কোভিড-১৯ পরবর্তী মধ্যবিত্তের সঙ্কট

কোভিড-১৯ পরবর্তী মধ্যবিত্তের সঙ্কট -- অচিরাংশু আচার্য

অচিরাংশু আচার্য

 


বিশ্বভারতীর অর্থনীতির অধ্যাপক, অনুষ্টুপ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক

 

 

 

লিখতে গিয়ে হঠাৎ ক্যালেন্ডারে চোখ পড়ে গেল। ২৬ সেপ্টেম্বর, বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। জন্মের ২০০ বছর পরে, আজও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। এই সময়ে তাঁর কথা বড় মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন “চোখের সামনে মানুষ অনাহারে মরবে, ব্যাধি, জরা, মহামারিতে উজাড় হয়ে যাবে, আর দেশের মানুষ চোখ বুঁজে ‘ভগবান’ ‘ভগবান’ করবে— এমন ভগবানে প্রেম আমার নেই। আমার ভগবান আছে মাটির পৃথিবীতে, স্বর্গ চাই না, মোক্ষ চাই না, বারে বারে ফিরে আসি এই মর্ত্য বাংলায়।” কোভিড-১৯ মহামারি ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে, বিদ্যাসাগরের মত মানুষের প্রয়োজনীয়তা আজ বড়ই বেশি। এই লেখা লিখতে লিখতেই খবর পেলাম প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপক শ্রী স্বপন কুমার চক্রবর্তী প্রয়াত হয়েছেন। আরও এক সংস্কৃতিমনস্ক কৃতি বাঙালি ব্যাক্তিত্বকে আমরা হারালাম কোভিড-১৯ ব্যাধিতে। অনুষ্টুপ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তাঁর লেখা বই “বাঙ্গালির ইংরেজি সাহিত্যচর্চা” সমাদৃত। তাঁর অকাল প্রয়াণে আমরা সবাই ব্যথিত। একে একে নিভিছে দেউটি।

 

কোভিড-১৯ পরবর্তী মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক সঙ্কট

শুধু স্বপন চক্রবর্তী নয়, বিগত দুবছরের কোভিড-১৯ মহামারিতে আমরা অনেক বাঙালি গুণীজনকে হারিয়েছি। এদের মধ্যে আছেন কবি শঙ্খ ঘোষ, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, লেখক বুদ্ধদেব গুহ ও অনীশ দেব, অভিনেতা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, বাচিক শিল্পী প্রদীপ ঘোষ ও গৌরী ঘোষ, চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনবুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়……। তালিকাটি দীর্ঘ। যাঁদের নাম করলাম, যাঁরা সদ্য কোভিড-১৯-এ প্রয়াত, তাঁরা কিন্তু নিজ নিজ ক্ষেত্রে দিকপাল। কিন্তু দিকপাল হলেও, এঁদের অনেকের অন্য এক পরিচয়ও আছে। এঁদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত অথবা নিম্নমধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার থেকে উঠে আসা ব্যাক্তিবর্গ, যাঁরা কষ্ট করে সমাজে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এঁদের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি সমাজ একাত্ম বোধ করত। তাই ৮৫ বছরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু কিংবা ৮৯ বছরে শঙ্খ ঘোষের মৃত্যু আপামর মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি যুবক-যুবতীদের মনে হাহাকার ডেকে এনেছে। কোথাও যেন সংস্কৃতিমনস্ক শিক্ষিত বাঙালির ভরসার স্তম্ভগুলো একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাংলা সংস্কৃতির একটা যুগ হয়তো কোভিড-১৯-এর জন্যে শেষ হয়ে গেল। সত্তর দশকের তুমুল আন্দোলন থেকে উঠে আসা অধিকাংশ কৃতি বাঙালি, যাঁরা আমাদের অনুপ্রেরণা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ প্রয়াত। তাই বাঙালি মধ্যবিত্তের আজ বড়ই সঙ্কট। এখন কোভিড-১৯-এর ফলে এ সঙ্কট যে শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাই নয়, মধ্যবিত্তের সঙ্কট আজ নানা ক্ষেত্রে।

