ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে— পর্ব ৮ (শেষাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

চার.

বেরোবার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে কাকিমা বলেছিল আছিস কদিন?

রেখা নিজের ঘর থেকে বেরোয়নি। মাধুরী ছলছলে চোখে বলেছিল, বেরোতে চায় না রে। তাও তো গত ছ-মাসে লেখার চাপে বাইরে পা রেখেছে। অবরে সবরে। কী যে করি মেয়েটাকে নিয়ে। তুই যে এলি, কী ভালো যে লাগছে। সেই দুর্গাপুরের দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল।

—আমি তো আছি কাকিমা, আবার আসব।

শুনেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল মাধুরীর মুখ। ইস, তুই কাল এলে আরও ভাল হত, আমি সত্যনারায়ণের পুজো রেখেছি। আসবি?

একটুও ইতস্তত না করে হীরক বলেছিল, একদম। সিন্নি করবে তো?

আজ আসার পরে সেই কথা শুনে রেখা হেসে অস্থির, তুই এখনও এত বড় ছোঁচা হীরু?

হাসি আর রেখা এক জায়গায় মেলে না এমন। কত যুগ। সেটা দেখে মাধুরীর মুখ লটারি পাওয়ার আনন্দে ঝলমল করে উঠল। আমার ছোঁচা ছেলেই ভাল। আজ তাহলে তুইও আয় না রেখা পুজোর ঘরে। জানিস তো হীরু, আমার ভগবানের উপর রাগ করে রেখা ঠাকুরঘরে আসাই ছেড়ে দিয়েছে।

কথাটা গম্ভীর দিকে চলে যেতে পারে ভেবে হীরক তাড়াতড়ি বলল, ছোঁচা শব্দটা ভুলে গেছিলাম রে রেখা, এমন কত শব্দই জীবন থেকে মুছে গেছে। তেমনি সিন্নি খাওয়াও। আয় আজ একসঙ্গে বসে সিন্নি খাব।

রেখাদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজোর দিনগুলোর স্মৃতি উজিয়ে উঠছিল হীরকের মনে। হলদেরঙা সেই ছবিতে ফুলকাটা ফ্রক পরা রেখা মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে প্রসাদ বিলির ব্যবস্থা করছে। ফুল, ধূপের গন্ধের স্নিগ্ধতার মাঝখানে নিবিষ্ট যেন সাক্ষাৎ দেবীরূপ। অন্তত হীরকের কাছে। ঝন্টু, তোতন ওরা সবাই তখন হুটোপাটি করছে হয়ত। হীরক ওদের সঙ্গে না গিয়ে ওখানেই বসে থাকত অনেক সময়ে। রেখা খুশি হয়ে বলত, কী চাই বল, নাড়ু খাবি? দাঁড়া! বলে ডিঙ্গি মেরে নৈবেদ্যর মাথা থেকে নাড়ু নামিয়ে দিত হীরকের হাতে। সত্যি কী চাই সেটা বোঝার বয়স তখনও হীরকের হয়নি।

পূজার আয়োজন করতে মাধুরী চলে গেছিল। রেখা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল হীরকের দিকে।

—কী দেখছিস অমন করে? আজ হীরু অনেক সহজ, কিন্তু রেখা যখন ওর একটা রয়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকে, না থাকা চোখটা হীরকের গলা জাপটে ধরে।
—তুই আজ আবার আসবি ভাবতে পারিনি।
—ভাবলি একবার বুড়িছোঁয়া করেই পালিয়ে যাব?
—আমি তো একটা ডানাভাঙা পাখি হীরু, আমার তো ওড়ার কোনও আকাশ নেই আর। কেন আসবি বারবার? কোন ভরসায় আশা করব?

