
নীহারকান্তি হাজরা
নদ-নদীর সঙ্গমভূমে
অধ্যায় ১: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১
গীতা খোদাই-করা সেই ইস্কুল
এবার একটু পাশ ফিরতে চাই। প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আগে জন্মের জনপদ জন্মের মতো ছেড়ে চলে এলাম। এবার আমার দ্বিতীয় বাড়ন্তভূমি। এবার হবে আমার দ্বিতীয় স্কুলজীবন শুরু। জেলাসদরের লালবাজারে জেলার দ্বিতীয় পুরনো স্কুলে পিতা নিয়ে গিয়েছিলেন— হিন্দু স্কুল। এখানে আমাকে বলা হয়েছিল ইংরেজিতে একটি চিঠি লিখতে। বিষয়: হঠাৎ অসুস্থ বোধ করায় টিফিনের শুরুতে ছুটির জন্য হেডমাস্টারমশায়ের কাছে আবেদন। লিখেছিলাম। এতে একটা বানান ভুল হয়েছিল। তাতে আমার ভর্তির আবেদন অগ্রাহ্য হয়নি। কিন্তু আমার পিতার এক সহপাঠী গোয়েঙ্কা ট্রাস্টের একটি স্কুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ছিলেন। স্কুলটির নাম গোয়েঙ্কা বিদ্যায়তন। পরিচিতির জন্যেই জেলাস্কুলের বদলে এখানে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। স্কুলটি ছিল ইংরেজি E অক্ষরের মতো। লম্বা এক সার সিঁড়ি দিয়ে উঠে উঁচু জমির উপর এর স্থিতি। অক্ষরের সব দিকগুলিতে থামের উপর ঝোলানো বারান্দার গায়ে গীতার একটি অধ্যায় লেখা। অক্ষরের মাঝখানটি একটি হলঘর। এর ভিতরে চারপাশে সিলিংয়ের নীচে মার্বেল পাথরে গীতার একটি অধ্যায়। এখানে তেওয়ারিজি চরকায় সুতো তৈরির ক্লাস নিতেন। এটি সপ্তাহে একদিন হত। তিনি আবার সপ্তাহে একদিন গীতার ক্লাসও নিতেন।
হেডমাস্টার ছিলেন নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি ইংরেজি পড়াতেন। তাঁকে কখনও বই ধরে পড়াতে দেখিনি। তিনটে বছর তিনি তাঁর ছাত্রজীবনের নানা কাহিনি বলে কাটিয়ে দিলেন। বাংলা আর ইতিহাস পড়াতেন কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বাংলা পড়ানোর সময় তিনি স্বগোতক্তি করতেন আর ইতিহাস পড়ানোর সময় বার বার ফুলহাতা জামার কব্জির বোতাম খুলে হাতা গোঁটাতেন আর নামাতেন। আর অশ্রুত স্বরে হস্তচালনা করে ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা করতেন। এখনও মনে আছে তাঁর দক্ষিণ হাত সঞ্চালন করে অসামান্য ক্ষমতায় দেখিয়েছিলেন কেমন করে বর্ষার ভরা গঙ্গা পার হয়ে শের শা হুমায়ুনকে আক্রমণ করে ভাগিয়েছিলেন। শেষে স্ফুটমান হত তাঁর স্বর— পগার পার পগার পার। তিনি ছিলেন আমাদের ‘ক্লাসটিচার’। প্রত্যেকদিন তাঁর আসতে দেরি হত। স্কুলের কাছেই ছিল তাঁর বাড়ি। আসার সময় তাঁর নিত্য অভ্যাস ছিল ছোট্ট মেয়েটিকে এই স্কুলসংলগ্ন মহাকালী পাঠশালায় দিয়ে আসা। আবার টিফিনের সময় তিনি তাকে পৌঁছে দিতেন বাড়ি। তারপর একদিন….। সেই থেকে প্রতিদিন তিনি বছরভর মহাকালী পাঠশালার যেখানটিতে বসত সে, সেই শূন্য স্থানটি দেখে স্কুলে আসতেন। প্রায়শই টিফিনে চলে যেতেন পাঠশালায়। আবার ফিরে আসতেন। এই দীর্ঘকায় ফর্সা মানুষটিকে কেউ কখনও বিরক্ত করেনি। তাঁর সহকর্মীরাও না। বাকি শিক্ষকদের কেউ কখনও আমাদের তেমন কোনও ধরনের প্রেরণা জোগাতে পারেননি। কেবল মাত্র উপাধ্যায়জি ছাড়া। চন্দ্রভূষণ উপাধ্যায়। তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্বব্যিালয় থেকে এসেছিলেন আর আমাদের হিন্দির ক্লাস নিতেন। থাকতেন বাঁকুড়ার লালবাজারে তখনকার সবচেয়ে বড় প্রেস— জ্যোতি প্রেসের উপরতলার একটি ঘরে। তাঁর চেহারাটি ছিল, উজ্বল নয়, জ্যোতির্ময়। অকৃতদার ছিলেন। দেখাশুনা করতেন প্রেসটি। এটি ছিল গোয়েঙ্কাদের। মোহনলাল গোয়েঙ্কা। বেশ কয়েক