আমি মধ্যবিত্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক সঙ্কটের কথা বললাম, আমার মনে হয় আরও তিন ধরনের সঙ্কটে আপামর মধ্যবিত্ত আজ জর্জরিত। এবং এই অন্য সঙ্কটের কিছুটা ফলস্বরূপও সাংস্কৃতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আমি মূলত আরও তিনটি সঙ্কট নিয়ে এখানে আলোচনা করব। মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক সঙ্কট, রাজনৈতিক সঙ্কট ও শিক্ষার সঙ্কট। প্রত্যেকটি বিষয়কে কেন “সঙ্কট” বলছি, সে আলোচনাতে আসব। তার আগে হঠাৎ শ্রী নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখা “আত্মঘাতী বাঙালী” বইটির কথা মনে পড়ে গেল। নীরদচন্দ্র বইটির শেষ অধ্যায়ে (যার শিরোনাম “বাঙালীর জাতীয় অদৃষ্ট”) লিখছেন “ব্যক্তিবিশেষের অকালমৃত্যু হইলে তাহার ক্ষেত্রে জন্মগত দোষ বা দৌর্বল্যের সঙ্গত কোনো কারণ আবিষ্কার না করিতে পারিয়া লোকে উহাকে অদৃষ্টের উপর আরোপ করে। জাতীয় ক্ষেত্রেও কি তাহা বলা যায়? আমি অন্তত বাঙালীর জাতীয় জীবনের দুনির্বার অধোগতি দেখিয়া এক ধরনের অদৃষ্টবাদে আস্থাবান হইয়াছি।” নীরদবাবু অবশ্য বাঙালি জাতির মৃত্যুঘণ্টা অনেকদিন আগেই ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু গত দু বছরে এতজন বিখ্যাত বাঙালির মৃত্যুমিছিল দেখে কোনও অদৃষ্টের হাত কাজ করছে কি না সন্দেহ হয়? শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি তবে কি দেশ থেকে বিলীন হতে চলল? এর উত্তর জানা নেই, কিন্তু কিছু বিষয় ও তথ্য নিয়ে আলোচনা করলে, হয়তো প্রশ্নের কিছু উওর পাওয়া যেতে পারে।

 

কোভিড-১৯ পরবর্তী মধ্যবিত্তের আর্থিক সঙ্কট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত গবেষণা সংস্থা (Pew Research Centre) জানিয়েছে যে কোভিড-১৯-এর জন্যে ভারতবর্ষে প্রায় ৩.২ কোটি মধ্যবিত্ত পরিবার, মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারে স্তানান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ তারা দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গেছে। এর মূল কারণ পরিবারের যে সদস্য আয় করতেন তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এর ফলে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার শহর থেকে গ্রামে ফিরে গেছে।

দেখা যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় নীতি ও কোভিড-১৯-এর জন্যে, সংগঠিত এবং অ-সংগঠিত, দু ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হয়েছে। বহু বছর ধরে অধিকাংশ বাঙালির লক্ষ্য থাকত শিক্ষা অর্জন করে একটি সরকারি চাকরি করা। সেই  সরকারি চাকরি এখন অনেকটা স্বপ্ন বা মায়াসুলভ আকার ধারণ করেছে। কিছু তথ্য দিলেই তা পরিষ্কার হবে। National Pension System-এর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে বিগত তিন বছরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সবচেয়ে কম সংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। আগের তিন বছরের তুলনায় কেন্দ্রীয় সরকার ২৭ শতাংশ কর্মসংস্থান কমিয়েছে ও রাজ্য সরকার ২১ শতাংশ কর্মসংস্থান কমিয়েছে। এর সঙ্গে যদি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির দিকে চোখ বোলানো যায়, তাহলে দেখা যাবে যে সরকারি কর্মসংস্থান তৈরি করতে তারা একেবারেই ইচ্ছুক নয়।

