Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আবহাওয়া পরিবর্তন ও নগরকেন্দ্রিক সুস্থায়ী উন্নয়ন: কিছু প্রশ্ন

আবহাওয়া পরিবর্তন ও নগরকেন্দ্রিক সুস্থায়ী উন্নয়ন: কিছু প্রশ্ন | অচিরাংশু আচার্য

অচিরাংশু আচার্য

 


State of Global Air Report (2020)-এ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে কলকাতার স্থান এখন দিল্লির পরেই। আর যে হারে গাছ কাটা হচ্ছে তাতে কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা বায়ুদূষণে প্রথম স্থান পেলে আশ্চর্যের কিছু হওয়ার নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) যে বায়ুদূষণের সীমারেখা নির্ধারণ করেছে, শহর কলকাতায় তার থেকে ১৭ গুণ বেশি বায়ুদূষণ হয়। পানীয় জলের অবস্থাও প্রায় তথৈবচ। Central Groundwater Board (CGWB)-এর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে কলকাতার মাটির তলার জলস্তর ভয়ঙ্করভাবে নেমে গেছে। কিন্তুপ্রশ্ন হল এ-ব্যাপারে শহরের মানুষ কি আদৌ চিন্তিত?

 

আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর দূরে নেই। এখন আমাদের আবহাওয়া পরিবর্তন ও তার প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতিকে মেনে নিয়েই চলতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা লক্ষ করছি যে বিগত কয়েক বছরে ভারতবর্ষে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে গেছে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমরা গ্রীষ্মে ৪০ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থর মরুভূমিতে দেখতাম। এখন শহর কলকাতাতে গ্রীষ্মে ৪০ বা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি। IPCC (2022)-এর তথ্য থেকে জানতে পারি যে এই শতকে তাপমাত্রা গড়ে চার থেকে সাড়ে চার ডিগ্রি বেড়ে যাবে এবং শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে তাপপ্রবাহ বছরে তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাবে। এর ফলে শৈল্য পর্বতের, বিশেষ করে হিমালয়ের, বরফচূড়া আরও দ্রুত গলবে। সমুদ্র ও নদীর জলস্তর বেড়ে যাবে, যার ফলে নদীর পার ভাঙন, বন্যা ও আগামীদিনে দ্বীপগুলি ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আবহাওয়া পরিবর্তনের আরেক প্রভাব দেখা যাচ্ছে ঋতু পরিবর্তনে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে শীত শুরু হত ভাদ্র মাস থেকে ও শেষ হত ফাল্গুনে। প্রায় ছয় থেকে সাত মাস একটা ঠান্ডা আবহাওয়া থাকত। এখন দেখা যাচ্ছে যে শীত মাত্র দুই থেকে আড়াই মাস থাকছে। অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ। শুধু তাই নয়, গ্রীষ্ম, বর্ষা ও কিছুটা শীত ছাড়া অন্য ঋতুগুলো, যথা শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত কোথায় যেন সব উধাও হয়ে গেছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ যেন অন্যান্য ঋতুগুলোকে গ্রাস করেছে। বর্ষা আগে যেখানে বৈশাখ বা আষাঢ় মাসে আসত, এখন আসে ভাদ্র বা আশ্বিনে, তাও আবার প্রবল বর্ষা নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিম্নচাপ রূপে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। বর্ষার আমন ধান চাষ পিছিয়ে যাচ্ছে। বর্ষার ধান পাকছে অগ্রহায়ণ মাসে। নবান্নের ধান লাগানোর সুযোগ থাকছে না। যে-সব কৃষক গ্রীষ্মে বোরো ধান চাষ করছে, প্রবল দাবদাহের জন্যে তাদের অনেক বেশি পরিমাণে মাটির তলার জল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এর ফলে, একদিকে মাটির তলার জলস্তর কমছে, আর, অন্যদিকে সেচের জলের দাম বাড়ছে। গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার ফলে নদ-নদী ও খাল-বিলের জল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় কৃষকদের চাষ করা দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। জমি উর্বর হয়ে ওঠার ফলে অনেক কৃষক চাষ ছেড়ে দিচ্ছে। গ্রামীণ জনজীবন ব্যাহত হয়ে পড়ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন দাবদাহ, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, অনির্দিষ্ট ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, খালবিল শুকিয়ে যাওয়া, উর্বর জমি, মাটির নিচের জলস্তর কমে যাওয়া, গঙ্গার প্লাবনে নদীর পার ভাঙা, সব ঘটনা একত্রিতভাবে দেখলে বেশ বোঝা যায় গ্রামীণ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের লোক আর গ্রামে থাকতে চাইছে না। শহরে চলে আসতে চাইছে।

