নহি যন্ত্র — পাঁচ

সৈকত ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ব্যাঙ্গালোরে রাস্তা-ঘাটে চলা যায় না, অনন্ত ট্রাফিক সমস্যা— কিন্তু এই মে মাসের মধ্যিখানে যখন আমাদের কলকাতা বা চেন্নাইতে আগুন জ্বলছে, তখন রাত্তিরে ফ্যানের স্পিডটা একটু কমিয়ে দিয়ে একটা চাদর টেনে ঘুম দিতে দিতে যে দিন দিন শহরটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি, তা বেশ বুঝতে পারছি। এখন যেমন, এই বিকেলবেলা অফিসের পর একটা কফি নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আমাদের এই বারোতলার ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে সামনে লেকের জলে মেঘের ছায়া দেখতে দেখতে জোলো বাতাস এসে মুখে লাগল। বৃষ্টি আসছে। মেঘের যা আকার দেখছি, ওই একই অনুপাতে বৃষ্টিটা যদি হয়, রাতে রবিঠাকুরকে খিচুড়ি আর মাছভাজা করতে বলতেই হবে। কাল শনিবার। সুতরাং সক্কালবেলা ওঠার তাড়া নেই। একটা জম্পেশ থ্রিলার দেখে তবে ঘুমোব।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে এই সব ভাবছি, আর ঠিক সেই সময় জয়দা চিৎকার করে উঠল, হে ভগবান!

জয়দা যে ধার্মিক মানুষ তা একেবারেই নয়, বরং উল্টোটা বলা যায়— আবার এমন চিল্লামিল্লি করে নিজের ইমোশন-টিমোশোনও দেখাতে দেখিনি আজ অবধি। সে এমন ‘হে ভগবান’ করে চিৎকার করে উঠল শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভেবলে গেছিলাম। সম্বিত ফিরতে জয়দার ঘরের দিকে দৌড় দিলাম। শুভ নেই। মঞ্জুশ্রীর জন্য থাকার জায়গা খুঁজতে গেছে। মঞ্জুশ্রী ব্যাঙ্গালোরে থাকবে আপাতত মাসখানেক। ওয়ার্ক ফ্রম হোম ম্যানেজ করতে পেরেছে। তাই আমাদের সারপ্রাইজ দিয়ে মহারানি হাজির হয়েছেন।

জয়দার ঘরে ঢুকতেই সে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। জয়দার এমন বিধ্বস্ত মুখ অতীতে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ল না। সায়াহ্নের আধো অন্ধকারে ল্যাপটপের স্ক্রিনের আলো জয়দার মুখের উপর একটা আলো-ছায়ার রহস্যময়তা তৈরি করে তুলেছে।

আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?

—সর্বনাশের হাতেখড়ি! জয়দা এটুকু বলে ফের ল্যাপটপের দিকে তাকাল। কপালে অসম্ভব একটা ভ্রূকুটি।

আবার জিজ্ঞেস করি, আরে, হল কী?

—মামা তার মোলো কি? জয়দাও আবার হেঁয়ালি করে।
—হেঁয়ালি না করে বলবে কী হয়েছে? একটা কড়া গলায় বলার চেষ্টা করি।
—সাইবারক্রাইম। জয়দা ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে বলল এবার।
—মানে?
—আমাদের প্রোডাক্টটা কেউ হ্যাক করেছে।
—তোমাদের প্রোডাক্ট মানে যেটা ওই ট্রাফিক সিগন্যাল রিলেটেড কী একটা?

জয়দার কোম্পানি ব্যাঙ্গালোরের ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের সঙ্গে কোলাবরেশনে একটা প্রোডাক্ট তৈরি করেছিল। সেটা দিয়ে নাকি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে।

—ইয়েস। পাইলট টেস্টিং চলছিল। জয়দা বলল।

এখানে বলে রাখি, পাইলট টেস্টিং কথাটার মানে হল কোনও কিছু সবার জন্য খুলে দেওয়ার আগে অল্প কিছু ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে পরীক্ষা করে দেখা যে ঠিকঠাক চলছে কি না। সব ক্ষেত্রেই হয়— সফটওয়্যার তার ব্যতিক্রম নয়।

—তো? কী হয়েছে?
—একটা মোড়ের মাথায় একসঙ্গে দুদিকের সিগন্যাল সবুজ করে দিয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। গোটা দশেক গাড়ি নিজেদের মধ্যে ঠোকাঠুকি করেছে, কয়েকজন বাইকারোহী আহত, প্রচণ্ড যানজট, হইচই… সব মিলিয়ে একেবারে জগাখিচুড়ি ব্যাপার!
—এ বাবা! কী করে হল?
—সেটাই তো ভাবাচ্ছে রে তোপসে! আমি নিজে হাতে প্রতিটা কোড রিভিউ করেছি। এ জিনিস হওয়া ইম্পসিবল নয়, আন-পসিবল। সরকারি জিনিসের এমন গোলমালের ঠেলায় এবার প্রোজেক্টটা হাতছাড়া হলেই কেলো!

