
নীহারকান্তি হাজরা
সানুদেশের দিন
ওঝার আসা না–আসা
শৈশব-কৈশোরে দেখেছি তুক-তাক, বশীকরণ, ভূত-প্রেত, অশরীরী শক্তিতে মানুষের ভরপুর বিশ্বাস। একবার আমরা জনাকয়েক বন্ধু বিকেলবেলা হাঁটতে বেরিয়ে হাজির হয়েছিলাম পাহাড়-সংলগ্ন বনে। সেখানে ছিল সাদা বাসকের একটা জঙ্গল। আমরা মগ্ন হয়ে গেলাম তার ফুলের মধু খাওয়ায়। ফেরার পথে পেলাম দুটো পায়ে চলার পথের একটাকে অন্যটার যুক্তচিহ্ণের মতো কেটে চলে যাওয়া। সেই ছেদের স্থানটিতে লাল কাপড়ে মোড়া এক ফুটের মতো একটি খোঁটা মাটিতে পোঁতা। এটার মাথায় এবং এর চারপাশ সিঁদুর ছড়ানো। খোঁটার মাথায় একটি বড় লাল জবাফুল। এক বন্ধু বলল, ভূত ছাড়ানো হয়েছে। তো এমন পথের মাঝখানে কেন? তার কারণ ভূত এখানে এসে চারটে পথের কোনটাতে যেতে হবে তা এখানেই বসে চিরকাল ভাববে। ভূত যাই করুক, কিন্তু সেদিন বাড়ি এসেই শুরু হয়ে গেল পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। অস্থির হয়ে গড়াগড়ি, চিৎকার শুরু করে দিলাম। আমাদের বাড়ির কিছুটা দূর থেকে এক ওঝা এল। চাইল কতগুলো ‘কুচি’। এটা হল ধূপের মাঝখানের মতো বাঁশের কতগুলো কাঠি। মুড়ি ভাজার কাজে জরুরি। একগোছা নিয়ে দেখাল সেগুলো সমান মাপের। তারপর শুরু হল মন্ত্র পড়া। একটু পরেই বলল ভূতে পেয়েছে। কোন সিনি। দেখুন একটা কুচি বেড়ে গেছে। এবার চাইল খানিকটা নুন। আবার মন্ত্র। এবার নুন খেতে হল। যন্ত্রণা ভয়ানক হয়ে উঠল। সেই রাত সেভাবে কাটার পর পরের দিন এলেন গৌর সুরাল। এমবি ডাক্তার। নিজেই আমাকে বার বার বলে নিজেই নিজেকে নিশ্চিত করে গেলেন যে, আমি কাঁচা কেঁদ খেয়েছি। দাগ দেওয়া শিশিতে তাঁর ওষুধ সাতদিন খাওয়ার পর প্রাকৃতিক নিয়মে সে ভয়ানক যন্ত্রণার অবসান হল। তারপরে অনেকবার ভেবেছি, কোনও একটা বিশেষ বাসকগাছের ফুলের মধুতে বিষ ঢুকে পড়া অসম্ভব নয়। তারই ক্রিয়া।
এর পরের জীবনে দেখেছি বাটি-থালা চালানো। পিঠে থালা বসিয়ে দেওয়া। ঝাড়-ফুঁক। সাপের ওঝা। আরও বড় হলে বিশ্বের সঙ্গে আমিও জেনে যাব যে, আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যায় সাপের ওঝা আছে বলেই সাপের কামড়ে এই দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। আবার এক ধরনের মোড়ক এসে পড়ে কোনও ঘটনাকে নিয়ে। চন্দ্র ময়রার ঘরের সামনের সেই আয়তাকার মাঠের ডানদিকের লালধুলোর রাস্তার ওপারে একট বড় মাটির বাড়িতে বাস করতে এল এক মুসলমান পরিবার। এদের একটি যুবককে একদিন রাত্রে সাপে কাটলে। চেনা গেছে গোখরো সাপ। যুবকটির পায়ে বাঁধন দিয়েছিল পরিবার। আর ঠিক সেই জন্যেই এল না কোনও