কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
শহরতলির আন্ডারস্টাফড শ্মশানের ডোম যুবক, মিউনিসিপ্যালিটির খাতায় যার পরিচিতি সহকারী সৎকারক— ছ-ফুট লম্বা, গিঁট বাঁধা দু-ভাঁজ চেক লুঙ্গি, ঘর্মাক্ত স্যান্ডোর নিচে গাঢ় বাদামি পেশি— জ্বলন্ত চুল্লির গহ্বরের মুখে চাটাই চাপা দিয়ে বাইরে এল। দেওয়ালে ঝোলানো শার্টের পকেট থেকে বিড়ি আর দেশলাই বার করে।
করোগেটেড অ্যাসবেসটস ছাউনির নিচে ভিড়। ফুলছাপ নাইটির বুক জড়ানো অনাবশ্যক গামছা। পাঁচ মিনিট আগে পর্যন্ত বডি জাপটে চেল্লামেল্লি চলছিল। আলজিভ দেখিয়ে হাউমাউ। আছড়ে শাঁখা ভাঙা। সে শোক বা শোকের শো শেষ। এখন হাঁফ ছাড়া চলছে।
পার্টির পুরুষ পপুলেশন বটগাছের নিচে টোটো স্ট্যান্ডে জড়ো হয়েছে। সিন্থেটিক জ্যালজেলে বারমুডার ওপর রিবক লেখা সিন্থেটিক জ্যালজেলে টি শার্ট— চাকরি নেই কিন্তু আঙুলে গ্রহরত্ন আংটি আর দেড়শো সিসির পালসার আছে— মোবাইলের দিকে দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠোঁটে বিড়ি চেপে ধরে দেশলাই জ্বালাল সৎকারক। ভোঁ ভোঁ মাছি হাত নেড়ে তাড়াল। চোখ কুঁচকে ধোঁয়া ছাড়ল আকাশের দিকে। আকাশি ঝলসে ধূসর। গরম হাওয়া কাঁপছে খারাপ টিভির মতো। এক সপ্তাহ ধরে পূর্বাভাস, বৃষ্টি নামবে আজকালের মধ্যেই। কপাল বেয়ে চোখে ঢুকে যাওয়া ঘাম কোমরের গামছা খুলে মুছল। দেওয়ালের উঁচুতে গাঁথা টেবিল ফ্যানের ভাঙা জালিতে হাত গলিয়ে ব্লেডে ঠেলা মারল, ব্লেড দুলে থেমে গেল। উল্টোদিকে ঠেলা দিল। ফ্যান ঘুরতে শুরু করল।
হলুদ এবড়োখেবড়ো দেওয়ালে হেলান দিয়ে ইন্সটা খুলল সৎকারক। সুরাত শহরের রাতভর বাজারে এক কেজি মাখনে পরোটা ভাজা হচ্ছে। ঝিংচ্যাক জিমে বেঞ্চপ্রেস করছে একজন। ফেঁপে ওঠা গুলির ওপর Don’t waste your time chasing butterflies. Mend your garden, and the butterflies will come. লাভ সাইন দিয়ে মুভ অন করল সৎকারক। একটা মেয়ে নাচছে, বা নাচাচ্ছে। টুসকির বয়সী, ছোটও হতে পারে। টুসকি ওর খুড়তুতো বোন। গার্লস স্কুলে ফার্স্ট হয়ে এইট থেকে নাইনে উঠেছে। ফোনের মেয়েটা জিভে আঙুল বুলিয়ে ওকে চোখ মারল। ও স্ক্রোল করল। গাঢ় সবুজ জঙ্গলের মাথায় আকাশভরা কালো মেঘ। টাইম ল্যাপসে সরছে, ঘুরছে, গর্জন করছে।
উঁহু, ইঞ্জিন।
গলি দিয়ে কাচের গাড়ি ঢুকছে। ধপধপে গায়ে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর মাদুর্গা জয়মাতাদি-র বর্ডারের ভেতর গর্বিত গেরুয়া অক্ষরে ‘স্বর্গরথ’। আগরওয়াল নার্সিংহোমের মালিক— ছ-মাস আগে মা মরার পর সার্ভিস চালু করেছে। শ্মশানের দেওয়ালেও প্যামফ্লেট সেঁটে গিয়েছিল।

কাকা বলেছিল, চলবে না। লোকে কি হাবা? পঞ্চাশ বছর ধরে হরিসভার টেম্পো মড়া তুলছে— কানাইপুর থেকে বামুনারি, প্রভাসনগর থেকে মিরপুর। টোটাল ফ্রি। এক পয়সা লাগে না। সে জায়গায় হাজার হাজার টাকা দিয়ে ইকনমি, ডিলাক্স, প্রিমিয়াম লাশ পরিবহন সার্ভিস?
প্রথম মাসে একটা ইকনমি এসেছিল। পরের মাসে দুটো ইকনমি, একটা কমফর্ট প্লাস। তার পর থেকে মাসে কমবেশি ছটা করে এসেছে। ইকনমি, কমফর্ট প্লাস সমান সমান।
প্রিমিয়াম এই প্রথম। চোখ সরু করে মিলিয়ে নেয় সৎকারক— আগরবাতি, সাদা চাদর। ভজন বাজছে না, ড্রাইভারও কালো প্যান্ট, চেক শার্ট। দিলীপ। দাদার জেরক্সের দোকান ছেড়ে মরার গাড়ি চালাচ্ছে। দিলীপও দেখেছে ওকে। হাত নাড়ছে। কাচের ঢাকনির কোণে কোণে রজনীগন্ধার মোটা গোছা আর মারিগোল্ড। বাপ রে বাপ, কিছু মারিগোল্ড। গোটা মহকুমার মারিগোল্ড এনে জুটিয়েছে। বডি চাপা পড়ে গেছে মারিগোল্ডে মারিগোল্ডে।
স্বর্গরথের পেছন পেছন একটা সাদা ইনোভা ক্রিস্টা, একটা মেরুন হোন্ডা অ্যাকর্ড, একটা ব্ল্যাক স্কোডা— ঢুকল না, ভেসে এল। কেউ হর্ন বাজাল না। প্যাসেঞ্জাররাও রংহীন। পিওর কটন শার্ট শাড়ি কুর্তা— সাদার এদিক-ওদিক। কয়েকজনের চোখে সানগ্লাস। এরা হল্লা পার্টি না, এদের হাঁটাচলা কথাবার্তা সাজপোশাক গাড়িবাড়ির সবেতেই একটা ফিসফিসানি, তবু যেন বাড়াবাড়ি রকম শান্তি। এই যে এতগুলো লোক নামল গাড়ি থেকে, নিজেদের মধ্যে প্রায় কথাই বলছে না। এই যে বডি নামানো হচ্ছে, কেউ এদিকে আয় ওদিকে যা করছে না।
একটা ছেলেই যা একটু দৌড়োদৌড়ি করছে। চশমা ঢাকা চুল, লম্বা ওর মাথায় মাথায়, জোরে হাওয়া দিলে উড়ে যাবে। সরু গলি দিয়ে রথ রিভার্স করছে দিলীপ। জানালা দিয়ে মুণ্ডু বার করে গলিতে ঢুকে পড়া টোটোদের চেঁচিয়ে গালি দিচ্ছে। নামানোর সময় টাল খেয়ে বডির মাথার গাঁদার ঢিপি সরে গেছে। মুণ্ডু পেঁচানো সাদা কাপড়।
তাই বল। ওই জন্য এত চুপচাপ।
সৎকারক জানে ওই কাপড়ের নিচে আছে কান টু কান সেলাইয়ের দাগ। কাটার পর সামনের চামড়া টেনে সামনে নামিয়েছে, পেছনের চামড়া টেনে পেছনে, তারপর ইলেকট্রিক করাত দিয়ে খুলিতে একটা গোল করেছে। ব্রেন বার করে পরীক্ষা করেছে— হেমারেজ-টেমারেজ যদি থাকে। তারপর ব্রেনের ফোঁকরে কাপড়ফাপড় ঢুকিয়ে আবার সব সেলাই করে দিয়েছে। সেলাই অনেক সময় আঁকাবাঁকা থেকে যায়, খাপে খাপে ফিট করে না, রস পুঁজ ইত্যাদি চোঁয়ায়। তাছাড়া ন্যাড়া মাথায় সেলাইয়ের দাগফাগ বাড়ির লোকেদেরও দেখতে অসুবিধে হয় নিশ্চয়। তাই কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দেয়।
টোটোস্ট্যান্ডের ছেলেগুলোও মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে। ফেট্টি কেস, একজন চেঁচিয়েই বলল। রোগা ছেলেটা ঘুরে তাকাল। একজন বয়স্ক লোক, এ স্কোডা থেকে নেমেছে, ছেলেটার পিঠে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দিল। ঠিকই করেছে। প্রথমত, গণতান্ত্রিক দেশ, বাকস্বাধীনতা। তাছাড়া, এ সব কেসে একটুআধটু শুনতে হয়। এ কিডনি ফেলিওর নয় যে আমার এতগুলো ডায়ালিসিস হয়েছে তোর কতগুলো হয়েছে নিয়ে বুক বাজাবে। ক্যান্সার নয় যে নভি মুম্বাইতে বাড়ি ভাড়া করে থাকার খরচ নিয়ে কলার তুলবে। কোভিড নয় যে মরার পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবে।
এ যত না শোক তার চেয়ে বেশি শেম।
চল চল, ভেতরে চল। মালাগুলো টেনে ফেট্টি যথাসম্ভব চাপা দিয়ে দিল একজন। শেষ টান দিয়ে বিড়ি টোকা মেরে দূরে ফেলল সৎকারক। একটা আলগা কৌতূহল, এ-সব কেসে, এত বছর পরেও মাথা তোলে।
—কী হয়েছিল?