রেখার গলায় কি অনুযোগ, না কি নেহাতই বিহ্বলতা? রেখার গলার চড়াই-উৎরাই ধরে চলতে চলতে মনের কথা পড়ার চেষ্টা করছিল হীরক।

—পাখির কথায় মনে পড়ল রেখা। তোদের বাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে একটা মুনিয়াপাখি মুখ থুবড়ে পড়েছিল? মনে আছে?
—কতদিনের কথা তোর মনেও থাকে বাবা? রেখার গলায় ফেলে আসা দিনের সুরের খেলাটা হীরকের কান এড়ায়নি।
—মনের মধ্যে কোন টঙে তুলে রাখা ছিল। তোর কথাটা আঁকশির কাজ করল। তুই আর লেখি পাখিটার কষ্টে কেঁদেকেটে একশা।
—হ্যাঁ, আর এত নিষ্ঠুর একটা ছেলে তুই, বললি আমরা দুই বোন নাকি ন্যাকামি করছি। এত বদমাশ, বললি নাকি মুনিয়াপাখির মাংস খেতে দারুণ।
—সেটা তো ইয়ারকি ছিল। তারপর কাকিমার কাছ থেকে হলুদবাটা নিয়ে লেপে দিলাম যে ওর ভাঙা ডানায়? ন্যাকড়া দিয়ে ব্যান্ডেজ। কে করেছিল সেসব, ভুলে গেলি?
—পাখিটা কেমন করুণ চোখে তাকিয়েছিল তখন হীরক, কিন্তু একটুও ছটফট করছিল না। বলতে বলতে আবছা হয়ে গেছিল রেখার গলা। জানলার আলসেতে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু কদিন বাদে আর ছিল না পাখিটা ওখানে।
—তখন আবার তোর সে কী ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না।
—কে জানে উড়ে গেছিল, না বিড়ালে নিল।
—ধ্যাত বিড়াল নিলে পালক পড়ে থাকত। তোর কথায় আমি জানালা বেয়ে উঠে আলসেতে দেখেছিলাম, সেরকম কিছু ছিল না। খারাপটা কেন ভাববি, ভালোটা ভাবতে পারিস না?
—সেদিনও তুই এরকম কিছু বলেছিলি হীরক। তখন তবু সহজে ভালোটা ভেবে নিতে পারতাম। এখন আর পারি না। আবার বিষাদের রাংতা জড়িয়ে গেল রেখার কথায়।
—চাইলেই পারবি রেখা, সব তোর মনের কাছে।
—যার সব আশার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, সেই মানুষ চাইতে ভুলে যায় হীরু।
—জীবনের কাছে চাইতে ভুলে যাওয়া মানে স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া রে রেখা। স্বপ্নই তো আমাদের বেঁচে থাকার পুঁজি।

কথাগুলো খুব ভারি। রেখা মনের দরজাটা একটু বাদে বাদে সপাটে বন্ধ করে দিচ্ছিল। হীরক ফিরে ফিরে ঠকঠক করছিল খোলার জন্য। বাদামী মলাটে ঝকমকে বই মুড়ে নেওয়ার মতো জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ গুটিয়ে নেওয়া মেয়েকে জাগানো কি সোজা! হীরক আশা হারাচ্ছিল। ভাগ্যিস মাধুরী ডাক দিল। আয় তোরা, আমার পাঁচালি পড়া হয়ে গেছে।

ভিতরের বারান্দা দিয়ে রেখাকে নিয়ে ঠাকুরঘরে যাওয়ার সময়ে রতনের সঙ্গে দেখা। ইজিচেয়ারে এলিয়ে ছিল। দেখে একটু অবাক হয়েছিল হীরক। বয়সটা যেন খুব তাড়তাড়ি বেড়ে গেছে কাকুর। মাথার চুল সব সাদা, মুখেও অনেক ভাংচুর। বিমলের চেয়ে এমন কিছু বড় কি? দেখতে মনে হচ্ছে অন্তত দশ বছর এগিয়ে গেছে বয়সে। হীরককে দেখে নড়েচড়ে বসল রতন। মাধুরী তোর কথা বলেছিল। ভাল আছিস তো? থাকবি কদিন? বাবা মা ভালো তো?