বলে জয়দা একটা সিগারেট ধরানোর উপক্রম করতেই আমি বললাম, বারান্দায় প্লিজ।

জয়দা বাধ্য ছেলের মতো বারান্দায় এসে সিগারেট ধরিয়ে রেলিং-এর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। কপালে বিষম ভ্রূকুটি। আমি বললাম, তা এবার কী করবে?

জয়দা একটু চুপ করে থেকে ছোট্ট করে বলল, ডিবাগ।

জয়দার মতো এআই নিয়ে কাজ না করলেও, ছোটোখাটো সফটওয়্যার সম্পর্কিত কাজ করার সৌজন্যে এটা ভালোই জানি যে একটা সফটওয়্যার সিস্টেম যদি কোনও কারণে কাজ না করে, তবে তার যে কারণ অনুসন্ধান পর্বটা আমরা চালিয়ে থাকি তাকেই ‘ডিবাগ’ করা বলা হয়। অর্থাৎ কি না, কোডের মধ্যে ডেভেলপারের ভ্রমে লুকিয়ে পড়া ‘ছারপোকা’টিকে খুঁজে বের করে আনা। অতএব জয়দার কথায় নতুনত্ব কিছু নেই। আবার জিজ্ঞেস করি, ডিবাগ করবে কী করে?

জয়দা এবার বলল, সে পরে দেখছি। সার্ভার থেকে অ্যাপ্লিকেশন লগ নিয়ে দেখতে হবে, কোথায় গোলমাল হল।

আধুনিক সফটওয়্যার সিস্টেম যেগুলো ইন্টারনেটের সাহায্যে চলে, তা প্রায় নব্বই শতাংশই থাকে ক্লাউডে। ক্লাউড মানে মেঘ নয়, এটা একটা সফটওয়্যারের পরিভাষা। এর মানে হল, এই অ্যাপ্লিকেশন বা সংক্ষেপে যাকে আমরা “অ্যাপ” বলে থাকি, সেইগুলোকে চালানোর জন্য আপনাকে আপনার নিজস্ব সার্ভার বা একটা কম্পিউটার রাখতে হবে না। মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজন ইত্যাদি বড় বড় টেকনোলজি কোম্পানিরা প্ল্যাটফর্ম অ্যাজ এ সার্ভিস বা PaaS নামে একটা পরিষেবা দেয়, যার মাধ্যমে আপনি ওদের একটা ভার্চুয়াল কম্পিউটারে এই অ্যাপটাকে রেখে চালাতে পারবেন। ফলে আপনার ঝামেলা কম। এবার এমন কিছু গণ্ডগোল হলে কী করে বুঝবেন যে গলদ কোথায়? তার জন্য অ্যাপের কোডেই কোথায় কী কীভাবে কী কাজ করছে, সেটা লিখতে বলে দেওয়া থাকে। সেই লগ দেখে বোঝা যায় যে কোথায় ভুল হয়েছে বলে বিষয়টা যেমনটি চলার তেমনটি চলল না। জয়দা সেই লগ দেখে ডিবাগ করার কথাই বলছিল। কিন্তু আমার মনে অন্য প্রশ্ন এল।

জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু তোমাদের এই পুরো সফটওয়্যারটা তো একটা এআই মডেলকে নির্ভর করে তৈরি?

জয়দা মাথা নেড়ে সায় দেয়।

আবার প্রশ্ন করলাম, মডেলটা তোমরাই ট্রেইন করেছ?

আবার ছোট্ট করে ‘হ্যাঁ’ বলল জয়দা।

—তবে গোলমালটা হল কোথায়? তোমরা নিশ্চয়ই ভালো করে টেস্ট করে নিয়েছিলে সব?
—সেটাই তো গোলমাল। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে আমাদের মডেলকে ‘পয়জনিং’ করা হয়েছে কোনওভাবে!
—পয়জন? মানে, বিষ?
—হুম, এআই-এর এত মানুষ হওয়ার ইচ্ছে যখন বিষই বা বাকি থাকে কেন? জয়দা সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল।

 

শুভ আর মঞ্জুশ্রী যখন ফিরল তখন সাতটা বাজে প্রায়। আমাদের পাশের সোসাইটিতে একটা ঘর পাওয়া গেছে মঞ্জুশ্রীর জন্য। কাল দেবে। অসুবিধা নেই। দুদিন ধরে আমাদের সঙ্গেই রয়েছে ও। জয়দা অফিসের মিটিং-এ ছিল। শুভ জয়দার এআই সফটওয়্যারের বেগড়বাঁইয়ের কথা শুনে বলল, এ তো পুঁদিচ্চেরি কাণ্ড রে ভাই!