২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০-তে ভারত সরকারের শ্রম নীতি নিয়ে তিনটি নতুন আইন সংসদের ছাড়পত্র পেয়েছে। সংসদে মাত্র তিন ঘণ্টা আলোচনা করে এই নতুন শ্রম আইনগুলিকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কী আছে এই নতুন আইনে? প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, আগের ২৯টি শ্রম আইনকে বাতিল করে এই চারটি আইন গৃহীত হয়েছে। এই নতুন আইনে শ্রমিকের অধিকারকে অনেকটাই খর্ব করা হয়েছে। এই নতুন আইনের ফলে মালিক-পক্ষ ইচ্ছানুযায়ী শ্রমিক নিযুক্তি ও ছাঁটাই করতে পারবে। এর ফলে প্রচুর বণিক সংস্থা শ্রম চুক্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে। তারা স্বেচ্ছায় কর্মী ছাঁটাই করতে পারবে। Aajeevika Bureau, একটি অলাভজনক সংস্থা, তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে যে এই তিনটি আইনের ফলে, শ্রমিকের মালিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ক্ষমতা একরকম কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নতুন নিয়মে কোনও শ্রমিক সংগঠন কখনওই হঠাৎ করে কাজে ধর্মঘট ডাকতে পারবে না। তাকে ন্যূনতম ধর্মঘটের ৬০ দিন আগে মালিকপক্ষকে জানাতে হবে। এর ফলে ধর্মঘট করার সুযোগ শ্রমিকের থেকে একরকম ছিনিয়ে নেওয়া হল।

কর্মী সঙ্কোচন, কর্মসংস্থান কমানো ও শ্রমবিরোধী আইন যদি কেন্দ্রীয় সরকারের একদিকের পদক্ষেপ হয়, অন্যদিকের পদক্ষেপ হল বেসরকারিকরণ ও সরকারি সম্পত্তি কতিপয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে বেচে দেওয়া। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে নতুন কৃষি আইন, নতুন শ্রম আইন, এই গুরুত্বপূর্ণ সব আইন-ই সংসদে ছাড়পত্র পেয়েছে ২০১৯-২০২০র সেই সময়ে যখন সারা দেশে ভয়ঙ্করভাবে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে। কোথায় যেন মনে হচ্ছে সরকার কোভিড-১৯এর সুযোগ নিয়ে প্রায় বিনা আলোচনায় এই আইনগুলি প্রণয়ন করেছে। এমনকি সদ্যসমাপ্ত মৌসুমি অধিবেশনে প্রায় ২০টি প্রস্তাব বিনা আলোচনায় সংসদের ছাড়পত্র পেয়েছে। দেখা গেছে একেকটি বিল পাশ করতে মাত্র ৮ মিনিট লেগেছে। কোনও বিল নিয়ে আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়নি।

১৭ মে, ২০২০তে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ঘোষণা করেন যে সরকার শুধু কৌশলগত বা “strategic” ক্ষেত্র (যেমন প্রতিরক্ষা) ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে বেসরকারিকরণের পথে এগোবে। এই বেসরকারিকরণের মধ্যে আছে রেল, জীবনবিমা, ব্যাঙ্ক ইত্যাদি, যার ওপর মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। এদের মধ্যে অনেক সংস্থা ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে সরকারি সংস্থা ছিল।

এটা বলাই বাহুল্য যে সরকারের এ হেন নীতির ফলে দেশে সরকারি চাকরি ভয়ঙ্করভাবে সঙ্কুচিত হবে। এমনকি যে সমস্ত সুযোগসুবিধা একজন সরকারি কর্মচারী পেত, বেসরকারি সংস্থায় তার ছিটেফোঁটাও পাবে না। আর নতুন শ্রম আইনের আওতায় সে যে কোনও সময়ে বরখাস্ত হতে পারে। ফলে কর্মীদের সুরক্ষা একরকম দেশ থেকে প্রায় উঠেই গেল।

