মতাদর্শের খোঁজে ভগৎ সিং: গোড়ার কথা

কণিষ্ক চৌধুরী

 


শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, সমাজবিজ্ঞানের উৎসাহী ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

গত কয়েক দশক ধরেই ভগৎ সিংকে নিয়ে বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক সংঘগুলির দড়ি টানাটানি খেলা দেখা যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি, প্রগতিশীল-আধা প্রগতিশীল, দক্ষিণপন্থী-চরম দক্ষিণপন্থী-অধঃপতিত বামপন্থী-আধা বামপন্থী সকলেরই দাবি ভগৎ সিং তাদের। তারাই ভগৎ সিং-এর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। এঁদের দাবি করায় কোনও দোষ নেই। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। ভগৎ সিং কী ভাবতেন, কেন ভাবতেন এবং কেমন করে ভাবতেন— এসব প্রশ্নে দাবি উত্থাপনকারীদের তেমন কোনও আগ্রহ চোখে পড়ে না। তাদের মূল আগ্রহ শহীদ সম্রাট ভগৎ সিং নামক বিপ্লবীকে নির্বাচনী স্বার্থে নিজেদের মান্যপ্রতিমা (icon) হিসেবে তুলে ধরা। কিন্তু চাইলেই কি পাওয়া যায়? ফলে শুরু হয় টাগ অফ ওয়ার— তাঁকে পকেটে পোরার লড়াই। আর যখন এসব চলে আসে তখন প্রায় সকলের অলক্ষ্যে ভগৎ সিং-এর লেখাগুলো এদের দিকে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে থাকে। ভগৎ সিং যেসব বিষয়কে সমর্থন করতেন, এরা সে ভাবনা থেকে শতহস্ত দূরে থাকে। তিনি যে মত বা রাজনীতিক/আর্থনীতিক শ্রেণিকে ঘৃণা করতেন, এদের কাছে সেই মতগুলিই অনুসরণযোগ্য, সেই ঘৃণিত পুঁজিপতিরাই পূজনীয়। যে শোষণমূলক শ্রেণিসমাজ, রাষ্ট্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণ-জাতভেদকে তিনি উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন, এরা তাদেরই প্রধান উপাসক। তিনি ঈশ্বরের স্থানে মানুষকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এরা সেই মানুষকে এমন একটা বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে যেখানে মানুষ বাধ্য হচ্ছে ঈশ্বর ও ধর্মের দাসত্ব গ্রহণ করতে। তাঁর মু্ক্তচিন্তা-বুদ্ধির মুক্তি-বস্তুবাদ আজ এদের হাতে ভূলুণ্ঠিত। তার অস্ত্রগুলিকে ব্যবহার করতে হবে— এটাই সময়ের দাবি। এই লক্ষ্যেই ভগৎ সিংয়ের চিন্তাদর্শকে আরও একবার দেখে নেওয়ার চেষ্টা করাটা খুব একটা ভুল হবে না।

ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে একটি চমৎকার প্রক্রিয়া রয়েছে যার মধ্যে দিয়ে বিরোধী মতগুলিকে নির্বিষ করে তোলা যায়। এটি হল আত্তীকরণ। গৌতম বুদ্ধের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। যে বুদ্ধ যজ্ঞ ও যজ্ঞে পশুবলির বিরোধিতা করলেন, বর্ণ-জাতভেদকে অমান্য করলেন, সেই বেদবিরোধী ঈশ্বরে অবিশ্বাসীকেও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বিষ্ণুর অবতার বানিয়ে ছাড়ল। যেমন অগ্নিপুরাণে বুদ্ধ বিষ্ণুর অবতার (ভট্টাচার্য, হংসনারায়ণ। ১৯৯৫: ২: ৩৩৪)। গণনায়ক গণেশের ক্ষেত্রে পরিণতিটা আরও ভয়ানক। রক্তকলুষ বিঘ্নরাজ থেকে একেবারে দেবতায় রূপান্তর। শুধু আত্তীকরণ নয়, এর সঙ্গে চলেছে বিকৃতকরণ, অবজ্ঞা প্রদর্শন ও বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে ধ্বংসসাধন। চার্বাক দার্শনিক ও দর্শনশাস্ত্রের ক্ষেত্রে এর প্রতিটা ঘটনাই ঘটেছে। সুতরাং ভগৎ সিংকে আত্তীকরণের প্রচেষ্টা যে হবে তা বলাই বাহুল্য। তবে এটাও সত্য যে ভগৎ সিংকে গিলে খাওয়ার চেষ্টাটা বোধহয় খুব একটা সহজ হবে না। আর তার কারণ নিহিত রয়েছে তাঁর কার্যকলাপ ও বৌদ্ধিক অনুশীলনের মধ্যে। এই সব মিলিয়েই ভগৎ সিংকে আরও একবার দেখে নেওয়ার চেষ্টা।

১৯২০-র দশকের পূর্ববর্তী বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে সেখানে রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল প্রবাহটি ছিল আবেগসর্বস্ব রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ। দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির প্রতি সীমাহীন ঘৃণাই ছিল তাদের সবথেকে বড় পুঁজি। কোন সুসংগঠিত মতাদর্শের জন্ম তখনও হয়নি, বা ঐতিহাসিক কারণেই হতে পারেনি। একটা মায়াময় অতীত সংক্রান্ত কল্পনাকেই তাঁরা আদর্শ মনে করতেন। খানিকটা এলোমেলো ভাবনা, স্বাধীন হওয়ার একান্ত মধ্যবিত্ত আকুতি, ধর্মীয় ভাবাবেগ, ব্রিটিশ আধিপত্যের উচ্ছেদ— এইসব মিলেমিশেই তৈরি হয়েছিল তাঁদের ভাবাদর্শ। আরও একটু স্পষ্ট করে বলা যায় এটা ছিল একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ। এই ভাবাদর্শ প্রতিক্রিয়াতেই জন্ম হল আরও একটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের— ইসলামিক জাতীয়তাবাদ। ভগৎ সিংয়ের মতাদর্শকে বোঝার ক্ষেত্রে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট।

যে সময়ে ভগৎ সিং কৈশোর ছেড়ে যৌবনের দিকে হাঁটা দিয়েছিলেন সেই ১৯২০-র দশকে, তখন গান্ধি ভারতের অবিসংবাদী নেতার আসনে আসীন। তিনি তাঁর সংগ্রামের পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন অহিংসাকে। তাঁর অহিংসা তত্ত্বের মূল নাকি নিহিত হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গীতার মধ্যে। এই গ্রন্থটিই তাঁর প্রেরণার উৎসস্থল (Gandhi. 2008: 88)। এইভাবে গান্ধি ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে ধর্মগন্ধী ধারণাকে আমদানি করেন। বিংশ শতাব্দীতে কংগ্রেসি রাজনীতির দুটি প্রধান স্রোতের মধ্যে নরমপন্থীদের মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও, চরমপন্থীদের মধ্যে তা ছিল তীব্র। এ প্রসঙ্গে তিলক, লালা লাজপত রায়, ভাই পরমানন্দের নাম প্রায় এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতে পারে। গান্ধির অবস্থানটি এই রাজনৈতিক প্রবাহের থেকে ভিন্ন বা মধ্যবর্তী অবস্থানে ছিল। এক অর্থে ভারতীয় রাজনীতিতে এটা তাঁর একটা মৌলিক উদ্ভাবন। তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীক/ভাষাগুলিকে পরিত্যাগ করলেন না, কিন্ত সাবেকি নিষ্ক্রিয়তাকে বর্জন করলেন। আর শেষ পর্যন্ত অহিংসার তত্ত্বকে যুক্ত করলেন হিন্দু ধর্মীয় ধারণার সঙ্গে। অহিংসাকে বৈধ করা হল ধর্মীয় যুক্তি দ্বারা।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিনটি দশকের দিকে তাকালে দেখা যাবে উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রাম ও মতাদর্শগুলি নানান রঙের, নানা মাত্রার। যেমন হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, অ-সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, সেকুলার জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, নিয়মতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রবাদ, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রবাদ, ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ কয়েকটি দশকেই দেশজ চিন্তাবিদদের কাছে ঔপনিবেশিক উদ্বৃত্ত শোষণের ছবিটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এই শোষণের তিনটি উপায় চিহ্নিত হয় এইভাবে: (১) সরাসরি করব্যবস্থার মধ্য দিয়ে লুণ্ঠন এবং প্রচুর সংখ্যক ইংরেজের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে; (২) ভারতবর্ষকে কাঁচামাল উৎপাদন ও বিক্রি এবং মেট্রোপলিটান শিল্পদ্রব্য ক্রয়ের জন্য, অর্থাৎ অসম বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে; (৩) ব্রিটিশ মালিকানাধীন পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে (দ্রষ্টব্য: চন্দ্র, বিপাণ। ২০১৭: ৬)। মোদ্দা কথাটি হল ব্রিটিশ অর্থনীতি ও সমাজের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজকে সার্বিকভাবে ব্যবহার করা। এই উপলব্ধি জাতীয়তাবাদীদের কিন্তু একটা ঐক্যবদ্ধ মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করেনি। বরং তারা ভিন্ন ভিন্ন পথ ও পদ্ধতি গ্রহণ করে। যে মতাদর্শ তাঁরা অনুসরণ করতেন তাও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কেউ কেউ উগ্র হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে গ্রহণ করেন। কারও কাছে নরম হিন্দুত্বের পথ ছিল সঠিক পথ। কেউবা ইসলামকে আঁকড়ে ধরলেন জোরের সঙ্গে। কারও পদ্ধতি অহিংস, কারও বা সহিংস। সে সময়টা ছিল একটা নানা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঝোঁকের সমাহার। এদের মধ্যে গণআন্দোলনে বিশ্বাস যেমন ছিল, তেমনই ছিল সশস্ত্র বিপ্লবী ভাবনার ব্যক্তিহত্যাবাদী ধ্যানধারণা। আর এসবের মধ্যেই ফলে ফুলে বিকশিত হয়ে উঠছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষটি। এসবের পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে আরও একটি রাজনৈতিক প্রবাহের আবির্ভাব ঘটে। সেটি হল পেরিয়ার-আম্বেদকরের নেতৃত্বে দলিত রাজনীতি।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যে প্রশ্নগুলিকে সামনে নিয়ে এসেছিল সেগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটির উল্লেখ প্রয়োজন:

