সুমন কল্যাণ মৌলিক
বহুবিজ্ঞাপিত স্টার্ট-আপের গল্পও মেক ইন ইন্ডিয়ার ব্যর্থতার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। একদা নরেন্দ্র মোদি এগুলোকে ভারতের প্রগতির প্রতীক বলে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তো অনেক দূরের কথা— ভারত ক্রমশ স্টার্ট-আপের বধ্যভূমি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৩ সালে ১৫টি এবং ২০২৪ সালে ১২টি স্টার্ট-আপ কোম্পানি অকাল মৃত্যুবরণ করেছে। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, কোনও নির্দিষ্ট সেক্টর নয়, সব সেক্টরেই সংকটের ছবি
পূর্ব-প্রসঙ্গ: আশা-নিরাশার এফডিআই
সময়টা ছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আকাশে-বাতাসে তখন নতুন স্লোগানের সুবাতাস। স্বপ্নো কি সওদাগরের নেতৃত্বে ভারতে আচ্ছে দিন আসছে— এই প্রত্যয়, কর্পোরেট মিডিয়ার কুশলী প্রচারের সৌজন্যে, আমজনতা বিশ্বাস করে ফেলেছে। ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ সিরিজে প্রচারের এক বড় অংশ জুড়ে ছিল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন এই মহতী প্রকল্পের তিনটি লক্ষ্য:
১) অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের বার্ষিক বৃদ্ধি ১২–১৪ শতাংশ করা, যাতে অর্থনীতিতে এই ক্ষেত্রের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।
২) ২০২২ সালের মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে ১০ কোটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা, যা এই বেকারত্বের বাজারে নতুন আশার আলো দেখাবে।
৩) ২০২২ সালের মধ্যে (পরে সংশোধিত হয়ে ২০২৫) দেশের জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের অংশ ১৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা।
এ-কথা অস্বীকার করার কারণ নেই যে, এই মহতী প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই দেশের অর্থনীতিতে তার সদর্থক প্রভাব পড়বে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, এই “আচ্ছে দিনের ভারত” বিভিন্ন বিদেশি ও দেশি কোম্পানির কাছে বিনিয়োগের প্রথম পছন্দ হবে। তাদের কাছে ভারতকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য শ্রম আইন এবং কর আইনের সংস্কার করা হবে। আশা করা হয়েছিল, এর ফলে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ রেকর্ড মাত্রা স্পর্শ করবে। চিনকে কয়েক গোল দিয়ে ভারত হয়ে উঠবে পৃথিবীর নতুন ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’।
এই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের পরপরই মিডিয়ায় আরেকটি ভাবনার প্রচার শুরু হয়— স্টার্ট-আপের গল্প। সরকারের ঋণ, ভর্তুকি, নতুন নতুন ভাবনা এবং তরুণ শিল্পোদ্যোগীরা— মোদ্দা কথা, ঘরে ঘরে টাটা-বিড়লার ক্ষুদ্র সংস্করণ।
মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্প ঘোষণার পর এক দশক অতিক্রান্ত; সময় এসেছে এই প্রকল্প তথা অর্থনৈতিক ভাবনার হাল-হকিকত জেনে নেওয়ার। বর্তমান নিবন্ধ সেই লক্ষ্যে এক প্রচেষ্টা মাত্র।
মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পটি রূপায়নের দায়িত্বে ছিল ডিপার্টমেন্ট অফ প্রমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ইন্টারনাল ট্রেড (DPIIT)। এ-ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, ১৯৫০ সালে ভারতে জিডিপির ৫৯ শতাংশ ছিল প্রাইমারি সেক্টর। এবং এ-কথাও সবারই জানা— কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির স্থায়ী বিকাশে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।
১৯৯০ সালে, অর্থাৎ বহু আলোচিত অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রাকমুহূর্তে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের জিডিপি অংশ ১৬–১৭ শতাংশ ছিল। আর আজ, মেক ইন ইন্ডিয়ার এক দশক পরে ২০২৪ সালে, এই সেক্টরের অবদান মাত্র ১৭.৭ শতাংশ। তাই সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা, অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্য, নেহাৎই আকাশকুসুম কল্পনা।