—নইলে আর বলছি কী? জয়দা বলছে যে মডেলকে নাকি কে বিষ খাইয়েছে!
—বিষ! সে কী রে! মডেল তো যন্ত্র!
—নহি যন্ত্র, নহি যন্ত্র, আমি প্রাণী— শুভর কথা শেষ না হতেই হেঁড়ে গলায় সত্যজিৎ-সঙ্গীত গাইতে গাইতে জয়দার আবির্ভাব হল।
—কী ব্যাপার জয়দা? মডেলকে বিষ? শুভ জয়দাকেই জিজ্ঞেস করে।

জয়দা তার স্পেশাল দোলনা চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে গুছিয়ে বসল। বসে বলল, হুম।

—কীভাবে?
—সে পরের কথা। তার জন্য যন্ত্র কীভাবে ‘মানুষ’ হল, সেটা বুঝতে হবে তো!

জয়দার কথা শুনে বুঝলাম মুড ভালো। আমাদের এআই-এর সেশনটা কন্টিনিউ হতে পারে। বললাম, নিশ্চয়ই।

জয়দা বলল, তার আগে কফি।

রবি ঠাকুর রান্নাঘরেই ছিল। চেঁচিয়ে চার কাপ কফির হুকুম দিলাম।

 

জয়দা রবি ঠাকুর স্পেশাল আমেরিকানো কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বেশ একটা তৃপ্তির ‘আহ্‌’ করে তারপর বলল, সেই সৃষ্টির গোড়ার কথা বলেছিলাম না তোদের? তারপর তো একথা-সেকথায় একেবারে এটাসেটামিক্স হয়ে গেছে। ‘প্রাণ’-এর জন্ম তো হল, কিন্তু তারপর এই ড্রয়িংরুম অবধি তো লম্বা পথ। এত কিছু হল কীভাবে? কেনই বা হল?

—সে তো ডারউইন সাহেব বলেই গেছেন, তাই না? মঞ্জুশ্রী বলে বসল।
—হ্যাঁ, বিবর্তনের মাধ্যমে। সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এমন বিবর্তন হল কেন যাতে মানুষই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র জীব যে অর্থপূর্ণ ভাষা পেল কথা বলার জন্য? প্রকৃতিদেবীর এমন একচোখামির কারণ কী?

এই প্রশ্নে আমাদের মুখের ভাষা হারিয়ে গেল দেখে জয়দা নিজেই আবার বলতে লাগল, যদি ভেবে দেখিস, সব কিছুর মূলেই আছে কিন্তু এই ভাষা। আমার জ্ঞান যদি প্রকাশ না করতে পারি, তাহলে আর সেই জ্ঞান রেখে লাভটা কী?

শুভ ফিসফিস করে বলল, যেমন তুমি…

জয়দা দেখলাম বেশ স্পোর্টিংলি নিল। বলল, এক্স্যাক্টলি। এই যে আমি কয়েকটা বই-টই পড়ে যা সামান্য জ্ঞানান্বেষণ করি, সেইসবগুলো তোদের কাছে যদি না বলি, তবে তোরাই বা আমায় একটা কেউকেটা বলে কেন পাত্তা দিবি, আর আমিই বা শুভর শুভবুদ্ধির উদয় ঘটিয়ে একটু পূণ্যার্জন কী করে করব? কিন্তু এই পুরো প্রসেসটার জন্য যেটা প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন তা হল একটা ভাষা। নইলে আমার মুখে কথাই ফুটত না! সেক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণীদের মতো বিভিন্ন শব্দ করে অনুভূতি হয়ত কিছুটা ব্যক্ত করা যেত, কিন্তু একটা কবিতা, একটা গান, অথবা থিওরি অফ রিলেটিভিটির মতো একটা গবেষণাপত্রের জন্ম হত না! তাই প্রশ্ন হল, এই মানবজাতি কী এমন মহৎ কাজ করেছিল যে বিবর্তনের ধারার এমন সুনজরে পড়ে গেছিল?