ক. স্বায়ত্তশাসন না পূর্ণ স্বাধীনতা?
খ. অহিংস না সহিংস— কোন পথ?
গ. গণআন্দোলন না ব্যক্তিহত্যা?
ঘ. শ্রেণিসংঘাত না শ্রেণিসমন্বয়?
ঙ. উদারনৈতিক গণতন্ত্র না রামরাজ্য না সমাজতন্ত্র?
চ. ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ না ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ না সেকুলার জাতীয়তাবাদ?
ছ. বর্ণ-জাতভেদ-এর সংরক্ষণ না উদাসীনতা না বিনাশ?
জ. লিঙ্গভেদের প্রশ্ন।
ঝ. সংস্কার না বিপ্লব?

সমসাময়িক কালের প্রধান রাজনৈতিক ধারাগুলি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছেন নিজেদের মতাদর্শগত অবস্থান থেকেই। জাতীয় কংগ্রেস কখনওই তার নিয়মতান্ত্রিক অবস্থান থেকে সরে যায়নি। তখনই সে সরতে শুরু করল যখন তার সামনে আর কোনও বিকল্প ছিল না। কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থীদের আবির্ভাবের এটাই প্রেক্ষিত। কিন্তু চরমপন্থীদের অবস্থান থেকে অনেকে সরে গিয়ে স্বাধীনতা ও ব্রিটিশ তাড়ানোর জন্য সশস্ত্র পদক্ষেপের কথা ভাবতে থাকেন। অর্থাৎ এখানে মতাদর্শগত পরিবর্তন চলতেই থাকে। শুরুতে আইনি গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ঔপনিবেশিক উদারনীতিবাদ, সেই নিষ্ক্রিয় উদারনীতিবাদ থেকে সক্রিয় উদারনীতিবাদ যা প্রত্যক্ষ আন্দোলনকে প্রশ্রয় দেয়— এমন একটি উত্তরণ ঘটে। এই মতাদর্শ থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে ওঠে উপনিবেশবাদবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের মতাদর্শ। কিন্তু ঘটনা হল এই মতাদর্শগত পরিবর্তন ঘটলেও মতাদর্শ-ধারণকারীদের কাছে ভাবাদর্শটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। কারণ ভাবাদর্শটি কোনওভাবেই সুসংবদ্ধ ও সুব্যবস্থিতভাবে গড়ে ওঠেনি। এই সিদ্ধান্তটির স্পষ্টতার জন্য একটু ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন।

২.
১৮৫৭-৫৮-র মহাবিদ্রোহের পর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে, আর শুরু হয় ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসন। নতুন ব্যবস্থায় শাসন ও নীতির ক্ষেত্রে কোম্পানির সাবেকি পদ্ধতিকে ত্যাগ করা হল। যেমন, নানা অজুহাতে দেশীয় সামন্ত রাজ্যগুলিকে দখল করার পরিবর্তে রাজা-মহারাজা ও জমিদারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার দিকেই ব্রিটিশ সরকার নজর দিল। সামন্ত রাজা ও জমিদারদের অবাধ কৃষক-শোষণের অধিকার দেওয়া হল। “বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী ইহাও উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিল যে ভারতের জনসাধারণের উপর প্রাচীন রাজন্যবর্গের প্রভাব অতি গভীর। এতদিনের বৃটিশ বণিকগোষ্ঠীর উন্মত্ত শোষণ ও শাসনের ফলে এই প্রভাব পূর্বাপেক্ষা বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছিল, বিশেষত মহাবিদ্রোহের পরাজয়ের পর ভারতের জনসাধারণ প্রাচীন রাজন্যবর্গকেই একমাত্র রক্ষাকর্তা বলিয়া মনে করিতেছিল। কিন্তু প্রাচীন সামন্ত রাজন্যবর্গই যে ভারতের প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রধান স্তম্ভ তাহাও উপলব্ধি করিতে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর বিলম্ব হয় নাই। সুতরাং মহাবিদ্রোহের পর বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী প্রাচীন রাজন্যবর্গকেই ভারতের বৃটিশ শাসনের প্রধান স্তম্ভ রূপে আরও শক্তিশালী করিয়া তুলিবার সিদ্ধান্ত করে।” (রায়, সুপ্রকাশ। ২০০৮: ১০২)। এই সব রাজাদের স্বাধীন সার্বভৌম নরপতি বলে মেনে নেওয়া হল। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সঙ্গে জুড়ে গেল দেশীয় সামন্তপ্রভুদের স্বার্থ। এভাবেই চরম প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক শোষণের একটি নিকৃষ্টতম ব্যবস্থা জীবনীশক্তি লাভ করল নতুন ব্রিটিশ নীতির ফলে। মজার কথা হল কোনও কোনও গৈরিক পোশাকধারী আধাসন্ন্যাসী নাকি এদের নিয়ে ইংরেজ তাড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন! ব্রিটিশ স্বার্থের সহায়ক সামন্তরাজারা ছিল ভারতীয় জনগণের অন্যতম প্রধান শত্রু।

দেশীয় বণিক ও শিল্পপতিদের অবস্থানটি এদের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। ঔপনিবেশিক শাসনের গর্ভেই এই বণিক ও শিল্পপতিদের আবির্ভাব। এরা তাই ব্রিটিশ পুঁজির আধিপত্য মেনে নিতে বাধ্য হত। ব্রিটিশ স্বার্থের সঙ্গে এরাও বাঁধা ছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। “বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী তাহাদিগকে কেবলমাত্র ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা ও মহাজনী ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফালাভের পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য করে। … কালক্রমে এই ব্যবসায়ী শ্রেণি এইভাবে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়। তাহার পর আমেরিকার গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি, বৃটেনের যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিপদ-আপদের সুযোগ লইয়া এই সম্পদশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সর্বপ্রথম বস্ত্রশিল্প স্থাপন করিয়া ভারতীয় মূলধনী বা বুর্জোয়াশ্রেণি রূপে আবির্ভূত হয় এবং শীঘ্রই বৃটিশ বুর্জোয়াশ্রেণির সাথে তাহাদের স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়।” (পূর্বোক্ত: ১০৫)।

এই মূলধনী শিল্পপতিশ্রেণির একটি সহায়ক শ্রেণির আবির্ভাব ততদিনে ঘটে গেছে। এরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি। যেমন, উকিল চিকিৎসক শিক্ষক সাংবাদিক শিল্প-পরিচালক ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে এদের অবস্থা নানা দিক থেকে সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসনের সর্বাত্মক শোষণ ও শাসন কম মাইনের কেরানিদের দুর্দশার মধ্যে ফেলে দেয়। ইতিমধ্যে স্কুল-কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে হাজারে হাজারে শিক্ষিত বেকারের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। স্কুল-কলেজ আদালত প্রশাসন সর্বক্ষেত্রেই ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণি নানাভাবে ইংরেজদের দ্বারা অপমানিত ও বঞ্চিত হত। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয়দের পক্ষে অপমানকর একটি নীতি সরকার গ্রহণ করে। এই নীতি অনুযায়ী ভারতীয় ভদ্রলোকেরা চটি জাতীয় কোনও জুতো পরে কোনও সরকারি উৎসবে বা অনুষ্ঠানে বা দপ্তরে যেতে পারবে না। তাদের বুট বা ওই জাতীয় ইওরোপীয় জুতো পরতে হবে। আত্মপ্রতিষ্ঠাকামী শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে ব্রিটিশদের এই অবমাননাকর ব্যবহার মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়াও ছিল ব্রিটিশদের নানা দমনমূলক আইন। ১৮৭৮-এর দেশীয় প্রেস আইন দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির স্বাধীনতা বহুলাংশে খর্ব করে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে এই বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইলবার্ট বিল আইনে পরিণত হতে পারল না শ্বেতাঙ্গদের চাপে। ফলে দেশীয় শিক্ষিত সম্প্রদায় অত্যন্ত অসম্মানিত হয়। ইলবার্ট বিলের পরাজয়ের সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন-এর ব্যর্থতাও স্পষ্ট হয়ে গেল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুঝতে পারে এই সংগঠনের থেকেও শক্তিশালী সংগঠন প্রয়োজন। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সঙ্গে দেশীয় বণিক ও শিল্পপতিদের মধ্যেও এই প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ইংরেজ শাসকদের স্বার্থ। কারণ তারা দেখতে পেয়েছিল সমাজের নানা স্তরে রয়েছে বিভিন্ন মাত্রার ক্ষোভ।