***
ফেস টু ফেস বা ফোনে, ফিসফিসিয়ে বা ফুঁপিয়ে, সবাই এই প্রশ্নটাই করেছিল।
—কী হয়েছিল? কিচ্ছু টের পাওয়া গেল না?
সেটাই তো। সকাল থেকে সব নর্মাল। সকালে উঠে নিজে নিজের চা করে খেয়েছে, বাথরুম গেছে, পাম্প চালিয়েছে, বন্ধ করেছে। ছাদের পিটুনিয়া থেকে পাতিলেবুর আজ সাপ্তাহিক যত্নের দিন। অরগ্যানিক খাদের বস্তা, খুরপি, গ্লাভস, জলের ঝাঁঝরি সারি করে রেখেছে।
কাজেই লোকটা ফিরে আসবে। এটা গ্রিল মোছা বা টেবিল ঝাড়া নয় যে দেরি হলে বা আদৌ না হলে গ্রিল বা টেবিল মাইন্ড করবে। এখানে ইনভলভড কয়েকটা জ্যান্ত প্রাণ, লোকটা যেচে যাদের ভালোমন্দ বাঁচামরার দায়িত্ব নিচ্ছে। যতক্ষণ সে দায়িত্বের বোধ আছে নিজেকে মারে না কেউ। নিজের জীবন কারও বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট ঠেকে না। অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন যেদিন বুকের ভেতর নিভে যায়, সব শেষ।
—তারপর?
তারপর কী? নিচে বেল বেজেছে নয় ফোন, দুধ এসেছে বা কাগজ। ছাদ থেকে নেমে দুধ নিয়েছে। কাগজের হেডলাইনে বা ফোনের আনরেড নোটিফিকেশনে চোখ বুলিয়েছে। গাজার বাচ্চাদের কান্না, ইউক্রেনে সৈনিকের ভাঙাচোরা মুখ, রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে নবতম হরর হয়তো উটের পিঠের শেষ খড়কুটো হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া ফোনে কোনও ব্যক্তিগত খারাপ খবরও তো, ধরুন বাড়ির কারও ব্যাপারে সামথিং স্ক্যান্ডালাস, আসতে পারে। সবই নিশ্চয় প্রকাশ হবে ক্রমশ। কতদিন আর চেপে রাখবে?
পাশের বাড়ির মাসিমা তো বলছেন, চেঁচামেচি হয়েছিল। গা করেননি, সংসারে বাসনের সহবাস। ঠিক কী নিয়ে চেঁচামেচি শুনতে পাননি কারণ ততক্ষণে ঘোষদের ট্যাঙ্ক ওভারফ্লো করতে শুরু করেছে। মাসিমা গ্রিলে গাল ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে পাম্প বন্ধ করতে বলছিলেন, ঠাকুরবউদি বাগানে বাটি ধুতে ধুতে বলছিল, এত জল নষ্ট করলে ক্লাইমেট চেঞ্জ হবে না? একবার যেন শোনা গেল, পারছি না, আমি আর পারছি না, একদিন ঠিক… তক্ষুনি দুধ ওথলাল, বাজারওয়ালা বেল বাজাল, গৌরী ঝাঁট দিতে দিতে বলল বিকেলে আসতে পারবে না, ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবে। এক সপ্তাহে ছেলের এই নিয়ে তিনদিন পেটখারাপ।
এসবের মধ্যেই আটটা পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, মোস্ট প্রব্যাবলি সাঁইত্রিশ, চিৎকারটা শোনা গেল। উঁহু, ভুল শোনার সিনই নেই। ওথলানো পাম্প বা কলিংবেলের সাধ্য নেই ও জিনিস চাপা দেওয়ার। কুলকুণ্ডলিনী জাগানো, রক্তজমানো, চোদ্দপুরুষের নাম ভোলানো চিৎকার। বাবাআআআআ!
—কোনও মানে হয়? এত স্বার্থপর হয় কী করে লোকে? যারা রয়ে গেল তাদের কথা একটু ভাববে না? এত নাকি শিক্ষিত?
কিছু বলার নেই।
***
টাইম লাগবে।
ছেলেটার হাত থেকে কাগজের তাড়া নিয়ে সৎকারক বলল। অন্য কেসে ডেথ সার্টিফিকেটে হয়ে যায়, এখানে কেস ফাইল রিপোর্ট, ইনভেস্টিগেশন অফিসারের নো অবজেকশন, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, মর্গের ক্লিয়ারেন্স। কে জানে হয়তো রাতভর ঘুরেছে।
গায়ের রং, গাড়ির মিছিল, হাতের ঘড়ি, চুলের ছাঁট, পায়ের জুতো, পিওর কটন মনে পড়ল সৎকারকের। নাহ্, এরা ঘোরেনি। বড়জোর সকালের কেস।
ছেলেটাকে বাজারে দেখেছে আগে। ওর দু-এক বছর এপারওপার, কিন্তু দেখতে ছোট লাগে। এ-সব বাড়ির ছেলেদের বড় হতে টাইম লাগে। বাবামায়ের আদরের গুটি ছিঁড়ে বেরোতে বেরোতেই পঁচিশ বছর। তবে এই যে ধাক্কাটা খেল, এবার বড় হয়ে যাবে। কাগজ চেক করতে করতে চট করে চোখ তুলে আর একবার মেপে নিল সৎকারক। সরু কাঁধ আঁকড়ে ঝোলা টিশার্ট একসময় সবুজ ছিল। ব্র্যান্ডেড জিনস ঝড়বাদল সয়েছে। এই যে হাঁটছে চলছে, কাগজ এগিয়ে ধরছে— হাতের সঙ্গে কাঁধের কথা নেই, কাঁধ কখন কী করে ফেলবে মাথা আঁচ করতে পারবে না। সরু কোমরে সরু কবজি রেখে দাঁড়িয়ে হাঁটু নাচাচ্ছে। হাত দিয়ে কপালের চুল সরাচ্ছে, চোখের দৃষ্টি ছিটকে যাচ্ছে। একমুহূর্ত স্থির হলেই যেন শোকের সুনামি চামড়া ফাটিয়ে বেরিয়ে পড়বে। যেটা ঘটেছে সেটা বিশ্বাস করার অভিনয় করছে, আসলে করছে না।
—কত?