শুধু আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্যেই যে গ্রামের মানুষ শহরে আসতে চাইছে তা নয়। এর সঙ্গে শহরের উন্নততর পরিষেবারও একটা যোগ আছে। ভাল স্কুলে সন্তানকে পড়ানো, উন্নততর স্বাস্থ্য পরিষেবা, বেশি মজুরির হাতছানি, ইত্যাদি। সম্প্রতি ক্ষুধা সূচকের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১১১তম স্থানে নেমে এসেছে। ওই সূচকে দেখা গেছে শিশুদের অপুষ্টির হার ১৮.৭ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্ব্বোচ্চ। যেহেতু ভারতবর্ষের গ্রামে এখনও প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ বাস করে, তাই অপুষ্টি যে গ্রামের শিশুদেরই বেশি, এবং অধিকাংশ গ্রামের মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় যে কষ্ট পাচ্ছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

International Food Policy Research Institute (IFPRI) তাদের সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখিয়েছে যে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে ভারতবর্ষের খাদ্য সুরক্ষা ব্যাহত হবে। তাছাড়া কোভিড ১৯-এর প্রভাব এখনও অনেকদিন থাকবে। ভারতের ২০১৮র Economic Survey থেকে জানা যাচ্ছে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে আগামীদিনে কৃষি থেকে আয় গড়ে ১৫ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ কমে যাবে। তাহলে কৃষকরা যাবে কোথায়? তাদের অনেকেই গ্রাম থেকে শহরে কাজের খোঁজে অভিপ্রয়াণ করবে। এর ফলে শহরের পরিষেবা-তে ভয়ঙ্কর চাপ পড়বে।

 

আবহাওয়া পরিবর্তন ও শহরে অভিপ্রয়াণ

মনে পড়ে গেল বিমল রায়ের সেই বিখ্যাত ছবি “দো বিঘা জমিন”। কৃষক গ্রামের জমিদারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে শহরে চলে আসে। তার প্রধান সম্বল হয় রিকশা। একসময় আসে সেই মুহূর্ত যখন রিকশা চালাতে চালাতে সেটি ভেঙে পড়ে। না, শহরে এসে তার কোনও সুরাহা হয় না। বিগত দিনে এবং বর্তমানে শহরে আসার মূল কারণ ছিল শহরে বেশি আয়ের হাতছানি। এর সঙ্গে ছিল পরিবারকে উন্নততর পরিষেবা দেওয়ার ইচ্ছা। সন্তানকে ভাল স্কুল, পরিবারের জন্য ভাল স্বাস্থ্যপরিষেবা, পাকা ঘর, ইত্যাদি। এর সঙ্গে শহরে অভিপ্রয়াণের এক নতুন কারণ যোগ হয়েছে, আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব। একটি প্রতিবেদনের গবেষণা অনুযায়ী, State of India’s Environment Report (2022), ভারতবর্ষে শুধুমাত্র আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্যে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ গ্রাম থেকে শহরে অভিপ্রয়াণ করবে। The Guardian পত্রিকা একুশ শতককে চিহ্নিত করেছে “আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষের গ্রাম থেকে শহরে অভিপ্রয়াণের” শতক হিসেবে। পৃথিবীতে বিগত দশ বছরে আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্যে গ্রাম থেকে শহরে মানুষের অভিপ্রয়াণের সংখ্যা আগের দশ বছরের থেকে দ্বিগুণ হয়েছে। কোভিড-১৯ ও তার জেরে লকডাউনের ফলে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা আমরা দেখেছি। গ্রাম থেকে শহরে এইভাবে মানুষের স্রোতের ঢল নামলে, আগামী দিনে কোনও অতিমারি আবার হানা দিলে, প্রচুর মানুষের জীবনহানি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। আবার এও সত্য যে আগামীদিনে মহামারি থেকে বাঁচতে ও কোভিড-১৯ থেকে শিক্ষা নিয়ে, উন্নততর চিকিৎসা পেতে গ্রামের অনেক অভিবাসী শ্রমিক পরিবার সমেত শহরে আসার চেষ্টা করবে। এ এক উভয় সঙ্কট।

 

শহরকেন্দ্রিক জীবন: আরাম না ব্যারাম?