—কিন্তু কিছু বাঁদরশ্রেণির প্রাণী আছে না, যারা বিভিন্ন অর্থপূর্ণ শব্দ দিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করে? কোথাও একটা পড়েছিলাম মনে হচ্ছে।

মঞ্জুশ্রী বলল। ও এত কোথায় পড়ে কে জানে! আমি তো অফিস করে আর মোবাইলে গেম খেলেই কূল করে উঠতে পারি না।

জয়দা মঞ্জুশ্রীর কথা শুনে বলল, একদম ঠিক বলেছিস। ভারভেট বলে এক ধরনের প্রাইমেট আছে। প্রাইমেটস কাদের বলে জানিস তো?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই সব বাঁদরজাতীয় প্রাণী যারা মানুষের তুতো ভাই-বোন— একই পূর্বপুরুষ ছিল কিন্তু বিবর্তনের একচোখামির জন্য বেচারারা খুব একটা কিছু করে উঠতে পারেনি, আর অন্যদিকে আমরা মানুষ হয়ে গেছি। আমি বললাম। এটা জানা ছিল।
—কারেক্ট। সেই মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে ভারভেটরা বিভিন্ন ধরনের আলাদা আলাদা আওয়াজ করে বিভিন্নরকম বিপদ সম্পর্কে স্বজাতিকে সচেতন করার জন্য। মানে, সিংহ আসছে, নাকি চিতা, আবার সাপ ঢুকে পড়েছে কি না— বিপদের ধরন সম্পর্কে বাকিদের সাবধান করে, যাতে গাছের আরও উঁচু ডালে উঠে পড়বে, নাকি মাটিতে নেমে পড়বে, সে বিষয়ে জলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। মজার ব্যাপার হল, ভারভেটরা নাকি মিথ্যা কথাও বলে। মানে, এমনিই বিপদের ডাক দেয়— বাকিদের ভড়কে দেওয়ার জন্য।
—হুম, এই জন্য কথামালার গল্পগুলো পড়া উচিত ছিল। একদিন নইলে সেই রাখাল বালকের মতো দশা হবে— যেদিন সত্যি বিপদ আসবে কেউ বিশ্বাস করবে না।

শুভ গম্ভীরভাবে বলল। ভারভেটদের জন্য সর্বশিক্ষা অভিযানটা শুরুই করে দিত, যদি না জয়দা বাধা দিয়ে বলত, আরে সে বোঝার জন্য ওদের আমাদের মতো বই পড়তে হয় না। কোনটা সত্যি আর কোনটা সত্যি নয় সেটা নাকি ওরা ডাক শুনলেই বুঝে যায়— প্রাণভয়ে ডাকের আর্জিই আলাদা হয়। যাই হোক, প্রাইমেটদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই এরকম একটা অপরিণত একটা ভাষাব্যবস্থা কাজ করে। কিন্তু সেটা আমাদের ভাষাব্যবস্থার ধারে কাছে নয়। ওদের অল্প কিছু শব্দ আছে, যেগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে মনের ভাব বা বিপদ ব্যক্ত করে। আমাদের আছে কিছু বর্ণ— সেগুলোও যদি দেখিস এক-একটা আলাদা আলাদা শব্দ— মানে, word না, sound— সেই প্রাথমিক শব্দগুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে আমরা জন্ম দিয়েছি লক্ষ লক্ষ শব্দের (words)— আর তার সাহায্যেই আমাদের জগৎ চলছে। কিন্তু প্রশ্নটা রয়েই গেল যে আমাদের জন্য বিবর্তনদেবতার এমন অতিরিক্ত সুবিধাদানের কারণ কী?

প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে জয়দা কফির বাকিটুকু একচুমুকে শেষ করে আমাদের মাথা চুলকোনো দেখে হেসে বলল, তোরা যেমন জানিস না, তেমন এর উত্তর সম্ভবত কারও কাছেই নেই। তবে কিছু জিনিস বলা যায়। যেমন শারীরিক ক্ষমতার দিক থেকে দেখলে মানুষের স্থান সবদিক থেকেই অনেক নিচে। আমরা না পারি চিতার মতো ছুটতে, না পারি ব্ল্যাক মার্লিনের মতো সাঁতরাতে, আবার না আছে হাতির মতো শক্তি, না করতে পারি বাঘের মতো শিকার, এমনকি পাখি, প্রজাপতির মতো উড়তেও পারি না। মানে, এক কথায়—

নই ঘোড়া, নই হাতি, নই সাপ বিচ্ছু,
মৌমাছি প্রজাপতি নই আমি কিচ্ছু
মাছ ব্যাং গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই
নই জুতা নই ছাতা, আমি তবে কেউ নই।

শুধু একটা জিনিসে আমরা সকলের চেয়ে এগিয়ে। সেটা কী?