—একটা সবে ঢুকেছে। আপনাদেরও তো ঘাটকাজফাজ আছে। শুরু করুন না। ঠাকুরমশাই ওদিকে আছেন।
—আমাদের ও সব লাগবে না।
কাগজের তাড়া থেকে চোখ তুলে ছেলেটার চশমায় রাখল সৎকারক। না লাগলেও ঠাকুরমশাইয়ের ফিজ দিতে হবে। হাজার টাকা, ফিক্সড। তাছাড়া সার্ভিস চার্জ চার হাজার। সব মিলিয়ে পাঁচ। ছাইয়ের আলাদা এক।
ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এক, দু্ই, তিন সেকেন্ড। দৃষ্টিতে এই প্রথম শোক ছিঁড়ে অন্য কিছু ফুটছে। বিরক্তি, হতাশা রাগ। হৃত টেরিটরির পুনর্দখল নিচ্ছে রিয়েল লাইফ।
—জোজো, লেট মি হ্যান্ডল দিস। পাশ থেকে স্কোডা-হাত সবুজ টি-শার্টের কাঁধ ছোঁয়।
—আরে তুমি ছাড়ো, ছোটমামা, আমি দিচ্ছি। টাকার ব্যাপার নয়। এরা সুযোগ পেয়ে যা তা একটা বলছে। আনবিলিভেবল।
—দিস ইজ নট দা টাইম, জোজো। ছোটমামা পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করেন। রিয়েল চামড়া, পুরনো। ঠাকুরমশাইয়ের ফিজ কত বললেন যেন ভাই? না না, আমাদের সবই লাগবে। কার্ড নেন আপনারা? না? ওনলি ক্যাশ? নট ইভন্ পেটিএম?
—আনবিলিভেবল।
***
গলিতে কিয়া, হন্ডা, এমজি-র মিছিল লম্বা হচ্ছে। একটা-দুটো উবার। শেডের নিচে অফ হোয়াইট পিওর কটনের ভিড় বাড়ছে। লালনীল নাইটি সরছে। আর আধঘন্টার মধ্যে ছায়া ছেড়ে রোদে বেরিয়ে যাবে। ধাক্কাধাক্কি হবে না, তুইতোকারি না, কেউ আঙুল তুলে গলার শিরা ফুলিয়ে— জানিস আমি কে— চেঁচাবে না। থ্যাঙ্ক ইউ, এক্সটিমলি সরি, সত্যি এ বছর যে কী গরম পড়েছে-র পোলাইটনেসে প্রিভিলেজ দখল নেবে।
উত্তর পাওয়া যাবে না জেনেও একে অপরকে জিজ্ঞাসা করবে, হাউ ডিড দিস হ্যাপেন? কিচ্ছু টের পাওয়া গেল না?
কে বলেছে যায়নি? সব গেছে। কিন্তু কেউ স্বীকার করবে না। করলে অনেক কিছুই স্বীকার করতে হবে যেগুলো ফাঁপা মুড়ির মতো কালেকটিভ বিবেকের গাল কামড়ে ধরবে। আজ যা ঘটল তার উপসর্গ তো বোঝা গিয়েছিল অনেক আগে। সে-সব তো হাওয়ায় ঘটেনি। রীতিমতো সাক্ষীসাবুদ ছিল।
যাদের একজন, ওই যে, টোটো থেকে নামছেন। ঝোলা থেকে বাটিকের পার্স বার করে আঙুল ঢুকিয়ে খুচরো খুঁজছেন। কপালের কুচো সাদা চুল ঘেমো কপালে লেপটে আছে। ভারি চশমা তৈলাক্ত নাক বেয়ে হড়কাচ্ছে। একজন যাঁকে দেখে, বোসো প্রজ্ঞাদি, বলে চেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে। মহিলা লোকটাকে চিনতে পারেননি, চেনার ভঙ্গি করছেন। কৌতূহলের উত্তরে জানাচ্ছেন, হ্যাঁ কলেজ আছে, তবে ফার্স্ট হাফে ক্লাস নেই, সেকেন্ড হাফে যাবেন। লোকটা ঘাড় নেড়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এবার তাঁর তরফ থেকেও কথোপকথনে কনট্রিবিউট করার প্রেশার বোধ করছেন প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়।
—স্যার কেমন আছেন?
—শরীর তো এমনিতেই খারাপ তার ওপর এই। শ্মশানে আসতে চেয়েছিলেন, আমরাই দিইনি।
—না না, উনি শ্মশানে আসবেন কী! “আমাদের” বিচক্ষণতার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন প্রজ্ঞাপারমিতা।
—কার কপালে যে কী থাকে। এত ভালো মানুষ, এত রেসপেক্টেবল, সারাজীবন এত মানুষের উপকার করেছেন। শেষ জীবনে এই শকটার দরকার ছিল না।
প্রজ্ঞাপারমিতা চুপ করে আছেন। লোকটা ভাবছে প্রজ্ঞাপারমিতা একমত হচ্ছেন। প্রজ্ঞাপারমিতা একমত হচ্ছেন না। কারণ প্রজ্ঞাপারমিতা জানেন, এটা শক নয়। নীরবতায় প্রজ্ঞাপারমিতা পিছু হাঁটছেন। কুড়ি পঁচিশ তিরিশ বছর। পেরিমেনোপজ টূ পিউবার্টি। সন্ধেবেলা অঙ্ক কোচিং ভেঙেছে। স্যারের বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে একটা গলা ঝুঁকে পড়ে নাম ধরে ডাকছে। লিকপিকে টিংটিঙে ছায়ামূর্তি— ওই যে জোজো ঘুরছে, এক্স্যাক্ট সেম বডি টাইপ— খাম হাতে দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। পায়োনিয়ার খাতাছেঁড়া দু-পাতার এ-পিঠ ও-পিঠ ভর্তি কথা, কোটেশন সব আবছা হয়ে একটি লাইন জ্বলজ্বলে দাঁড়াচ্ছে।
তুই ‘না’ বললে আমি মরে যাব।
পিউবার্টির ছ-মাসের অকওয়ার্ডনেস যখন আশৈশবের বন্ধুত্বের সহজতা আবার ঢেকে দিয়েছে, অন্য শহর থেকে ফিরে রাস্তায় আচমকা দেখা হওয়ায় জেনুইন উল্লাস, আরও কয়েকবছর পর কমপ্লিট বোর্হেস বগলদাবা করে একজন অন্যজনের বিয়েতে বাসন্তী পোলাও আর লম্বা ডাঁটি বেগুনভাজা সাঁটাচ্ছে, স্টেজে দাঁড়ানো যুগলপ্রতিমার উজ্জ্বলতায় চোখ ধাঁধাচ্ছে, বছর পাঁচেক পর ছোট্ট জোজো— মানুষের বাচ্চা যে অত মিষ্টি হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না— আধো গলায় হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লুচি লুচি ফুলকো লুচি ছড়া বলছে, বাবামায়ের চোখ চুম্বক, গর্বিত উল্লাসে স্যার হাততালি দিচ্ছেন— জীবনের সেই অসহনীয় আঁচের মাঝখানে বসে, কখনও কখনও, বেশি না, একবার দু-বার— প্রজ্ঞাপারমিতার মাথায় দুটো শব্দ ঘাই মেরেছে।
মরে যাব।
একসময় যাকে প্রেম মনে হয়েছিল, সময়ের প্রলেপে তা-ই ড্রামাবাজি, আরও সময় পেরিয়ে দৃষ্টি নরম হলে— কাঁচা বয়সের আবেগ। এ-সবের বাইরে অন্য কোনও ডায়গনসিস ছিল কি যা এক লাইনে সারা যায় না? মানবমনের জটিলতার প্রতি আর একটু সম্ভ্রম দাবি করে? সমস্ত ব্যাখ্যা নিজেদের বুদ্ধির নাগালে রাখতে গিয়ে যা মিস হয়ে গেল? যার পরিণামে এই ভ্যাপসা ভাদ্রদুপুরে শ্মশানে বসে জোজোর ভাঙাচোরা মুখটা দেখতে হচ্ছে?
