নীহারকান্তি হাজরা
নদ-নদীর সঙ্গমভূমে
অধ্যায় ১: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮-ক। পর্ব ৮-খ
ক্ষেত থেকে রান্নাঘর: শাক-সবজি-ডাল
সেই সময়কার গ্রামে নদীর মাছ জুটত শরৎকাল পর্যন্ত। তবে বছরভর অন্তত মাসে একদিন বিভিন্ন পাড়ায় গাছের ডালে বেঁধে ছাগল কাটা হত। মুরগির মাংসের প্রশ্নটি ধর্মের দখলে ছিল। তবে বাইরে চাকুরি করা যুবক বা কলেজপড়ুয়ারা নদীর ধারে কোনও গাছের নিচে মুরগি বধ করে মাটির পাত্রে রান্না করে খাওয়ার কিছু চল ছিল। ভোজনশেষে অবশিষ্ট নদীগর্ভে দিতে হত।

এ-সময়টায় কেউ না কেউ ভুগত যক্ষায়। রোগটাকে বলত থাইসিস। রোগী আর পরিবার প্রায় একঘরে হয়ে যেত। এরা খেত অসুখ সারার নিদান হিসেবে
পায়রার মাংস। কিছু পরিবারে আবার বাদুড় খাওয়ার চল ছিল। মাছ ধরা ছাড়াও মল্লরা এই প্রাণীটার শিকারি ছিল, চলতি নামে মেটে। প্রশস্ত পথের দু-পাশে বড় বড় গাছে তারা আড়াআড়ি জাল ঝুলিয়ে দিত পর পর। শীতের রাতে শূন্যবিহারি বাদুড় আটকে যেত। এদের মুখটা ইঁদুরের মতো। ছোট ছোট দু-পাটি দাঁত। খাদকেরা বলত আরে শিউরে ওঠার কী আছে! ওরা কী খায় দেখ। কেবল ফলের রস— তাহলে?!
আর এই জাল ঝুলে গেলে বিপত্তিও ঘটত। মুখুজ্জেদের মণীন্দ্রবাবু, আমাদের ন-কাকা, সদরে ওকালতি সেরে নদী পার হয়ে ঘর ফেরার সময় তাঁর সাইকেল-সহ পড়ে গেলেন জালে। দুপাশের খুঁট ছিঁড়ে তিনি একবারে জালবন্দি হয়ে কুপোকাৎ। শেষে সিন্ধু মেটে তাঁকে জালমুক্ত করে। হাসছিল সিন্ধুখুড়া। জালবন্দি অবস্থায় ন-কাকা বাদুড়ের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করার শাসানি দিচ্ছিলেন।
স্কুলে যাওয়ার তাড়ায় এবং তার ঘটমান ভবিষ্যতের সাড়ে তিন কিলোমিটার অতিক্রম করার তাগাদায় ভাতের সময় হত সকাল নটায়। গরম ভাতে পাতে পড়ত গাওয়া ঘি। মুসুরডাল সেদ্ধ। এর পদ্ধতিটা ছিল একটা পরিষ্কার কাপড়ে মুসুরডালের পুঁটুলি ভাতের মধ্যে সেদ্ধ করা। তার মধ্যে ঘি। বেগুনভাজা। তার সময় না হলে একটা বড় পোস্তর বড়া। অথবা ঘি-চর্চিত আলু-মুসুর সেদ্ধ। আর এক বাটি দুধ। বিকেলে ফিরে অভাবের পূর্তি ঘটত। ভাত। দুপুরের বেগুন, বড়ি, নৈনিতাল আলু আর ডাঁটা মিলিয়ে একটা ঘন্ট। ছোট মাছের হাল্কা সরষের ঝাল। অবশ্যই বিরির খোসা সমেত এক বাটি ডাল। ভর সন্ধেয় এক বাটি দুধ। রাতে সবজি, দুধ আর ভাত।
