স্মৃতিপরব: অধ্যায় ২, পর্ব ৯

নীহারকান্তি হাজরা

 

নদ-নদীর সঙ্গমভূমে

অধ্যায় ১: পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১ পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮-কপর্ব ৮-খপর্ব ৮-গ

 

কৃষিজীবনের পাঁচালিপূজাপার্বণ

এই গ্রাম এবং আশেপাশের প্রত্যেকটি গ্রামে অন্তত দুটো করে নিবিড় গাছপালা ঘেরা দেবস্থান ছিল। একটি উচ্চবর্ণের জন্য, অন্যটি নিম্নবর্গের। দেবতারা পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়ায় বিরাজিত হতেন। এখানের বৃক্ষলতাগুলির উপরে মানুষের হস্তক্ষেপ ঘটার উপায় ছিল না। তাদের জন্ম-মৃত্যু ঠিক করত প্রকৃতি। প্রথমটির ক্ষেত্রদেবতা ছিলেন লৌকিক শিব। চৈত্রমাসের বিশেষ তিথি ধরে তাঁর পুজো এবং খিঁচুড়িভোগ হত। আর নিম্নবর্গের ‘থান’টিতে শ্রাবণ মাসে পুজো হত মনসার। গোপীনাথ জিউয়ের পাড়াটার নাম ছিল ঠাকুরপাড়া। এখানের মাজি পদবির মানুষেরাই এর পূজারী। প্রধান সেবাইত ছিলেন বয়সে সকলের বড় বাবুলাল মাজি। এই উপলক্ষে গ্রামের অন্যান্য পাড়ার মাজি পদবিধারীরাও জড়ো হতেন। কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে মহিলাদের উপবাস চলত দিবারাত্র। পুজো চলার সময় ধুপধুনোর গন্ধ আর ঢাকের বাজনা বাজলেই বাবুলালের ভর আসত। বাজনার তালে তালে লাফঝাঁপ করে তিনি গাছে উঠে যেতেন। কথা বলতেন দেবতার গলায়। পাড়ার লোকের প্রার্থনায় নিদান দিতেন। বহুক্ষণ পরে মাথায় জল ঢেলে তাঁকে স্বাভাবিক করা হত। মানুষ এবং দেবতার সঙ্গে সম্পর্কটার যাতায়াতের পথটা এতটাই সরল ছিল যে, কোথাও কোনও অবিশ্বাসের ফাঁকফোকর ছিল না। এই পার্বণটার নাম বারুণী ব্রত।

লৌকিক অনুষ্ঠানগুলি ধরেই গ্রামের জীবন ঘুরে চলত। এগুলির মধ্যে দুটো-একটা মনে আছে। আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির নাম ছিল ডাকসংক্রান্তি। শুক্লপক্ষের এই দিনটিতে চাষিরা তাদের কর্ষিত জমির শেষমাথায় দাঁড়িয়ে ধানকে জাগিয়ে তুলত। এখন জলভর্তি মাঠ। ফুল শেষ হয়ে ধানের ভিতর দুধ পূর্ণতা পাচ্ছে। কার্তিক মাস দুয়ারে। হেমন্তের শিশিরসম্পাতে স্নানরত হয়ে ধান বাড়বে। ঘন হয়ে গুচ্ছশিষ যেন আনত হয় তারই আবেদন তাদেরই ভাষায়। আমার দুর্ভাগ্য যে এতদিন পরে সে প্রাণের ডাকের মন্ত্রগুলি আমার স্মরণে নেই।

গৃহস্থ বাড়িতেও এর অন্য একটা আয়োজন হত। ওইদিন সকালেই আসত আখের ক্ষেত থেকে তিনটি নবীন আখ। ত্রিধারায় বসিয়ে সন্ধেবেলা এর মাঝখানে বসত একটি প্রদীপ। অপর একটি প্রদীপ ঘুরিয়ে গৃহস্থের প্রবীণা এর অভ্যর্থনা করতেন।