ওই পর্যন্তই, রুটিনমাফিক কথাগুলো ছুড়ে ইজিচেয়ারের হেলানে ফিরে গেল রতন। হীরকের মনে হল এই বাড়িতে ধংসস্তূপ একটা নয়।

ঠাকুরঘরে মাধুরী সিন্নি মাখছিল। হীরক একটা মোড়া টেনে বসল, রেখা মাটিতে হাঁটুর উপর থুতনি। সবুজ কলকা নাইটিটা একটু উঠে গেছে। অক্ষত পায়ের পাতায় রেখার সব সৌন্দর্য এসে জমা হয়েছে যেন।

তখনই কথাটা বলেছিল হীরক। একটা জায়গায় যাবি আমার সঙ্গে?

—কোথায়? আমি তো কোথাও যাই না হীরু। আজ হঠাৎ কেন যেতে যাব?

রেখার অন্তর্ভেদী দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে হীরক বলল, পুজোর ঘরেও তো আসতি না শুনলাম। নিয়ম ভাঙার খেলাটা শুরু করেছিস যখন, মাঝপথে ছেড়ে দিলে লোকে দুয়ো দেবে।

মাধুরী অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, ছেলেটা বারবার বলছে, একবার ঘুরে আয় না মা।

—কোথায় সেটাও তো জানি না মা।
—তোর শানুকে মনে আছে রেখা?

শুনেই শিন্নি মাখতে মাখতে মাধুরীর হাত এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছিল। তারপর আবার আটা আর দুধের মধ্যে নৈবেদ্যর ফল মাখা হাত চলতে শুরু করেছিল।

রেখা কোনও উত্তর না দিয়ে দাঁতে নখ কাটছিল। নিশ্চয় মনে আছে রেখার। এইসব মনে রাখা নিয়েই তো দিনগুলো ভরিয়ে রাখে।

—কদিন আগে শানুর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম। কত দুঃখের দিন গেছে শানুর, তার কিছুটা তুই দেখেছিস। কিন্তু সবটা নয়। এবার শানুকে দেখে এত ভালো লাগল। যেন সেই ডানাভাঙা মুনিয়াপাখিটা। ডানা জুড়ে গিয়ে বাতাস কাটছে আবার।
—কেন আবার কী হয়েছিল শানুর?

ওরা তো শানুর কোনও কথা শোনেনি। মাধুরীর সামনে শানুর বাবাকে মারার ঘটনাটা বলতে চাইল না হীরক। বলল, ভালো কিছু তো হয়নি ছেলেটার। তবুও, সেদিন যখন আমাকে জড়িয়ে ধরল, ওর শরীর থেকে আমি আনন্দের ঘ্রাণ পেলাম।

হঠাৎ একটা ওঁক তুলে রেখা এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কী হল, কী হল রেখা? থতমত খেয়ে হীরক কী করবে বুঝতে না পেরে মাধুরীর দিকে তাকিয়েছিল। এই তো ভালো কথা হচ্ছিল, আবার এখুনি এমন ছুটে পালিয়ে গেল! শানুর কথা তুলে কিছু ভুল করল কি?

হীরক যখন রেখার ঘরে গেল, বিছানায় শুয়ে মেয়েটা ফুলে ফুলে কাঁদছে। পাশে বসে কাঁধে হাত রাখল হীরক। কী হল রেখা, আমি কিছু ভুল বললাম?

গলায় শব্দ আটকে ঘনঘন মাথা নাড়ল রেখা।

—তবে?

রেখার কান্না থামতে একটু সময় লাগল। যখন কথা বলল, তখন সেই কথার পরতে পরতে কান্না জড়িয়ে ছিল। আমার ওই ঘটনাটার পর শরীরের অনেকটা জ্বলে গিয়েছিল তো, কি বিশ্রী পোড়া গন্ধ পেতাম নিজের শরীর থেকে। মাংসপোড়া গন্ধ। এখনও পাই, সেই তীব্র গন্ধ থেকে পালাতে চাই রে। অন্তত আর কেউ সেই গন্ধ পাক, চাই না।

—রেখা, এই সব তোর মনের মধ্যে, আসল সত্যি সেরকম হয় নাকি? এই তো আমি তোর সামনে বসে আছি, এত কাছে, কই আমি তো কোনও গন্ধ পাচ্ছি না।
—শরীর থেকে কতটা গেছে জানি না, মনের থেকে সেই গন্ধটা তাড়াতে পারি না।