বছরভর কৃষিভূমি আমাদের অন্ন এবং ব্যাঞ্জন দুইই জুগিয়ে চলত। সেখান থেকে খাবারপাতে গরমকাল জুড়ে যেটা জুটত, সেটা বাটি-ভর্তি কালো খোসাসুদ্ধ বিউলি— বিরি কলাইয়ের ডাল। বর্ষা শেষ হয়ে আসার মুখে ধানক্ষেতের আল ধরে ছড়ানো হত বিরি কলাই। আর হেমন্তের শেষে পরিপক্ক শুঁটির গাছগুলি চলে আসত খামারে। রৌদ্রপক্ক হত। তারপরে শীতের শেষে এর মাড়াই। এই নিতান্ত অবহেলার চিকনকালো ডালগুলি বেশ কিছু একমণি বস্তায় বন্দি হয়ে এখানে ওখানে দেয়াল-পিঠ হয়ে থাকত। আর মাঝেমধ্যে ডালের প্রয়োজনে মায়ের আদেশ ধরে পাই মেপে এটা বের হত ভাঙার জন্য। বাড়ির রান্নাঘরের একপাশে ছিল একটা জাঁতা। এটা এক ফুট ব্যাসের দুটো গোলাকার পাথর উপরে-নিচে চাপানো। তলার চাকতিটার ঠিক মধ্যের ফুটোয় শক্ত করে গোঁজা থাকত একটা গোলাকার কাঠের টুকরো। এটা উপরের গোলাকার পাথরের মাঝখানের ছিদ্রে ঢুকে যেত। উপরের অংশে ছিল দুটো গর্ত। একটা নিচের অংশটায় পৌঁছয়। অন্যটা সামান্য। কাঠি দিয়ে ঘোরানোর প্রয়োজনে। এবার একটা ফুটোয় এক মুঠো ডাল ঢেলে দিয়ে কাঠি দিয়ে চাকাটা ঘোরালেই ডালগুলি আধখানা হয়ে চারপাশে পড়ত।

এই ডাল রান্নায় একটু রসুন অপরিহার্য ছিল। কিন্তু মুগ আর মুসুর কেনা হত। তখন মুসুরের নাম ছিল খাড়িমুসুর। অনেক পরে জেনেছি এটা আসত শুকনোলঙ্কার সঙ্গে গুজরাতের খাঁড়ি অঞ্চল থেকে। বিরি কলাই বহুসাধক। ডালটা ভিজিয়ে নরম হলে এর খোসা তুলে বাটা হত শিল-নোড়ায়। তাপর একটা বড় জামবাটিতে তুলে এটা দম ধরে ফেটানো হত। ফেনার মতো হলে আঙুলের ডগায় তুলে ঝরে পড়লেই বোঝা গেল উত্তম পাক। এর পরে একটা বড় পরিষ্কার টিনের উপর তেল মাখিয়ে শ্রেণিবদ্ধ বড়ি। আবার এর শেষ পর্যায়ে খানিক পোস্ত মেখে কড়ে আঙুলের ডগার মাপে পোস্ত বড়ি।
এই সর্বসাধারণের একান্ত অবহেলার ডালটি পরের কুড়ি বছরের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। ছোটখাটো প্রাণীকুল, তার মধ্যে মাঠভর্তি ল্যাঠামাছের সঙ্গে এর অন্তর্ধান ঘটল প্রয়োজনের শস্যের পথ ধরে। অতঃপর পাঞ্জাব থেকে আসবে এই ডাল। বাজারের এক নম্বর দামে। আর বহুকাল ধরে দেখব আমাদের রান্নাঘরের বারান্দার এক কোণে এর স্মৃতি রয়ে গেল ঘোরানো জাঁতার পাথরে।
লাউ, লাউডাঁটা বা কুমড়োর তরকারি বছরভর চলত। শীতে শিম। এর কোনওটাই কিনতে হত না বা আমাদের ক্ষেতে ফলত না। খামারের একদিকে লাউয়ের মাচা তার সঙ্গে শিম বছরের বহু মাস ধরে বজায় থাকত। বেগুনি ফুলের নিচে পর্যাপ্ত শিম হত শীতে। জৈব সারপুষ্ট পল্লবিত নধর লাউডগার নিচে ঝুলে থাকত নরম চিকন পূর্ণরোম সবুজ লাউ। আর হত মাচায় ঝিঙে। এর সুগন্ধি হলুদ রঙের ফুলগুলি বিকেলে ফুটে সুগন্ধ ছড়িয়ে দিত। আর একটা হেলাফেলার শাক হত খামারে মাচায়— পুঁই। এর পুরু পাতাগুলি বেসন-বড়ার উপকরণ। শীতের শেষে পাতার কোনায় গুচ্ছ ছোট ফল। পাকলে হত গাঢ় বেগুনি। এগুলি হালকা সরষে দিয়ে