উঁচু ক্ষেতের ধান সংগ্রহ হবে খানিকটা আশ্বিনের শেষে: আউশ ধান। ভয়ানক ভাদ্রের দুর্দশার পার হয়ে ফুল্লরাদের ঘরে ঘরে আসবে মোটা চালের সফেন ভাত। মাঠের ধান অগ্রহায়ণে আর আখ চৈত্রের গোড়ায়। সর্ব সম্পদের শ্রেষ্ঠ।

আশ্বিনের দুর্গাপূজা এ-গ্রামে ছিল উচ্চবর্ণের পুজো। একটি মাত্র দুর্গাপূজার আয়োজন হত। ভট্টাচার্যদের পারিবারিক পুজো। ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য। প্রচুর জমিজমার মালিক। পেশায় উকিল। জেলাসদর লালবাজারে অধুনা বসবাস। কিন্তু সপরিবার চলে আসেন পুজোর সময়। নদীর খাড়া পাড়ের একেবারে সংলগ্ন তাঁর বড় দালানবাড়ি। তার সামনে প্রশস্ত দুর্গাদালান। এর মধ্যে অর্ধবৃত্তের কাঠের পাটাতনের উপরে দুর্গা এবং তাঁর সন্তানদের পট। বছরে একবার রং ধরানো হয়। আর এ সময় তাঁদের বাড়িটিরও কলি ফেরে। নবপত্রিকা প্রতিষ্ঠার দিনটি থেকে এই অট্টালিকা, পরিবার, তাদের বৈভব সমস্ত গ্রামের আটপৌরে ধারাবাহিক জীবন থেকে একটা বিচ্ছিন্ন চমক হয়ে অবস্থান করত। এর মধ্যে একটিমাত্র সুগম সেতু ছিল অবনী ভট্টাচার্য। তিনি ক্ষুদিরামের পুত্র। বিলেত থেকে চোখের ডাক্তারি পাশ করে এসে লেন। কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। বাঁকুড়া পুরসভায় আরও পরে তিনি লালবাজার কেন্দ্র থেকে কমিশনার হয়েছিলেন। এই গ্রামের আপামর মানুষ তাঁর কাছে নিখরচায় সমস্ত চিকিৎসা পেতেন। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ওষুধ এবং চশমা। আমাকে তিনি আমার ডাকনাম ধরেই ডাকতেন। আমিও তাঁকে বলতাম টেলুকাকা। আরও পরে শুনব তাঁর আয়ের সিংহভাগই চলে যায় জনহিতায়।

তবে একটি দিন, সন্ধেবেলা গ্রামের মানুষ ভট্টাচার্যদের দুর্গাদালানের সামনের প্রশস্ত চাতালে ভিড় করত, সেদিন দশমী। রাত্রির প্রথম প্রহর শেষ হলে রামায়ণ গানের আসর বসত। কোনও গ্যাসের আলোর ব্যবস্থা হত না। দুর্গাদালানে ঝুলত দু-তিনটে হ্যারিকেন। কয়েক ঘন্টা পরেই কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে সেগুলির দম বন্ধ হয়ে যেত। আর ওমনি ঘোষালপাড়ার পথের বাঁকের ওপারে বিচ্ছিন্ন ওই অট্টালিকা, দুর্গাদালান, পিছনের ঘন বাঁশবন, খাড়া খাতের বাঁক ধরে গন্ধেশ্বরীর বয়ে চলা স্রোতে দশমীর চাঁদের নিরন্তর ভাঙাগড়া, শেষ শরতের শিউলির পরিণামী গন্ধের আশ্রয়ে শতাব্দীপ্রাচীন অশ্বত্থের প্রসারিত বাহু দশমীর জ্যোৎস্নায় ঢেকে গিয়ে সেই মায়াবী আবরণ তৈরি করে দিত, যার ওপরে রামায়ণ-কথক আর তার দোহারের স্বরগ্রামের ঢেউ ধরে আঁকা হয়ে চলত বশিষ্ঠমুণির আশ্রম, রামের দুই পুত্রের পরিচয়, তাদের বীরত্ব, হনুমানের কথা, সীতাদেবীর অনুসন্ধান, চেড়িদের তাড়না। তার আগে রামায়ণ-কথকের ভূমিকা: জগদ্রাম সুতরাম প্রসাদেতে গায়। রামের প্রসাদে আজ রামেরই ব্যাখ্যায়।। দোহার: রামেরই ব্যাখ্যায়। দশমীর পরের কয়েকটি দিন গ্রামের অন্তত উচ্চবর্ণের মহিলাদের জন্য অবকাশ তৈরি করে ভেঙে ফেলত তাদের বারোমাসের প্রাচীরবদ্ধ পরিণামী জীবনধারা।