মঞ্জুশ্রী এবার হেসে নিজের মাথায় তর্জনী দিয়ে দুটো টোকা মেরে বলল, মগজাস্ত্র!

—রাইট! মগজাস্ত্র। কিন্তু এবার ভেবে দ্যাখ, প্রকৃতিদেবীর খেয়ালে না হয় আমাদের এই খুলির ভিতরকার বস্তুটা একটু বেশিই ভারি, যার জন্য আমরা আবার অন্যান্য প্রাণীদের মতো জন্ম-সাঁতারু নই, আমাদের শিখতে হয় এই ভারি মাথাটা কীভাবে জলের উপর ভাসিয়ে রাখা যায়— কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের ভাষা-দক্ষতার সম্পর্ক কী? এই নিয়ে অনেকরকম তত্ত্ব আছে। তোরা অ্যালফ্রেড ওয়ালেসের নাম শুনেছিস?

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে আমাদের নিরুত্তর মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার প্রশ্ন করল, চার্লস ডারউইনের নাম তো শুনেছিস আশাকরি।

এটা কমন পড়েছে। তিনজনেই একসঙ্গে বেজায় মাথা নেড়ে সায় দিলাম। জয়দা আবার বলতে থাকল, ওয়ালেস আর ডারউইন দুজনে যাকে বলে সহকর্মী— মানে, একসঙ্গে আপিসে বসে কাজ করেননি, কিন্তু একই বিষয়ের উপর গবেষণা করে গেছেন। সেটা হল, বিবর্তনবাদ। ওয়ালেস কিছুটা জুনিয়র ছিলেন ডারউইনের থেকে। নিজের গবেষণালব্ধ কাজকর্ম প্রায়শই ডারউইনকে দিয়ে একবার দেখিয়ে নিতেন প্রকাশ করার আগে। এই ওয়ালেস সাহেব একদিন ডারউইনকে লেখা এক চিঠিতে লিখলেন যে, দাদা, আমরা যে এই বিবর্তনবাদের প্রচার করছি, কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। এই যে আমাদের মুখের ভাষা, যা দিয়ে এত জ্ঞান বিতরণ করে বেড়াচ্ছি, চিঠি লিখছি, গবেষণাপত্র লিখছি, সাহিত্য-টাহিত্যও গাদাগুচ্ছের লেখা হচ্ছে, এই ভাষার উৎপত্তি হল কীভাবে? আমাদের বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে ভাষার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা আমার মতে সম্ভব নয়। ভেবে দেখুন, মানুষ হিসাবে যে লড়াই লড়ে আমরা প্রাকৃতিকভাবে আমাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছি, সেখানে ভাষার কোনও ভূমিকাই নেই। মুখে কথা না থাকলেও যা হত, থেকেও তাই হয়েছে। তাহলে এর উত্তর কী? ওয়ালেসের এই চিঠির উত্তরে ডারউইন সাহেব একটাই কথা লেখেন, I hope that you have not murdered too completely your own and my child. অর্থাৎ, তোমার এই চিন্তাভাবনা দিয়ে যাই করো, বাপু, শুধু আমার-তোমার সন্তানসম তত্ত্বটিকে হত্যা কোরো না। অতঃপর বৈজ্ঞানিক মহলে ওয়ালেসের এই উদ্বেগের বিষয়টার নামই হয়ে গেল, Wallace’s concern— ওয়ালেসের উদ্বেগ। পরবর্তীতে দেখা গেছে, ওয়ালেসের এই ধারণাটাই সম্ভবত সঠিক যে বাকি সমস্ত কিছুর মতো আমরা আমাদের মুখের ভাষা বিবর্তনের অংশ হিসাবে পাইনি। তার স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে।

একটানা অনেকটা বলে জয়দা দম নেওয়ার জন্য একটু থামল। বাইরে বেশ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে তখন। রবি রান্নাঘরে অনেকক্ষণ ধরে কীসব করছিল। ছ্যাঁকছোঁক শব্দের সঙ্গে বেশ মনোলোভা একটা সুঘ্রাণও নাকে আসছিল। শুভকে বললাম, দ্যাখ তো কী করছে লোকটা! খাবার-দাবারের ব্যাপারে শুভর উৎসাহ সর্বদাই বেশি। ফলে, আলস্য ত্যাগ করতে সময় লাগে না। উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

মঞ্জুশ্রী বলল, কিন্তু জয়দা বিবর্তনের মাধ্যমে না হলে এই অসাধারণ উপহারটা আমাদের দিল কে? যদি দেখো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও তো একটা পরিবর্তন হয়ে চলেছে। মানে সেই তিব্বতের গল্প বলার সময়ই বলেছিলে, আমার মনে আছে, কীভাবে প্রাচীন সংস্কৃত থেকে নানারকম পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রাকৃত, অবহঠট হয়ে বাংলার জন্ম হয়েছে। তারপরেও বাংলা কত বদলেছে— সেই মনসামঙ্গলের বাংলা বঙ্কিমি বাংলা হয়ে আজ একেবারে জেন জেডের জগাখিচুড়ি বাংলা। এটা কি বিবর্তন নয়?

