দত্তাত্রেয় দত্ত

পাঁচটি কবিতা -- দত্তাত্রেয় দত্ত

পাঁচটি কবিতা

 

সেস্টিনা: রাপুনজেল

যাও নদী, সবটুকু গ্লানি নিয়ে চলে যাও সমুদ্রের কাছে
নিবিড় নীলাভ ঘাসে মুখ গুঁজে পড়ে আছে সবুজ আকাশ,
একটি বিবর্ণ ফুল এর মধ্যে যদি ফোটে, যদি বেঁচে ওঠে
নীল হাসি নীল দিনে নীলরঙা কিশোরীর নীল জানলায়—
এসব স্বপ্নের কোনও মানে নেই, এই স্বপ্ন তুমি তো দ্যাখোনি,
আমি তো ডাকিনি, তবু স্বপ্নে কেন বারবার ফেরো?

তোমার স্বপ্নে তো আমি নেই; তবু অকারণে নিশারাজ্যে ফেরো
একই সঙ্গে জেগে থাকো অদৃশ্যন্তী এ-নিঃসঙ্গ বিছানার কাছে
অথচ এ-স্বপ্নরাজ্যে যা পেয়েছি আমি, তার কিছুই দ্যাখোনি—
ধাতব মনসাকাঁটা, বিষের বীজেতে ছাওয়া বিপন্ন আকাশ,
সহস্রারে বসে থাকা রাপুনজেল গম্বুজমিনার জানলায়
অজগর বেণী ছুঁড়ে যাকে বাঁধে, সে ওপরে ওঠে।

এসব নিশীথত্রাসে দিনমানে যেন স্নায়ু কেঁপে কেঁপে ওঠে।
সে-জ্বরের উপশম নেই: যত এপাশ-ওপাশ তুমি ফেরো
কষ্ট বাড়ে। শ্বাসরুগ্ন অভিতপ্ত যদি খুলে দিই জানলায়
সমুদ্র-হাওয়ার নুনে নাক জ্বলে। নিষ্কৃতি মিললে তার কাছে
আগ্রাসী রোদ্দুর ফোঁসে। রুষ্ট হলে কী যে করে সবুজ আকাশ
কী করে জানবে তুমি? স্বপ্নে তুমি কিছুই দ্যাখোনি।

সর্বদেহে মাখা গ্লানি কীরকম, নিজে স্বপ্নে কখনো দ্যাখোনি?
স্পিরিটে থিনারে ধোও, ইতিহাস কোনওদিন পাতা থেকে ওঠে?
যত ব্যগ্র হয়ে খোঁজো, কোন্ হাতে ছোঁবে গত কালকের আকাশ?
অতীতের বাতায়নে খোলা শ্বাস নিতে গিয়ে দ্রুত পিঠ ফেরো
আলো থেকে সরে এসে খুঁটিয়ে কী দ্যাখো ওই আয়নার কাছে—
মুখে কি হঠাৎ কালো রং লেগে গেল জানলায়?

মনে করো, লজ্জায় বদন গুঁজে আলো পড়ে আছে জানলায়
আর তুমি আঁধারিতে পর্দার আড়ালে, যেন ভুলেও দ্যাখোনি
সেই সে বিবর্ণ ফুল, যেটা এই ফেলে দিলে জঞ্জালের কাছে
ইতিহাস ভুলে যেতে। তাই যেই অতীতের কলরব ওঠে
দু’হাতে দু’কান চেপে বয়সের বদ্ধ ঘরে দ্রুত ঘোরো ফেরো,
আড়ে দ্যাখো কতখানি নিভে এল পাঁশুটে আকাশ।

ফুরানো আলোকবর্ষে স্পন্দমান ছিল বুকে রঙিন আকাশ
কিশোরী ডাকিনি সখী, তোমাকে ডেকেছি, ছিলে নীল জানলায়:
নীচে লাল কাঁটাতার। যদি আজ সময়ের বিপরীতে ফেরো
জানবে ঝাঁপান খেলা হয়েছিল। রাপুনজেল, সে-খেলা দ্যাখোনি?
লোহার মনসাঝোপ— বেণী বেয়ে চড়কের গাছে যারা ওঠে,
রক্তমাখা পড়ে থাকে অতঃপর সময়ের কাছে।

নিজেকে কি খেসারত দেওয়া যায়? দেনা কার কাছে?
কবে তা শুধবে, যদি উজিয়ে আলোকবর্ষ প্রতিমুখে ফেরো?
আঁধারের গতি কত মাপেনি যে রাত্রির আকাশ!