পরের পুজোগুলো গ্রামে তেমন ছাপ ফেলত না। কালীপুজোয় একটা রীতি ছিল ঘরের সদর দরোজার দু-পাশে খড়িমাটিতে চুবিয়ে ওপর থেকে নিচে শ্রেণিবদ্ধ ডাঙাডোঙা ফলের বারোটি করে ছাপ দেওয়া। এই গাছটি আগাছার জঙ্গলে মিলত। সোজা উঠে যাওয়া গাছটির গুটিকয়েক শাখা ওপরে। তাতেই ধরত এর ফুল। ইঞ্চি ব্যাসের মাথা গোল আটটি পাঁপড়ির গন্ধহীন উজ্জ্বল হলুদ রঙের ফুল। পাপড়িগুলি ধরে কেন্দ্রে একটি হলুদ-সবুজ-খয়েরি চক্র। আর এর ফলটি আঙুলগুলো জড়ো করে ঊর্ধ্বমুখী করলে যেমন আকার পায় তেমনই অনেকগুলো সূক্ষ্ম ভাঁজের। এর চমৎকার ছাপ পড়ত। আর সদর দরোজার সামনে তেলভর্তি মাটির প্রদীপ জ্বালানো হত। সেই অমাবস্যার রাতে শনের পাঁকাটির গুচ্ছ ছোট নদীর গর্ভে জ্বালানো হত। ইঞ্জলো পিঞ্জলো। সে সময় গ্রামের বেশ কয়েক জায়গায় শনের চাষ হত। চার-পাঁচ ফুট খাড়াইয়ের এই পণ্যটির চাষ হত উঁচু জমিতে। ঘন গাছগুলির মাথায় সমানভাবে ফুট খানিক ধরত এর হলুদ রঙের ফুল। সবুজ-হলুদের পরিমাপ শোভা পেত মাঠ জুড়ে। শন পচিয়ে বেরোত পাঁকাটি। পেন্সিলের মতো সরু। শনের আঁশগুলি দীর্ঘ এবং নমনীয়। এর থেকে হত উৎকৃষ্ট দড়ি। আমাদের শনের চাষ ছিল। উঠোনে পাঁকাটির বোঝা বান্ডিল করে রাখা হত। শনের আর একটা প্রকার অতসীগাছে। ফুলগুলিও একইরকম। আর অতসীফুল দুর্গাদেবীর পুজোর অন্যতম উপকরণ।

পূর্ণিমা ধরে কখনও আসত একটা মুসলমান ফকিরের দল। গাজি সত্যপির। গাইত সত্যনারায়ণের পাঁচালি। মুশকিল আসান করে গাজি সত্যপির, এই বৃন্দগান শেষে চাল ভিক্ষা। এর একটা সুমধুর লালিত্য পল্লীজীবনের সত্যনারায়ণ ব্রতের বিশেষ উপকরণ ছিল।