—গুড কোশ্চেন, মাই লেডি। কিন্তু সেটা কি প্রাণীজ বিবর্তন না ভাষাতাত্ত্বিক পরিবর্তন? মানে, আমাদের জিভের বা বাকযন্ত্রের কি পরিবর্তন হয়েছে এর জন্য? নাকি শুধু ভাষাটাই বদলে গেছে?
—ভাষাটাই বদলেছে।
—মানুষ হোমো সেপিয়েন্স হয়েছে যবে থেকে তার আগে থেকেই আমাদের বাকযন্ত্র এই এতরকম শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষমতা লাভ করে ফেলেছে। নিয়েন্ডার্থাল মানুষের কথা ইশকুলে পড়েছিলিস, মনে আছে? সেই নিয়েন্ডার্থাল ম্যানদের বাকযন্ত্রও ফসিল পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে যথেষ্ট উন্নত ছিল। বৈজ্ঞানিকরা বলছেন যে এক লক্ষ বছর আগে আমাদের যে পূর্বপুরুষ থেকে আজকের এই মানবজাতির জন্ম তাদের এই আধুনিক ভাষার মতো জটিল শব্দরাজি উচ্চারণ করার ক্ষমতা বিন্দুমাত্র কম ছিল না। কিন্তু বলা কথার তো আর ফসিল হয় না! অতএব তারা ঠিক কীভাবে কথা বলত, তার স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ নেই। তাদের আঁকা ছবি, গয়না, ইত্যাদিতে প্রকাশিত ভাব দেখে অনুমান করা যায় যে তাদের মধ্যে অন্যান্য প্রাণীদের থেকে অনেক উন্নত একটা ভাষার আদানপ্রদানের চল ছিল এবং তা শুধু প্রয়োজন বা বিপদসঙ্কেত নয়, এই যে আমরা যেমন আগডুম বাগডুম গল্প করছি, তেমন সামাজিক কথাবার্তা বলতে ব্যবহৃত হত। আর এই সমাজ হল ভাষার উৎপত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া আর একটা বিষয়।

আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম কিছু একটা। কিন্তু একটা মনমাতানো গন্ধে প্রশ্নটা ভুলে গেলাম। রবি ঠাকুর দেখি প্লেটে করে গরম গরম বেগুনি নিয়ে চলে এসেছে, সঙ্গে শুভর হাতে একটা বড় ডেকচিতে আমতেল, পেঁয়াজ, চানাচুর দিয়ে জম্পেশ করে মাখামুড়ি। জয়দা তাই দেখে— জিতে রহো বেটা— বলে আশীর্বাদ করে চেয়ার থেকে নেমে মেঝেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পড়ল। আশীর্বাদটা কাকে করল বুঝতে পারলাম না— কিন্তু সেসব আর ভাবার সময় নেই।

এক গাল মুড়ি মুখে পুরে বেগুনিতে একটা কামড় দিয়ে শুভ জিজ্ঞেস করল, সমাজ-টমাজ কীসব বলছিলে?

জয়দা গরম বেগুনি মুখে ভরে আর মুখ বন্ধ করতে পারছিল না, হুশ হুশ করছিল। তার ফাঁক দিয়ে কোনওমতে বলল, বলছিলুম, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। তারপর বেগুনিটা কোনও রকমে গলাধঃকরণ করে আবার বলল, সেই কারণেই ভাষার উদ্ভব।

মঞ্জুশ্রী আমাদের সবার মুখের প্রশ্নটা নিজেই করে ফেলল, সে আবার কী? সে তো মৌমাছিও সমাজবদ্ধ জীব। তাদের ভাষা নেই কেন?

