাবে না। রডরিগেজ সাক্ষী রাখে না। পুলিশ এখনও জানে না, আমি ঠিক কী মতলব আঁটছি। এরা সেটা জেনে গেছে। তবে হ্যাঁ, আর এদের কষ্ট দেব না।
বিশাল ডেস্কের ড্রয়ারটা খুলে একটা রুপোর ভারী পিস্তল বের করে উঠে দাঁড়াল রডরিগেজ ওর পাহাড়প্রমাণ চেহারা নিয়ে।
শাহিদ আর মৌলিনাথের হাসাহাসির শব্দ তখন যদি পেত রডরিগেজ, নিঃসন্দেহে ভাবত, ওরা আবার কিছু ফন্দি আঁটছে। কিন্তু দুই বন্ধুর এতদিন পর দেখা! ওরা নিজেদের মধ্যে কোনও ছক কষার জায়গায় এখন আর নেই। যেন একরকম দুজনেই জেনে গেছে, মৃত্যু নিশ্চিত। তাই আর কোনও ভয় নেই, দুজনেরই।
—তোমাকে বিশ্বাসঘাতক বানিয়ে ছেড়েছিল আমার কাছে! শাহিদ বলল।
—তুমি তাই মনে করেছিলে?
—ধুর! তবে তোমাকে ওপেনহাইমার মনে হয়েছিল এক মুহূর্তের জন্য!
মৌলিনাথ মুচকি হাসল।
—অ্যাঞ্জেলা…?
মৌলিনাথ একটু বিষণ্ণ হয়ে বলল,
—জানি না। তবে এরা নাগালে পায়নি। সেটা এদের কথা থেকে বুঝলাম।
—তবু ভাল!
এবার শাহিদ একটা ব্যাপারে কৌতূহলী না হয়ে পারল না।
—সরিতের ব্যাপারটা তো বুঝলাম। ওই জারটা তুমি চিঠির হিন্ট ধরে বের করলে তাও বুঝলাম। কিন্তু একজ্যাক্টলি কী ঘটল বলো তো?
মৌলিনাথ গম্ভীর হল।
—বুঝতে পারছি না, জানো তো! কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাইনি আমি ব্যাপারটার। এত বিপদের মধ্যেও ব্যাপারটা আমি বারবার ভেবেছি। কিন্তু…
—একটা হিরে! একটামাত্র হিরেই তো! তার ভেতর এমন কী থাকতে পারে বলো তো? তুমি জিওলজির কারও সঙ্গে কথা বলেছিলে? অ্যাঞ্জেলা? অ্যাঞ্জেলা দেখেনি জিনিসটা?
—দেখেছে। তবে ভাল করে নয়। সময় পেলাম কই ঠিক করে কারও সঙ্গে কথা বলার? তোমাকে নিয়ে আসলে এতটা দুশ্চিন্তা…
—ওইটাই তো ভুল করলে! সোজা ওই স্কাউন্ড্রেলটার কাছে চলে গেলে! না হলে এরা জানতেও পারত না, তোমার কাছে বিষয়টার কোনও হদিশ আছে।
—আচ্ছা, এরা চায়টা কী?
শাহিদ বিমর্ষ গলায় উত্তর দিল, চাইবে আবার কী! নতুন গ্রহ আবিষ্কারের ক্রেডিট। অথবা আরও মজারু কিছু, এলিয়েন আবিষ্কার করতে চায় হয়তো।
দুজনেই আবারও হো হো করে হেসে উঠল।
—আচ্ছা একটা কথা বলো তো শাহিদ, তুমি কী করে নিশ্চিত হলে যে এই হিরেটাই আসল, ওটা তুমি অ্যাকোরিয়ামে লুকিয়ে রাখলে কেন?
শাহিদ সেই রাতের কথা বলল মৌলিনাথকে।
—এই হিরে তো তোমার দাদুর। তাছাড়া তোমার কাকা, মানে চাচাজির কাছে ছিল এতদিন! তোমার কাছে এতদিন রইল, কিছু বুঝতে পারোনি?
—সত্যিই পারিনি মৌলিনাথ! পারলে তো মিটেই যেত। কী আশ্চর্য জিনিস এই হিরেটা ভাবি! তুমি তো জানো, এটা চাচার সঙ্গে ঘুরে এসেছে, নেতাজির ফৌজ যেখানে যেখানে গেছে, ওটাও গেছে। অথচ…
মৌলিনাথ আরও কৌতূহলী হয়ে এবার একটা প্রশ্ন করে বসল।
—তোমার দাদু এটা কোথা থেকে পেয়েছিলেন শাহিদ?
শাহিদ এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর চাচার থেকে শোনা গল্পটা মনে পড়ে গেল। টেগার্টের এনকোয়ারির গল্প। ওর নানাকে কী কী প্রশ্ন করা হয়েছিল সেদিন, ওর চাচা বলেছিল ওকে। ব্রিটিশ পুলিশের বিশ্বস্ত অফিসার হলে কী হবে, মুসলমানরা যখনতখন বেইমানি করতে পারে, টেগার্টের কানে তুলেছিল কোনও হিন্দু অফিসার।
মৌলিনাথ ওর বন্ধু। ওর প্রাণের বন্ধু। এতটা বিশ্বাস ওকে খুব কম বন্ধুই করেছে। ওরা আগে থেকেই ভারতের বাসিন্দা, এপারের বাসিন্দা। কিন্তু দেশভাগের পর থেকেই ওদের সন্দেহ করেছে ওদের পড়শিরা, বন্ধুরা। ওর দাদু নেতাজির ফৌজের, জেনেও ক্ষান্ত হয়নি শাহিদের ইশকুলের সহপাঠীরা। কলেজেও খোঁটা শুনেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় অবস্থাটা পালটেছিল। তখন ‘রিফিউজি’ আর গালাগালি ছিল না। তবে সেটা কিছুদিনের জন্য মাত্র। জানত শাজাহান। মৌলিনাথের সঙ্গে আলাপ ওকে বিশ্বাস জুগিয়েছে, ও বুঝেছে, সন্দেহ ছাড়াও বন্ধুত্ব হয়।
আজ হঠাৎ টেগার্ট থেকে শুরু করে ওর সন্দেহপ্রবণ বন্ধুদের মুখ মনে পড়তে ওর ভয় করল। মৌলিনাথ যা জানতে চাইছে, তার সঠিক উত্তর কি দেওয়া যাবে?