রান্না। বীজগুলি ভাঙত মুড় মুড় করে। কুমড়োর ফলন হত বাড়ির চালার উপরে। কুমড়োগুলির ওজন হত দশ সের বা আরও বেশি। সংখ্যায় পনেরো-কুড়িটা। চালায় এগুলি পরিপক্ক হত। ভেতরটা প্রগাঢ় গেরুয়া। চৈত্র মাসে গাছগুলি মরে গেলে এগুলি সংগ্রহ করা হত। নাম চৈতালি কুমড়ো। বহু মাস এগুলি খাদ্য হত। পরিমাণমতো কেটে খেলেও বাকি অংশে এর কখনও পচন ধরত না। এর বীজগুলির কিছু গাছের জন্য শুকিয়ে রেখে বাকিগুলি মুড়িভাজার সময় নুন মাখিয়ে ভাজানো হত। পুরুষফুলগুলি তুলে সবজিতে যেত। বা অবসরে বেসনে ডুবিয়ে সরষের তেলে ভাজা। মাঠে এক ধরনের ছোট ঝিঙের চাষ হত। চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। নাম কাদা ঝিঙে। আর উচ্ছের চাষ হত। তখন মাঠে মাচা করে চাষের চল ছিল না।

বাড়িতে ডিমের প্রচলন তেমন ছিল না। তবে একটা সময় পোষা হাঁসের ডিম পাওয়া যেত। এগুলি পিতামাতা কদাপি খেতেন না। বড় মাছ আমার সেই জন্ম-জনপদে নিত্য জুটত। কুসুমমাসি মাটির বারান্দার একপাশে ঝুড়িভর্তি মাছ নিয়ে আসত। পছন্দের মাছটি কেটে দিত। এটা নিত্য ঘটত। কিন্তু এখানে সদরের মাছবাজার থেকে বড় মাছ আনার চল ছিল না। মাংস মাসে একবার হত। পাড়ার কোথাও ছাগল কাটার আগে খবর দিয়ে চাহিদার পরিমাণও জেনে যেত। মা এটি খেতেন না। শীতের দিনে সবজি ফলত নানা ধরনের। মাঠ থেকেই তুলে আনা হত মুলো, বেগুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি, পালং, লাল ডাঁটা। গৃহস্থের বড় একটা ঘন্টের প্রয়োজনে পাওয়া যেত আলতি। ভদ্রজনেরা এটাকে বলেন গাঁঠিকচু। এই ফসলটি সারি দিয়ে লাগানো হত আলের ধারে। অতএব আলতি। গলা কাটত না। আর একটি বিখ্যাত কচু মিলত। তার নাম সার (সার+অ)। এটি হাতখানিক মাটির গভীরে চলে যেত। ওজন হত দু-আড়াই সের। এর উপরের মাথার দিকটি ভাতে সেদ্ধ করার পর মাখনের মতো হত। আর বাকিটা হত গরম মশলা দিয়ে ডালনা। এই অঞ্চলের এই কচুটির এতই প্রসিদ্ধি ছিল যে আত্মীয়স্বজনেরা এটি চেয়ে পাঠাতেন: আসিবার সময় অবশ্যই বেশ কিছু সার আনিতে ভুলিবেন না। এর মাথার উপরে শাকের মাঝের ডাঁটার নাম ছিল আঞ্জা ডাঁটা। এর ব্যুৎপত্তির হদিশ পাইনি। এটির স্বাদের তুলনা ছিল না। বড়দি বাড়ি এলে এখান থেকেই সংগ্রহ করত সরষে আর মটরশাক। এই গ্রামের পিছনে নদীর তীর ধরে গ্রামগুলোতে পর্যাপ্ত সবজির চাষ হত। ভোরবেলা ঝাঁকাভর্তি সবজি নিয়ে তারা নদী পার হয়ে যেত সদরে। আজ মনে করে বলতে হচ্ছে এগুলি সবই সরষের খোল আর গোবরসারের ফসল। অন্য কোনও সার ছিল না। এ-সময়টাতে একমাত্র আলু ছিল সুস্বাদু নৈনিতাল আলু। বাঁকুড়া জংশনের মাল শেডে নামত ওয়াগন