এই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের কথায় আসি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি অনেকদিন আগেই সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলিতে অসফল হতে শুরু করেছে। এদের অনেকেরই এখন প্রধান আয়ের উৎস “প্রাইভেট টিউশন”। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের চাকরির বাজার যে শুধু সঙ্কুচিত তাই নয়, সেখানে দুর্নীতির ছায়াও ঢুকে পড়েছে। কান পাতলেই শোনা যায় অর্থের বিনিময়ে লিস্টে নাম তোলা বা চাকরি পাওয়ার কথা। আদালতে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে কয়েকশো মামলা হয়। ফলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি, যারা অনেকদূর অবধি পড়াশুনো করেছে, যাদের ইচ্ছে মানসম্মান নিয়ে চাকরি করার, শহরে তাদের অনেককেই আজ দেখা যায় বড় দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে, বাড়ি বাড়ি নানা খাবার ও সামগ্রী পৌঁছে দিতে, কিংবা ভাড়া গাড়ি চালাতে। না, উচ্চশিক্ষা তাদের কোনও কাজেই লাগেনি। মনে পড়ে যায় ১৯৭২ সালে তৈরি সত্যজিৎ রায়ের ছবি “প্রতিদ্বন্দ্বী”র শেষ দৃশ্যের কথা। শহরের বেকার যুবক শেষমেশ শহরে কোনও চাকরি না পেয়ে বালুরঘাটে একটি ছোট চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে শুনতে পায় “রাম নাম সত্য হ্যায়”।

 

কোভিড-১৯ পরবর্তী মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক সঙ্কট

উইনস্টন চার্চিলকে যখন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়ার কথা বলা হয়, তিনি বলেছিলেন, “If independence is granted to India, power will go to the hands of rascals, rogues, freebooters; all Indian leaders will be of low calibre and men of straw. They will have sweet tongues and silly hearts. They will fight amongst themselves for power and India will be lost in political squabbles. A day would come when air and water would be taxed in India.” কোথাও যেন চার্চিলের কিছু কথা কানে বাজে। অনেক অবক্ষয়ের মধ্যে রাজনৈতিক অবক্ষয় আমাদের দেশে এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালির গর্বের জায়গা ছিল সে মার্জিত, শিক্ষিত ভদ্রলোক। সেই ছাপ ছিল তার রাজনৈতিক অবস্থানেও। জনসমক্ষে কটু কথা বা অশ্রাব্য ভাষার প্রয়োগ সে করত না। সে ছিল সহিষ্ণু। সে অন্যের মতামত শুনত। সে সমালোচনা করত কিন্তু ঝগড়া করত না। আমরা শুনেছি যে কেন্দ্রীয় সংসদে হীরেন মুখার্জি যখন তাঁর বক্তব্য রাখতেন, আলপিন পড়লেও তা শোনা যেত। পরবর্তী সময়ে নিজে শুনেছি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ও অটলবিহারী বাজপেয়ির অসাধারণ বক্তৃতা। কোনও ব্যক্তি-আক্রমণ না করে, কারও সম্বন্ধে তির্যক মন্তব্য বা কটু কথা না বলে, তীব্র শাণিত ভাষায় দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন তাঁরা। ছোটবেলায় গ্রামে মামার বাড়িতে দেখেছি গ্রামের নেতা দাদুর পায়ে প্রণাম করছে। সাধারণ তার পোষাক। কিন্তু ক্ষুরধার তার আলোচনা। সমাজ সম্পর্কে সে সচেতন।

যে রাজনীতি আজ চলছে সেখানে মধ্যবিত্তের কোনও ঠাঁই আছে বলে মনে হয় না। হয় তাঁকে রাম অথবা রহিম হতে হবে। বামেরা আজ অস্তমিত। কিন্তু বামেরা চলে যাওয়াতে বোধহয় শালীন, শৃঙ্খলাপরায়ণ রাজনৈ্তিক পরিবেশেরও মৃত্যু ঘটল। এখন অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতানেত্রীর সঙ্গে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি আর একাত্ম বোধ করে না। এই রাজনৈ্তিক অবক্ষয় কোথায় গিয়ে শেষ হবে বলা কঠিন। শেষমেষ চার্চিলের কথা আবার পুরোপুরি মিলে না যায়। তবে রাজনীতির আমূল পরিবর্তন না হলে ভারতীয় রাজনীতিতে মধ্যবিত্তের জায়গা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসবে।

 