ব্রিটিশ ও সামন্তরাজাদের যৌথ শোষণে ভারতের একদা সমৃদ্ধ কৃষকও ভিখারিতে পরিণত হয়। এদের সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো মাড়োয়ারি, সাউকার মহাজন ও সরকার-জমিদারদের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা স্বাধীন কৃষকদের প্রায় ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল। কোম্পানি শাসনের শুরুতে বোম্বাই প্রদেশের কৃষকদের মোট রাজস্ব দিতে হত ৮০ লক্ষ টাকা, মহারানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালে ১৮৭২-এ এই রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২ কোটি ৩ লক্ষ টাকা। মাদ্রাজে রানির শাসনে পূর্বের তুলনায় ১০ লক্ষ টাকা বেশি ভূমিরাজস্ব আদায় করা হত। মাদ্রাজে ১৮৮৯-৯০-এ খাজনা বাকি থাকায় সরকার ৮৪০৭১৩ জন কৃষকের ১৯ লক্ষ ৬৩ হাজার ৩৬৪ বিঘা জমি নিলামে বিক্রি করে দেয়। মধ্যপ্রদেশের সব জেলাতেই কৃষকের রাজস্ব বৃদ্ধি করা হয় ১০২ শতাংশ থেকে ১০৫ শতাংশ হারে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, পাঞ্জাবে কৃষকের উপর করভার চাপিয়ে দিয়ে তাদেরকে এক সীমাহীন দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। (দ্রষ্টব্য: রায়, সুপ্রকাশ। ১৯৯৩: ৩৮-৩৯)। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষ করে শেষ তিনটি দশকে ব্রিটিশ-জমিদার শোষণের ফলে আবির্ভাব ঘটে মহাদুর্ভিক্ষের। ভারতবর্ষ পরিণত হয় স্থায়ী দুর্ভিক্ষের দেশে। ১৮৬০ থেকে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৬ বার ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের আবির্ভাব ঘটে এবং মৃত্যু ঘটে ৫০ লক্ষেরও বেশি। এই শতাব্দীর শেষ ২৫ বছরে ১৮বার দুর্ভিক্ষ হয়। মৃত্যু ১ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষের। (পূর্বোক্ত: ৪০)।

এই ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি ও কৃষক সম্প্রদায়। অনিবার্যভাবেই এই বিপর্যয় ভারতব্যাপী কৃষক বিদ্রোহের সম্ভাবনা তৈরি করে। বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়— বাংলায় নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬১), সুন্দরবন অঞ্চলের বিদ্রোহ (১৮৬১), সন্দ্বীপের চতুর্থ বিদ্রোহ (১৮৭০), সিরাজগঞ্জ বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩), যশোহরের নীল বিদ্রোহ (১৮৮৯), রাঁচির আদিবাসী কোলচাষিদের বিদ্রোহ (১৮৮৯), মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৫-১৯০০) ইত্যাদি। (রায়, সুপ্রকাশ; ১৯৬৬: ৩৮২-৪৩৫)। শ্রমিকশ্রেণিও বিভিন্ন স্থানে লড়াই সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছিল। ১৮৬২-তে হাওড়ার রেলশ্রমিকরা ধর্মঘট করে। ওই বছরই অডিট বিভাগের কেরানিরা এক দিনের ধর্মঘট করে। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দেই কলকাতার গরুর গাড়ির গাড়োয়ানরা একাধিক দিন ধর্মঘট করে। পরের বছর একই আন্দোলন তারা আবার গড়ে তোলে। ১৮৭৩-এ বোম্বাইয়ের ছাপাখানার শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজ ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করে। ১৮৭৭-এ নাগপুরের শিল্পকেন্দ্রে দীর্ঘকাল ধরে ধর্মঘট সংগঠিত হয়। ১৮৮২ থেকে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বোম্বাই, মাদ্রাজ ও বাংলায় বেশ কয়েকটি বড় ধরনের ধর্মঘট সংগঠিত হয়। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। তাদেরও দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কাজের সময়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে আমেদাবাদের সকল মিলের তাঁতিরা ধর্মঘট করে এবং কয়েকদিন মিল বন্ধ করে দেয়। ১৮৯৬-এ বজবজের চটকলের শ্রমিকরা দু সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট চালায়। এইরকম কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারত ধীরে ধীরে একটা বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছিল। আসন্ন বিদ্রোহের ভয়ে ব্রিটিশ শক্তি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই তাদের একটা কিছু করার দরকার হয়ে পড়েছিল। প্রয়োজন পড়ল জাতীয় স্তরের একটি হাতিয়ারের যার মধ্যে দিয়ে মানুষের ক্ষোভবিক্ষোভ প্রশমিত করা যাবে। তৈরি করা হল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে।

৩.
জাতীয় কংগ্রেস গঠনের আগেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল। যেমন, বাংলায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, দাদাভাই নওরোজি ও জগন্নাথ শেঠ প্রতিষ্ঠিত বোম্বাই অ্যাসোসিয়েশন, পুনার সার্বজনিক সভা ইত্যাদি। এগুলি ছিল মূলত উচ্চবর্ণের ও উচ্চমধ্যবিত্তের সংগঠন। এদের কাজকর্মের পরিধি নির্দিষ্ট অঞ্চল ও নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে জাতীয় স্তরে এদের কোনও ভূমিকা পালন সম্ভব ছিল না। তাই প্রয়োজন হল জাতীয় স্তরের একটি সংগঠন— কংগ্রেস গঠন। এ আর দেশাই লিখেছেন:

প্রবল বিদ্রোহের সম্ভাবনা [১৮৭০-৮০ দশক] আন্দাজ করেই হিউম [এ ও হিউম, ব্রিটিশ আমলা] ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর অল্প পরেই হিউম ভারতের বিশিষ্ট উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস স্থাপন করেন। কংগ্রেস জাতীয় অসন্তোষ— বিশেষ করে শিক্ষিতশ্রেণির অসন্তোষ ব্যক্ত করার প্রধান সংগঠন হয়ে উঠতে পারত, এবং ভারতীয়দের রাজনৈতিক অগ্রগতির উদ্দেশ্যে জাতির অসন্তোষ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে পরিচালিত করতে পারত, সরকারি ব্যবস্থাদি সম্পর্কে শিক্ষিতশ্রেণির মতামত সরকারের গোচরে আনার ব্যবস্থাও কংগ্রেস করতে পারত।

(দেশাই। ১৯৮৭: ২৭৬-৭)

কংগ্রেস গঠনের পেছনে যে লক্ষ্য ছিল সেটা স্পষ্ট। ভারতে বৈপ্লবিক অসন্তোষ ঠেকানোর নিরাপত্তাযন্ত্র হিসেবে কংগ্রেস যে একটি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে বলে হিউম কল্পনা করেছিলেন তা তার কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়: “আমাদের কার্যকলাপের ফলে যে বিপুল (বিরুদ্ধ) শক্তি বেড়ে চলেছে সেটা দূর করা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছিল। নিরাপত্তাযন্ত্র হিসেবে আমাদের এই কংগ্রেস আন্দোলনের মতো কার্যকর আর কিছুই হতে পারে না।” (Wedderburn, উদ্ধৃত Dutt, R.P. 1947: 261)। ভাইসরয়ের পক্ষে হিউমের এই ধারণা বুঝতে কষ্ট হয়নি। অবস্থা যে যথেষ্ট বিপদজনক তা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কৃষক বিদ্রোহ হলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা তার প্রতি সমর্থন জানাতে পারে। আর সেই জন্যই তাদের কার্যকলাপ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যেই সীমিত করে ফেলতে হবে। এই জন্যই প্রয়োজন কংগ্রেসের মতো একটি সংগঠন।

উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী

প্রথম অধিবেশনের সভাপতি উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী কংগ্রেসের উদ্দেশ্যগুলিকে এইভাবে চিহ্নিত করেছেন:

ক. জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা।
খ. সমস্ত দেশপ্রেমিকদের মধ্যে জাতি, বর্ণ ও প্রাদেশিক সংস্কার লোপ করা এবং তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যের ভাব সংহত করা।
গ. শিক্ষিত ভারতীয়রা মূলগত ভারতীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনার পর যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হল সেগুলি নথিবদ্ধ করা।
ঘ. পরবর্তী বছরের জন্য কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা।

জাতীয় কংগ্রেসের দাবিগুলো ছিল মোটামুটি এইরকম— ইন্ডিয়া কাউন্সিলের বিলোপ সাধন; একযোগে আইসিএস পরীক্ষা গ্রহণ; পরীক্ষার্থীদের বয়ঃসীমা বৃদ্ধি; আইনসভায় নির্বাচিত সদস্য নেওয়ার ব্যবস্থা; উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, অযোধ্যা এবং পাঞ্জাবে আইনসভার প্রবর্তন করা; ইত্যাদি। (দ্রষ্টব্য: দেশাই। ১৯৮৭: ২৭৮)।