রেখার দুই কাঁধ ধরে উঠে বসিয়ে দিল হীরক। এখন রেখার মুখটা একদম তার মুখের কাছাকাছি। সুন্দর তো বলা যাবে না, কিন্তু কোনও বীভতসতাও অনুভব করছিল না হীরক। রেখা তার এক চোখ দিয়ে হীরকের দুই চোখ ধারণ করে রেখেছিল। ধীরে ধীরে সেই চোখের কোল জলে ভরে গেল আবার। খুব ধীরে রেখা ওর মাথাটা হীরকের কাঁধ আর বুকের মাঝখানে রাখল। সন্তর্পণে, সঙ্কোচভরে। হীরক তার সমস্ত ভালোবাসাকে জড়ো করে দুই হাতে রেখার পিঠে বেড় দিয়ে মাথাটাকে আরও জোরে বুকে চেপে ধরল। এখন রেখার চোখ দু-কূলভাঙা নদীর মতো। সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে হীরকের দুই হাতের মাঝখানে। গোঙাচ্ছিল রেখা। হীরকের কানে মনে হল রেখার গলায় তুই কেন এলি কথাটা আস্তে আস্তে তুই কেন আগে এলি না হয়ে গেল। ঠিক যেমন ছোটবেলায় মরা মরা বলতে বলতে রাম রাম হয়ে যেত।

রেখা যেতে রাজি হয়েছিল। যদিও প্রশ্ন করেছিল, কী লাভ? শানু কি চিনতে পারবে? কিংবা চিনতে পারলেও তাতে শানুর কি কিছু লাভ আছে? রেখারই বা কী লাভ? লাভক্ষতির সেই হিসেব থেকে রেখাকে বের করতে পেরেছিল হীরক। ঘরের বাইরে, জীবনের দোরগোড়ায়।

সারাদিনের জন্য একটা জিপ ভাড়া করেছিল। হুড খোলা। মুখে বাতাসের ঝাপটা এসে পড়ছে। অর্ধেক কথা খেয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।

রেখা প্রথমে রাজী হয়নি এভাবে যেতে। কেন মাথাখোলা গাড়ি নিয়েছিস এমন? মনে হয় বলতে চাইছিস, পৃথিবী আমাদের দেখো।

—খারাপ কিসে সেটা?
—ইটচাপা ঘাসে রোদ লাগাচ্ছিস?
—আমি এখন যে দেশে থাকি, সেটাই করে লোকে। গরম পড়ল কি পড়ল না, ফ্যাকাশে চামড়ায় রোদ শুষে নেওয়ার জন্য যেখানেই এক চিলতে রোদ পায় তোয়ালে বিছিয়ে চিত হয়ে শুতে পড়ে। পুড়ে ঝামা হয় মনের খুশিতে।
—আমি কি যথেষ্ট পুড়িনি এই জীবনে?

আগের দিন হলেও এই কথায় থমকে যেত হীরক। পুড়েছিস রেখা। ভিতরে, বাইরে। কিন্তু ঘা শোকায়নি। ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে হামেশাই হাঁটু ছড়ে যেত। প্রথম ক-দিন ব্যান্ডেজ বেঁধে ঘুরতাম, কিন্তু তারপরে খোলা ছেড়ে দিতাম। না হলে ঘা শোকাত না, ভিতরে পুঁজ জমত।

—জানিস হীরু, একসময় আমি রাস্তা দিয়ে গেলে অনেকের ঘাড় ঘুরে যেত, এখন ভুল করেও আমার দিকে চাইলে ঝটিতি চোখ সরিয়ে নেয়।
—জানলি কী করে? তুই তো বাড়ি থেকেই বেরোসনি এত বছর।
—জানি আমি।

রেখার জানাটা হাওয়া কেড়ে নিয়ে চলে গেল ঝরা পাতার মতো। চোখেমুখে বাতাসের ঝাপটা এসে পড়ছে, কতদিন যেন পৃথিবীর সঙ্গে এমন সম্পর্ক জোড়েনি রেখা। একটা দেওয়াল ভাঙছিল কোথাও। সেটা হীরক বুঝতে পারল যখন রেখা এই প্রথম হীরকের বিষয়ে জিজ্ঞেস করল, তোর কথা কিছু বলছিস না হীরু একদম। তোর ওই দেশের জীবন নিয়ে কিছু বল না।