বছর পরে, আমি কলেজের ছাত্র তখন, একটা পত্রিকা বার করি। এটার নাম ছিল বিভাস। ১৯৫৬-৫৭ সাল। তখন আমি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর শহরের বাসিন্দা। এটা ছাপাবার জন্য জ্যোতি প্রেসে গিয়েছিলুম। তখনও উপাধ্যায়জি ছিলেন। এবং আশ্চর্য আমার পদবি ধরে ডেকে অবাক করে দিলেন। আরও অবাক করে দিলেন আমার কাগজ বিনা পয়সায় ছাপার বন্দোবস্ত করে দিয়ে। মনে আছে প্রথম সংখ্যাটিতে আমার একটা ছোট গল্প ছিল— ফুলদি। গল্পটা খুব নাম করেছিল। কাগজটির সম্পাদক ছিলেন অমরশংকর ভট্টাচার্য। আমি কার্যকরী সম্পাদক। অমরদা আমার থেকে তিন ক্লাস উপরে পড়তেন। পত্রিকাটির অনেকগুলি সংখ্যা বেরিয়েছিল। শক্তি ঘোষ (পরে যিনি উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা হয়ে একাধিক বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন) ও রণজিৎ মিত্র এতে নিয়মিত লিখতেন। শহরে পত্রিকাটির খুব চাহিদা হয়েছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠেছিলেন রণজিৎ মিত্র। পরে তিনি আনন্দবাজারের দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর ছোটগল্প ‘হরবোলা’-র জন্যে। তাঁর বহু শ্রুতিনাটিকা অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অভিনীত হয়েছিল। ‘শুকতারা’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন।
পিতৃদেবের দুই বন্ধুর যিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ছিলেন তাঁর নাম ছিল কুচিলচন্দ্র সিংহ। তিনি ইংরেজির এমএ ছিলেন। আমার স্থিতিকালে কখনও তিনি আমাদের ক্লাস নেননি। থাকতেন শহরের নুনগোলা রোডের গলিতে। ক্লাস টেনে উঠে কিছুদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে কোচিং নিয়েছি। তাঁর ছোটছেলে ছিল বদ্ধ পাগল। আমরা বাইরের ঘরে কম্বলের উপরে পড়বার সময় প্রায়শই হা রে রে রে করে সে সব লন্ডভন্ড করে দিত। আবার বড়ছেলের স্ত্রী, কুচিলবাবুর দেশের বাড়ি ভাদুলে থাকত বলে সেখানে নানা সামগ্রী আমাদেরই পৌঁছতে হত। জায়গাটা ছিল শহর থেকে চার-তিন মাইল দূরে দ্বারকেশ্বর নদীর পশ্চিম তীরে। মাঝেমাঝেই স্কুল চলাকালীন তিনি এই সব আদেশ দিতেন। এমনকি পিঠে করে চুনও। আর ছুটিছাটা হলেই মোপেড নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তেন পিয়ারলেস ইনসিওরেন্স করার জন্যে।
পিতার আর একজন বন্ধু ছিলেন করালীকিঙ্কর চক্রবর্তী। তিনি মাঝেমাঝে অঙ্কের ক্লাস নিতেন। ঢুকেই বোর্ডে কোনও একটা অঙ্ক করে দিয়ে কঠিন নীরবতায় বসে পড়তেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিট অসম্ভব দমবন্ধ অবস্থায় আমাদের রেখে তিনি নিষ্ক্রান্ত হলে আমরা সকলে উল্লাসে ফেটে পড়তাম। সমস্ত স্কুল তিনজন শিক্ষককে বন্ধনীর মধ্যে এনেছিল— কালী-করালী-কুচিল। আবার, আমাদের স্কুলটির অবস্থান ছিল কুচকুচিয়ায়। এই সব ভয়ানক ভস্মাধারের মধ্যে একমাত্র বিভা ছড়িয়ে ছিলেন আমাদের হিন্দির মাস্টারমশাই। সভ্যতার ইতিহাসের অসংখ্য মানুষ, তাঁদের দর্শনের নমুনা, মানুষের মনের নানা পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন। আবার এ-সবের মধ্যে বহুকাল আগে ফেলে আসা আমার আর এক মাস্টারমশাই সুধীরঞ্জন দাস আর ক্যাসাবিয়ঙ্কার কথা মনে পড়ে। পরে যখন বিএ পরীক্ষার পরে একটি স্কুলে কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতায় ঢুকি তখন আমার অতদিনের অভাবগুলি মনে করে ছাত্রদের পড়াতুম। বাড়ন্ত মনের ক্ষুধার আহার জোগানো শিক্ষকের কাজ। এ-রকমই আমার মনে হয়েছিল।
[ক্রমশ]