***
প্রজ্ঞাপারমিতা না হয় নাবালিকা ছিলেন, প্রজ্ঞাপারমিতার প্রাজ্ঞ প্রাচীন স্যার? গণবিবেচনার ভোটে হেরে যিনি শ্মশানে আসতে পারেননি, অশক্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন? না চাইতেও বারবার ফিরে যাচ্ছেন জোজোর চিৎকার শুরু হওয়ার মুহূর্তটায়? ভাষাহীন, অশ্রুহীন, শোকহীন। অনৈচ্ছিক, অনিয়ন্ত্রিয়ণীয়, অমানুষিক। কান্নার চেয়ে গভীর, শোকের চেয়ে আদিম। জোজো একটা কোনও বিপদের মুখোমুখি হয়েছে। জোজোর সারভাইভ্যাল ইন্সটিঙ্কট সেই বিপদের বিরুদ্ধে জোজোকে একটা চিৎকারের পিণ্ডে পরিণত করেছে। জোজোর গোটা শরীর, প্রতিটি পেশি, রক্তবিন্দু এখন ফাইট মোডে।
জোজোর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে অনেকদিন। টুবুন, বৌমা, চব্বিশ ঘণ্টার সহকারী— নাম ধরে ডাকছিলেন বারবার। সর্বশক্তি দিয়ে। সাড়া পাননি। স্বাভাবিক। যে যেখানে ছিল জোজোর কাছে ছুটে গিয়েছিল। চেনা গলার কান্না শুনতে পাচ্ছিলেন স্যার। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে, জোজো ওঠ। শক্ত হ।
খবরটা পৌঁছনোর বেশ কিছুক্ষণ পর জোজো এসেছিল। দরজা ভেজিয়ে তাঁর বুকে মাথা রেখে শুয়েছিল। জোজোর পাখির মতো শরীর শোকে ভারি। গরম, ধীর নিঃশ্বাস। জোজোকে জাপটে ছিলেন স্যার। মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন। মৃদু কারেন্টের মতো দুজনের মধ্যে দিয়ে শোক বইছিল। জোজো চুপ করে ছিল, স্যারেরও কিছু বলার ছিল না।
কিন্তু সমীকরণ মেলানো এতদিনে সেকেন্ড নেচার। মারধরের শাসনে কোনওদিন বিশ্বাস করেননি স্যার, কিন্তু এতরকম স্ট্রেস সামলে সারাদিন স্কুলে ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফিরে কখনও কখনও তো সত্যিই সংযম দেখাতে পারেননি। একদিনের কথা পার্টিকুলারলি মনে আছে, একটু বেশিই বকে ফেলেছিলেন, একটা চড়ও বোধহয় সামলাতে পারেননি। বড় বড় চোখ জলে ভরে এসেছিল। ওইটুকু ছেলে, বাবার মুখের দিকে তাকাতে ঘাড় পঁচাত্তর ডিগ্রি বেঁকাতে হয়, রিনরিনে গলায় চেঁচিয়েছিল।
—আমি যেদিন মরে যাব, সেদিন তুমি বুঝবে।
থতমত খেয়েছিলেন স্যার। সামলেও নিয়েছিলেন। টুবুনের মায়ের সঙ্গে আড়ালে হাসাহাসি করেছিলেন। ওইটুকু ছেলের মুখে মৃত্যুর কথা সিরিয়াসলি নেয় নাকি কেউ? নিলে হয়তো জোজোর এই ভাঙাচোরা শরীরটা বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতে হত না।
রিটায়ারমেন্টের ছ-মাস আগে স্কুলে প্রথম কাউন্সেলরের রিক্রুটমেন্ট হয়েছিল। সহকর্মীরা প্রায় সবাই হেসেছিলেন, স্যার মন খোলা রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তবুও, প্রথম যেদিন কাউন্সেলর এল, এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাসে ফার্স্ট, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট কাউন্সেলিং-এর কোর্সে রেকর্ড মার্কস। একটা পালকের মতো মেয়ে, শাড়ি পরে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করেছে। স্যার নিখুঁত ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু মনে মনে মুখ ছাদের সমান হাঁ হয়েছিল। বেয়াল্লিশ বছর ধরে পড়িয়েছেন তিনি। ক্লাস সেভেন টু টুয়েলভ, দুটো করে সেকশন, পার সেকশন ষাটটা করে বাচ্চা। পঁয়ত্রিশ বছর টিউশন করিয়েছেন। এ-শহরতলির যে-কোনও মোড়ে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুড়লে তাঁর তিনজন স্টুডেন্টের গায়ে লাগবে। সাইন কস ট্যান থিটা বিটার চেয়ে তিনি ভালো জানেন দশ থেকে সতেরো বছরের ছেলেদের। এই পুঁচকে মেয়ে চার পাতা পড়ে সে-সব ছেলের মন তাঁর চেয়ে বেটার বুঝবে?
শুকিয়ে যাওয়া চোখ আবার ভিজে ওঠে। মেয়েটার ক্ষমতায় সংশয় করার স্পর্ধায় লজ্জা হয়। নিজের ঔরসজাত সন্তানের মন পড়তে পারেননি তিনি, অন্যের ছেলেদের মন বোঝার দেমাক এল কোত্থেকে? জোজো কোনওদিন আঙুল তুলবে না দাদুর দিকে, কিন্তু তিনি জানবেন এই পরিণতি থেকে জোজোকে রক্ষা করতে পারার দায় ছিল তাঁর। একমাত্র তাঁর। যাতে তিনি ডিসগ্রেসফুলি ফেল করেছেন।
***
সূর্য আজ এসপার-ওসপার করবে বলে মাঠে নেমেছে। স্নান সেরে যারা ঘাটে উঠছে, কংক্রিটে পরের পায়ের ছাপ পড়তে পড়তে আগের পায়ের ছাপ উবে যাচ্ছে। যাদের রুমাল আছে বেঁচে গেছে, যারা টিস্যু ব্যবহার করার চেষ্টা করছে কুচি কুচি কাগজ সারা মুখে গলায় সেঁটে থাকছে। গলির মুখের চায়ের দোকানের ছেলে দেড়-কর লম্বা কাগজের কাপে বেশি-মিষ্টি চা ধরিয়ে গেছে। আইস টি-র অপশন চাওয়ার স্পর্ধা দেখায়নি কেউ, গরম কিটকিটে চায়েই চুমুক দিচ্ছে। যারা টি পার্সন, যারা কফি পার্সন, যারা ডায়াবেটিক, যারা চিনির বদলে আর্টিসানাল মধু আর অর্গ্যানিক গুড় ধরেছে— সবাই।
থমকে থমকে কথোপকথন এগোচ্ছে। কী বলা যাবে, কী বলা যাবে না, বলার সময় কোন বাক্যের পর কতটা বিরতি— শিওর নয় কেউ। নর্মাল শোকপালনের একটা স্ক্রিপ্ট থাকে। ভালোই হয়েছে গেছে, কষ্ট পাচ্ছিল। সময় হলে যেতেই হবে, আটকানো যাবে না। আসলে তো কেউ যায় না, আমাদের মনে থেকে যায়। কোনওটাই এই সিচুয়েশনে খাটবে না। কতদিন ভেন্টিলেশন, কটা ওপিনিয়ন, আইসিইউ-র ভাড়াও অবান্তর। জানতে চাইলে জিজ্ঞাসা করতে হবে দড়ি না ওড়না। টুল না চেয়ার। পায়খানাপেচ্ছাপ হয়ে গিয়েছিল কি না, জিভ কতখানি বেরিয়ে গিয়েছিল। মনে মনে কৌতূহল থাকলেও মুখে ও সব উচ্চারণ করে না কেউ।
কাজেই আশপাশ দিয়ে কথা বয়। অমুককে বলা হয়েছে? গ্রুপে লেখা হয়েছিল তো। দাঁড়াও আর একবার লিখে দিই।
—টেম্পোরারি ইনস্যানিটি।
—আজকাল এত স্ট্রেস।
—মেন্টাল হেলথ ইজ আ বিস্ট।