শাজাহান সব বলেছিল মহম্মদকে, শাহিদের চাচাকে। আজ শাহিদ ঠিক করল, মৌলিনাথের থেকে কিছু লোকাবে না।
রডরিগেজ গটগট করে আসছিল এই ঘরের দিকে, পাশে স্যামুয়েল। বাঙ্কারের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে লোহার দরজার নব বিশেষভাবে ঘোরাল স্যামুয়েল। পিস্তলটা রডরিগেজের পকেটে।
শাহিদের থেকে সবটা শুনে থম মেরে গিয়েছিল মৌলিনাথ। অবিশ্বাস্য লাগছিল ওর এই গল্পটা। গল্প নয়, এই ঘটনাটা।
সনাতন হাজরার গল্প, শাহিদের নানা, যে কিনা ছিল এমন দাপুটে খুনে অফিসার, তার হঠাৎ বদলে যাওয়ার গল্প। সনাতন হাজরারও দাদু, যে কিনা এই হিরেটার লোভ সামলাতে পারেনি। সব মিলিয়ে আশ্চর্য এই ঘটনাক্রম মৌলিনাথের যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এমন অদ্ভুত ওর দেশ, ইতিহাসের ভেতর কত স্রোত…
ভাবতে ভাবতেই বাঙ্কারের দরজা খোলার আওয়াজ হল।
রডরিগেজ পিস্তলটা বের করে সোজা তাক করল শাহিদের দিকে।
মৌলিনাথ আর শাহিদ— দুজনেই ছিল বাঁধা অবস্থায়। এখন দুজনেই বুঝতে পারল, ওদের আর প্রয়োজন হবে না রডরিগেজের। ও এখন সরিতের পিছনে ধাওয়া করবে।
কিন্তু ঘর পর্যন্ত আসতে আসতেই মন বদলে ফেলেছে রডরিগেজ। ওকে জানতে হবে, সরিৎ পালাল কেন? হতেও তো পারে যে, সরিৎ আসলে ওদের সঙ্গেই কাজ করছে। কী আছে সরিতের কাছে? আসল ব্যাপারটা কী? জানতেই হবে!
পিস্তলটা হঠাৎ একটু নামিয়ে আনল রডরিগেজ। একটা বুলেট সোজা ছুটে গেল শাহিদের পা লক্ষ্য করে।
চিৎকার করে উঠল মৌলিনাথ।
স্যামুয়েলকে রডরিগেজ কিছু একটা ইশারা করতেই স্যামুয়েল একখানা বড় ছুরি বের করল পকেট থেকে। শাহিদের প্যান্ট গুটিয়ে ওর গোড়ালির ওপর বুলেটের ক্ষতস্থানে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিল নিমেষে।
মৌলিনাথ চিৎকার করে যাচ্ছিল পাগলের মতো।
—শয়তানের বাচ্চা! ছাড় ওকে তোরা। ছাড় বলছি!
—চোপ শুয়ার! তিনটে ইন্ডিয়ান মিলে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছাড়ছে! একটা স্কাউন্ড্রেল ভেগেছে। তার আগে ওই বিচটাকে একটা হাসপাতালে দিয়ে গেছে! কত বড় হারামজাদা! এরপর পুলিশ খুঁজবে আমাকে। পাবে না যদিও! কিন্তু এই ছিঁচকেমিটা করে ও পার পাবে ভেবেছে!
মৌলিনাথের মাথায় হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল। অ্যাঞ্জেলা পুলিশের কাছে যাবে তার মানে। তা জেনেও সরিৎ পালাল। রডরিগেজের পিঠে ছুরি মারার জন্য তো বটেই। কিন্তু ওই জারটা নিয়ে ও কোথায় যাচ্ছে তা কি জানা সম্ভব?
মাথা থেকে এক মুহূর্তে ওই ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলল মৌলিনাথ। শাহিদ পাগলের মতো চিৎকার করে চলেছে।
—কী জানে ওই বেইমানটা? কী খুঁজে পেয়েছ তোমরা? বলো!
রডরিগেজ কর্কশ গলায় প্রশ্নটা ছুড়ে দিল। দৈত্যাকার চেহারার স্যামুয়েল তখনও শাহিদের পায়ে ছুরিটা বসিয়ে রেখেছে, নির্লিপ্ত মুখে।
—হীরে! একটা হীরে!
মৌলিনাথ চিৎকার করে উঠল দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে।
শাহিদ অবাক হয়ে তাকাল মৌলিনাথের দিকে। রডরিগেজ আর স্যামুয়েলও বিস্ময়ে ফিরল মৌলিনাথের দিকে।
মৌলিনাথের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। এদের সাহায্য করে যদি শাহিদকে এই অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই দেওয়া যায়, ও তবে তাই করবে।
[আবার আগামী সংখ্যায়]