বছর অনুযায়ী ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের জিডিপি-অংশ জনলে আলোচনার সুবিধা হয়:
২০১৪ – ১৫ শতাংশ,
২০১৫ – ১৬ শতাংশ,
২০১৬ – ১৫ শতাংশ,
২০১৭ – ১৫ শতাংশ,
২০১৮ – ১৫ শতাংশ,
২০১৯ – ১৩ শতাংশ,
২০২০ – ১৪ শতাংশ,
২০২১ – ১৪ শতাংশ,
২০২২ – ১৩ শতাংশ,
২০২৩ – ১৭ শতাংশ,
২০২৪ – ১৭ শতাংশ।
এখানেই লক্ষণীয় যে, সরকারের তরফ থেকে একাধিক উৎপাদনবান্ধব নীতি ঘোষণা সত্ত্বেও, মোট জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের ভূমিকা মোটের উপর একই থেকে গেছে।
কর্মসংস্থানের প্রশ্নে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। গত এক দশকে এই সেক্টরে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি নামমাত্র। ষষ্ঠ আর্থিক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৩–১৪ অর্থনৈতিক বর্ষে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে ৩ কোটি লোক নিযুক্ত ছিলেন। সরকারের বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথমদিকে এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সেক্টরে ৫ কোটি লোক কাজ করছিলেন। তারপর অতিমারি শুরু হওয়ার আগেই কর্মসংস্থানে ভাঁটার টান শুরু হয়। এক্ষেত্রেও সালওয়াড়ি হিসেব দেখে নেওয়া যাক—
২০১৮ – ৪ কোটি,
২০১৯ – ৪ কোটি ৭ লক্ষ,
২০২০ – ৪ কোটি ৯ লক্ষ,
২০২১ – ২ কোটি ৯৮ লক্ষ,
২০২২ – ৩ কোটি ১৬ লক্ষ,
২০২৩ – ৩ কোটি ৫৭ লক্ষ।
এমনকি কর্পোরেট মিডিয়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে যে-সমস্ত বৃহৎ লগ্নির কথা প্রচার করা হয়, সেখানেও কর্মসংস্থানের ছবি খুবই করুণ। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাতে কোকা-কোলা কোম্পানির ৩,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ মাত্র ১,৪০০ জনের কর্মসংস্থান জুগিয়েছিল। একইভাবে ওড়িশায় নেসলে কোম্পানির ৯০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ মাত্র ৮০০ জনকে কাজ দিয়েছে।
ভারত সরকার মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পকে সফল করতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ইলেকট্রনিক্স ও চিপ তৈরিতে। শুধু ২০২৪ সালের বাজেট বরাদ্দই ছিল ১৩,১০৪.৫ কোটি টাকা। কিন্তু সমস্যা হল, ভারি বিনিয়োগ-সমৃদ্ধ এই শিল্পগুলিতে উন্নত প্রযুক্তির কারণে কর্মসংস্থান খুবই কম। আর যেসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বেশি— যেমন টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, ফুটওয়্যার, মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ— সে-সব ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ কম। ২০২২–২৩ অর্থনৈতিক বর্ষে বস্ত্রবয়ন মন্ত্রক বাজেটে টেক্সটাইল শিল্পের জন্য বরাদ্দ করেছিল ১১,০৫৯.৮১ কোটি টাকা, কিন্তু বছরের শেষে সংশোধিত বাজেট দাঁড়ায় মাত্র ৩,৫৭৯ কোটি টাকায়।
মোদ্দা বিষয় হল, ১০ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি অনেক অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মতোই গঙ্গা দিয়ে ভেসে গেছে।
মেক ইন ইন্ডিয়ার সফলতাসূচক যে দুটি প্রকল্পের কথা মোদি সরকার সবচেয়ে বেশি বলে, সেগুলোর দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন। প্রথমটি হল চিপ প্রস্তুতকারী সংস্থা মাইক্রনের ভারত আগমন। কথা হয়েছিল, দুই পর্বে মাইক্রন গুজরাতে ৮২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে ‘DRAM and NAND’ (storage and memory chips) কারখানা তৈরি করবে— যা প্রথমে চিপ অ্যাসেম্বল করবে, পরে গবেষণাকেন্দ্র হবে। এতে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হবে ৫,০০০ জনের।