ব্রিটিশ শক্তির উদ্দেশ্য সফল হল। কংগ্রেস গঠনের মধ্য দিয়ে একদিকে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিকে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও আইনসভার নির্বাচনের মধ্যে আটকে রাখা গেল। তেমনি কৃষক আন্দোলনগুলির সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর সম্ভাবনাও কমে গেল। কংগ্রেসের সে সময়কার দাবিগুলি ছিল স্বশ্রেণির স্বার্থবাহী। তারা কখনওই স্বরাজের কথা ভাবতে পারেনি। উপনিবেশের অবসান, স্বাধীনতা ইত্যাদি তাদের কাছে তখন অচিন্তনীয়। কংগ্রেসের নেতারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে নানা দাবি উত্থাপন করতেন আর সরকার তা অবজ্ঞা করত। সরকারের অবজ্ঞা-উপেক্ষা-অপমানের বিরুদ্ধে এই নেতারা কোনওদিনই আবেদন-নিবেদনকে বাদ দিয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা ভাবেননি বা গড়ে তোলেননি। কংগ্রেসের এই মেরুদণ্ডহীনতায় শিক্ষিত মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশ বিরক্ত হয়ে ওঠে। এর মধ্যে দিয়েই ভারতে নতুন রাজনৈতিক চিন্তার স্ফূরণ ঘটে। আবির্ভাব ঘটে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের। আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি পরিত্যক্ত হয়। তিলক, লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ সংগ্রামী জাতীয়তাবাদীরা বলতে শুরু করেন যে, ব্রিটিশ ও ভারতের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী। তাই শুধুমাত্র শাসনসংস্কার করে কিছু হবে না। প্রয়োজন স্বায়ত্তশাসন। রাজনৈতিক ক্ষমতা দ্বারাই ভারতের মৌলিক, সামাজিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সম্ভব। সুতরাং ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে হবে।

সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের এটাই ছিল প্রেক্ষাপট। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনীতির অকার্যকারিতা দেখে মধ্যশ্রেণির একাংশের মোহভঙ্গ হয়। তাঁরা ব্রিটিশমুক্ত ভারতের কথা ভাবতে শুরু করেন। রাশিয়ার নিহিলিস্ট ও ইওরোপের বিভিন্ন দেশের গুপ্ত সংগঠনগুলির কার্যকলাপ সংক্রান্ত বই পড়ে সেই পথে হাঁটার প্রেরণা পান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকেই গুপ্ত সমিতিগুলি[1] গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৯৭ খিস্টাব্দে বাংলায় নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘আত্মোন্নতি সমিতি’। সমসাময়িক কালেই মহারাষ্ট্রে দামোদর চাপেকর ও বালকৃষ্ণ চাপেকর-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় গুপ্ত বৈপ্লবিক সমিতি। কাশী ও অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলেও গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠার কথা জানা যায়। (ঘোষ, কালীচরণ। ২০১৭: ১: ১০৯)।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলা ও পাঞ্জাবে বিপ্লবী সংগঠনগুলি গড়ে উঠতে থাকে এবং বিপ্লবী সংগ্রামও শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করে। বাংলায় গড়ে ওঠে চারটি দল। তিনটি কলকাতায় একটি মেদিনীপুরে। ১৯০২-এ গঠিত হয় অনুশীলন সমিতি। সতীশচন্দ্র বসু অনুশীলন সমিতি গঠনে প্রধান ভূমিকা নিলেও ব্যারিস্টার পি মিত্র, যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের ভূমিকাও কম কিছু ছিল না। ১৯০৬-এ পুলিন দাসের উদ্যোগে ঢাকা অনুশীলন সমিতি গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়ায় বিপ্লবী সংগঠনগুলিরও বিশেষ অগ্রগতি ঘটে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দেই ‘যুগান্তর’ নামে একটি বিপ্লবী পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। পরবর্তীকালে এই পত্রিকার নাম অনুসারে গঠিত হয় যুগান্তর দল। শোনা যায়, স্বদেশি ডাকাতির সূত্রপাত ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে। এর এক বছর আগেই (১৯০২) ডিসেম্বর মাসে গোয়ালন্দ স্টেশনে ঢাকার ভূতপূর্ব ম্যাজিস্ট্রেট এলেন সাহেবকে গুলি করা হয়। শুরুতে এই আন্দোলনের অবস্থা ছিল খুবই হতাশাজনক। কিন্তু ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিপ্লবী সমিতিগুলি (যেগুলি কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঝিমিয়ে পড়েছিল) প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। হেমচন্দ্র কানুনগো লিখেছেন: “বয়কট ও দেশজাত দ্রব্য প্রচলন-চেষ্টার দ্বারা যখন ভাভা বাংলা জোড়া লাগল না, অধিকন্তু গুঁতোটা-আশটা [অর্থাৎ সরকারি দমনপীড়ন] লাভ হতে লাগল, তখন প্রতিশোধ নেবার প্রবৃত্তি আরও বেড়ে গেল। তা চরিতার্থ করবার জন্য ক্রমে বোমা রিভলবার প্রভৃতি জোগাড়ের চেষ্টা অনিবার্য হয়ে উঠল।” (কানুনগো। ২০১৬: ৫৫)। ১৯০৭-এ বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর ফ্রেজারকে তিনবার হত্যার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু ব্যর্থ হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত সমিতির সদস্যরা পিস্তল ও ছোরা নিয়ে শিবপুরে একটি ডাকাতি করে। ১৯০৮-এর এপ্রিল মাসে চন্দননগরের মেয়রের বাড়িতে বোমা মারে। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে মোজাফফরপুরে।

১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিল ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী নামক যুগান্তর দলের দুই বিপ্লবী বারীন্দ্র ঘোষের নির্দেশে অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেবের গাড়িতে বোমা ছোড়েন। যদিও সে গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না। ছিলেন মিসেস ও মিস কেনেডি। তাঁরা মারা যান। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে প্রফুল্ল চাকী নিজের রিভলভার দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান। ১১ আগস্ট ১৯০৮ ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়। এই ঘটনার সূত্র ধরেই শুরু হয় আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা। এর পর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে একটানা সংগ্রাম। এ হল বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের গোড়ার কথা।

এই পর্বে বাংলার মতোই পাঞ্জাবেও বিপ্লবী কার্যক্রম সংঘটিত হতে শুরু করে। সিডিশন কমিটির রিপোর্টে লেখা হয়:

এই নতুন হাওয়া [বিপ্লবী ভাবধারা] সম্পর্কে স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, এই সময় (বাঙলাদেশের) ‘যুগান্তর’ পত্রিকা ও এই প্রকারের অন্যান্য প্রচার-সাহিত্য প্রতিদিনই বাঙলাদেশের হাজার হাজার লোকের মনে বিষ ঢালিয়া দিতেছিল, তাহার সঙ্গে সঙ্গে আলিপুর ও ঢাকার ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁহাদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করিতেছিলেন, সত্য সংগ্রহ করিয়া তাঁহাদের দল ভারী করিতেছিলেন এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করিয়া প্রস্তুত হইতেছিলেন। তাহার সঙ্গে সঙ্গে এই নতুন ভাবধারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও যে ঝড় তুলিবে তাহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই।

(রায়, সুপ্রকাশ। ১৯৯৩: ২৪৯-৫০)

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের ছোটলাট ইবেটসন এই ঝড় লক্ষ করে বড়লাটকে লেখেন:

প্রদেশের [পাঞ্জাবের] পূর্ব ও পশ্চিম দিকে এই নূতন ভাবধারা (বৈপ্লবিক ভাবধারা) কেবলমাত্র শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, আর শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকেরা হইল উকিল, কেরানি ও ছাত্র। প্রদেশের কেন্দ্রস্থলের দিকে তাকাইলে দেখা যায় যে, শহরের লোকের মনোভাব ক্রমশ উত্তেজনাপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে, তাহাদের মধ্যে বিক্ষোভ ও কর্মচাঞ্চল্যের লক্ষণও দেখা যাইতেছে। লাহোরের উত্তেজনা সৃষ্টিকারীরা অমৃতসর ও ফিরোজপুর শহরে আসিয়া রাজদ্রোহের মনোভাব জাগাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছিল। ফিরোজপুরে তাহাদের চেষ্টা ব্যর্থ করা সম্ভব হইয়াছে, কিন্তু অমৃতসরে তাহা সম্ভব হয় নাই। রাওয়ালপিন্ডি, শিয়ালকোট ও লায়ালপুর শহরে ইংরেজ-বিরোধী প্রচার প্রকাশ্যভাবেই বিশেষ জোরের সহিত চালানো হইতেছে। প্রদেশের রাজধানী লাহোরের প্রচার-পদ্ধতি ভীষণ উগ্র এবং তাহার ফলে ঐ শহরে একটা বিক্ষোভের অবস্থা সৃষ্টি হইয়াছে।

(পূর্বোক্ত)