গুণিন। মা মনসার গায়ে বাঁধন! এ তো ভয়ানক অপরাধ! কোনও ডাক্তারকে ডাকা হয়েছিল কিনা জানা নেই। এলেও সেকালে সাপে-কাটা রোগী একমাত্র মা মনসার করুণাই দাবি করত। জয় মা বিষহরী! সেই স্বাস্থ্যবান সুন্দর যুবকটিকে আমার মনে পড়ে, তাদের বাইরের ঘরে খোলা দরোজার সামনে সে খাটে শুয়েছিল। তারপর ক্রমশ নীল হয়ে আত্মসমর্পণ করল। কোথাও থেকে নেমে আসা একটা ধারণা আমাদের কিশোরমহলে একটা রং দিয়ে গেল— যুবকটি মুসলমান এবং মা মনসাকে গালি দিয়েছিল। অথচ এ-জনপদে সেই তালাওয়ের পাশে একটা বড় মুসলমান বসতি ছিল। একটা মসজিদ আর তার মুয়েজ্জিন ছিল। দূরে কবরিস্তান ছিল। অসংখ্য মোম-জ্বালানো শবেবরাত ছিল। ঈদ মোবারক আর তার সঙ্গে নতুন জামাকাপড়-টুপির বহর ছিল। ভাই-চারা ছিল। নানা রঙের ফিরনি-সিমুই ছিল। সত্য ময়রার দোকানের মিষ্টিও ছিল। আর এসব উৎসবে আমাদের যোগ দেওয়ার কোনও বাধা ছিল না। আমাদের উৎসবে তাদেরও। এইভাবে চলতে থাকা সময়ের তাল কাটার কোনও ঘটনা এর আগে আমার জীবনে ঘটেনি। অনেক-অনেকদিন পরে বুঝেছিলাম এর বীজ ওই জনপদের ভিতরেই ছিল। বোধে আসেনি।
আবাসে ভ্যারেন্ডা–বাতি, উৎসবে ডে–লাইট
এক সময় কেরোসিনের আকাল দেখা দিয়েছিল। এতে একটা টেমি আর একটা হ্যারিকেন কিছুটা সময় জ্বলবে। টেমিটার নাম ছিল লম্ফ। ছোট গোলাকার পাত্রের উপর একটা সলতে পরানোর নল। কিছুকাল পরে এর বিকল্প চলে এল— ভ্যারেন্ডার বীজ। পাহাড়গুলোর ওপারের বহু দূরের গ্রাম থেকে এগুলো সংগ্রহ করে দিত বাবার পরিচিত লোকেরা। বারান্দার উপর বড় বড় ঝুড়ি ভর্তি করে রাখা থাকত এই বীজ। বীজগুলো পুষ্ট চিনেবাদামের থেকে সামান্য বড়। আতার বীজের মতো কালো। আমাদের কাজ ছিল ছেঁচে এগুলোর খোসা ছাড়িয়ে রাখা। বাঁশের কুচি-কাঠিতে এগুলো পর পর গেঁথে দেওয়ালের ফুটোয় আটকে রাখা হত। সন্ধেবেলা পনেরোটা এরকম বীজের কাঠির উপরের বীজটা জ্বালালেই পরপর জ্বলে উজ্বল আলো দিত আধ-ঘন্টা। এটা চলেছিল মাসের পর মাস ধরে।
সে-সময় আমাদের বাড়িতে দুটো হ্যারিকেন ছিল। একটার কাচ লম্বা আর অন্যটার বেঁটে। লেখাপড়া করা বা বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনে হ্যারিকেন অপরিহার্য ছিল। লম্ফ বা টেমির ভুষো নাকে ঢুকে দম বদ্ধ হয়ে যেত। অনেকটা দূরে রেখে টেমির আলো ব্যবহারে আসত। হ্যারিকেনের তলায় তেল ভরার জায়গায় যে প্যাঁচটি থাকত তার দু-পাশে লেখা থাকত— Made in Germany! আর মাথায় কাচটা যেখানে ঢুকে বসত সেই অংশে লেখা থাকত EFAR। অনেক পরে বুঝেছি এটা কোনও ব্র্যান্ডের সংক্ষেপ। গরিব লোকেরা একমাত্র টেমিই ব্যবহার করত। কারণ তাদের লেখাপড়া করার ব্যবস্থা ছিল না। এই সময় থেকে বহুবার শুনেছি শীতের বদ্ধ ঘরে রাত্রে টেমি জ্বালিয়ে রেখে ঘুমোনোয় মৃত্যুর খবর।