হীরক জানে এই প্রশ্নটা করতে সাহস লাগে। হীরকের গত দশ বছরের জীবন রেখার হতে পারত, হতে যাচ্ছিল। সেই জীবনের কথা শুনে কিছু হারানোর বেদনা পাওয়া রেখার জন্য অস্বাভাবিক হবে না। হীরক সেই সময়টাকে খুব তাচ্ছিল্য করে শোনাতে পারে। কিন্তু সেটা অনেক সময়েই উল্টো বিপদ ঘটায়। ছোটবেলায় ষষ্ঠীর রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল হীরক। আসলে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ছোট বলে। রূপা বাবার সঙ্গে যাত্রা দেখে এসেছিল মধ্যরাত অবধি। বর্গি এল দেশে। যখনই হীরক ঠোঁট ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কেমন হয়েছিল রে যাত্রাটা? রূপা হাতের পাতা উল্টিয়ে বলেছে, ধুস, শুধু শুধু রাতের ঘুম নষ্ট! যায় নাকি কেউ এত বাজে যাত্রা দেখতে। সেই মিথ্যাটা আরও বেশি বুকে বেজেছে হীরকের। এর চেয়ে রূপা যদি ওর কথায় যুদ্ধের দামামা বাজার শব্দ টেনে আনতে পারত, কষ্ট পেলেও হীরক নিজেকে বাঁশের ছাউনির খুঁটি আঁকড়ে দেখতে পেত কোনও কোনায়।

সেই বিশ্বাসে ভর করে আজ হীরক বলল, ও-দেশে গিয়ে আমার একটা নদী হয়েছে জানিস?

—আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে?
—একদম সেইরকম। নদীর নাম হুরন। যার উপর দিয়ে প্রথম গ্রীষ্মে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হওয়া যায়, বর্ষায় পানসি বাওয়া যায় আর শীতকালে বরফ হয়ে যাওয়া সেই জলের দুধারে দাঁড়িয়ে থাকা পাকাচুলো গাছগুলোর সঙ্গে আড়ি আড়ি বলে গাড়ি নিয়ে কোনওমতে পালিয়ে যেতে হয়।
—নিজের একটা নদী আছে বুঝলাম। নিজের একটা বউও তো আছে তোর। তোর বউয়ের নাম কী রে হীরু?
—মঞ্জিনি।
—তুই আর মঞ্জিনি একসঙ্গে নৌকা বেয়ে চলিস ওই নদীতে?
—গেছি কখনও, অনেকদিন যাওয়া হয়নি।
—সেই নদীটাকেও এখন আমার মতো ভুলতে বসেছিস?
—তোকে আমি ভুলিনি কখনও রেখা। নদীকেও ভুলিনি। আমাদের অ্যান আরবার শহরের মাঝখানে একটা বটানিক্যাল গার্ডেন আছে, তার নাম নিকলস আরবোরেটাম। কিন্তু আমাদের হাওড়ার বটানিক্যাল গার্ডেনের মতন নয়। উঁচুনিচু টিলা, মাঝখান দিয়ে ছলছলাচ্ছে হুরন। সেই বাগানে কতরকমের যে গাছ রেখা। মেপল, সাদা পাইন, কাটাসুরা। খুব লম্বা সেইসব গাছ আর তাদের মাঝখান দিয়ে গুঁড়িপথ। আমি সেই গাছ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমার হুরনের কাছে পৌঁছে যাই হরদম। জল ছুঁয়ে বসে থাকি। ওই জলে নেমে দাঁড়িয়ে থাকি কখনও। পায়ের তলায় নুড়িপাথর। বয়ে যাওয়া জল পায়ে ঠোকর মারে ছোট মাছের মতো।
—দ্যাখ দ্যাখ হীরু, তোর কথা শুনে আমার কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