—এখন তো তবু অ্যাওয়্যারনেস হচ্ছে।
—ড্রপ ইন দা ওশেন।
মাথার ভেতরে পাতি বাংলায় অপরাধবোধ শিকড় গাড়ে। অ্যাপল-ওয়াচ কবজির ফ্লিকে মাছি উড়ে যায়, গিল্ট অত সহজে ওড়ে না, মাথা থেকে মাথায় গুঁড়ি মেরে চারায়। দৃশ্য, শব্দ, মাঝরাতের ফোনকল, মেসেজ।
একদিন সব শেষ করে দেব, দেখবি।
কতবার সাড়া দেবে লোকে? পড়া ছেড়ে, ঘুম ভেঙে, খোঁয়ারি ছিঁড়ে, শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে দৌড়ে যাবে ক্যাম্পাসের ও-প্রান্তে? হোস্টেলের রুমের দরজা ধাক্কিয়ে দেখবে সব ফুরফুরে? একদিন না একদিন তো সহ্যের সীমা ছাড়াবে। ঘুম ভেঙে মেসেজ দেখেও পাশ ফিরে শোবে, পড়তে বসার আগে ফোন সুইচ অফ করবে, গাঁজায় দম দিতে দিতে বলবে, ছাড় তো। করতে দে শেষ। দম থাকলে এতদিনে করে ফেলত।
এবং কিছুই ঘটবে না। সবাই মুচকি হাসবে। দেখলি তো? ফুল রাখাল কেস।
নীতিশিক্ষাটা কী? অতবার মিথ্যে বাঘ বাঘ চেঁচাতে নেই। নীতিশিক্ষাটা কার জন্য? রাখালের। কেন? সর্বদা রাখালের জন্যই কেন? গ্রামবাসীদের জন্য কেন নয়? পিতা, প্রেয়সী, প্রতিবেশী, বন্ধু, সন্তানের জন্য কেন এই নীতিশিক্ষা থাকবে না যে যতবার চিৎকার হবে ততবার সাড়া দেবে। ততবার ছুটে যাবে। না হলে একদিন শ্মশানে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে, মুখে ফেনা তুলে এই মিথ্যে বলে যেতে হবে যে কিচ্ছু টের পাওয়া গেল না।
***
প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে বার্ধক্যের দিকে রওনা দেওয়া দুপুর ঢুলে পড়তে পড়তে লরির হর্নে চমকে ওঠে। কমফর্ট, ক্লাস, বয়স, লিঙ্গ, পরিচিতি অনুসরণ করে জটলা অ্যমিবার মতো ভেঙে ভেঙে যায়। আগের বডিটা কতক্ষণ ধরে পুড়ছে? আরে এ-সব চুল্লির মেন্টেন্যান্স নেই, এক ঘণ্টার মড়া তিন ঘণ্টা লাগাবে। ইন্ট্রোভার্টরা রক্তমাংসের সান্নিধ্য আর সহ্য না করতে পেরে আড়ালে গিয়ে টুইটারে ঢোকে। এক্সট্রোভার্টরা প্লাস্টিক চেয়ারে বসে নুয়ে পড়া ধূপের সারির নিচে ছাইয়ের আলপথ দেখে। পোড়া কাঠ, চটকানো কলা, ঘষা চন্দনগন্ধের মধ্যে বসে ঠাকুরমশাই দুলে দুলে মন্ত্র পড়েন।
সৎকারক ঘুরে ঘুরে কাজ করে। ঝাঁট দিয়ে বাসি ফুল সরায়। ঠোঁটে বিড়ি চেপে, জড়ো করে রাখা কাঠ তুলে এদিক থেকে ওদিক যায়। ঘামের গন্ধ ঝাপটা মারে প্রজ্ঞাপারমিতার নাকে। সেলারের তরফ থেকে আশ্বাস ছিল, ডিসক্রিট প্যাকেজিং। তবু হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর তো হওয়া যায় না। ওটিপি চেয়ে আসা ফোনের গলায় চিরুনি চালিয়ে খুঁজতে হয়, ক্লান্তি ও বিরক্তির নিচে কৌতুক গুঁড়ি মেরে আছে কি? বা আরও ভয়ের, করুণা? হ্যাঁ মাসিমা, ডেলিভারি নিয়ে নিন, পেমেন্ট করা আছে বলতে বলতেও বুক ধড়ফড়। বাড়ি ফিরে প্যাকেট হাতে নিয়ে শান্তি। ডেফিনিটলি ডিসক্রিট। প্রায় গোটা সেলোটেপের রোল দিয়ে মোড়া কার্ডবোর্ডের বাক্সের— অন্য বাক্সের মতো বাইরে রিসিটও সাঁটা নেই— ভেতর কালো প্লাস্টিক পেঁচানো আবার একটা বাক্স। রহস্যরোমাঞ্চ মাখামাখি সে বাক্সের মধ্যে পোক্ত প্লাস্টিকের প্যাকেজিং-এর গ্রুভে শুয়ে আছে সিলিকনের উদ্যত পুরুষাঙ্গ। একটি পরিপূর্ণ তৃপ্ত শীৎকার সহকারে পিতৃতান্ত্রিকতার লক্ষ্মণগণ্ডি অতিক্রম করে নিজেদের যৌনচয়েস ও প্লেজারে অবশেষে নিজেদের অধিকার কায়েম করার বিজয়নিশান। ঠিক যেরকম মেয়েরা পছন্দ করে। ক্যাটকেটে গোলাপি।
***
গর্ভগৃহে নেমে ছাই বার করে আনে সৎকারক। স্লিভলেস রিবক মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো তুলে শেষ চেষ্টা করে। তিনশো হবে না? সৎকারক মাথা নাড়ে। বাঁহাতে নোটটা নিয়ে রিবকের পাশে দাঁড়ানো বছর-পনেরোর ন্যাড়া, রোগা ছেলের বাড়ানো হাতে ছাই ধরায়। রিবক হাঁক পাড়ে। চ… চ… চ। লেভেল ক্রসিং-এ ফাঁসা এড়াতে লালনীল নাইটির ভিড় তুলে নিয়ে চার-পাঁচটা টোটো ঊর্ধ্বশ্বাস বেরিয়ে যায়। গোল হয়ে শুয়ে থাকা কুকুর ফাঁকা বটতলা পাহারা দেয়।
***
আর আধঘণ্টা, ম্যাক্স। পিণ্ড মাখা চলছে। চুল্লির সামনে বডি শুয়ে আছে। গলা ঘিরে কালশিটে গাঢ় হয়ে উঠেছে। ত্বক চামড়া হতে শুরু করেছে। ডানচোখের পাতা, বারবার হাত চেপে বন্ধ করা সত্ত্বেও খুলে চোখের সাদা বেরিয়ে পড়ছে।
আত্মীয়পরিজন পড়শিরা দূরত্ব মেন্টেন করছে। এই সব বডির ওপর কেউ আছড়ে পড়ে কাঁদে না। সম্ভব না। নিজের প্রতি যে এতখানি হিংস্রতা দেখাতে পারে, তার নিষ্প্রাণ শরীরটাকেও যেন বিশ্বাস করা যায় না। জীবনের শেষ মুহূর্তেও সারেন্ডার করতে পারেনি। পৃথিবীর চোখে চোখে রেখে আঙুল তুলে বলেছে, ব্যস।
পিণ্ড রেডি। এবার মুখে ঢেলে দিতে হবে। ঠোঁটের পাশ দিয়ে গলা বেয়ে নামবে চটকানো থকথকে মিশ্রণ। শেষযাত্রার আগে মৃতের প্রতি শেষ অশ্রদ্ধাজ্ঞাপন। ঠাকুরমশাই মন্ত্রপড়া পাটকাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে ছেলেটাকে ধরিয়েছেন। জ্বলন্ত পাটকাঠি হাতে বডি ঘিরে ছেলেটা ঘুরছে। ঘোরা শেষ।
ঠাকুরমশাই বলছেন, নাও এবার ছোঁয়াও।
ছেলেটা চুপ করে পাটকাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তটার ফাইনালিটি অতি বড় সাহসীকে থামিয়ে দেয়। যদি সব শেষ না হয়ে গিয়ে থাকে? যদি হঠাৎ নড়ে ওঠে? যদি ভেতরে কিছু একটা বেঁচে থাকে কোথাও? মাথায় সাদা ফেট্টি, ঠোঁটের কষ বেয়ে নামা পিণ্ড, চেনা মানুষের সঙ্গে প্রায় কোনও মিল না থাকা সত্ত্বেও, এটা জাস্ট খোলস, ভেতরে কিছু নেই জানা সত্ত্বেও তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া কি সোজা? তাছাড়া খোলসটাকেই যখন আসল জিনিস ভেবে এসেছি এত বছর? সেটাকেই মেজেঘষে ভেবেছি সেলফ লাভ?