—খাসা! বেগুনি না মঞ্জুশ্রীর প্রশ্নকে কাকে বলল জানি না, বলেই চোখ বন্ধ করে বেগুনির স্বাদ নিতে নিতে জয়দা কেমন একটা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। আমরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, এমন সময় হঠাৎ আবার বলে উঠল, মানবসমাজের সবচেয়ে বড় গুণ কী জানিস? যেটা মৌমাছি কেন, অনেক পশু-পাখি-মাছ দলবদ্ধভাবে থাকে, কিন্তু তাদের মধ্যে সেই গুণটা নেই।
—কী? সমস্বরে প্রশ্নটা ফিরিয়ে দিলাম জয়দার দিকেই।
—পরের উপকার করা। নিঃস্বার্থভাবে। ইংরিজিতে যাকে বলে, আলট্রুইজম (Altruism)। এই জন্য ছেলেবেলাতে মা-বাবা মানুষ হতে বলে। অন্য অনেক প্রাণীই দেখবি সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। কিন্তু তাদের সেই সমাজবদ্ধতার মধ্যে একটা স্বার্থ থাকে। যেমন ধর, মৌমাছির কথাই বললি যখন, এই পুঁচকে পতঙ্গগুলো একসঙ্গে একটা সমাজ গঠন করে কেন থাকে? ভাব।
—কারণ ওখানে বিভিন্ন ধরনের মৌমাছি থাকে, যাদের আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে এই মৌমাছি-সমাজকে চালানোর জন্য।
—ঠিক। ওরা নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার জন্য অন্যকে সাহায্য করে। শ্রমিক মৌমাছির কাজ যেমন রানি মৌমাছি পারে না, তেমন উল্টোটাও সত্যি। আবার দ্যাখ মাছেদের মধ্যে। অনেক ছোট ছোট সামুদ্রিক মাছ আছে, যারা দল বেঁধে থাকে। ন্যাট জিও চ্যানেলে গভীর সমুদ্রের ভিডিও দেখলেই দেখা যায়।
—হ্যাঁ, আমি আন্দামানে গিয়ে স্নর্কলিং করতে গিয়ে দেখেছি নিজের চোখে। হাজার হাজার মাছ ঝাঁক বেঁধে ঘুরছে। শুভ বলল।
—আচ্ছা! তবে তো জানিসই কেমন করে দল বেঁধে থাকে ওরা। কিন্তু কেন থাকে? এটাকে ইংরিজিতে বলে Shoaling— মানে আমাদের শোলমাছের ঝোল— সেই শোল না। ইংরেজি শোলিং-এর মানে হল পারস্পরিক কিছু লাভের জন্য দল বেঁধে থাকা। মাছেরা প্রথমত বড় খাদক মাছেদের থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য এটা করে। ঝাঁকের কই হয়ে থাকলে অন্যের পেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আর কী! আবার সবসময় সব্বাই চেষ্টা করে ঝাঁকের কেন্দ্রের কাছে থাকার। যাতে ধরা পড়ার প্রোব্যাবিলিটি সবচেয়ে কম হয়।
—এখানেও প্রোব্যাবিলিটি! বলেই ফেললাম আমি।
—হুঁ হুঁ বাওয়া। সেই কে একটা বলেছিল না, লাইফ ইজ আ স্কুল অফ প্রোব্যাবিলিটি! যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, সমস্ত প্রাণীরাই নিজেদের স্বার্থসন্ধানের জন্য দলে থাকে। কেউ খাবার পাবে বলে, কেউ বিপদের হাত থেকে বাঁচবে বলে, বা কেউ সন্তান উৎপাদনের জন্য। মানুষ কেবলমাত্র নিঃস্বার্থভাবে দিতে জানে। যার হাতেগরম উদাহরণ আমাদের সামনে— শ্রীমতী মঞ্জুশ্রী দেবী।
—এহ, পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজের মঞ্জু দেবীর কথা মনে পড়ে গেল।

শুভ ফুট কাটল। তাই শুনে মঞ্জুশ্রী ওর কান বা চুল কিছু একটা ধরার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু নাগালের বাইরে থাকায় মাফ করে দিল।

—শান্ত হয়ে বসো বাচ্চারা। গম্ভীরভাবে বলে জয়দা আবার বলতে শুরু করল, মঞ্জুশ্রী যেমন অসহায় বাচ্চাগুলোকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে। এতে ওর কী লাভ? না পায় পয়সা, না কেউ ওকে চেনে। তাও ও করছে। আবার ধর এই যে দেশ স্বাধীন করার জন্য এত বিপ্লবীরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা কী পেয়েছেন? কজনের আর নাম জানি আমরা? দশজনেরও না বোধহয়। এরকম গাদা গাদা উদাহরণ ছড়িয়ে আছে আমাদের মানবসমাজে। তবে মজার ব্যাপার কী জানিস? বিবর্তনবাদ বলছে, তুমি যত স্বার্থপর হবে, তোমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা তত বেশি হবে! নিঃস্বার্থ কাজকে প্রকৃতিও পাত্তা দেয় না!
—সে কী কথা! কী অন্যায়! এমন কেন? মঞ্জুশ্রীর প্রায় ভগ্নহৃদয় অবস্থা।
—এতকাল কর্পোরেটে কাজ করে কি সন্দেহ আছে তাতে? জয়দার হয়ে আমিই বললাম এবার।