এ তো সত্যি যে ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ শহরে থাকতে চায়। প্রকৃতির কোলে থাকা বা কৃষিকাজের থেকে আমাদের কাছে অনেক জরুরি বেশি অর্থের জীবিকা ও শহরের উন্নততর পরিষেবা। এর মূল কারণ গ্রামে কাজের সুযোগের অভাব ও শহরের সঙ্গে গ্রামের পরিষেবার ভয়ঙ্কর বিভেদ। ১০০ দিনের কাজ (MGNREGA) গ্রামে চালু করে কিছুটা আয়ের ক্ষেত্রে বিভেদ কমানোর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সেই প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে এখন অথৈ জলে। এ-রাজ্যে বাকি নানা সরকারি প্রকল্প কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতে বিপর্যস্ত। প্রকল্প তুমি কার? এই দ্বন্দ্বে গ্রামবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। মনে পড়ে যায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কবিতা “রাজা আসে যায়”-এর কয়েকটা লাইন:

রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায়, লাল জামা গায়
এই রাজা আসে, ওই রাজা যায়
জামাকাপড়ের রং বদলায়,
দিন বদলায় না।

এটাও আমাদের বুঝতে হবে যে গ্রাম থেকে যত শহরে লোক ঢুকবে, মানুষে মানুষে সংঘাত তত বাড়বে। শহরে জায়গা সঙ্কুচিত। তাই এক চিলতে জায়গার জন্যে সংঘাত হবে। কিছুদিন আগে এরকমই এক সংঘাতের প্রত্যক্ষদর্শী ছিল কলকাতাবাসী। এপ্রিল ২০২৩ সালের ঘটনা। পার্কসার্কাসে একটি অভিজাত শপিং মলে আশেপাশের বস্তির লোক পরিবার ও দলবল সমেত ঢুকে পড়ে। এরা আবার একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়াতে শপিং মলে আগত ক্রেতারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অবশ্য পরে জানা যায় যে, যে বস্তির মানুষেরা শপিং মলে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের বস্তিতে টানা তিনদিন কোনও বিদ্যুৎ ছিল না। গরমের প্রবল দাবদাহে ও জলকষ্ট থেকে বাঁচতে তারা শপিং মলে আশ্রয় নিতে একপ্রকার বাধ্য হয়। অনেক অনুরোধ, উপরোধ ও পুলিশি হস্তক্ষেপের পরে তারা সেখান থেকে চলে যায়। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, এ বছর তীব্র দাবদাহে ও ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ফলে শহর কলকাতায় রেকর্ডসংখ্যক শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বিক্রি হয়েছে। এ-বছর শুধু এপ্রিল মাসেই কলকাতা শহরে কয়েক লক্ষ যন্ত্র বিক্রি হয়েছে। এর ফলে, একদিকে যেমন বিদ্যুতের চাহিদা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেছে, অন্যদিকে বিদ্যুতের জোগান না বাড়ার ফলে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনাও বেড়ে গেছে। আর হ্যাঁ, এর ফলে বিদ্যুৎ চুরিও অনেকটা বেড়েছে। এর নিট ফল বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন শহর। এই যদি হাল হয় ২০২৩-এর গরমে, তাহলে আগামী বছরের গরমকালে যে অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত পশ্চিমবঙ্গবাসীদের কাটাতে হবে, এ-নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।

শহরের কেউ যদি মনে করে আগামী দিনের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে তিনি বাইরে একটু হাওয়া খেতে বেরুবেন, তাহলে তিনি নিরাশ হবেন। State of Forest Report 2022 থেকে জানা যাচ্ছে যে শহর কলকাতায় বিগত দশ বছরে গাছের পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এর কারণ মূলত উন্নয়নের নামে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে আবাসন প্রকল্পে অনুমতি দেওয়া। এরকম চলতে থাকলে আগামী দিনে গাছ দেখতে হয়তো কলকাতাবাসীকে গ্রামে যেতে হবে।

কীভাবে মানুষ লোভে পড়ে প্রকৃতিকে লুন্ঠন করছে, সে ব্যাপারে সাবধানবাণী শুনিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর Robbery of the Soil বক্তৃতাতে। তিনি বলেছেন “today the blight that has fallen upon our social life and its resources is disastrous because it is not restricted within reasonable limits.”