কিন্তু মজার বিষয় হল, মাইক্রনের এই কারখানা ভারত সরকারের ‘Modified Assembly, Testing, Marking and Packaging Scheme’-এর আওতায় প্রজেক্ট খরচের ৫০ শতাংশ আর্থিক সাহায্য পাবে। এছাড়াও গুজরাত সরকার দেবে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ ইনসেন্টিভ। হিসাব করলে মোট প্রজেক্ট খরচ দাঁড়াচ্ছে ২.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, কিন্তু মাইক্রনকে দিতে হচ্ছে মাত্র ৮২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, মোদি সরকার মাইক্রনকে যে আর্থিক ভর্তুকি দিচ্ছে, তা দেশের উচ্চশিক্ষার বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ। রাজন হিসাব করে দেখিয়েছেন, মাইক্রনে একটি চাকরির সুযোগ তৈরি করতে খরচ পড়ছে চার লাখ মার্কিন ডলার।
আরেকটি বহুল বিজ্ঞাপিত প্রকল্প হল অ্যাপেল কোম্পানির স্মার্টফোন উৎপাদন কারখানা। অ্যাপেল এখানে কারখানা তৈরি করছে, যাতে তাদের চিনের প্রতি নির্ভরতা কমানো যায়। এই প্রকল্পে কোম্পানির প্রধান কনট্রাকটর— ফক্সকন, টাটার ওয়েস্টন, এবং পেগাট্রন— ২০২৩ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে Production-Linked Incentive (PLI) হিসেবে পেয়েছে ৪৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এইভাবে, কোষাগারের বিপুল অর্থ খরচ করে বিদেশি কোম্পানিকে উৎপাদনে আগ্রহী করার চেষ্টা, অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে না।
এই দশকে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের গড় বার্ষিক বৃদ্ধি মাত্র ৫.৯ শতাংশ, যা ঘোষিত লক্ষ্য (১২–১৪ শতাংশ) থেকে অনেক কম। যদি আমরা এই সেক্টরের বিভিন্ন উপ-খাতের বৃদ্ধির হিসাব দেখি, হতাশাজনক চিত্র আরও পরিষ্কার হবে:
- ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি – ১.৮ শতাংশ
- কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস ও অপটিক্যাল প্রোডাক্টস – ২ শতাংশ
- পরিবহন শিল্পের যন্ত্রপাতি – ২.৩ শতাংশ
- মোটর ভেহিকেলস – ১.৬ শতাংশ
- টেক্সটাইল – ০.৫ শতাংশ
- পোশাক – ১.২ শতাংশ
- চর্মশিল্প – ১.৮ শতাংশ
মেক ইন ইন্ডিয়ার সাফল্যের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল কর্পোরেট বিনিয়োগ, কিন্তু প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ঘাটতি[1] প্রকল্পের প্রধান বিপর্যয় হিসেবে দেখা গেছে। এমনকি দেশের ভেতর থেকেও বিনিয়োগ কমে গেছে। বিশ্বায়নের প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর সর্বোচ্চ বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ২০০৭–০৮ অর্থবর্ষে ২৭.৫ শতাংশ। এরপর উল্টো যাত্রা শুরু হয়। ২০১৫–১৬ সালে তা দাঁড়ায় ২১.৩ শতাংশ, যা ২০২০–২১ সালে ১৯.৬ শতাংশে নেমে আসে। অথচ সরকারের তরফ থেকে ইনসেন্টিভের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এক্ষেত্রে ২০১৯-২০ সালে কর্পোরেট ট্যাক্স অনেক কমানো হয়।
এই মেক ইন ইন্ডিয়া কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে কোনও সুরাহা করতে পারছে না, তার আরেকটি বড় প্রমাণ হল কৃষিক্ষেত্রে শ্রমশক্তির বৃদ্ধি। আরেকটি তথ্য হল, পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী শ্রমশক্তির ৫৮ শতাংশ (৯ কোটি ৫০ লাখ) স্বনিয়ুক্ত।
এই প্রসঙ্গে চিনের প্রসঙ্গ আসা জরুরি, কারণ মোদি সরকারের প্রচারের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ‘চিনের সর্বনাশ, ভারতের পৌষমাস’। বিশেষ করে অতিমারি-পরবর্তী সময়ে বলা হয়েছিল, দলে দলে বহুজাতিক সংস্থা চিন ছেড়ে ভারতে আসতে চলেছে। অতিমারি শুরু হওয়ার আগেই পলিসি অনুসারে চিন বহু বিদেশি সংস্থার উপর করভার বৃদ্ধি করে। ফলে চিনের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর থেকে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাত বাইরে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারত এই অঙ্কের মাত্র দশ শতাংশও নিজের দেশে আনতে পারেনি। বরং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো— ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া— নতুন বিনিয়োগের গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