রেখা ডান হাত তুলে ধরেছিল হীরকের সামনে। গমরঙা হাতে বাদামি রোম নতুন চারার মতো মুখ বাড়িয়েছে। কবজি থেকে তালু একটু নেমে গেছে, তর্জনী একটু উঁচিয়ে, কড়ে আঙুল আরও। কে জানে কোনও নাচের মুদ্রা নাকি। হীরক সেই হাত আলগোছে ধরল নিজের দুই হাতের মধ্যে। রেখা কিন্তু ঝট করে সরিয়ে নিল হাত। তারপর অস্ফুটে বলল, হীরু তুই একা কেন যাস তোর নদীর কাছে? তুই কি সুখী নোস?

সুখ ব্যাপারটা কি? থাকে কোথায়? সেটা কি লেখার সেই সাতটা কাঠের পুতুলের মতো, একটার পর একটা খুলে খুলে ভিতরের পুতুলটা বের করতে হয়। হীরকেরও কি লেখার মতো সেই ভিতরের পুতুলটা হারিয়ে গেছে? রেখাই কি তার সেই ভিতরের পুতুল?

জিটি রোড দিয়ে ছুটছিল গাড়িটা। হীরকের মনে হল রেখা নিজের চারপাশে যে খড়ির গণ্ডি টেনে দিয়েছিল, খুব সাবধানে যেন তার বাইরে পা রাখছে। যে বাইরের জগতের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল, আজ সমস্ত দেহমন দিয়ে তাকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। প্রাণের সুর একসময় গলায় বসল। বাইরে চোখ রেখে গুনগুন করতে করতে একসময় গলা তুলল রেখা।

একটুকু ছোঁয়া লাগে
একটুকু কথা শুনি
তাই দিয়ে মনে মনে
রচি মম ফাল্গুনি।

শুনতে শুনতে হীরক ভাবছিল সে কিছু ভুল করছে না তো? এই যে এইভাবে রেখার কাছে ফিরে এসেছে, অন্য কোনও স্বপ্ন দেখিয়ে ফেলছে না তো মেয়েটাকে। রেখার পাশে না দাঁড়াতে পেরে জিনিকে পুরোটা কখনও দিতে পারেনি। নিজের বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পেয়ে জিনির কাছে ফিরে যেতে না পারলে আবার কি একটা ফাঁক হয়ে যাবে না কোথাও?

রেখার ডানহাতের আঙুলগুলো আলগোছে ছুঁয়ে ছিল হীরককে। ছুঁয়েই ছিল যতক্ষণ না ওরা বসিপোতা পৌঁছাল।

হীরকের একেকবার ইচ্ছে হয়েছিল রেখার আঙুলে আঙুল জড়িয়ে নেয়। কিন্তু ভালোবাসার সেই আশ্রয় কি আজ আর দিতে পারবে সে রেখাকে? ভালোবাসা একটা বাড়ির মতো। ফিরে তো আসা যায়, কিন্তু সেই বাড়িতে আর ঠাঁই পাতা যায় না। লেখার স্বপ্নের মতো সেই বাড়ির জানালা তখন চোখ, দরজা শ্বাস নেওয়ার নাক। তাকে ছুঁয়ে উষ্ণতা নিতে হয় অহরহ, কিন্তু দরজা পেরিয়ে ভিতরের ঘরে পৌঁছানো যায় না। পাবলো বলে, তুমি তোমার বাড়ি সারাজীবন বুকে নিয়ে ঘুরবে, কিন্তু সেই বাড়িতে আর ফিরতে পারবে না। তুমি সেখানে বাইরের লোক হয়ে গেছ। হীরক জানে সেও রেখার ভালোবাসা সারাজীবন বুকে নিয়ে ঘুরবে, কিন্তু সেই ভালোবাসার ঘরে আর বেঁচে থাকা হবে না।

তবু রেখার ভালোবাসার বন্ধ ঘরের কপাট খোলার কাজটা তাকেই করতে হবে। ওই ঘরটা যে তার জীবনের একটা চেনা গন্ধে জারানো অধ্যায়। বেঁচে থাকবার জিয়নকাঠি।

 

[শেষ]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5222 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...