ব্রিটিশ সরকারের আতঙ্কিত হওয়ার আরও কারণ ছিল। গ্রামাঞ্চল ও শিল্পকারখানাগুলি ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছিল বারুদের স্তূপে। সে-সময় চন্দ্রভাগা নদীর খালের জলকর আদায়ের বিরুদ্ধে সমগ্র পাঞ্জাবের কৃষকদের মধ্যে বিরাট ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এই আন্দোলনে কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল কলকারখানার শ্রমিক এবং উত্তর-পশ্চিম রেলপথের শ্রমিকেরা। গোটা পাঞ্জাব জুড়ে এই শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায় তাদের বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিয়ে যোগদান করে। (পূর্বোক্ত)

সমগ্র পাঞ্জাবে যখন এইরকম একটা উত্তাল পরিস্থিতি তখন এরই পাশাপাশি বৈপ্লবিক সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ তৈরি হয়। লালা লাজপত রায়, ভাই পরমানন্দ, অজিত সিং (ভগৎ সিংয়ের কাকা), সুফি অম্বাপ্রসাদ, ডাঃ হরিচরণ মুখার্জী প্রমুখ এই কাজে এগিয়ে আসেন। সুফি অম্বাপ্রসাদকে বলা হয় ‘পাঞ্জাবের প্রথম বিপ্লবী’। তাঁর নেতৃত্বেই এখানে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা ও বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এ কাজে তাঁকে যিনি সাহায্য করেছিলেন তিনি ছিলেন একজন বাঙালি বিপ্লবী, নাম হরিচরণ মুখার্জী।

সুফি অম্বাপ্রসাদ

পাঞ্জাবে গণ আন্দোলন এবং বিপ্লবী আন্দোলন বিকশিত হলে সরকার কড়া হাতে তা দমন করতে উদ্যোগ নেয়। ১৯০৭-এ লাজপত রায় ও অজিত সিংকে বিনা বিচারে পুলিশ আটক করে। জনসমাবেশ নিষিদ্ধ হয়। সরকারবিরোধী প্রকাশ্য বক্তৃতা, প্রবন্ধ, প্রচারপত্র নিষিদ্ধ হয়। শ্রমিক, কৃষক সহ মধ্যবিত্তশ্রেণির শত শত মানুষকে রাজদ্রোহের কারণে বন্দি করা হয়। জেলখানায় আটকে রেখে তাদের উপর চলে অকথ্য অত্যাচার। কৃষকদের ঘরবাড়ি ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার সমগ্র পাঞ্জাবে এক সন্ত্রাসের শাসন কায়েম করে। প্রচণ্ড দমন-পীড়নে বৈপ্লবিক সংগঠন ভেঙে যায় আর সংগ্রামী শক্তি সাময়িকভাবে হলেও দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তারা আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে অজিত সিং মুক্তিলাভ করেন। তিনি যোগাযোগ করেন সুফি অম্বাপ্রসাদের সঙ্গে। বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। উভয়ের উদ্যোগে পাঞ্জাবের নানা অঞ্চলে বিপ্লবী সংগঠনের শাখা গড়ে ওঠে। বিপ্লবীদের প্রচার-সাহিত্য গ্রাম গঞ্জে শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এসব দেখে ব্রিটিশ সরকার উন্মত্ত হয়ে ওঠে। দলে দলে লোক গ্রেপ্তার হয়। অজিত সিং ও অম্বাপ্রসাদের জন্য গোয়েন্দা পুলিশ সবরকমের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়। একজন বাঙালি বিপ্লবী হৃষিকেশের সঙ্গে তাঁরা পারস্যে পালিয়ে যান। শোনা যায় অম্বাপ্রসাদকে ইংরেজরা ইরানে হত্যা করে। (দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ। ১৯৮৩: ৬৫)। ১৯০৯-এ লাজপত রায়, কিষেণ সিং (ভগৎ সিংয়ের বাবা) এবং ভাই পরমানন্দকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে ভাই পরমানন্দ মুচলেকা দিয়ে জেলের বাইরে থাকার সুযোগ পায়। (রক্ষিত রায়। ২০১৬: ৫৫)। মুচলেকা দেওয়ায় হিন্দুত্ববাদীরা বরাবরই দক্ষ। ভাই পরমানন্দের মতো আরেক হিন্দুত্ববাদী সাভারকর এই মুচলেকা দিয়েই ব্রিটিশের জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল।

এটাই হল সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের প্রথম পর্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ১৯০১-১১ থেকে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব। যথাসময়ে সে প্রসঙ্গে আসা যাবে। এখন দেখা দরকার এই পর্বে যে মতাদর্শ দ্বারা সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল তার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য।

৪.
কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতাদের আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি অন্যান্যদের বিরক্তি উৎপাদনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর মধ্যে দিয়েই আবির্ভাব ঘটে চরমপন্থী ও বিপ্লববাদী রাজনীতির। নরমপন্থীদের যে মতাদর্শ ছিল সেখানে উৎকট রকমের ব্রিটিশ ভক্তি থাকলেও ধর্ম নিয়ে খুব একটা বাড়াবাড়ি ছিল না। চরমপন্থীরা কিন্তু এই ধর্মীয় ভাবাদর্শ দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। সশস্ত্র বিপ্লবীদের ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। মহারাষ্ট্রের কথায় আসা যাক। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে চাপেকর ভাইরা গড়ে তোলেন ‘হিন্দু সংরক্ষণী সমিতি’। হিন্দু ধর্মের পথে সমস্ত বাধা দূর করতে এবং হিন্দুদের শরীরচর্চা ও সামরিক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যেই এই সমিতির আবির্ভাব। এই সংগঠনটি প্রতিবছর শিবাজী ও গণপতি উৎসব পালন করত। তারা তাদের অনুষ্ঠানে প্রচার করত: “শুধুমাত্র পাখিপড়ার মতো শিবাজি শ্লোক আউড়ে গেলেই আমাদের স্বাধীনতা আসবে না। … মনে রাখতে হবে, এখন যে কোন অবস্থাতেই সব সাচ্চা লোককে হাতে তুলে নিতে হবে তলোয়ার আর ঢাল; জাতীয় সংগ্রামে আমাদের জীবনপণ করেই যোগ দিতে হবে; আমাদের ধর্মবিনাশকারী শত্রুর রক্তে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে।” (সিডিশন কমিটি (রাওলাট) রিপোর্ট; ১৯১৯। উদ্ধৃত ভার্মা, শিব। ২০০৬: ১৮)

গণপতি উৎসবের শ্লোকগুলি ছিল আরও বেশি পরিমাণে উগ্র ও আক্রমণাত্মক। গরু ও হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে এখানে বলা হত: “হায়! দুষ্ট লোকেরা কসাইয়ের মত রাক্ষুসে নৃশংসতায় তোমাদের গোরু, বাছুর হত্যা করে চলেছে। এই সঙ্কট থেকে গোমাতাকে রক্ষা করো। মরতে যদি হয়ই তাহলে ইংরেজদের মেরে তবে মরো।” (পূর্বোক্ত)

একইসঙ্গে চরমপন্থীদের শক্তিশালী নেতা বালগঙ্গাধর তিলকের উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রচার বিপ্লবীদের অবশ্যই প্রভাবিত করেছিল। ১৮৯৭-এর জুন মাসের একটি সভায় সভাপতির ভাষণে তিলক বলেন:

আফজল খাঁ’কে হত্যা করে শিবাজি কি অন্যায় করেছিলেন? মহাভারতেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ হলো, ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব না করে কেউ যদি নিজের শিক্ষক বা আত্মীয়দের হত্যা করে তাহলেও দোষের কিছু নেই। মহত্তর উদ্দেশ্যে, অন্যের উপকারের জন্যই শিবাজি এ কাজ করেছিলেন; নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়। বাড়িতে চোর ঢুকলে তাকে তাড়াবার শক্তি যদি আমাদের না থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় তাকে ঘরে আটকে পুড়িয়ে মারা উচিত। ঈশ্বর কোন তাম্রপত্রে খোদাই করে বিদেশীদের হিন্দুস্তান উপহার দেন নি। শিবাজি তাঁর জন্মভূমি থেকে বিদেশীদের বিতাড়নের চেষ্টা করেছিলেন।

(পূর্বোক্ত: ১৭)

চরমপন্থী ও বিপ্লবীদের মধ্যে যে ভাবনাটি ছিল তা হল হিন্দুধর্মের মঙ্গল করা, তার বিকাশ ঘটানো। তাই হিন্দু ধর্মের প্রয়োজনেই তাঁরা ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। এখানে বিরোধিতা কেবল ব্রিটিশের সঙ্গে নয়, মুসলিমদের সঙ্গেও। একথা মহারাষ্ট্রের সংগ্রামশীল মানুষেরা প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে প্রকাশ করতেন। ফলে একটা সময় ব্রিটিশ বিরোধিতা হ্রাস পেয়ে মুসলিম বিরোধিতাই প্রকট হয়ে পড়ে। তাই তাঁদের স্বদেশপ্রেম ছিল হিন্দু-ভারতপ্রেম। তাদের ভারতপ্রেমে মুসলিমদের কোনও স্থান ছিল না। ছিল উগ্র মুসলিমবিদ্বেষ। এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়ায় আবার মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বাড়বৃদ্ধি ঘটে।