এ সব মুহূর্তে কেউ তাড়া দেয় না। ছেলেটা জ্বলন্ত পাটকাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।
***
অনেক বছর পরে, অনেক বছর ধরে ওই মুহূর্তটা যখনই মনে করবে জোজো— বুদবুদটার কথা মনে পড়বে। আধখোলা চোখ আর চটকানো পিণ্ডমাখা খসখসে খোলসটা আর জোজোকে ঘিরে যেটা তৈরি হয়েছে। বাকি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেছে। বুদবুদের ভেতর রাগ নেই, দুঃখ নেই, শোক নেই, জোজোর মাথার ভেতর ননস্টপ কথা বলা চলা গলাটাও চুপ। জোজোও একটা খোলসে পরিণত হয়েছে। সে খোলসের স্মৃতি নেই, স্বপ্ন নেই। ভবিষ্যৎ নেই এগিয়ে যাওয়ার। অতীত নেই পিছু ফেরার। চেতনাহীন, বোধহীন সে ভ্যাকুয়ামে ক্রমে কয়েকটি অক্ষর, কয়েকটি শব্দ জমে একটি বাক্য তৈরি হচ্ছে।
আর দেখা হবে না। এই শেষ।
টা টা। জোজো হাত বাড়ায়। আগুন মুখ স্পর্শ করে। বুদবুদ ফেটে যায়।
***
বডি খাট থেকে নামিয়ে মাদুরের ওপর রাখে সৎকারক। হাঁক পাড়ে, কাকা!
কনভেয়ার বেল্টের ফান্ড এসেছিল। পৌরসভার টিউবজ্বালা, মাকড়সার ঝুলঝোলা কোনও ঘরের টেবিলে আটকে গেছে। এখন ম্যানুয়ালি চুল্লির ভেতর ছুড়ে ফেলতে হয়। বডির যা ওজন, ও একাই পারবে, তবু কাকাকে ডাকে। জীবন যত অগোছালোই হোক না কেন, শেষের পরের শেষটুকু ডিসিপ্লিন দাবি করে। সে ডিসিপ্লিন সৎকারক রক্ষা করবে।
ধনুক পায়ে দুলে দুলে কাকা আসে।
এবার দুজনে মিলে মাদুর তুলে মোমেন্টামের জন্য সেটা প্রথমে চুল্লির উল্টোদিকে নিয়ে গিয়ে তারপর এদিকে এনে বডি ছুড়ে দেবে চুল্লির ভেতর। সিম্পল ফিজিক্স। ইমপালস-মোমেন্টাম। নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র। কত মোমেন্টাম লাগবে, সে জন্য মাদুর কতটা উল্টোদিকে নিয়ে যেতে হবে নির্ভর করবে বডির ওজনের ওপর। যা পাওয়া যাবে জ্যান্ত বডির ওজন থেকে একুশ গ্রাম, অর্থাৎ প্রাণপাখির ওজন মাইনাস করলে।
এ সব গুগল উইকিপিডিয়ায় লেখা আছে। সৎকারক জানে জ্যান্ত বডির সঙ্গে মরা বডির ওজনের সম্পর্ক নেই। আঁজলাতে এঁটে যাওয়া বাচ্চা থেকে শুরু করে উদরিতে ফেঁপে ওঠা একশো বারো কেজির বডি তুলেছে ও, কারও মোমেন্টাম ঠিক করে ক্যালকুলেট করতে পারেনি। উদরি পালকের মতো হালকা ঠেকেছে, শরীরের অর্ধেক রক্ত ঘাম হয়ে বেরিয়ে গেছে পনেরো বছরের মেয়েকে তুলতে, যে প্রেমিককে অন্য মেয়ের সঙ্গে পুজোয় ঘুরতে দেখে হাতে ব্লেড চালিয়েছিল। কবজিতে তখনও ফেট্টি জড়ানো ছিল। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে শাড়ির পাড় ছিঁড়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল কেউ।
কেউ কেউ যাওয়ার অনেক আগে হাওয়া হয়। কেউ কেউ যাওয়ার পরও প্রাণপণ আঁকড়ে থাকে। কে কোনটা আগে থেকে বোঝা অসম্ভব।
ও নিচু হয়, কাকা নিচু হয়। ও স্টেডি, কাকা স্টেডি। ওপাশে জিটি রোডের কুরুক্ষেত্র, এপাশে নিয়মিত ইন্টারভ্যালে ভোঁ দেওয়া গঙ্গা, টোটোস্ট্যান্ডের হাহাহিহি, কুকুরের কামড়াকামড়ি-র মধ্যেই নীরবতার অদৃশ্য তাঁবু জমি থেকে উঠে, আকাশ থেকে নেমে আসে। সে তাঁবুর ভেতর এখন শুধু চুল্লির গোঁ গোঁ, আঁচের হলকা। দুজনে মিলে মাদুর হ্যাঁচকা দিয়ে তোলে। নিখুঁত ক্যালকুলেশনে মাদুর দুলিয়ে বডি ছুড়ে দেয় চুল্লির ভেতর।
সৎকারক চেঁচিয়ে ওঠে, হরিবোওওওল!
বডি উড়ে গিয়ে চুল্লির ভেতর পড়ে। একটা শরীর, একটা জীবন, একটা গল্পে ডবল দাঁড়ি।
কাকা পেছন ফিরে ধনুক পা নিয়ে দুলে দুলে চলে যায়। চাটাই টেনে গহ্বর চাপা দেয় সৎকারক। আপাতত ওর কাজ শেষ। পাপ পুণ্য কাম ক্রোধ পুড়িয়ে ছাই করার দায়িত্ব অগ্নিদেবতার। দেওয়ালে টাঙানো শার্ট থেকে দেশলাই আর বিড়ি নিয়ে বেরোনোর জন্য রেডি হয়। ফাঁকা চাতালে চাটাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।
—এই গরমে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। বাইরে গিয়ে বসুন। বেশিক্ষণ লাগবে না। খুব জোর পঞ্চাশ মিনিট।
***
হাঁসফাঁস, লেদার জুতোর ঘষটানি, একটা জুম আর অগুন্তি অপরচুনিটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আফসোস থেমে যায়। ওই চাপা দেওয়া গহ্বরটা যেন একটা পোর্টাল। কিছুক্ষণের জন্য যার ঢাকনা সরেছিল। অন্ধকারের মধ্যে জীবনের মতোই আদিম ও অলঙ্ঘ্যণীয় কিছু নড়ছিল-চড়ছিল। যার আঁচ, চাপা গর্জন, দুটো জগতের সীমারেখা ঘেঁটে দিয়ে গেছে। যা ছিল যা নেই, যা নেই কিন্তু আছে, যা এখনও ঘটেনি কিন্তু ঘটবেই। ব্যস্ততা দিয়ে গাঁথা সাততলা সাম্রাজ্যের অ্যাবসার্ডনেস মনে পড়িয়ে দিয়েছে। ঝোড়ো হাওয়ায় সব পাতা উল্টে রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের লাস্ট লাইন দেখিয়ে দিয়েছে— স্পয়লার সতর্কীকরণ ছাড়াই।
পাঁচ মিনিট। চার মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড, মোর লাইকলি। গঙ্গা দিয়ে ভোঁ বাজিয়ে লঞ্চ যায়। জিটি রোড দিয়ে হর্ন বাজিয়ে তিন নম্বর। একটা-দুটো করে টোটো ট্রিপ খেটে বটতলায় ফিরে আসে। কাঁচাঘুমভাঙা কুকুর গরগর করে জায়গা ছাড়ে।
ঘোর কেটে যায়। হইহই করে ফিরে আসে ইএমআই, এসআইপি, গোলাপি ডিলডো। অমরত্বের প্রত্যাশা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়।
***
জোজোর কাঁধ চাপড়ে কিছু লোক বেরিয়ে যাচ্ছে। পুরুষরা বলছেন, যা লাগবে কোনও সঙ্কোচ না করে জাস্ট গিভ আ পিং। মহিলারা বলছেন, সকাল থেকে কিছু তো পেটে পড়েনি।