জয়দা বলল, যাই হোক, আমাদের মূল আলোচনায় ফেরত আসি, যার জন্য এত কথা। মানুষ ভাষা কেন পেল? দৃষ্টিশক্তি বা ঘ্রাণশক্তি কারও ভালো হলে বেঁচে থাকার সুবিধা হয়, মানে যদি আদিম যুগের মানুষদের কথা ধরিস, যার দৃষ্টিশক্তি ভালো, সে চট করে গাছের ফল দেখতে পাবে সকলের আগে, বা বিপদকে লক্ষ্য করতে পারবে। ঘ্রাণেও তাই। এটা শরীরের বাকি সমস্ত অঙ্গের ক্ষমতার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু বাকশক্তি দিয়ে নিজের কী উপকার হয়? কথা বলার প্রয়োজনীয়তা তখনই হয়, যখন একের বেশি মানুষ একসঙ্গে আছে। মানে তোরা আছিস বলেই আমি এত বকবক করছি। নইলে সোফায় শুয়ে বই পড়তাম। অতএব ভাষার প্রয়োজনীয়তা আসে দলের প্রয়োজনে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীরা কিছু নির্দিষ্ট শব্দ করে একে অপরকে বিপদ থেকে সাবধান বা খাবারের সন্ধান দিচ্ছে, মানুষের কেন এত লক্ষ লক্ষ শব্দের দরকার পড়ল? সেইখানে এই পরোপকারের ভূমিকা আছে। ওই যে মগজাস্ত্রের কথা বলছিলিস না? সেই মগজ শুধু অস্ত্র হিসাবে কাজে আসে তা তো নয়, মানুষকে দিয়ে অন্য মানুষের সাহায্য করাতেও চায়। আর স্বাভাবিকতার সঙ্গে সেই অন্যকে সাহায্য করার প্রবণতাটা আমাদের জিনের মধ্যে আত্মীকৃত হয়ে গেছে অনেক যুগ আগেই। আমরা যেমন একটা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করলে অন্যকে জানাতে চাই, আদিম মানুষও আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে তেমনটাই চাইত। নইলে একটা লোকই কেবলমাত্র চাকা বানাতে পারত বা আগুন জ্বালতে পারত অথবা পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে পারত। স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগত ক্ষমতার বাইরে এই যা সমস্ত বিশেষ পারদর্শিতা তা অন্যকে শেখানোর জন্য প্রয়োজন একটা বাক্যালাপের মাধ্যম। আর তাই এই জ্ঞান বিতরণের মাধ্যম হিসাবে জন্ম হয়েছে আমাদের কথ্য ভাষার। তবে খুব ইন্টারেস্টিং আর একটা বিষয় কি জানিস? রবিন ডানবার (Robin Dunbar) নামে এক নৃতত্ত্ববিদ একটা পরীক্ষা চালান— তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এটা জানা যে মানুষ কোন বিষয়ে সবচাইতে বেশি কথা বলে, বা, নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ করে? সেটা কী জানিস?

জয়দা প্রশ্ন করে হাসি হাসি মুখে আমাদের দিকে তাকাল।

—পড়াশোনা? আমি বললাম। জয়দা মাথা নেড়ে বাতিল করে দিল।
—পলিটিক্যাল বক্তৃতা? মঞ্জুশ্রী এক কাঠি এগিয়ে বলল।

সেটাও নাকচ করে দিয়ে জয়দা বলল, কূটকচালি— মানে, ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি, গসিপ।

—অ্যাঁ?
—নইলে আর বলছি কী! ডানবারের পরীক্ষা অনুযায়ী সত্তর শতাংশ কথাবার্তার বিষয়ই হচ্ছে সব পরনিন্দা আর পরচর্চা। কার বাড়িতে কী হয়েছে, কে আপিসে গিয়ে পরকীয়া করছে— এইসব হাবিজাবি। আর ডানবার সাহেবের মতে আদিম যুগ থেকে মানুষের ভাষা এত উন্নত হওয়ার পিছনে প্রধান ভূমিকাই হল এই গসিপ-এর। এমন মুচমুচে বেগুনির মতো গরম গরম খবর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গুছিয়ে শেয়ার না করতে পারলে মন ভরে?

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...