বাংলায় বিপ্লবীদের চিন্তাজগতে (বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক) এই ধরনের হিন্দু মতাদর্শ প্রাধান্য অর্জন করেছিল। ১৯০২-এ প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন সমিতির আদর্শ ও কর্মসূচির দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। যোগ্য সভ্যদের দুটি বিশেষ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হত:

  • ঈশ্বর, মাতা-পিতা, গুরু ও পরিচালকের সাক্ষাতে আমি অঙ্গীকার করিতেছি যে, সমিতির উদ্দেশ্য সফল না হওয়া পর্যন্ত আমি এই কেন্দ্র পরিত্যাগ করিব না।
  • যদি আমি এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি তাহা হইলে ব্রাহ্মণ, পিতামাতা এবং সকল দেশের দেশপ্রেমিকদের অভিশাপ যেন আমাকে ভস্মীভূত করে।

(হালদার। ১৯৭৭: ৩৬-৭)

প্রতিজ্ঞা গ্রহণের ভাষা দেখলেই বোঝা যায় তারা কীভাবে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবকে গ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয় সভ্যদের যেসব বই পড়তে দেওয়া হত সেগুলিও ছিল মূলত হিন্দুধর্মকেন্দ্রিক। যেমন রামায়ণ, মহাভারত, কথকতা, গীতা, চণ্ডী ইত্যাদি। এর সঙ্গে দুই হিন্দু উত্থানবাদী বঙ্কিম ও বিবেকানন্দের লেখা পাঠ করা হত ও পড়তে উৎসাহ দেওয়া হত। সদস্যদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নৈতিক ও ধর্মীয় পাঠদান করা হত। গুপ্ত কার্যের জন্য কালীমন্দিরে সদস্যদের দীক্ষা দেওয়া হত। কালী মূর্তির সামনে নিজের আঙুল কেটে সেই রক্তে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করতে হত সদস্যদের। মহারাষ্ট্রের অনুকরণে কলকাতায় অনুশীলন সমিতি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে শিবাজি উৎসবের আয়োজন করে। শক্তি ও অস্ত্রপূজার জন্য মহারাষ্ট্র থেকে ব্রাহ্মণ আমদানি করার ব্যবস্থাও সেই সময় ছিল। আর এর সঙ্গে ছিল আরও হরেক কিসিমের কুসংস্কারাচ্ছন্ন, গোঁড়ামিপূর্ণ ব্রত অনুষ্ঠান। (পূর্বোক্ত: ১০-১৬)

এই সময়ের বৈপ্লবিক সংগঠন, নেতাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে মাতামাতি ও সংগঠনের উপর ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক (বা হিন্দু) প্রাধান্য লক্ষ করে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন: “বিপ্লববাদ বঙ্গে ধর্ম্মের আকার” গ্রহণ করেছিল। (দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ; ১৯৮৩: ১৭)। আর “ভারতীয় জাতীয়তা তখন হিন্দুধর্ম্ম পুনরুত্থানকারীদের ছায়ায় আসিয়া আর্য্যামী ও হিন্দুজাতির পুনরুত্থান মতবাদেই পরিণত হইয়াছিল।” (পূর্বোক্ত: ১৬)। অর্থাৎ তাদের প্রচারিত জাতীয়তাবাদ ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। ফলে একটা সময় মুসলিম সভ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। (পূর্বোক্ত)। বিপ্লবী নেতা ধর্মের নামে লোক ক্ষেপিয়ে নিজেদের কার্যোদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। এনাদের একটাই লক্ষ্য ছিল ‘ইংরেজ তাড়াও’। অন্য কোনও দিকে নজর দেওয়ার দরকার নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন:

ব্রাহ্মণ শূদ্রকে ঘৃণার চক্ষে দেখিবে; হিন্দু অহিন্দুকে ঘৃণা করিবে; জমিদার প্রজার রক্ত শোষণ করিবে; স্ত্রীলোকের উপর অত্যাচার ও অবিচার পূর্ব্ববৎ থাকিবে বা চলিবে; শ্রেণি ও বর্ণবিভাগ পূর্ব্বের ন্যায় থাকিবে; ব্রাহ্মণ্য গোঁড়ামির চূড়ান্তও থাকিবে; অথচ স্বজাতীয়তার নামে সকলে একীভূত হইয়া ইংরেজ তাড়াইবে ইহাই আমাদের বৈপ্লবিক দর্শনশাস্ত্র। আসল কথা, পরবর্ত্তী সময়ে বঙ্গে বিপ্লববাদ ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রকারান্তর হইয়াছিল।

(পূর্বোক্ত: ৩৬)

এই সময়ের নেতৃস্থানীয় সকল ব্যক্তিই প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ্যবাদী ছিলেন। তাঁরা ধর্মের চোখেই বিপ্লববাদকে দেখতেন। ফলে বিপ্লববাদকে সমাজ ও অর্থনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে তাঁরা জানতেন না এবং ভাবতেনও না। (পূর্বোক্ত: ৩৭)

 

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত

এই নেতারা কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদীই ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন রাজতান্ত্রিক। অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন এইরকম একজন রাজতন্ত্রবাদী নেতা। এই অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এই রাজতন্ত্রের সমর্থনে একটি আষাঢ়ে গল্প প্রচার করেছিলেন। “নর্ম্মদাকূলের সাধুরা যোগবলে স্থির করিয়াছেন যে, রাজপুতানার কোনও সূর্যবংশীয় কুলে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্রাট জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। তিনি এক্ষণে বালক আছেন। তাহাকে দলপতি মানিয়া লইয়া একটা ভারতব্যাপী বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতি স্থাপিত হইয়াছে।” (পূর্বোক্ত: ৮)। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সহ আরও অনেকেই অরবিন্দ ও বারীনের এই গাঁজাখুরি গল্পে বিশ্বাস না করলেও, কেউ কেউ নিশ্চয়ই করেছিল।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর মতোই সেসময়ের (১৯০০-১৯০৯) আরও একজন সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ বিপ্লবী রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী হেমচন্দ্র কানুনগোর রচনা থেকে বিপ্লবীদের উপর ধর্মের কুৎসিত প্রভাব সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। তিনি দেখিয়েছেন যে, সংগঠনের সদস্যপদ পাওয়া থেকে শুরু করে প্রায় গোটা প্রক্রিয়াটিই ধর্মীয় ভাবনা প্রভাবিত। যেমন, “সভ্য শ্রেণীভুক্ত হতে গেলে তলোয়ার সাক্ষ্য করে গীতা ছুঁয়ে দীক্ষা নেওয়া। ক্ষমতাপ্রাপ্ত দীক্ষিত গুরু ব্যতীত অন্য কেউ দীক্ষা দিতে পারত না। দীক্ষার মন্ত্র সংস্কৃত ভাষায় রচিত ছিল।” (কানুনগো। ২০১৬: ২০)। সুতরাং অহিন্দুদের পক্ষে বিপ্লবী সমিতির সভ্যপদ পাওয়া যে কতটা অসম্ভব তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।

অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, দেবব্রত বসু ধর্মের সাহায্যে স্বদেশ উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। মজার কথা হল তাদের এই ‘উপায়’ কিছুদিনের মধ্যে ‘উদ্দেশ্যে’ রূপান্তরিত হল। বঙ্কিমের আনন্দমঠের অনুকরণে বিপ্লবীরা একদিন অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন সিদ্ধপুরুষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। (পূর্বোক্ত: ৪৭)। উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে লিখেছেন:

মানিকতলায় বারীন্দ্রদের [ঘোষ] একটা বাগান ছিল। স্থির হইল যে, একটা নূতন দলের উপর যুগান্তরের [পত্রিকা] ভার দিয়া যুগান্তর অফিসের জনকতক বাছাই-বাছাই ছেলে লইয়া ঐ বাগানে একটা নূতন আড্ডা গড়িতে হইবে। যাহাদের সংসারে টান নাই, অথবা টান থাকিলেও অকাতরে তাহা বিসর্জন দিতে পারে, এরূপ ছেলেই লইতে হইবে। কিন্তু ধর্মজীবন লাভ না হইলে এরূপ চরিত্র প্রায় গড়িয়া উঠে না; সেইজন্য স্থির হইল যে, বাগানে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। আমি তখন সাধুগিরির ফেরত আসামী, সুতরাং পুঁথিগত মামুলি ধর্মশিক্ষার উপর আমার যে বড় একটা গভীর শ্রদ্ধা ছিল, তা নয়। বারীন্দ্র কিন্তু নাছোড়বান্দা। গেরুয়ার উপর তাহার তখন অসীম ভক্তি। একজন ভালো সাধু-সন্ন্যাসী ধরিয়া আমাদের দলে পুরিতে পারিলে তাহার শিক্ষায়-দীক্ষায় যে ছেলেদের ধর্মজীবনটা গড়িয়া উঠিবে, এই আশায় সে সাধু খুঁজিতে বাহির হইয়া পড়িল।

(বন্দোপাধ্যায়। ১৯৭৬: ৬)