খাতড়ার বড় দোকানগুলিতে এক বা একাধিক কেরোসিনের পাম্প করা আলো জ্বলত। এটার নাম ছিল হ্যাজাক লাইট। এর ভাল নাম পেট্রোম্যাক্স। এটা হ্যারিকেনের মতো লোহার পাতের হত না। উজ্বল ইস্পাতের বা সম্ভবত পিতলের উপর নিকেল করা হত। হ্যারিকেনের মতোই বহনের জন্য মাথায় একটা হাতল থাকত। তেল ভরার জায়গায় থাকত একটা পিস্টন। এটা দিয়ে পাম্প দেওয়া হত। তলার তেলের আধারের থেকে একটা পাইপ পাশ দিয়ে উঠে উপরের শেষ অংশটা তলার দিকে বেঁকে থাকত n-এর মতো। বাঁদিকের এই অংশটুকু ঠিক আলোর কাঠামোর মাঝখানে পড়ত। এর ডগায় বাঁধা হত উজ্বল রুপোলি রঙের বেলুনের মতো একটা জাল। লম্বায় দু ইঞ্চি। এই ফাঁপা জালটি একটি লাল আর কালো রেখার মোড়কে আসত। এর গায়েও লেখা থাকতো EFAR, Made in Germany। জালটির খোলা মুখের সঙ্গে লাগানো থাকত ঠিক ওই উপাদানের একটা সুতো। লাইটের মাথাটা সম্পূর্ণ খুলে রেখে ওই বাঁদিকের নলের অংশটুকুতে এই জাল শক্ত করে বাঁধা হত। তারপর পাম্প করে জালটিতে আগুন জ্বালানো হত। আগুনের লাল শিখায় জালটি পুড়ে হয়ে যেত উজ্বল রূপালি। এর পর অভ্রের ঘেরা দেওয়া মাথাটি বসিয়ে দেওয়া হত। সশব্দে জ্বলত বাতি। কোনও ঝাঁকুনিতে ওই ছাই হওয়া জালটি পড়ে না গেলে জ্বলত অনেক দিন। এই আলোগুলি ছিল দুশো ক্যান্ডল ওয়াট-এর।
এই আলোরই আর একটা বিশাল বপু ছিল। ঝোলানো থাকত মাথা নিচু করে। তেলের আধার আর পাম্প দেওয়ার ব্যবস্থা উপরে। এগুলির ক্ষমতা ছিল পাঁচ হাজার ক্যান্ডল ওয়াট। বা আরও বেশি। বিএনআর রেলের জংশন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এগুলি সারি দিয়ে ঝোলানো থাকত। রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থাও চলত কেরোসিন তেলে। স্টেশনমাস্টারের ঘরের পাশেই থাকত একটি লন্ঠনের ঘর। সেখানে থাকত উত্তল লাল আর সবুজ কাচের বহু লন্ঠন। গ্যাসলাইট আর তাদের সরঞ্জাম। কেরোসিনের পিপে আর আলোর কালির ভূষা মোছার সুতোর বান্ডিল। নির্দিষ্ট লোকটির কাজ ছিল এগুলি সাফসুতরো করে হোম আর ডিসট্যান্ট সিগন্যালের সবগুলি আলো আটকে দিয়ে আসা।
মফস্বল শহরে নানা আকারের গ্যাসের আলো ব্যবহৃত হত সভাসমিতি, অনুষ্ঠান আর বিয়েবাড়ির শোভাযাত্রায়। শ্রেণিবদ্ধ মহিলা শ্রমিকেরা এগুলি বইত মাথায়। এগুলিকে বলা হত ডে-লাইট। এর মধ্যেই এসেছে কাচ দেওয়া চৌকো লন্ঠন। উৎপত্তিস্থল বিষ্ণুপুর মহকুমা শহর। জেলার অগণিত গ্রামে এই লন্ঠন টেমির আবরণহীন অস্থিরতা থেকে মুক্তি এনেছিল।
[ক্রমশ]