কৃষিজীবনের পাঁচালিতে এবার এসে যাবে বাস্তুসংলগ্ন খামারে বর্ষার ফেলে যাওয়া উদ্গত আগাছা মুক্ত করার কাজ। তারপর গোময় লিপ্ত করা। তারপরে আরও পরিপাটি। এখানেই মা লক্ষ্মী মাঠ শূন্য করে ঠাঁই নেবেন। প্রথমে আউশ তারপরে আমন, অগ্রহায়ণের এই শস্যটি গ্রামীণেরা ডেকে থাকে মাঠের ধান বলে। খামারের কোনা ধরে পড়ে আউশের পালই। মোটা ধান। মোটা চাল। আর এরই কিছু মুড়ির উপাদান: প্রধানত ভূতমুড়ি ধান। ঠিক এই সময়টিতে গ্রামের প্রাকৃতিক আবরণের শাখা-প্রশাখায় যখন, তখনও অন্ধকার জড়িয়ে সমস্ত নিম্নবর্গের ঘরে ঘরে ওঠে ঢেঁকির শব্দ। একটানা ক্যাঁচ-দুম। ক্যাঁচ-দুম। ঢেঁকি-পিছু তিনজনা বধূ। দুজনা ‘পাহার’ দেয়, একজনা ঢেঁকির মুখের গর্তে ঢালা সন্নিবিষ্ট ধান উল্টেপাল্টে দেয়। তাদের হাই তোলার শব্দেও হাঁড়ির মধ্যে ফুটে ওঠা চালের উতলা ফ্যানের শব্দও জড়িয়ে যায়।

কিন্তু মাঠের ধান, তার আলাদা গৌরব। কার্তিকের শিশিরের ফোঁটায় তার পরিপুষ্টি ঘটছে। আর তাই আরও আরও প্রাচুর্যের কামনায় গ্রামের মেয়েরা চলে কুমোরপাড়ায়। ঘরে আসে সরা। একটি ছড়ানো মাটির পাত্র। তার চারিদিক ঘিরে পড়ে আলপনা। সিঁদুরের টিপ। ভর্তি করা হয় মাটি দিয়ে। তারপরে পরিত্যক্ত শস্যের ক্ষেতে। এখানে সংগৃহীত হবে নব শাখের প্রধান, ধানের একটি চারা। তারপরে বাকিগুলি। মান, তিল, সরষে, যব, শুশনি, হলুদ, আর দুটি কলাইয়ের অঙ্কুর: মুগ, আর বিউলি। ইতুপুজো। আশ্বিনের সংক্রান্তি থেকে কার্তিকের সংক্রান্তি। সন্ধ্যায় পুজোর পরে গন্ধেশ্বরীর স্রোত বেয়ে ইতু চলে যাবে বড় নদী দ্বারকেশ্বরের স্রোত ধরে কোথায় কোন অসীম সাগরে। যাও ইতু। ফিরে এসো গুচ্ছ গুচ্ছ সোনার শিষে।

চাষিদের বারোমাস্যায় আর একটা দিন আসে অগ্রহায়ণের কোনও এক তিথি ধরে। চাষি চলে যায় মাঠে। তার আবাদি মাঠের প্রত্যেকটি থেকে ধানকে ডেকে একটি করে গাছ তুলে নেয়। গাছের আগায় পরিপক্ক ধানের গাঢ় উজ্বল হলুদ বর্ণের উদ্ভিজ্জ সুবাস। সবগুলি নিয়ে তৈরি হয় একটি-দুটি মোটা আঁটি। খামারের আলপনা আঁকা স্থানে রেখে রাসবিহারীর অপেক্ষা। তারপরে ঝরানো ধানের আশ্রয় ঢেঁকিশালায়। নানা মাপের চাল ধরে গাঢ় দুধে চালের পরিপাক। নবান্ন। বাটিভর্তি পায়সান্ন, আমপল্লব, হরিতকি, হরিদ্রা, দুর্বাঘাস, তুলসিপত্র, পাইভর্তি ধান, সামুদ্রিক কিছু কড়ি আর ডোকরার প্যাঁচার সহযোগে স্থাপিত হবে মা লক্ষ্মীর পটের সামনে। পুজো শেষের পর পায়সান্নের বিতরণ।