[প্রথম স্তবকটি বন্ধুবর নিরুপম চক্রবর্তীর ছ’টি কবিতার ছ’টি পংক্তির সমবায়ে রচিত হয়েছে।]

 

সেস্টিনা: সেই তারা

একেবারে চলে যায়নি সকলে, ঘিরে আছে চার দিকে
ছোঁয়া না পেলেও, দেখা না হলেও, নেভানো প্রদীপ হাতে
আঁধারেতে আসে, ছায়া হয়ে ভাসে, তাকায় আমার মুখে।
তারা চায় না কি, বাঁচবার ফাঁকি এড়াতে তাদের ডেকে
বলব: ‘সময় শুধু ঠক নয়, আছে আরও কিছু বাকি—’
তখনি দুপাশে সকলে কোরাসে জ্বালিয়ে তুলবে আলো?

কোন্‌ ভরসায় থাকি সে-আশায়? সন্ধ্যার পরে আলো
উঠলো না জ্বলে, ধোঁয়াশা বিকেলে ছেয়ে গেল সব দিকে
গোধূলির সোনা গলে পড়ল না, কিছু রইল না বাকি
ধূসর জগতে বিপন্ন পথে নিরাশার ঝুলি হাতে—
হাওয়া ঝাপটাল, ঢেলে দিল ধুলো, যাদের পাইনি ডেকে
এখন তাদের ডাকব কি ফের বিপন্নতার মুখে?

*

নাকি ফিরে পরে নেব যন্ত্রণামুখোশ এই দ্বিধাদীর্ণ মুখে,
প্রত্যাগত ক্লাবে বসে ঘোষাব যে এরই নাম আলো?
আবার টেবিলে এসে অক্‌শানে ব্রিজ গড়ে টুউ হার্ট্‌স্‌ ডেকে
দু-হাতে হৃদয় ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেউ দেবে চার দিকে।
কোথায় অনার কার্ড— এ-খেলায় অনার কি থাকে নিজ হাতে?
ফলে সুদ দিয়ে চলি, বাজি-হারা মূল দেনা রয়ে যায় বাকি।

প্রেতার্ত জগতে নয়, প্রদোষ-ছায়ায় যারা রয়ে গেছে বাকি
ঘরের বাহির থেকে দেখে তারা প্রত্যাশাপরায়ণ মুখে
কতক্ষণে নিঃস্ব হই শূন্য বটুয়া নিয়ে দেউলিয়া হাতে
উল্লাসে জ্বালাবে তারা হতাশ আঁধারে সন্ধ্যা ফুরোবার আলো
সে-প্রভায় তমোহর অগ্নিবীণা দীপক বাজাবে হার্দিকে
আমার তমসাদোর ভেঙে ঘরে নতুনকে কাছে নেবে ডেকে।

*

তবে কি সরবে উৎসব হবে যেই কাছে নেব ডেকে?
আশঙ্কা হয়, কী করে সময় এগোবে, কী রবে বাকি,
ছায়াদেহ যারা সে-আলোতে তারা টিঁকবে কি চার দিকে
মোমবাতি হাতে? যেই সে-নিশীথে দীপ্তি পড়বে মুখে
দ্যুতির ঝলকে তাদের পলকে মুছে দেবে সেই আলো
হতাশা, বেদনা, ঘৃণা-সান্ত্বনা, কিছু থাকবে না হাতে।

*

সেই এক ভয় হয় একা বসে ভর দিয়ে মাটিতে দুহাতে—

দেখা না-ই যায় যদি ছায়াদের, তবে কোন্ ভরসায় ডেকে
আনি এ-কারায়? চোখে সইবে কি সে নতুন অনভ্যস্ত আলো?

থাক্ তারা অস্তিত্বের গোধূলিতে। আলোর পিপাসা যদি বাকি
থাকে থাক্, স্তরায়িত অন্ধকারে, লুপ্তপ্রায় সময়ের মুখে
আজ কোনও শব্দ নেই— জেগে থাকি সমাপ্তি বিছিয়ে চার দিকে।

*

এসব ভাবনা আলোতে আনি না, আঁধারে যাতনা নেয় ডেকে
কালো গাছপালা হাতে ঠেলে বলা প্রণয়-কোবালা কোন্‌ মুখে
শুনেছি, ভুলেছি; বেঁচে বা কী আছি— ওড়ে মড়া-মাছি দশ দিকে।

 

ভিলানেল: উত্তরীবায়

উত্তরীবায় ঝাঁট দিয়ে যায় বাগানের ঝরা পাতা
সেদিকে তাকিয়ে ভাবি কী ফাঁকি এ খসে যাওয়া দিনগুলি
স্মরণের দেনা হিসেবে রাখে না সময়ের ছেঁড়া খাতা।

কিছু বা দীর্ণ, কিছু বিশীর্ণ পত্রে ধরেছে ছাতা
কাজ কী কুড়িয়ে, কী হবে এ নিয়ে, ক’টাই বা বেছে তুলি
উত্তরীবায় ঝাঁট দিয়ে যায় বাগানের ঝরা পাতা।

মনে ঠিক বুঝি, বাগানে যা খুঁজি, থাকার তো ছিল না তা
সঙ্গীর ডাকে ওড়ে এক ফাঁকে হাতে ধরা বুলবুলি
স্মরণের দেনা হিসেবে রাখে না সময়ের ছেঁড়া খাতা।