ধর্ম, অলৌকিকতা, কুসংস্কার ও গোঁড়ামির কুফল সম্পর্কে এই নেতারা সচেতন থাকলেও, তাঁরা এগুলিকেই প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন এগুলির মধ্যে দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করা যাবে সহজেই। ধূর্ত ওঝা ও গুণিনরা বা পুরোহিতরা মানুষের ভয়, ভক্তি, গুণমুগ্ধতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্ধত্ব ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে মানুষের চিন্তাজগতে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ও নিজেদের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সেই পথই নেতারা নিয়েছিলেন। হেমচন্দ্র কানুনগোর পর্যবেক্ষণটি এইরকম:

আমাদের নেতাদের এই অলৌকিক শক্তিশালী গুরু খোঁজা বা ধর্মের মধ্য দিয়ে স্বদেশ উদ্ধার, উল্লিখিত ওঝামির বিংশ শতাব্দীর উপযোগী উন্নত সংস্করণ কি-না, এ সন্দেহের ভাব এদেশে আজকাল কদাচিৎ দেখা দিলেও আমাদের দেশবাসী চিরকাল এত অধিক পরিমাণে অন্ধবিশ্বাস-পরায়ণ যে, সন্দেহবাদ (scepticism) যতটুকু প্রবল হলে সত্য নির্ধারণের জন্য একটুও অনুসন্ধিৎসা জাগতে পারত কোনও বিষয়ে আমাদের সন্দেহ ততটুকু প্রবল কখনও হতে পারেনি। এখনও [১৯২৩] যে তেমন প্রবল আকার ধারণ করবে, তার কোনও আশাও নেই। তার কারণ, ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস বা সন্দেহ করাটা যে সবচেয়ে ঘৃণিত পাপ, তা আমাদের আবহমানকাল সবচেয়ে বেশি করে শেখানো হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আর সকল শিক্ষার ভিত্তি গাড়া হয়েছে ভক্তিবাদের ওপর। তাই যুক্তিবাদ বা চিন্তার স্বাধীনতা ঘৃণ্য; তাই গতানুগতিকতা বা গড্ডলিকাপ্রবাহ আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে; তাই প্রকারান্তরে এই গড্ডলিকাপ্রবাহের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে constructive method (গঠননীতি); আর এর উল্টো যা কিছু, তাই না-কি destructive method (ধ্বংসনীতি)।

(কানুনগো। ২০১৬: ৪৮)

হেমচন্দ্র কানুনগো ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দেই ধর্মকে বিপ্লবের ভাবাদর্শ করার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি এই ভাবাদর্শ গ্রহণের দুটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেন— প্রথমত, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কজনিত সমস্যা। সেই সময়ের বিপ্লবী নেতাদের বক্তব্য ছিল: “মুসলমানগণ যদি এই বিপ্লবে যোগ দেয়, তবে ভালোই; দেশ স্বাধীন হলে তাদের সাহায্যের পরিমাণ অনুযায়ী অধিকার তাদের দেওয়া যাবে। আর যদি তা না করে, তাদেরকে শত্রু অর্থাৎ ইংরেজদের সামিল বলে গণ্য করা হবে।” (পূর্বোক্ত: ৫০)। এ চিন্তা সত্যিই বিস্ময়কর। কারণ একে তো মুসলিমদের বাদ দেওয়ার সাংগঠনিক নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, আবার অন্যদিকে বিপ্লবের ভাবাদর্শকে হিন্দুধর্ম দ্বারা পরিচালিত করা হয়েছিল। অর্থাৎ এই আন্দোলনে মুসলিমদের প্রবেশ করতেই দেওয়া হয়নি। অথচ নেতারা মুসলিমদের সাহায্য পাওয়ার কথা কল্পনা করেছিলেন। হেমচন্দ্র মন্তব্য করেছেন: “এ প্রকার সমাধানের কল্পনাও যে নিতান্ত চিন্তাহীনতার পরিচায়ক তা বলা বাহুল্য।” (পূর্বোক্ত)

দ্বিতীয়ত, হিন্দু ধর্মের বর্ণ-জাত ব্যবস্থা। হেমচন্দ্র লিখেছেন:

যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, কোনও গতিকে উক্ত দুই ধর্মাবলম্বীদের [হিন্দু-মুসলমান] মধ্যে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ ঘুচে গেল, তাহলেই পরস্পরের প্রতি পরস্পরের ব্যক্তিগতভাবে কি সাম্প্রদায়িকভাবে গুণমুগ্ধতা উৎপন্ন হওয়া স্বভাবসিদ্ধ। তখন অকৃত্রিম গুণমুগ্ধতা হতেই বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালোবাসা প্রভৃতি স্থায়ী মিলনের বীজ উপ্ত হবেই। তখনই শাস্ত্রের নিষেধ সত্ত্বেও যৌন আদান-প্রদান ইত্যাদি অবশ্যম্ভাবী। হিন্দুধর্ম গ্রহণশীল নয় বলেই তাতে হিন্দুরই সংখ্যা হ্রাস ও সেইসঙ্গে নাশ অনিবার্য। অথচ হিন্দুধর্মকে গ্রহণশীল করাও প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব, অথবা কোনও প্রকারে সম্ভব হলেও, হিন্দু জাত (caste)-ভেদ প্রথার আবর্তনে তা কেবল বিড়ম্বনায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। অর্থাৎ মুসলমান ধর্ম হতে যারা হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত হবে, তাদের স্থান কোথায়? হিন্দু সমাজের জাত (caste) বিভাগ একেবারে লোপ করে, ব্রাহ্মণ হতে চণ্ডাল পর্যন্ত সকল বর্ণকে এক করতে পারলে তবেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বাইরের লোক আনা সম্ভব হতে পারে। তাতে কিন্তু হিন্দু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ও গৌরব ক্ষুণ্ণ হয়। কারণ জাত-ভেদই হিন্দুধর্মের একমাত্র অবলম্বন; কাজের সেরূপ আশা করা একেবারেই বৃথা। জাত (caste) প্রথা বর্তমান থাকতে হিন্দুধর্মকে গ্রহণশীল করলে নতুন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি এমন জাতে (caste) পরিণত হতে হয় যে, সে জাত এক দেশে পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বাস করে নিরন্তর হিন্দুর দ্বারা— সবচেয়ে নিম্নস্তরের পতিত হিন্দু বলে— যেমন সকরুণভাবে ঘৃণিত হতে থাকবে, মুসলমানদের দ্বারাও সেইরূপ নিদারুণভাবে নির্যাতিত ও ঘৃণিত হতে বাধ্য হবে।

(পূর্বোক্ত: ৫১)

হেমচন্দ্র কানুনগো

এভাবেই হেমচন্দ্র কানুনগো হিন্দু জাতীয়তাবাদ বা (বিপ্লবীদের) মতাদর্শ হিন্দুধর্মের আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি উন্মোচন করেন। আর ধর্মের মধ্যে দিয়ে স্বদেশ উদ্ধারের ধারণাকে নস্যাৎ করে দেন। তাই তিনি যুক্তিবাদ ও ধর্মমুক্ত জাতীয়তাবাদের ধারণাকে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। ধর্ম তাঁর কাছে মনুষ্যত্ব বিকাশের বাধা। কারণ ধর্ম বিশাল সংখ্যক মানুষকে হীন করে রাখার হাতিয়ার বিশেষ। (পূর্বোক্ত: ৫১-৫২)। ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী যে বোমা ছুড়েছিলেন তার স্রষ্টা হেমচন্দ্র কানুনগোর এই পরামর্শ সমসময়ের প্রগতিশীল ও বিপ্লবীদের কানে পৌঁছায়নি বা পৌঁছালেও তাঁরা এই পরামর্শ গ্রহণ করেননি। একই সময়ে (১৯২২) ডাক্তার ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (যুগান্তরের সম্পাদক) এই সেকুলারবাদী স্বদেশচিন্তার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেন। (দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ। ১৯৮৩)। অনেকের কাছে না হোক, কয়েকজন হলেও এই পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন। এনাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলেন ভগৎ সিং। যদিও তাঁর চিন্তার উৎস ছিল ভিন্ন, কিন্তু ভাবনাটি হেমচন্দ্র ও ভূপেন্দ্রনাথের অনুসারী। যথাসময়ে সে প্রসঙ্গে আসা যাবে।