এর পরের চিত্র গোটা পুরুষ-পরিবার কাস্তে হাতে মাঠে। অগ্রহায়ণ মাস। ফসল সংগ্রহ হবে। বিশু কামারের শান দেওয়া কাস্তে শব্দ তুলে শুইয়ে দেবে মুঠোয় ধরা ধানের গুচ্ছ। সারিবদ্ধ ভূপাতিত পুঞ্জ পুঞ্জ শ্রম। পায়ের নিচে এখন মাটি সন্দেশের মতো। আবডালে গজিয়েছে অসংখ্য লতাপাতা। ত্রস্ত কাঁকড়ির দল ছানাপোনা নিয়ে গর্ত সন্নিধানে। সূর্য পশ্চিমে হেললেই গৃহস্থ বধূগুলি গামছায় বাঁধা জামবাটি, মাটির ছোট কলস কাঁখে নিয়ে আলপথ ধরে। তারপরে একদিনের দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা অন্তহীন নীলের নিচে পরিণামী সবুজ মুছে গিয়ে জেগে রইল একটা ভোঁতা শূন্যতার ‘না’। সেই শূন্য মাঠ জুড়ে এর পর, তার পরে, নামবে চক্র শেষ করে পায়রার দল উদ্বৃত্ত দানা অসামান্য দ্রুততায় ঠোঁটে তুলে নিতে। ভর্তি গরুর গাড়ির উপরে চড়ে আমার লক্ষ্য আমাদের খামার্। একটির পর একটি পালই পড়বে সেখানে। তাদের চালে সাময়িক আশ্রয় জুটবে চকিত শব্দে ডানার ফেরাই দেওয়া দলবদ্ধ চড়াই।

আর এরই শেষ, সেই বছরের জন্য, পৌষের সংক্রান্তিতে। তখন তার আগের দশদিন সমস্ত গ্রামে নাওয়া-খাওয়ার সময়টুকু ছেড়ে রেখে ঢেঁকির শব্দে বাতাস ঠাসবুনন। চালের গুঁড়ো তৈরি হচ্ছে। তেলিপাড়া থেকে ঘুমের ফাঁকফোকর ধরে ডানা মেলে আসে টুসুগানের বোধ ঘষে চলা একটানা সুর। প্রতিপক্ষের সঙ্গে কলহের আবরণে অসূয়ার তৃপ্তি-রসের মোক্ষণ: ওর টুসু জলকে গেছে কালো কুকুর ভেবিয়ে। আমার টুসু জলকে গেছে পক্ষিরাজ উড়িয়ে। সংক্রান্তির দিন শেষ হবে ছোটনদী-বড়নদীর সঙ্গমে টুসুর ধানভরা সরা ভাসানোর মধ্যে। সংক্রান্তির রাতভর তৈরি হবে পিঠে, গড়গড়ে, আসকে, সরুচাকলি। ভিতরে সম্পূরণ আখের গুড়-পক্ক নারকেল, তিল আর রমা কলাই (মানে বরবটির ডাল)। তপোবন গ্রামের ওপারে আকাশে রং ধরার আগেই নদীর স্রোতের উপরে ঝুলে থাকা শীতের গাঢ় কুয়াশা ঠেলে গামছা কাঁধে, নতুন কাপড় হাতে চলবে মহিলারা। উত্তরায়ণের প্রথম সূর্যে প্রথম মাঘে তিনটি ডুব। ইহকাল। পরকাল। আর পূর্বজ যাঁরা। তারপরে রোদে পিঠ করে পিঠে খাওয়ার পরব। এখানেই শেষ হল না। তার পরের দিন শিকার পরব। আদিবাসীদের এই শিকার পরব নদীনালা বেয়ে রাঢ়ের গ্রামের অঙ্গে লেপটে। গ্রামপ্রান্তের বাউরিরা তাদের পালিত শূকরের বিশেষ একটিকে তীক্ষ্ন শলাকায় বিদ্ধ করে সেটির প্রাণকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চাওয়ার শেষের আর্তনাদটুকু উপভোগ করবে খানিক সময়। তারপরে…। কিন্তু তারাই বা কেন! গ্রামের সবগুলি পাড়ায় কোনও ভূমিস্পর্শী গাছের ডালে ঝুলবে ছাগল। খাসির মাংস সংগ্রহ করবে সাধ্যে ভর করে। তার পরের দিন সেখান। আরও দুদিন তারও পরে, সাঁই, সুঁই, তার পরের দিন আসবি তুই। মানে দাঁড়াল মাঘের প্রথম সপ্তাহের প্রথম পাঁচটা দিন কাজকর্মে খিল তুলে দিয়ে পিঠে-পরবের উদ্বৃত্ত উপকরণগুলিকে আত্মসাৎ করে গাছের তলায় আধো রোদে, আধো ছায়ায়, কিংবা স্রেফ খেজুরপাতার চাটাইয়ে শরীরী নিদ্রায় মজে যাওয়া। আশ্চর্য হই, এই গ্রামে, পরেরটায়, তারও পরে, কোথাও কোনও মাতাল চোখে পড়েনি। অথচ তার রসদের ঘাটতি ছিল না। পৌষেই চারপাশে এসে পড়েছে মুসলমান রসচাষির দল। খেজুরগাছের পরিষ্কার মাথার নিচে টইটম্বুর কলসি। তাদের রাত্রিযাপনের খেজুরপাতার তৈরি কুঁড়ে। আর তারই একপাশে শুকনো খেজুরপাতার জ্বালানিতে ভোররাত থেকে ফুটছে রস। উদ্গত গরম বাস্প ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে ঝুলে থাকা কুয়াশা। কিন্তু একই রসকে গাঁজিয়ে তোলার কোনও চল চোখে পড়েনি।