তিনটে তেত্রিশের রোদে গঙ্গা চকচক করছে। ঘাটের তিন-চারটে সিঁড়ি নেমে জোজো বসে। টের পায় কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ওপারে কাগজ কারখানার এলানো ত্রিভুজের খাঁজে খাঁজে বিকেল জমছে। অলস নৌকো জলে ভাসছে। কাল যেমন ভেসেছিল। আবার কাল যেমন ভাসবে। আজকের দিনটা কি আশ্চর্যরকম অন্য দিনের মতো। রোদ, জল, জোজোর ঘামে ভেজা টিশার্ট— সব। সো। ফাকিং। অর্ডিনারি।
সৎকারক ছেলেটা ওরই বয়সী হবে, দু-এক বছরের এদিকওদিক। জোজো একটা মৃত্যুকে হ্যান্ডল করতে পারছে না আর ওই ছেলেটা মৃত্যুর কত কাছাকাছি বসবাস করে। ছেলেটার ‘হরি বোওওওল’ কানে বাজে। কী দৃপ্ত, কী সপাট। বিদায়ফিদায় অশ্রু-ফশ্রুর প্যানপ্যানানিহীন। যার যার নিজস্ব নাগরদোলার উন্মাদ ঘূর্ণি পূর্ণ করে মাঠ ছাড়ার মানানসই গান স্যালুট।
কারা যেন বলছিল, একা এসেছ একা যেতে হবে। বুলশিট। আসার ব্যাপার জানে না জোজো, কিছু কিছু যাওয়া নিঃসন্দেহে কো-অপারেটিভ উদ্যোগ। এই সমবায়িক মরণে যার অ্যাবসলিউটলি কোনও হাত নেই, শেষ গান স্যালুট দেওয়ার অধিকার শুধু তারই আছে। ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে জোজো।
বড় ঢেউয়ের পাশে ছোট ঢেউ, ছোট ঢেউয়ের পাশে আরও ছোট ঢেউ, সে ছোট ঢেউয়ের পাশে আরও ছোট ঢেউ। তাদের ভাঁজে ভাঁজে রোদ্দুর একবার ধূসর, একবার রুপোলি, আচমকা গাঢ় নীল। জোজোর ভেতর শব্দহীন রেখা ও রঙেরা নড়েচড়ে। এদের দুভাবে মনে রাখতে পারে জোজো। মুঘল মিনিয়েচারের নির্মম ডিসিপ্লিনে। প্রতিটি গাছের প্রতিটি পাতার শিরা-উপশিরা, আঙুলের নখ, ওড়নার ভাঁজ গুনে গুনে। কথোপকথনের প্রতিটি বিরাম, প্রতিবার হাত বাড়িয়ে উল্টোদিকের হাত ছুঁতে না পেরে গুটিয়ে নেওয়া, প্রতিটি আলগোছ আঘাত, প্রতিটি সারকাজম, প্রতিটি গিলে নেওয়া দীর্ঘশ্বাস, প্রতিটি ফেটে পড়া এবং শেষমেশ হাওয়ায় দুলতে থাকা কানফাটানো নীরবতা— চিরকালের মতো খোদাই করে রাখতে পারে, যাতে ইচ্ছেমতো কেউ সেগুলোকে ধেবড়ে দিতে না পারে।
কিন্তু সত্য কি চিরকালের হয়? ধ্রুব হয়? সত্যের আউটলাইন কি সর্বদাই ঈষৎ ধ্যাবড়ানো নয়? সেক্ষেত্রে কি বেটার নয় ক্লড মনে-র উৎক্ষিপ্ত ব্রাশস্ট্রোকে আকাশ জল একশা করে দেওয়া? টার্নারের উন্মত্ততায় যুদ্ধশ্রান্ত টেমেরেয়ারের মাস্তুল আকাশ একাকার করে দেওয়া? কার দায়, কার নয়, কী হলে কী হতে পারত, কী না হলে কী এড়ানো যেত-য় বিস্মরণের ব্রাশ ঘষে, যা হয়েছে, ক্যানভাস জুড়ে শুধু সেটাকেই ফোকাসে রাখা?
নাকি সেটা কাপুরুষতা? পালানো? নিজেকে সহজে ছাড় দিয়ে দেওয়ার অজুহাত?
জোজো খুঁজেছিল। টেবিল হাঁটকে, ডায়রি উল্টে, কবিতার বইয়ে গুঁজে রাখা রিসিটের পাতা খুলে। ওর জীবনের উইয়ার্ডতম সকালে, এক আদ্যন্ত অবাস্তব রিয়েলিটিতে শ্বাস নিতে নিতেও জোজোর ব্রেন আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। নেই। কিছু লিখে যাওয়া নেই। জোজোর দিকে কোনও আঙুল তোলা নেই। জোজোর নিজেকে ডিফেন্ড করার কোনও প্রয়োজন নেই। কারও কাছে ক্ষমা চাওয়ার নেই। নিজেই নিজেকে ক্ষমা করে যেতে হবে জোজোর আজীবন। কারণ কিছু লেখা থাকুক না-থাকুক, কেউ আঙুল তুলুক না-তুলুক, জোজো জানে এক্স্যাক্টলি কোন মুহূর্ত থেকে বলটা গড়াতে গড়াতে এই গঙ্গার ঘাটে এসে পৌঁছল। কোন ঘটনাটা হয়ে উঠল উটের পিঠের শেষ খড়কুটো। কফিনে শেষ পেরেক। সলতেয় আগুন।
সে সলতেয় কে আগুন ধরিয়েছিল জোজো জানে। ও।
***
ডাইনিং টেবিলে আর্ট কলেজের লোগোওয়ালা খামটা পড়েছিল। পড়ে ছিল না, ফেলা ছিল। পড়ে থাকার মধ্যে যে দৈবাতের দ্যোতনা, তার আড়ালে আর লুকোবে না জোজো।
—আমি খড়গপুর যাব না। কলকাতায় থাকব। ছবি আঁকব। মাইনের টাকা তোমাকে দিতে হবে না, টিউশনি করে জোগাড় করব।
বাবা হেঁটে হেঁটে জোজোর পাতা ফাঁদে ঢুকে গেল।
—জোজো, এত কষ্ট করে তোকে বড় করেছি। যা চেয়েছিস দিয়েছি। আই হ্যাভ স্যাক্রিফাইসড আ লট ফর ইউ। আমি কিন্তু বলে দিচ্ছি জোজো, তুই খড়গপুর না গেলে আমি সুইসাইড করব।
ইগনোর করাই যেত। প্রথম তো শুনছে না। শব্দগুলোর এত বছরে দাঁতনখ হারিয়ে শুধুমাত্র ধ্বনিতে পরিণত হওয়ার কথা, কিন্তু সেদিন জোজো তা হতে দেয়নি। সমারোহে ওদের চামড়ার ভেতর আবাহন করেছে, উদ্যোগ নিয়ে রক্তস্রোতে বইয়ে দিয়েছে, যাতে ওরা মগজের কোণে কোণে ঢুকে রাতজাগা বালকের আতঙ্ক জাগিয়ে তুলতে পারে। অন্ধকার ঘরে ঘুম ভেঙে সিলিং ফ্যানের দিকে চোখ পড়লে, বাবার ঝুলন্ত দুলন্ত মৃতদেহ কল্পনা করে যে বালকের শরীর ঘামে ভিজে যায়, ভেজানো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বাবার ঠোঁটের কষে ফেনা, রক্তমাখা কবজি কল্পনা করে যে কিশোরের হৃদপিণ্ড হাতে চলে আসে। যে জোজো জানে বাবার এই পরিণতি না ঘটতে দেওয়ার দায়িত্ব সামহাউ ওর। বেসলেস জেনেও জোজো কিছুতেই যে এ বিশ্বাস উপড়ে ফেলতে পারে না— ভালোবাসা আর ব্ল্যাকমেল সমার্থক।
ভয় পেতে পেতে, ঘষা খেতে খেতে জোজোর স্নায়ুসিস্টেম যে অব্যবহিত বিস্ফোরণের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, সে বিস্ফোরণকে বছরের পর চাপা দেওয়ার, সে উদ্গীরণকে বছরের পর বছর গিলে নেওয়ার শ্রান্তি ও ক্ষয় আর এক মিলিসেকেন্ডের জন্য অ্যালাউ করেনি জোজো। বাবার স্তম্ভিত দৃষ্টি, মায়ের চাপা গলার তীব্র ‘জোজো!’-র ওপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছে। গলা কাঁপেনি, জিভ জড়ায়নি।
