চক্রব্যূহে ভারতের অর্থনীতি— টাকার ধারাবাহিক মূল্যহ্রাস

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 


একসময় নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন নিয়মিত টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে আক্রমণ করতেন। এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন: "প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় মুদ্রা দুইই আজ নীরব। একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীজুড়ে ভারতীয় রুপির আওয়াজ শোনা যেত। কিন্তু আজ সে শব্দ হারিয়েছে। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী আজ অখণ্ড নীরবতা পালন করছেন...." মজার কথা হল— যিনি চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনি আজ শুধু নীরব নন; একই সঙ্গে তাঁর আমলে ভারতীয় অর্থনীতি কোমায় চলে গেছে

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: মেক ইন ইন্ডিয়া ও স্টার্ট-আপের গল্পস্বল্প

২৪ সেপ্টেম্বর (২০২৫) দিনটা ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই দিন বিশ্ববাজারে এক মার্কিন ডলারের দাম হয়েছিল ভারতীয় মুদ্রায় ৮৮.৭৪ টাকা। রেকর্ড তৈরি হয় ভাঙার জন্য, তবে মনে রাখা দরকার— বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি বলে অহরহ বিজ্ঞাপিত ভারতে এই রেকর্ড আদতে লজ্জার ইতিহাস বহন করে। প্রসঙ্গত, এটাও উল্লেখ থাকা দরকার যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হস্তক্ষেপ না করলে এই লজ্জার ইতিহাস আরও দীর্ঘায়িত হত। সবচেয়ে বিস্ময়কর হল— বিশ্ব-অর্থনীতিতে মার্কিন মুদ্রা দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও ডলারের তুলনায় ভারতীয় টাকার পতন অব্যাহত। এ-বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে ইউরো, ইয়েন ও পাউন্ডের তুলনায় ডলারের মূল্য পড়েছে গড়ে ১০.৮ শতাংশ। ডলার দুর্বল হওয়ার কারণ— মার্কিন দেশে ক্রমবর্ধমান আর্থিক ঘাটতি, বৃদ্ধির সম্ভাবনা দুর্বল হওয়া এবং ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমানোর প্রত্যাশা। সাধারণ অবস্থায় অর্থনীতিতে দেখা যায়, ডলার দুর্বল হলে রুপির মতো উদীয়মান অর্থনীতির মুদ্রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে; কারণ এতে আমদানি মূল্য হ্রাস পায় এবং বিদেশি পুঁজি দেশে আসে। ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু ঘটনা সেভাবে ঘটছে না।

ডলারের তুলনায় টাকার এই অবমূল্যায়ন যদিও কোনও নতুন কথা নয়। ১৯৯১ সালে যখন ভারতীয় মুদ্রার উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হল, তখন এক ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ২২.১৮ টাকা। ২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলেন, তখন এক ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৬২.৩৩ টাকা। কিন্তু অমৃতকালে দেখা যাচ্ছে, এই অবমূল্যায়নের গতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে রুপির মূল্যহ্রাস ছিল ০.৬ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে ওই একই সময়সীমার মধ্যে হয়েছে ৬ শতাংশ।[1] তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল— আমাদের মতো অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, যেমন মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড বা ফিলিপাইনের মুদ্রা কিন্তু ডলারের তুলনায় অনেকটাই স্থিতিশীল রয়েছে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলির মুদ্রার মধ্যে ভারতীয় রুপির পারফরম্যান্স সবচেয়ে খারাপ।[2]

সাম্প্রতিক মূল্যহ্রাসের ক্ষেত্রে অনেকেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতীয় পণ্যের উপর শুল্কবৃদ্ধির ইস্যুটিকে সামনে আনছেন। এটা কারণ হিসেবে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় পণ্যের উপর অস্বাভাবিক শুল্ক ও জরিমানা চাপানো অবশ্যই মার্কিন দেশে রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিন দেশে কর্মরত ভারতীয়দের ভিসা-সংক্রান্ত নতুন নিয়ম, যাতে নতুন ভিসার আবেদনপত্রে এক লক্ষ মার্কিন ডলার ফি লাগবে।[3] গত বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এইচ-১বি ভিসা, যা বিদেশিরা মার্কিন দেশে পেয়েছেন, তার মধ্যে ৭১ শতাংশই ভারতীয়দের। এই তথ্যগুলির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ না থাকলেও বলা যায়, মার্কিন শুল্কযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই টাকার মূল্য ধারাবাহিকভাবে পড়ছিল; বর্তমান সংকট তার গতিবৃদ্ধি করেছে মাত্র।