শীতের রাতে গ্রামে পড়ত ডাকাত। ভট্টাচার্যদের দুর্গাদালানের বারান্দায় বসে তাস খেলার আসর। সেদিনও বসেছিল। গ্রাম ঘুমিয়ে পড়ে নটার মধ্যে। খেলা ভাঙে সেদিন রাত্রি বারোটা। তারার আলোয় পথ ধরে কুশীলবেরা বাড়ির পথ ধরে। অল্প পরেই, দুর্গাদালানের সামনের বাঁক নেওয়া পথের এ-পারে প্রাচীন অশ্বত্থ, ঝুঁকে থাকা ঘন বাঁশবন পিছনে রেখে তিনকড়ি ভট্টাচার্যদের বাড়ি। সামনের ঘরে তাঁর মুদি-মশলার দোকান। তিনকড়ির পুত্র পাঁচকড়ি অধুনা একটি আন্তঃজেলা বাসের ড্রাইভার। সেদিন তার পুরুলিয়ায় মোকাম। দোকানঘরের পাশে পাঁচিলঘেরা উঠোনের দরোজা। তাতেই ঠেলা পড়ল জোরে। গ্রামপ্রসিদ্ধ পাঞ্চজন্যের মতো গলা। তিনকড়ির বলশালী স্ত্রী কাঁথার নিচে আন্দাজ করলে ব্যাপারটা। আবার সেই ছিঁচকে চোর মেটে ছেলেটা। দেখাচ্ছি মজা। দরোজার খিলটা খুলে দিয়ে দরোজার পিছনে লাঠি হাতে অপেক্ষা। প্রথম কালো হাফ প্যান্টপরা একটা মূর্তি ঘরে ঢুকতেই, ‘এবার ধরেছি তোকে, চুরি’— পিঠে লাঠির বাড়ি। ততক্ষণে আরও তিনজনা। পাঁচিলের উপরে আরও তিন। ক্রমাগত মারের মুখে তিনকড়ির স্ত্রীর সপ্তসুরের আর্তনাদ। পিছনের তিনটে ঘোষালবাড়ি জেগে শুনছে। তাদের ঘরের সামনে লাঠি হাতে কালো চেহারা দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যে শীর্ণকায় তিনকড়ি তার মাথার কাছে রাখা মা দুর্গার বলির তলোয়ার তুলে বাইরে, তবে রে…। তিনু, ভট্টাচার্যদের পুজোয় ওই তলোয়ার দিয়েই অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় চালকুমড়ো বলি দেয়। আজ হাতে সেই তলোয়ার। এবার তেলমাখা শরীরে হড়োহুড়ি। তিনুর শীর্ণ কব্জি মুচড়ে তলোয়রের হাতবদল। একটার পর একট কোপ। তিনুর মরণান্তিক আর্তনাদ। এমন সময় আর একটা ঘটনা ঘটল। পিছনের বাঁশবনের ভিতরে রামদাস ঘোষালের বাড়ি। সে সদরে একটা ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড। বিখ্যাত কুস্তিগীর। লাল ল্যাঙোটি পরে একটা বিরাট বর্শা নিয়ে বেরিয়ে এক কালো মূর্তি লক্ষ করে নিক্ষেপ। বাবা গো বলেই তার পতন। মুহূর্ত ধরে আর একটা লোক এসে উরুতে হাড় ভেদ করে গেঁথে যাওয়া বর্শা ধরে টান। এবার আর্তনাদ ডাকাতের। মরণপণ কান্না। একটা শব্দ উঠল তাদের সর্দারের গলায় ‘মাছি-মাছি’। সঙ্গীকে কাঁধে করে তারা নদীর ঘাট ধরে ওপারে। পরের দিন দেখা যাবে রক্তের ফোয়ারায় ভিজে আছে ধূসর মাটি। আর রক্তের ধারানদী স্রোতের এ-পারে থেমেছে। তিনুর মাথা থেকে সারা অঙ্গে মোট তেত্রিশটি কোপ। অর্ধমৃত হয়ে গরুর গাড়িতে বাঁকুড়ার সদর হাসপাতাল।