কোভিড-১৯ পরবর্তী মধ্যবিত্তের শিক্ষার সঙ্কট

একটি কথা প্রায়শই শোনা যায় যে ভারতবর্ষের আগামী দিনগুলি খুব উজ্জ্বল কারণ দেশে যুব সম্প্রদায়ের সংখ্যা আগামী দিনে অনেক বাড়বে এবং তারা কাজ করার ফলে দেশের জাতীয় আয় অনেক বেড়ে যাবে। ফলে ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। ভাবনা খুব-ই ভালো। ইংরেজিতে একে বলে “demographic dividend”। কিন্তু প্রশ্ন হল ভারতবর্ষ আদৌ কি এই demographic dividend-এর সুযোগ নিতে পারবে? যে যুবকরা আগামী দিনে কাজের অপেক্ষায় বসে থাকবে তারা কাজ পাবে তো? আর যে কাজের চাহিদা থাকবে তাদের সেই কাজ করার যোগ্যতা থাকবে তো? ২০১৯-এ কোভিড-১৯ আসার আগেই ভারতবর্ষে কর্মহীনের সংখ্যা বিগত ৪৫ বছরের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছিল। কোভিড-১৯ অতিমারির পর তো বেকারত্বের সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর।

আগামী প্রজন্মের শিক্ষার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ অতিমারি এক বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে। বিখ্যাত গবেষণা সংস্থা Centre for Science and Environment (CSE) শিক্ষার ওপর কোভিড-১৯ অতিমারির প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করে। তাদের গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে কোভিড-১৯ অতিমারির ফলে প্রায় ৩৮ কোটি শিশু তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের অনেকের মধ্যে শারীরিক অসুস্থতার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে এদের অনেকেই সরে এসেছে। যেসব শিশু কোনওভাবে এখনও শিক্ষার সঙ্গে জুড়ে আছে তারাও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের শিক্ষার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছে না। এদের অধিকাংশের না আছে কম্পিউটার, না আছে ইন্টারনেট।

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সমূলে পরিবর্তন না করলে এই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে চাকরির কোনও যোগ-ই থাকবে না। গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারতবর্ষে শিক্ষা যত আধুনিক হবে, নতুন প্রযুক্তি যত বেশি ব্যবহৃত হবে, ততই শিক্ষা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। নিজের চোখে দেখেছি বাবা তার চাষের জমি বেচে বা মা তার বিয়ের গয়না বেচে সন্তানকে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করতে চাইছে।

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুল ও কলেজগুলি দেখলে সত্যি দুঃখ হয়। স্কুলগুলো তো চাল, ডালের ভাণ্ডার শিবির হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে আর কলেজে চলছে রাজনৈ্তিক শিবির। তাই অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালি স্কুল পাশ করার পরেই সন্তানকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে, তা সে যত খরচ-ই হোক।

অথচ পশ্চিমবঙ্গে ছিল তো সবই। ইংরেজদের তৈরি অসংখ্য স্কুল। সেদিন রবীন্দ্রনাথের ছাত্রবয়সে কাটানো স্কুল “The Oriental Seminary” দেখতে গেছিলাম। জীর্ণ দশা। কলেজের মধ্যেও ছিল তো সংস্কৃত কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ। এমনকি এশিয়ার প্রথম পলিটেকনিক যার নাম ‘কাশিমবাজার পলিটেকনিক’ সেটিও প্রথম কলকাতার বাগবাজারে স্থাপিত হয়।

পরবর্তী সময়ে কী হল শিক্ষার মানের? শুধু কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করলেই আর ইটের পাঁজা তুলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করলেই কিন্তু উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন হয় না। ভালো শিক্ষক প্রয়োজন, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন আর সর্বোপরি পড়াশোনার পরিবেশ প্রয়োজন। আর এর সঙ্গে উল্লেখ করতেই হয় প্রযুক্তির ব্যবহারে ভারসাম্যহীনতার কথা যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি ‘digital divide’. আজকের দিনে যার কম্পিউটার আছে, ইন্টারনেট আছে, আধুনিক প্রযুক্তি আছে সেই আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে, সফল হবে, বাকিরা থাকবে অন্ধকারে। অর্থাৎ প্রযুক্তি দিয়েই ছাত্রছাত্রীর মেধার বিচার হবে। জুলাই ২০২০তে নতুন যে শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকার চালু করেছে সেটিও বেশ উদ্বেগের। সেখানে মাতৃভাষায় শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার বেসরকারিকরণের কথাও বলা আছে।