শহরে থাকার লোভ ও উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা এবং তার সঙ্গে আবহাওয়া পরিবর্তন নিঃসন্দেহে শহরের জনজীবনকে ব্যাহত করবে। কলকাতা পুরসভার তথ্য অনুযায়ী শহর কলকাতাতে প্রায় ৩৩ শতাংশ মানুষ বস্তিতে থাকে। ছোট, বড় মিলিয়ে বস্তির সংখ্যা ৩০,০০০-এরও বেশি। যত গ্রাম থেকে শহরে মানুষ আসবে, নিঃসন্দেহে বস্তির সংখ্যা আরও বাড়বে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে যত তাপমাত্রা বাড়বে, যত তাপপ্রবাহ বেশি সংখ্যক হবে, যত ঝড়-বৃষ্টি বাড়বে, ততই বস্তিতে থাকা মানুষের কষ্ট বাড়বে, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা খোলা ছাদের তলায় থাকে। তাদের কোনও বাড়ির সুরক্ষা বা নিরাপত্তা নেই। অন্যান্য সুযোগ  সুবিধেও ন্যূনতম। এমতাবস্তায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বস্তির শিশুরা। তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে নানা রোগ যেমন ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়াতে তাদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যত শহরে মানুষের সংখ্যা বাড়বে, ততই বায়ুদূষণ, জলদূষণ ও তার সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়বে, শহরের লোকেদের রোগের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। Indian Institute of Population Studies (IIPS)-এর তথ্য অনুযায়ী, সারা ভারতবর্ষের মধ্যে কলকাতা শহরের জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এখানে এক স্কোয়ার কিলোমিটারের মধ্যে ২২,০০০ মানুষ বসবাস  করে। তাই একবার কোনও মহামারি দেখা দিলে বহু মানুষের মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা আছে।

আরও আছে। পৃথিবীর অধিকাংশ শহর নদীকেন্দ্রিক। শহর কলকাতার পাশ দিয়েই বইছে গঙ্গা। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে যত তাপমাত্রা বাড়বে, বরফ গলবে, ততই গঙ্গার জলস্তর বাড়বে। বিজ্ঞানীদের কথা মিলে গেলে, ভবিষ্যতে শহর কলকাতার জলের তলায় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

 

শহর-জীবন ও সুস্থায়ী উন্নয়ন: কোন পথে আমরা?

আমার লেখা মূলত আবহাওয়া পরিবর্তন ও শহরের জনজীবন নিয়ে। কারণ বহুদিন ধরে ভারতবর্ষে গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রবণতা চলে আসছে। ইদানিং এই প্রবণতা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। দেশের জনসংখ্যার আদমসুমারি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে যে ১৯০১ সালে গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল দেশের ১১ শতাংশ মানুষ, ১০০ বছর পরে ২০০১ সালে সেটি বেড়ে হয় ২৯ শতাংশ। জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালে ভারতের শহরগুলিতে থাকবে প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষ এবং ২০৫০ এর মধ্যে এই সংখ্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ফলত আমাদের শহরকেন্দ্রিক সভ্যতার গতি বেড়েই চলবে। এই অবস্থায় প্রশ্ন হল এত লোক শহরে এলে শহরের অবস্থা কী হবে আর সবচেয়ে বড় কথা শহরের মানুষ ভাল থাকবে কি না? এই আগামীদিনে মানুষের ভাল থাকার ব্যাপারে একটি নিৰ্ণয়-সূচক যেটি বিশ্বের প্রায় সব দেশ মেনে নিয়েছে সেটি হল Sustainable Development Goals (SDG)। বাংলাতে একে আমরা বলতে পারি “টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা”। এই নির্ণয়সূচকে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা সমস্ত দেশগুলিকে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে, দেশের সব মানুষের উন্নয়ন করতে গেলে। এর মধ্যে একটি লক্ষ্যমাত্রা (১১ নম্বর) হল টেকসই ও উন্নত শহর গড়া। এর মধ্যে আছে শহরবাসীদের দূষণমুক্ত পরিবেশ দেওয়া, শহরবাসীদের সুস্থতা নিশ্চিত করা, ইত্যাদি। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী এই লক্ষ্যমাত্রা পৌঁছুনোর সারিতে ভারতের স্থান ১৬৬টি দেশের মধ্যে অনেক নিচে ১১২ নম্বরে। বোঝাই যাচ্ছে ভারত খুব একটা টেকসই উন্নয়নে এগোয়নি। এর মধ্যে টেকসই শহর উন্নয়নের যে-কথা বলা হয়েছে (SDG-11), তাতে যে লক্ষ্যমাত্রা ভারতের শহরগুলোতে পৌঁছুতে হবে, তার মধ্যে আছে বস্তিমুক্ত শহর, শহরের সবার জন্যে সঠিক বাসস্থান, বায়ুদূষণমুক্ত পরিবেশ, পরিষ্কার পানীয় জল ও পরিচ্ছন্ন ও সন্তোষজনক রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত যানবাহন। দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রত্যেকটি সূচকেই ভারতের শহরগুলির অবস্থা নিম্নগামী।