এক্ষেত্রে বিশেষভাবে ভিয়েতনাম উল্লেখযোগ্য। ১০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশ ভারতের সমান মূল্যের ১.৪ বিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করে। মোদি সরকার এই পর্বে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ স্লোগানের আড়ালে জাপানের জাইবাৎসু ও দক্ষিণ কোরিয়ার চেবলসের মতো দুটি বিশেষ কোম্পানিকে সমস্ত সুযোগসুবিধা দিয়ে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন প্রোগ্রাম চালু করেছে। এতেও বিদেশি সংস্থাগুলোর মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
অবশ্য, আম্বানি ও আদানি আজকের দিনে দেশের প্রধান শক্তি হয়ে উঠেছে, কিন্তু তারা কোনও বেসিক গুডসের উৎপাদক নয়। মোদি-জমানায় প্রায় ২,৭০০ বহুজাতিক সংস্থা ভারত ছেড়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জেনারেল মোটরস, ফোর্ড, হার্লে-ডেভিডসন, কেয়ার্ন এনার্জি, হাচিনসন ইত্যাদি। সব মিলিয়ে বলা যায়, পরিকাঠামোতে ব্যাপক সরকারি বিনিয়োগ এবং নানান ধরনের ইনসেন্টিভ প্যাকেজ থাকা সত্ত্বেও মেক ইন ইন্ডিয়া তার লক্ষ্যের ধারে কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি।
বহুবিজ্ঞাপিত স্টার্ট-আপের গল্পও আলাদা কিছু নয়। একদা নরেন্দ্র মোদি এগুলোকে ভারতের প্রগতির প্রতীক বলে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তো অনেক দূরের কথা— ভারত ক্রমশ স্টার্ট-আপের বধ্যভূমি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৩ সালে ১৫টি এবং ২০২৪ সালে ১২টি স্টার্ট-আপ কোম্পানি অকাল মৃত্যুবরণ করেছে। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, কোনও নির্দিষ্ট সেক্টর নয়, সব সেক্টরেই সংকটের ছবি। অতিমারির সময় অস্থায়ী চাহিদার সুযোগে অনেকে পুঁজি জোগাড় করে কোম্পানি খুলেছিলেন, কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে শুরু করেছে। ২০২৪ সালে গ্রিনইক (কৃষিপ্রযুক্তি), গোল্ডপে (আর্থিক পরিষেবা), ব্লুলার্ন (শিক্ষা), কেনকো (স্বাস্থ্য), কু (মিডিয়া), নিনটেক (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা)-এর মতো বহুবিজ্ঞাপিত স্টার্ট-আপ তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। একটি আর্থিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, মাত্র ২০ শতাংশ স্টার্ট-আপ গড়ে ৫ বছর বাঁচে, এবং ১০ বছরের বেশি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম মাত্র ৮ শতাংশ স্টার্ট-আপ। এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অতিমারি পর্বে ভারতে প্রায় ৭৫,০০০ স্টার্ট-আপ ছিল, যেখানে কর্মরত ছিল ৭.৪৬ লক্ষ জন। আজ তার ৯০ শতাংশ অসফল। মূল সমস্যা হল পুঁজির অভাব, উদ্ভাবনী শক্তির অভাব, এবং সঠিক পরিকল্পনা না থাকা।
সম্প্রতি মন্ত্রী পীযুষ গোয়েল স্টার্ট-আপের ব্যর্থতা নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর মন্ত্রক কেন স্টার্ট-আপের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি নীতি তৈরি করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ, তার উত্তর মেলে না।
তথ্যসূত্র:
- Babu, M. Suresh. Why ‘Make in India’ has failed. The Hindu. Jan 20, 2020.
- Shastry, Vasuki. As Modi makes ambitious pitch in the US, Make in India is qualified failure 10 years on. Scroll.in. Sep 24, 2024.
- Raghuram Rajan slams government’s manufacturing subsidies and policies. Economic Times. May 16, 2024.
- Todi, Juhi. But did we really ‘Make in India’? Down to Earth. Sep 25, 2024.
- Chidambaram, Jayakosh. ‘Make in India’: An Abysmal failure. Madras Courier. Jan 22, 2024.
- Yadav, Pooja. 2024’s Startup Graveyard: 12 Indian Startups That Shut Down This Year. Inc 42. Dec 11, 2024.
- Karpe, Ninad. What’s behind the failure of most startup? Economic Times. Mar 24, 2023.
[ক্রমশ]
[1] মৌলিক, সুমন কল্যাণ। চক্রব্যূহে ভারতের অর্থনীতি— আশা-নিরাশার এফডিআই। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। জুলাই, ২০২৫।