মহারাষ্ট্রে বিপ্লববাদীদের আদর্শের উৎস হিসেবে মুঘল-শিবাজির সংঘাত, পেশোয়া রাজত্ব ইত্যাদি (তথাকথিত) হিন্দু প্রভাবগুলিকেই চিহ্নিত করা যায়। সশস্ত্র বিপ্লবীরা ইংরেজদের হটিয়ে সাবেকি হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকেই লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সুপ্রাচীন হিন্দু গৌরব উদ্ধার ও হিন্দুর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা যেমন তাদের উদ্দেশ্য ছিল, তেমনই সমান পরিমাণে ছিল মুসলিমদের দমিয়ে রাখা। সকল ধরনের উদার, প্রগতিশীল, সমন্বয়মূলক ধ্যানধারণার তাঁরা তীব্র বিরোধিতা করতেন। বাংলার ক্ষেত্রে ছবিটা যে খুব একটা আলাদা নয় তা বোঝা শক্ত নয়। বাঙালি বিপ্লবীদের ধ্যানধারণাগুলির উৎস ছিল প্রধান তিন তাত্ত্বিকের রচনা— রাজনারায়ণ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দ। এঁরা তিনজনেই যে ভারতকে তুলে ধরেছেন তা হিন্দু ভারত, তাঁদের জাতীয়তাবাদ হিন্দু জাতীয়তাবাদ। রাজনারায়ণ খোলাখুলিভাবে মুসলিম-বিদ্বেষ প্রচার না করলেও বঙ্কিম-বিবেকানন্দ তা করেছিলেন। (দ্রষ্টব্য: চৌধুরী, কণিষ্ক। ২০১৯: ২৮-৩৭)। পাঞ্জাবে লাজপত রায় ও ভাই পরমানন্দ হিন্দু উত্থানবাদী ভাবনা ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে পাঞ্জাবের প্রধান বিপ্লবী সুফি অম্বাপ্রসাদ, সর্দার অজিত সিং ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না। এসময়ের অপর দুজন সংগঠক লালচাঁদ ফালকে এবং লালা হরদয়াল শুধু হিন্দু জাতীয়তাবাদীই ছিলেন না, ছিলেন তীব্র মুসলিমবিদ্বেষী। লালচাঁদ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ করেন। তিনি মনে করতেন যে কংগ্রেস হিন্দুস্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ। (চন্দ্র, বিপাণ। ১৯৯১: ১১২)। গদর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী লালা হরদয়ালের ভাবাদর্শটি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই:

আমার ঘোষণা হল হিন্দু জাতি, হিন্দুস্থান ও পাঞ্জাবের ভবিষ্যৎ চারটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে: (১) হিন্দু সংগঠন; (২) হিন্দু রাজ; (৩) মুসলিমদের শুদ্ধি ও (৪) আফগানিস্তান ও সীমান্ত অঞ্চলগুলির দখল ও শুদ্ধি। যতদিন না হিন্দু জাতি এই চারটি বিষয়কে বাস্তবায়িত করছে, ততদিন আমাদের সন্তান ও তস্য তস্য সন্তানদের নিরাপত্তা বিপদের মধ্যে থেকে যাবে এবং হিন্দু জাতির নিরাপত্তা অর্জন অসম্ভব থাকবে। হিন্দু জাতির একটিমাত্র ইতিহাস আছে এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলি সমস্বত্ব। কিন্তু মুসলমান ও খ্রিশ্চানরা হিন্দুস্থানের চৌহদ্দি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। কেননা তাদের ধর্ম বিদেশি এবং তারা পার্সি, আরব ও ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভালোবাসে। এইভাবে যেমন কেউ চোখে পড়া বালিকে দূরে সরিয়ে দেয়, শুদ্ধি তেমনই দুটি ধর্মকে তাই করবে। যদি হিন্দুরা নিজেদের রক্ষা করতে চায় তবে আফগানিস্তান ও সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং সমস্ত পাহাড়ি উপজাতিগুলিকে ধর্মান্তরিত করতে হবে।

(উদ্ধৃত Ambedkar. 1990: 8: 129)

এখানে যা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা হল প্রথম পর্যায়ে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সকল নেতৃস্থানীয়রাই শুধু নন, তাঁদের কর্মীবাহিনীর বিরাট অংশও এই হিন্দু ধর্মীয় ভাবনা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও নানা ধরনের দুর্বলতা। শিব ভার্মা এই সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করেছিলেন এইভাবে:

(ক) হিন্দু ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত বিপ্লবী ভাবাদর্শ। এনারা মুসলমানদের মধ্যে থেকে কর্মী সংগ্রহের বিশেষ কোনও উদ্যোগ নেননি। তবে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।
(খ) বৃহত্তর জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা। জনগণকে নিয়ে কাজ করার থেকেও ব্যক্তি-উদ্যোগের উপর বিপ্লবীরা জোর দিতেন। সাধারণ মানুষ এঁদের বিপ্লবী সাহস, দৃঢ়তা ও আত্মত্যাগকে প্রশংসা করত ঠিকই, কিন্তু নিজেদের প্রতিদিনের সমস্যা ও সঙ্কটের সঙ্গে তাঁদের যুক্ত করেনি। বিপ্লবীদের এই জনবিচ্ছিন্ন কার্যকলাপের ফলে ব্রিটিশ শক্তি সহজেই তাদের দমন করতে পেরেছিল।
(গ) শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা। বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীরা বেশিরভাগই এসেছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে। এই শ্রেণীর স্বভাবতই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই শ্রেণি নিজে নেতৃত্ব দিতে না পারলেও শক্তিশালী সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। মধ্যবিত্ত যদি বুর্জোয়াদের সঙ্গে যায় তাহলে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে, যদি শ্রমজীবীদের পক্ষে দাঁড়ায় তবে বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু স্বাধীনভাবে কিছু করতে গেলে এই শ্রেণির মানুষদের কাজ সাধারণত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। আলোচ্য সময়ে বুর্জোয়া বা শ্রমিকশ্রেণি কেউই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কোনও গণআন্দোলন গড়ে তোলার মতো অবস্থায় ছিল না। স্বাভাবিকভাবে মধ্যবিত্ত ঘরের যে যুবরা স্বপ্ন সফল করার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন তাঁরাই প্রথম দিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার অবশ্যম্ভাবী ফল হল যে এই আদর্শবাদী যুবদের যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার স্তরেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল। (ভার্মা, শিব। ২০০৬: ২২-২৩)

যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সেসময়কার বিপ্লবী কার্যকলাপের দুর্বলতাগুলো আরও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ একবার দুঃখ করে বলেছিলেন: ‘আমরা ধনী শ্রেণীর ভাড়াটিয়া গুন্ডা ছিলাম।’ (দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ। ১৯৮৩: ৪০)। হিন্দু ধর্ম দ্বারা বিপ্লবীদের মন আচ্ছন্ন থাকায় তাঁদের স্বদেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ সঠিক দিশায় পরিচালিত হয়নি। তাঁরা নিজেরা মনকে সাবেকি সংস্কারের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেননি। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন: “আমরা ইংরেজের বিপক্ষে স্বাধীনতা সমর করিব অথচ তথাকথিত নীচ জাতিকে সাম্য দিব না, স্ত্রীলোককে নুক্ত করিব না, অহিন্দুদের সঙ্গে সাম্য ও মৈত্রীর ভাব দেখাইব না, পৌরহিত্যের অত্যাচার হইতে মনকে মুক্ত করিব না, কুসংস্কার হইতে মুক্ত হইব না। অর্থাৎ বিপ্লবীরা বরাবর ভাবের ঘরে চুরি করিয়াছেন। মুখে বুলি ‘চাই স্বাধীনতা’ ‘মার ইংরেজ’ অথচ গোলামির শতবন্ধনে নিজেকে ও স্বজাতিকে বদ্ধ করিয়া রাখিতে চাই— ইহার চেয়ে ভাবের ঘরে চুরি আর কী হতে পারে! এই জন্যই বিপ্লববাদ কোনও নিজস্ব দর্শনশাস্ত্র [ভাবাদর্শ] সৃষ্টি করিতে পারে নাই এবং শেষে সব ধূয়ায় পরিণত হইয়াছিল। (পূর্বোক্ত: ৩৭-৩৮)। বারীন্দ্রনাথ ঘোষের উক্তিটি এই বোধের করুণ প্রকাশ। অর্থাৎ আদর্শগত অস্পষ্টতার জন্য সম্পত্তিবান জমিদারের আর্থিক সাহায্যে তাঁরা বোমা বানিয়েছেন ইংরেজ মারার জন্য। আর জমিদারগণ যখনই স্থিতি লাভ করেছে সঙ্কটমুক্ত হয়েছে তখনই তারা অর্থসাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। স্বদেশি আন্দোলনের সময় ও তার পরে এটাই ঘটেছিল। শুধু তাই নয়, জমিদারতন্ত্র ও পুঁজিপতিশ্রেণিও যে ব্রিটিশ শোষণ-শাসনের সঙ্গে যুক্ত— এটাও তাঁরা অনুধাবন করতে পারেননি। স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে অর্থনৈতিক শোষণের বিষয়টি যুক্ত করার কথা ভূপেন্দ্রনাথ ও হেমচন্দ্র ১৯২২-২৩ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করলেও তাকে সুস্পষ্টভাবে সাংগঠনিক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করেন তরুণ বিপ্লবী ভগৎ সিং। ভগৎ সিং-এর কাছে স্বাধীনতা মানে শুধু ব্রিটিশ শাসনের অবসান নয়, সকল ধরনের শোষণ থেকে মুক্ত সাধারণ মানুষের স্বাধীন সমাজ, বা সমাজতন্ত্র।


[1] ১৮৭১-এ শিবনাথ শাস্ত্রী একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন। সমিতির লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা লাভ। পরবর্তীকালে সমিতির সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং সমিতিটি বিলুপ্ত হয়। ১৮৭০ দশকের মাঝামাঝি তৈরি হয় সঞ্জীবনী সভা বা হানচু পামু হাফ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাজনারায়ণ বসু অন্যতম সদস্য ছিলেন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4663 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. মতাদর্শের খোঁজে ভগৎ সিং: মাঝের কথা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...