বোঝাই। বহু পরে আমদানি হত গয়ার লাল গোল আলু। তারপর নতুনগঞ্জের আড়তে। খুচরো মাল এখান থেকেই তুলত ছোট ব্যবসায়ীরা। জেলায় তখন আলুর চাষের তেমন চল হয়নি। আমার লখনউ প্রবাসী মাতুল জ্যেষ্ঠ, এক ব্যাগ নৈনিতাল আলুর বীজ আর দেরাদুনের বাসমতী ধানবীজ উপহার দিয়েছিলেন পিতৃদেবকে। শালডাঙায় এ দুটোরই চাষ করেছিল পচাই মন্ডল। এই লোকটির নিবাস ছিল এই জমিটার থেকে পিছনের দিকে কোসঠা গ্রামে। শ্রেণিবদ্ধ দাঁড়াগুলির উপরে আলুগাছ আমার এই প্রথম দেখা। গরমের সঙ্গে গাছগুলি মরে আসে। ফলন তখন তৈরি। একদিন সকালে গিয়ে দেখা গেল প্রায় সিকি জমির ফসল রাত্রেই কেউ খুঁড়ে নিয়ে গেছে। বুঝতে অসুবিধে হয়নি এ কাজটি কার। স্বয়ং পচাই তার পনেরো নম্বর পায়ের ছাপগুলি তুলে নিয়ে যেতে ভুলেছিল। এই আলুগুলি যখন গরুর গাড়ির সওয়ার হয়ে ঘরে এল, তাদের ফরসা স্বচ্ছ মসৃণ ত্বকের বাহার ঘরে আলো এনে দিলে। আর পরের বর্ষায় পচাই চাষ করেছিল দেরাদুন বাসমতীর। চমৎকার ধানগাছ জুড়ে ফুলও এসেছিল। তারপরে হলুদ বর্ণ নিয়ে গাছগুলি শুকিয়ে গেল। এই জমি, এই জলবায়ু তার উপযুক্ত ছিল না। এসব কথা সত্তর বছর পরে লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে এখনকার মানুষেরা কখনও কোনওদিন কোনও ফসলের স্বাদ পায়নি। তারা কখনও দেখলে না যে বেগুন ভাজলে বেগুন থেকে তেল বেরোয়। পেঁয়াজকলিটাও তেলতেলে।

ফেমাস চা
কেরানি বাজারে ফেমাস হোটেল খুব বিখ্যাত ছিল। এর নিচের তলায় ছিল একটা দেওয়ালজোড়া দার্জিলিংয়ের ছবি। এখানে বিক্রি হত সুগন্ধি চা। দু-আনা কাপ। এর সঙ্গেই বিক্রি হত চায়ের পাতা। ফেমাস হোটেলে থাকার ঘরও মিলত। এখানে একটি পুরো মিলের দাম ছিল বারো আনা। মাছ, তরকারি, ডাল, ভাজা, চাটনি আর পেটভরা ভাত। সবই দরকারমতো পাওয়া যেত ওই দামে।

চায়ের কথা বলতেই পিতৃদেবের কথা মনে পড়ে গেল। চা প্রচলিত হওয়ার প্রথমদিকের ইতিহাস। তিনি সে সময় ওয়েসলিয়ান মিশনারি স্কুলের ছাত্র। এই সময় শহরের দু-এক জায়গায় সকালে এবং বিকেলে সাহেবরা তৈরি চা রাস্তার ধারে পথচারীদের পান করতে দিতেন। প্রথমে বিষয়টাতে ভয় ছিল। নেশা হয়ে যাওয়ার ভয়। আবার ধর্মের ভয়ও ছিল। এ সব কাটিয়ে তোলার জন্য বেশ কয়েক মাস এরকম বিনি পয়সায় চা বিতরণ করা হত। তার পরে এক সময় চায়ের পাতা বিক্রির আয়োজন হয়েছিল। সঙ্গে প্রস্তুত করার পদ্ধতি।