এক্ষেত্রে সংকটের প্রধান কারণ হল— প্রত্যক্ষ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারত থেকে তাঁদের লগ্নি প্রত্যাহার করে চলেছেন।[4] এ বছর সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইকুইটি তুলে নিয়েছেন। বিশ্ববাণিজ্যের অনিশ্চয়তা, মার্কিন নীতি এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের অচলাবস্থা এর বড় কারণ। একদিকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কমছে, অন্যদিকে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা তাঁদের পুঁজি সরিয়ে নিচ্ছেন। সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে একদিনে ৩৫৫১.১৯ কোটি টাকার ইকুইটি বিদেশিরা বিক্রি করেছেন, যা এক রেকর্ড। ফলে শেয়ারবাজারেও তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে। ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে সরকারের ঋণ শোধ করার ক্ষমতা কমছে। এর সঙ্গে বেড়েছে সোনার আমদানি।[5] শুধুমাত্র আগস্ট (২০২৫) মাসে ভারতে সোনা আমদানি বেড়েছে ৫৬.৭ শতাংশ।

এইভাবে টাকার মূল্যহ্রাস হলে দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ে তা কারও অজানা নয়। টাকা যত দুর্বল হবে, আমদানি তত মহার্ঘ্য হয়ে উঠবে। আর আমাদের দেশে অপরিশোধিত তেলের নব্বই শতাংশ আমদানি করতে হয়। ফলে আমদানি মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উপর পড়ে। একসময় নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন নিয়মিত টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে আক্রমণ করতেন। এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন: “প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় মুদ্রা দুইই আজ নীরব। একটা সময় ছিল যখন পৃথিবীজুড়ে ভারতীয় রুপির আওয়াজ শোনা যেত। কিন্তু আজ সে শব্দ হারিয়েছে। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী আজ অখণ্ড নীরবতা পালন করছেন…. আজ ভারতীয় মুদ্রা মৃত্যুশয্যায় এবং দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন…. সময় এসেছে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর। জনগণের জানা উচিত কেন এবং কাদের জন্য দেশ আজ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে।”[6] মজার কথা হল— যিনি চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তিনি আজ শুধু নীরব নন; একই সঙ্গে তাঁর আমলে ভারতীয় অর্থনীতি কোমায় চলে গেছে।

আজ ভারতকে ডলার অর্থনীতির এই সংকট বুঝতে হবে। রাশিয়ার তেল ভারত, চিন ও তুরস্ক— এই তিনটি দেশই কিনেছিল। কিন্তু চিন বা তুরস্কের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক নমনীয় নীতি নিয়েছে।[7] কারণটা খুব সহজ। চিনের রেয়ার আর্থের সম্পদ ও বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক শক্তি তাকে অর্থনৈতিকভাবে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে যে, আমেরিকা তর্জন-গর্জন ছাড়া অন্য কোনও পদ্ধতি অবলম্বন করলে তা মার্কিন অর্থনীতির পক্ষে আত্মঘাতী হতে বাধ্য। অপরদিকে, পশ্চিম এশিয়ায় তুরস্ককে চটানো এই মুহূর্তে মার্কিন দেশের বৈদেশিক নীতির পক্ষে বিপজ্জনক হবে। আজ ডলারের আগ্রাসন থেকে ভারতকে বাঁচতে হলে বিকল্প পথের অনুসন্ধান করতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে মিলিতভাবে ‘ডি-ডলারাইজেশন’ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি দাবি করছে চিনের সঙ্গে প্রগাঢ় আর্থিক সম্পর্ক, কারণ রাশিয়ায় ভারতের রপ্তানি খুবই সামান্য। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের এজেন্সিগুলির বিকল্প সন্ধান করতে হবে। ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল— আমদানির তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ কম। আর অর্থনীতি এই নব্য-উদারবাদী জমানায় বিদেশি বিনিয়োগ-নির্ভর। ফলে পুঁজির নিয়মিত এ-দেশ থেকে উড়ান এক গভীর সমস্যা। আবার অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি না-হওয়ার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতকে আর আদর্শ লগ্নিক্ষেত্র ভাবছেন না। এই অবস্থা চলতে থাকলে এক ডলারের মূল্য একশো টাকা ছুঁতে বেশিদিন লাগবে না।

 

তথ্যসূত্র:

 

[ক্রমশ]

 


[1] Monthly Economic Review September 2025. Government of India, Ministry of Finance, Department of Economic Affairs.
[2] Rupee worst Asian currency in U-turn as yuan carry trades unwind. Business Standard. Aug 5, 2025.
[3] H-1B FAQ. US Citizenship and Immigration Services.
[4] মৌলিক, সুমন কল্যাণ। চক্রব্যূহে ভারতের অর্থনীতি— আশা-নিরাশার এফডিআই। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। জুলাই ২৪, ২০২৫।
[5] India’s Q3 gold demand value rises 23% to Rs. 2,03,240 crore: World Gold Council. Rising Kashmir. Oct 30, 2025.
[6] Narendra Modi blasts ‘mute’ PM, says both UPA & rupee have lost value. Economic Times. Aug 24, 2013.
[7] Sanctions Programs and Country Information. Office of Foreign Assets Control, U.S. Department of the Treasury.

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...