এমতাবস্থায় ২০১৫ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী শহরগুলির উন্নয়নের জন্যে একটি নতুন প্রকল্প চালু করেন যার নাম “Smart Cities Mission”। এর উদ্দেশ্য হল ওই আগের আলোচিত টেকসই উন্নয়নের ১১ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর মধ্যে পূর্ণ করা। শুরুতে প্রায় ১০০টি শহরকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে কিছু শহর এই প্রকল্পের সুযোগ নিয়ে ১১ নম্বর লক্ষ্যমাত্রার দিকে কিছুটা এগিয়ে গেছে, যেমন ভুবনেশ্বর। কিন্তু অধিকাংশ শহর-ই প্রকল্প রূপায়ণে অনেকটা পিছিয়ে আছে। মজার কথা হল আমাদের দেশের রাজধানী দিল্লি ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত শহর। দিল্লির আশেপাশের শহরগুলিও দূষিত। যেমন ফরিদাবাদ বা নয়ডা।

এবার আসা যাক পশ্চিমবঙ্গের কথায়। স্মার্ট সিটি প্রকল্পের আওতায় এ-রাজ্য থেকে একমাত্র শহর ছিল ‘নিউ টাউন’। প্রথমদিকে প্রকল্পের আওতায় থাকলেও, পরবর্তী সময়ে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্বের জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিউ টাউনকে এই প্রকল্পের আওতা থেকে সরিয়ে নেয়।

আর আমার প্রিয় শহর কলকাতা, তার কী অবস্থা? ২০১১ সালে যে সরকার পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শহর কলকাতাকে সবুজ ও পরিষ্কার রাখার (clean and green city)। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল শহর কলকাতাকে লন্ডন বানানোর। সেই কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতা আজ রোল, বিরিয়ানি ও চপের দোকানে ভরপুর। আর হবে নাই বা কেন? এটাই তো এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রধান শিল্প। State of Global Air Report (2020)-এ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে কলকাতার স্থান এখন দিল্লির পরেই। আর যে হারে গাছ কাটা হচ্ছে তাতে কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা বায়ুদূষণে প্রথম স্থান পেলে আশ্চর্যের কিছু হওয়ার নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) যে বায়ুদূষণের সীমারেখা নির্ধারণ করেছে, শহর কলকাতায় তার থেকে ১৭ গুণ বেশি বায়ুদূষণ হয়। পানীয় জলের অবস্থাও প্রায় তথৈবচ। Central Groundwater Board (CGWB)-এর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে কলকাতার মাটির তলার জলস্তর ভয়ঙ্করভাবে নেমে গেছে। এর ফলে পানীয় জলে আর্সেনিক বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এমনকি আগামী দিনে কলকাতায় পানীয় জল মানুষ পাবে কি না তাই নিয়েও বেশ সংশয় আছে।

 

পরিশেষ

এত কথা হল শহরের দূষণ নিয়ে, প্রশ্ন হল এ ব্যাপারে শহরের মানুষ কি আদৌ চিন্তিত? এই যে কলকাতা শহরে সবুজ কমে যাচ্ছে, বায়ুদূষণ বেড়ে যাচ্ছে, জলস্তর কমে যাচ্ছে, এই বিষয়গুলো কি আদৌ আমাদের ভাবায়? কোনও রাজনৈতিক মঞ্চে এইসব বিষয় নিয়ে কোনও আলোচনা চোখে পড়ে না। মনে পড়ে মনোজ মিত্রের বিখ্যাত নাটক “নরক গুলজার”-এর একটি গানের কিছু কথা যা এক সময়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরত— “কথা বোলো না, কেউ শব্দ কোরো না, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলোযোগ সইতে পারে না।” আর মনে পড়ে যায় পুর্ণেন্দু পত্রীর কলকাতা নিয়ে ছড়া “রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি।” তাই কলকাতা যা ছিল তাই থাক। অলক্ষুণে কথা ভেবে লাভ নেই। বরঞ্চ আসুন সবাই মিলে দুর্গাদর্শনে মাতি।  সেখানেও দেখি ফুটপাথ ও রাস্তা জুড়ে বিজ্ঞাপন। ঠাকুরকে দেখারও উপায় নেই। এ কি তবে সাংস্কৃতিক দূষণ? রাস্তার গলিতে ঢুকে মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের “মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে” কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন:

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাবো
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

 

তথ্যপঞ্জী