গোলাপ শাখায় পোকা শুষে খায়, কাঁটায় বেঁধায় মাথা
শুক্‌নো হাওয়ায় মাটি ফেটে যায় মুখে ঢোকে উড়ো ধূলি
উত্তরীবায় ঝাঁট দিয়ে যায় বাগানের ঝরা পাতা।

কেন যে হৃদয় কী যে পেতে চায়, কী লোকসানের কথা
কড়া-গণ্ডায় ঝাঁঝরা করায় কৃতকর্মের ঝুলি—
স্মরণের দেনা হিসেবে রাখে না সময়ের ছেঁড়া খাতা।

নব মরণের পাতা ওঠে ফের, আবার বিদায়গাথা
সেই তো অমোঘ না-সারার রোগ, বারবার কেন ভুলি?
উত্তরীবায় ঝাঁট দিয়ে যায় বাগানের ঝরা পাতা
স্মরণের দেনা হিসেবে রাখে না সময়ের ছেঁড়া খাতা।

 

ভিলানেল: স্মৃতিসুধা

স্মৃতিকে দু পায়ে দলে রস বার করে,
বিরহে গেঁজিয়ে তুলে, ছেঁকে নিয়ে তাকে
রেখেছি লেবেল এঁটে বোতলেতে ভরে।

নিভন্ত বিকেলে রোজ এসে ফাঁকা ঘরে
ডোবাই অভাব যত রক্তিম মাদকে
স্মৃতিকে দুপায়ে দ’লে রস বার করে।

কখনও ডেকেও আনি মনের অন্দরে
পুরনো সঙ্গীকে কোনও; বলি: ‘দ্যাখো চেখে—
‘রেখেছি লেবেল এঁটে বোতলেতে ভরে।’

কেউ বা তাকায় অনুকম্পায়ী নজরে;
হয়তো ভাবেও মনে: ‘এ-মাতালটা কে—
স্মৃতিকে দু’পায়ে দলে রস বার করে?’

বোঝে না তো, সব দুঃখ খসে খসে পড়ে
অ-সুখের দেহ থেকে। সে-শান্তিটুকুকে
রেখেছি লেবেল এঁটে বোতলেতে ভরে।

নিত্য মধুচন্দ্রিমা গেলাসে-অধরে।
সে-আকর্ষণে, আমি সে-নেশার ঝোঁকে
স্মৃতিকে দু’পায়ে দ’লে রস বার করে
রেখেছি লেবেল এঁটে বোতলেতে ভরে।

 

একটি ভিলানেস্ক বার্লেস্ক

কথা কি ফুরিয়ে গেছে? একই কথা বলো বারে বারে।
বাঁধা গৎ একখানা গোঁজো না কোথাও ফাঁকা পেলে—
এ-ফর্মুলা লেখা আছে কাব্যকলাপাতের কিনারে।

একখানা পদ বুঝি নেই এই তেপায়া চেয়ারে?
পাসেপার্তু তো আছে — দাও ওকে ঐখানে ঠেলে!
কথা কি ফুরিয়ে গেছে? একই কথা বলো বারে বারে।

চর্বি তো চর্বণযোগ্য নয় — খেতে দাও না উহারে।
বেশিভাগ অতিথি তো চোখ বুজে কোঁৎ করে গেলে—
এ-ফর্মুলা লেখা আছে কাব্যকলাপাতের কিনারে।

পংক্তিভোজনে তারা ধোঁকা খাবে যতগুলো পারে,
আমিষের পাতে ঠিক চলে যাবে এই গোঁজামিলে।
কথা কি ফুরিয়ে গেছে? একই কথা বলো বারে বারে।

কোথায় নতুন পদ? অত পদ কে রাঁধিতে পারে?
কুমিরের শেষ ছানা দেখাও বারংবার তুলে—
এ-ফর্মুলা লেখা আছে কাব্যকলাপাতের কিনারে।

অনেক খাটিনু আমি দুইখানা ক্রাচে ভর করে,
চুকেছে পদ্যের ল্যাঠা, যদিও তা ভরা গ্যাঁজাগুলে।
কথা কি ফুরিয়ে গেছে? একই কথা বলো বারে বারে,
এ-ফর্মুলা লেখা আছে কাব্যকলাপাতের কিনারে।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. দত্তাত্রেয় দত্ত বাংলা ভাষায় সেস্টিনার ভগীরথ। এই অতিদুরূহ পাশ্চাত্য কাব্যরীতি তাঁর হাতে প্রবাহিণী কলস্বরা। তাঁর ভিলানেলগুলিও রোচিষ্ণু কিন্তু সেস্টিনাদুটি মননের গভীরতম আলোড়নের নির্মাণ। মুগ্ধ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা।
    প্রথম নির্মাণটির শেষে কবির স্বীকারোক্তিটি উপভোগ করলাম!

আপনার মতামত...