—বাবা, ইউ নো হোয়াট? প্লিজ, করো তুমি সুইসাইড। একবার সত্যি সত্যি মরে গিয়ে দেখিয়ে দাও। যাতে আমরা বাঁচতে পারি।
***
অন্য সব সকালের মতো শুরু হওয়া সকালগুলোই ডেঞ্জারাস। পূর্বাভাস মেনে সূর্য উঠেছিল পাঁচটা সাঁইত্রিশে, মোস্টলি ক্লিয়ার আকাশে যে সিরাসেরা পূর্বদিকে ভেসে ভেসে যাচ্ছিল, দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ছয় থেকে নয় কিলোমিটার বেগে বওয়া সমীরণের সঙ্গে তাদের দেখা হবে কি না বলা যাচ্ছিল না। সৃঞ্জয় সেন রান্নাঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে ঘোষণা করছিলেন যে তাঁর সহ্যের সীমা অবশেষে পার হয়েছে, তিনি পারছেন না, সত্যিই পারছেন না, এই বার তিনি নিজেকে শেষ করবেন। কেউ জানতে চাইছিল না কেন, কারণ এই পয়েন্টে নো ওয়ান কেয়ারস। সৃঞ্জয় সেন নিজের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়েছিলেন। পরের চল্লিশ মিনিট ধরে ঘোষেদের ট্যাঙ্ক ওভারফ্লো করল, ক্লাইমেট চেঞ্জের চিন্তায় ঠাকুরবউদির ভাত হজম হল না, কিছু বলা হয় না বলে ঠিকে ঝি-দের বাড় বাড়াবাড়িরকম বাড়ল। সৃঞ্জয় সেন দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। বাথরুমে ঢুকলেন। বেরোলেন। ফুরফুরে গলায়— শুনছ?— বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে হাঁটলেন। থালায় নুনহলুদ মাখা কাতলার পিস, খুন্তি, নেভা বার্নারে বসানো কড়াইয়ে ঠান্ডা সর্ষের তেল। সৃঞ্জয় সেন— কী গো— বলতে বলতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে— কোথায় গেলে— বলতে বলতে এদিকওদিক তাকালেন। তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করে জোজোর বন্ধ দরজায় টোকা দিলেন। জোজো ঝাঁজিয়ে উঠল। কী?
—তোর মাকে দেখেছিস? ফুরফুরে গলায় জানতে চাইলেন সৃঞ্জয় সেন।
—না।
সৃঞ্জয় সেন বেডরুমে গেলেন। দ্বিতীয় বাথরুম চেক করলেন। রান্নাঘরে ফেরত এলেন। থালায় নুনহলুদ মাখা কাতলার পিস, খুন্তি, নেভা বার্নারে বসানো কড়াইয়ে ঠান্ডা সর্ষের তেল। সৃঞ্জয় সেন সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে গলা ছাড়লেন। এবার নাম ধরে।
জোজো দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
—মা? মাআআআ?
—দাদুর ঘরে নাকি? দ্যাখ তো।
সৃঞ্জয় সেনের কথা শেষ হওয়ার আগে দুটো করে সিঁড়ি টপকাতে শুরু করল জোজো। যাওয়ার পথে একতলা দোতলার মাঝে খাপছাড়া ঘরটার— যা গোছালেই হয় তবু অগোছালো জিনিসে গাদাগাদি, লুচি হওয়া এবং কোনওদিন পড়া না হওয়া বইয়ে ঠাসাঠাসি— দরজায় ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে বন্ধ।
থমকাল জোজো। একবার, দুবার, তিনবার ধাক্কাল। দাদুর বাবার আমলের ছিটকিনি হার মানল, জোজো হুমড়ি খেয়ে চৌকাঠ পেরোল। রিফ্লেক্সে বাবাআআআ চিৎকার বেরিয়ে আসার আগে, মাধ্যাকর্ষণের কাছে নিঃশর্ত নতিস্বীকারের আগে কী দেখেছিল এখনও শিওর নয় জোজো। উল্টোনো টুল? কালো শাড়ির আভাস? সোনালি পাড়ের কুচি? জোজোর পর যারা দৌড়ে ঢুকবে ঘরে, জোজোকে টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করবে, জোজোকে পেরিয়ে ছুটে যাবে উক্ত দৃশ্যের ভেতর— তাদের কেউ কেউ হয়তো দেখতে পাবে। কেউ কেউ তখনও পাবে না।
মরে যাব মরে যাব বলার থেকে মরে যাওয়া কত সহজ।
***
ছোটমামা খবর আনেন। বার্নিং শেষ, ওরা চুল্লি ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষা করছে। তারপর ছাই বার করে দেবে।
স্বস্তির মেক্সিক্যান ওয়েভ খেলে যায়। এই গরমে এতক্ষণ শোকের মুখোশ পরে থাকা থেকে মুক্তি। সে স্বস্তি লুকিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে সবাই বেরোনোর অনুমতি চায়। ওদিকে আবার, বুঝতেই তো পারছ। স্বস্তি লুকিয়ে ছোটমামা বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, গো অ্যাহেড, আমি ফোন করব। এর পরে কী হবে, কবে হবে এটসেটরা।
চারদিনে হবে। অপঘাত তো। বিশেষজ্ঞরা জানান। বিচক্ষণ মামা ঘাড় না পেতে বলেন, দেখা যাক। ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে যা স্থির হবে জানাব।
গেট দিয়ে ভিড় বেরোয়। কাল পরশু সময় করে বাড়িতে যাব একবার। এনিথিং ইউ নিড, জাস্ট পিং। বাড়ি গিয়ে কিছু মুখে দিস। প্রজ্ঞাপারমিতার সঙ্গে সৃঞ্জয়ের দেখা হয়। প্রজ্ঞা গম্ভীর। সৃঞ্জয় বিভ্রান্ত। নীরবতার কয়েকটি মুহূর্ত পেরিয়ে সৃঞ্জয় বলে ওঠেন, আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না এখনও। এ সব কী করে হল? কেন হল?
***
সৎকারক ছাইয়ের সরা জোজোর দিকে এগিয়ে ধরে। জীবন যে একমুঠো ছাই থিওরেটিক্যালি সবাই জানে, প্রথমবার প্র্যাকটিকালি দেখে চমকায়নি এমন লোক দেখেনি সৎকারক।
অবশেষে জোজোর আওয়াজ বেরোয়। থ্যাঙ্ক ইউ। পেমেন্টটা…
—কাকা দেখে নিয়েছে।
ছোটমামা জোজোর নাম ধরে ডাকেন। জোজো পেছন ফিরে হাঁটে। সৎকারক ফিরে আসে। দেওয়ালের ফ্যান ঠেলে হাওয়ার মুখ পছন্দমতো ঘুরিয়ে বিড়ি ধরায়। দগ্ধ দেশলাই ছুড়ে দেওয়ালে হেলান দেয়। ইন্সটা খোলে। নাচ শুরু হয়। বলিউড বিটিএস সাদা কালো চিনা জাপানি সালসা ট্যাঙ্গো কুচিপুরি নাঙ্গা। গেট দিয়ে গাড়িরা মিছিল করে বেরোয়। সৎকারক আনমনা তাকিয়ে থাকে।
ছাইটুকুই অল্প। আমরণ যা বুকের ভেতর বইতে হবে, সেটা অল্প হবে না।