 

পরিশিষ্ট— উন্নয়নের নামে প্রহসন

ভারতবর্ষে মধ্যবিত্তশ্রেণি আজ নানাভাবে কোণঠাসা। অতিমারি, কর্মহীনতা, আর্থিক অনটন, সব নিয়েই তাঁকে চলতে হচ্ছে। ২০১১র আদমসুমারি ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, যেসব রাজ্য থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ অভিবাসী হয়েছে, তাদের মধ্যে চার নম্বরে আছে পশ্চিমবঙ্গ। ২০০১ থেকে ২০১১, এই দশ বছরে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ কাজের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যত্র চলে গেছে। ২০১১ থেকে ২০১৮, এই ৮ বছরে সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ১১ লক্ষ। বাঙালি মধ্যবিত্তের পক্ষে অভিবাসী শ্রমিক হওয়া আবার অত সহজ নয়। সে তো শিক্ষিত হয়ে কোনও ইটভাটা বা কোনও বাড়ি বানানোর কাজে যোগ দিতে পারবে না। অমিত ভাদুড়ি-র একটি বই আছে “মর্যাদার সঙ্গে উন্নয়ন”। মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে আত্মমর্যাদা এক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু সে আত্মমর্যাদা, যা ছিল গর্বের, তা আজ অস্তমিত। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের “মুক্ত গণতন্ত্র” কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেল—

সবাই শুধু মিথ্যে রটায়
পথগুলি সব দেদার খোলা
যার খুশি আয় বিরুদ্ধতায়
যথার্থ এই বীরভূমি
উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে এসে
পেয়েছি শেষ তীরভূমি
দেখ খুলে তোর তিন নয়ন
রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে
দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন
সবাই আমায় কর তোয়া
ছড়িয়ে যাবে দিগ্বিদিকে
মুক্ত গণতন্ত্র আজ।

দেশে উন্নয়নের আরেক নাম এখন প্রহসন। উন্নয়নের নামে একদিকে কেন্দ্রের বেসরকারিকরণ, কর্মীসঙ্কোচন, সরকারি সম্পত্তি বিক্রি, কৃষকের অধিকার, শ্রমিকের অধিকার হরণ আর অন্যদিকে রাজ্যে দানখয়রাতি। মধ্যবিত্ত বাঙালি আজ ১০০০ টাকার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে পদপৃষ্ট। একবেলা ডিম-ভাত হলেই তো জীবন চলে যায়। এর বেশি হরিদাস কাঙালের আর প্রয়োজন কী?

নোবেল জয়ী লেখিকা নাদিম গরডিমার ক্রীতদাস সম্পর্কে লিখেছেন যে একজন ক্রীতদাস বুঝতেই পারে না যে সে ক্রীতদাস। কারণ বাপ, ঠাকুরদাকে সে এ কাজই করতে দেখে এসেছে। তাই সে মনে করে দাসত্বই তার একমাত্র জীবনধর্ম। আর এভাবেই হাজার বছর ধরে দাসপ্রথা চলতে থাকে। আমি আশা রাখি মধ্যবিত্ত এর শিকার হবে না। তারা লড়াই করে তাদেরটা বুঝে নেবে। এ বছর কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মের ১০০ বছর। তাঁকে স্মরণ করে এই লেখা শেষ করছি। তাঁর ‘বেকার জীবনের পাঁচালি’ কবিতা থেকে—

কিবা আসে-যায় আশ্বিনে যদি আকাশ বিষায় কালো মেঘে
শরতের রোদ মুছে নিয়ে যায় মরা শ্রাবণের মেঘে মেঘে
হেমন্তে যদি বাতাস ফোঁপায় কিংবা পঙ্গপাল আসে
অসময়ে গাঁয়ে, খামারে গঞ্জে বস্তিতে বাঁকা শীত হাসে
তাতে আমাদের কতটুকু ক্ষতি, মিতে!
এসো তালি-দেওয়া জুতোজোড়ায় সযত্নে বাঁধি ফিতে!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...