ফলের দোকানগুলিও ছিল কেরানি বাজারে। ডাব রোগীর পথ্য, আসত বাইরে থেকে। আপেল আর আঙুর ভূগোলের পাতায় কেবল পাওয়া যেত। কলাও আসত বাইরে থেকে। গুড়ে ফোটানো তাল-পাকানো খেজুর থাকত কাঁচের জারে। ঝুনো নারকেল ছোবড়া-সহ বিক্রি হত ওজন দরে। তবে খুবই মূল্যবান। এখানে আবার ছিটের মতো বহুকাল পরের একটুকরো ঘটনা স্মরণে এল— ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে আমরা চারজনা বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের (বিপিএসএফ) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট থেকে বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় যাই। উপলক্ষ বড়জোড়া বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী ছিলেন অশ্বিনী রাজ। আমরা চার কমরেড ছিলাম বিপিএসএফ-এর সম্পাদক পল্টু দাশগুপ্ত, মানস চ্যাটার্জি, বিজন মজুমদার আর আমি। সে-সময় আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বাঁকুড়া জেলা পার্টির দেবব্রত চ্যাটার্জি। শীতের সেই সন্ধ্যায় দুর্গাপুর ব্যারেজ পার হয়ে আমরা নেমেছিলুম বড়জোড়ায়। বাস যেখানে থামে সেখানে একটিই চায়ের দোকান। সামনে পিছনে শূন্য। চায়ের দোকানের বারো-তেরো বছরের একটি কিশোর চাঁদমুখে নিয়ে ফসলকাটা মাঠের আলপথ ধরে আমাদের সঙ্গী হতে চাইল গয়লাবান্দি গ্রামের পথে, পাঁচ-ছয় মাইল দূরে। সে কখনও নারকেলগাছ দেখেনি। সদ্য একটি লাগানো হয়েছে গয়লাবান্দিতে কারও ঘরে। সেখানে রাতে থেকে যাবে দিদির বাড়িতে। এই ঘটনার বহুকাল পরেও পশ্চিম রাঢ়ের কোথাও নারকেলগাছ আর তার ঝিরি ঝিরি পাতার উপরে চাঁদের আলো কবিতার বই ছাড়া আর কোথায় ছিল আমার জানা হয়নি। আরও পরে দেখেছি কোনও কোনও উৎসাহীকে দীঘির পাশে বিশাল গর্ত কেটে নুন ঢেলে রাখতে। বর্ষায় লাগানো হবে একটি অকস্মাৎ অঙ্কুরিত নারকেল। আটের দশকে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল গ্রামীণ নার্সারির। রাঢ়ের আর কোথাও বাকি ছিল না নারকেলগাছের বাড়বাড়ন্তের। এখন আর কোনও উদ্যমী কিশোরের কৌতূহল নিবারণের মুখে পাঁচ মাইল পথ নেই। তার সংক্ষিপ্ত উঠোনেই এই কাজটি সাঙ্গ হয়ে চলেছে। কিন্তু এই যে একটি পিচ্ছিল স্থান এসে গেল গাছ আর প্রাথমিক বড়জোড়ার ধূসর ভূখণ্ডে সেখানে দামোদর পার হয়ে দুর্গাপুর। তার মধ্যিখানে ইস্পাত কারখানা আর তাকে ঘিরে শালের অরণ্য। শালের অরণ্যের মধ্যে আবাসন। দামোদরের ভাঁটির দিকে ত্রিভঙ্গ স্রোত। উজানে নীল আর সবুজ— নীল আদিগন্ত। তখনও, ওই রংগুলি মেখে লুকোচুরি খেলে যেত পরিযায়ী পাখি। এর চল্লিশ বছর পরে, দেখব, ওইখানে, এদেরই অনেক শব বিধুর আকাশের নিচে পড়ে আছে, কিংবা প্রাণপণ চেষ্টায় অন্য কোথাও ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাচ্ছে স্পঞ্জ আয়রনের উচ্ছিষ্ট অন্ধকার ঠেলে।
[ক্রমশ]