তেমনই এক শীতের রাতে আমাদের বাড়িতে পড়ল ডাকাত। সে সময়টা আমি বাইরে। বাড়িতে বাটানগর থেকে এসেছে আমার বড়দি, ধানবাদ থেকে মেজদি। তখনকার চল ধরে দুজনেই পরে এসেছে গা-ভর্তি গয়না। গভীর রাতে পড়ল ডাকাত। হাফপ্যান্ট পরা তেলমাখা চেহারা। পাঁচিল টপকে দরোজার খিল খুলে ভিতরে প্রবেশ। তারপর ওপরে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে দরোজা নেই। ঘরের দরোজা খুলে দেওয়ার হুকুম। তারপর গয়নার সন্ধান। না সেগুলি গায়ে নেই। বাক্সতে নেই। সব অনুসন্ধান শেষ করে তখনকার একটা বড় মারফি রেডিও নিয়ে বরযাত্রীদের মতো প্রস্থান। কিন্তু গয়না? এক দিদি ডাকাত টের পেয়েই সব গয়না একটা কাপড়ের পুঁটুলিতে বেঁধে পাশের জানালা দিয়ে পিছনের দত্তবাড়ির খড়ের চালায়। তারপর সেটি গড়িয়ে পিছনের অন্ধকার সঙ্কীর্ণ গলিতে। ডাকাত চলে যাওয়ার পরে তার উদ্ধার।

কৃষিজীবনের পাঁচালি, ছোট-বড় দুই নদীর ঋতু ধরে রপের পরিবর্তন ঘটে চলা, ছোট-বড় গ্রাম্য পূজা-পার্বণ— এসবের নিচে একরকম চাপা পড়ে যেত দুঃখ-দারিদ্র্যের অসহায়তা। ভাগ্য এমন একটা নির্বিকার ভূমিকা তৈরি করেছিল, উপোসী মানুষ কখনও খামার থেকে ধানের একটি আঁটিও চুরি করেনি। খোঁজেনি একমুঠো চাল। একমুষ্টি ভাত। বরঞ্চ এটা দেখেছি, অভাবটার প্রকাশটাই লজ্জা। তারপর অগোচরে মরে যাওয়া। গরিব, মধ্যবিত্ত সকলে।

 

[দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5223 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...