নীহারকান্তি হাজরা
নদ-নদীর সঙ্গমভূমে
অধ্যায় ১: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪
বিডিআর— বড় দুঃখের রেল
বাঁকুড়ার পথের কথার স্মৃতির অনেকখানি জুড়ে আছে এক বিচিত্র রেলপথের কথা, যার উল্লেখ আগে করেছি— পোশাকি নাম ‘বাঁকুড়া-দামোদর রিভার রেলওয়ে’। কিন্তু সে-নাম মনে হয় না খুব বেশি লোক জানত, তা পরিচিত ছিল আদ্যক্ষর দিয়েই— বিডিআর। রসিক বাঁকুড়াবাসী যার পূর্ণঙ্গ রূপ দিয়েছিল ‘বড় দুঃখের রেল’! আমাদের গ্রামে ছুতোরপাড়ার বেশ কিছু যুবক যে বিডিআর কারখানায় কাজ করত তা উল্লিখিত। প্রযুক্তিবিদের অধীনে তাদের কাজ ছিল কামরা মেরামত বা নতুন করে তৈরি। কারখানাটা ছিল জেলাসদর ঢোকার মুখে লালবাজারের শুরুতে ঠিক বাঁদিকের সেকেন্ড ফিডার রোড ধরে তার শেষ মাথায়। ফিডার রোড শেষ হয়ে ডানদিকে ঘুরে নতুনগঞ্জের রাস্তা শুরু হতেই ডানদিকে বিডিআর রেলের স্টেশন, হেড অফিস। বাঁদিকে বিএনআর রেলের বাঁকুড়া স্টেশন। আর এই দুই রেলপথের জন্যই বিএনআর-এর বাঁকুড়া স্টেশনের দুই প্রান্তে হলুদ বোর্ডের উপর লেখা থাকত বাঁকুড়া জং।

১৯১৬ সালে ভারত সরকারের সমূহ কর্তৃত্বে আর ইংল্যান্ডের ম্যাকলিওড কোম্পানি লিমিটেডের (এদের হেড অফিস ছিল কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে) ৩৪ লক্ষ টাকা পুঁজি লগ্নিতে চালু হয়েছিল বিডিআর। ন্যারোগেজ। সিঙ্গল ট্র্যাক। শেয়ার পুঁজির লাভ পাঁচ লক্ষের উপরে উঠলেই সমান ভাগাভাগি হত ভারত সরকারের সঙ্গে। আর বছরে ৩.৫ শতাংশ হারে দেয় সুদের নিচে নামলেই ভারত সরকার পুষিয়ে দিত। কেন? তো এটা একটু পরে।
বাঁকুড়া থেকে দামোদর নদীর তীর পর্যন্ত রেলপথটি তিন পর্যায়ে তৈরি হয়েছিল। কিঞ্চিৎ উত্তর ছুঁয়ে তারপর পুবে। প্রথমটি বাঁকুড়া থেকে ইন্দাস ৬৮.১৪ কিমি। ইন্দাস থেকে সেহারাবাজার ১৮.৮০ কিমি। সেহারাবাজার থেকে রায়নগর ৯.৫৭ কিমি। এরপর দামোদরের ফেরিঘাট পার হয়ে বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিতে। লাইন-বরাবর জমি দিয়েছিল ভারত সরকার। তবে এর কর্তা রইল তারা।
কেবল পূর্বদিকটা ছাড়া বাঁকুড়া জেলার অধিকাংশ জায়গাটা ছিল গভীর জঙ্গল। এখান থেকে সংগৃহীত হত টিম্বার (কাঠ বললে কাষ্ঠসম্পদ বোঝায় না)। প্রায় পুরোটাই শাল। তারপর সেগুন, পিয়াশাল। জেলার পূবদিকটা ধীর পায়ে এগিয়ে মাটির রুক্ষ ঢেউ ফেলে রেখে গাঙ্গেয় সমভূমিতে মিশেছে। জেলার বাকি তিনদিকের বেশ উঁচু-নিচু জমাট তামাটে নুড়ির ঢেউয়ের মাঝে মধ্যের উপত্যকায় সঞ্চিত মাটিস্তর ধরে চলত চাষাবাদ। বিডিআর রেলের ছোট ছোট ওয়াগন ভর্তি হয়ে অনেক ধরনের ফসল চলে যেত দামোদরের এপারে রায়নগর। রেলপথের শেষ। দিনে চারটি মালগাড়ি চলত। এরা বইত টিম্বার, জ্বালানি কাঠ, তৈলবীজ আর ধান। এই রেলপথের সুবাদে জেলার উত্তর ছুঁয়ে পূর্বদিকের বড় জনপদগুলিতে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু চাল আর তেলকল।

তিনটি প্যাসেঞ্জার গাড়ি বাঁকুড়া থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করত। তিন-চারটে বগি নিয়ে। মনে আছে প্রত্যেক বগির গায়ে একটা বড় অ্যানোফেলিস মশার ছবি থাকত। তার নিচে লেখা, ‘ম্যালেরিয়া বাংলার মৃত্যুদণ্ড’। ভিতরে দুটি সাবধানবাণী ছিল: ‘ঝড়ের সময় জানালা দরোজা খুলিয়া রাখিবেন, নতুবা গাড়ি উল্টাইয়া যাইতে পারে।’ এবং ‘দুই পাশ সমান করিয়া বসিবেন নতুবা গাড়ি উল্টাইয়া যাইতে পারে।’

অনেক সময় দুই স্টেশনের মাঝে ভিড়বর্তী মানুষ হাত তুললেই পরম করুণাময় ড্রাইভার গাড়ি থামাতেন। এভাবেই এই রেলগাড়িটি হয়ে উঠেছিল গ্রামীণ মানুষের গৃহপালিত প্রাণীর কোনও একটি। মাঝেমধ্যেই এর নানা যান্ত্রিক গোলযোগ ঘটে গাড়ি থেমে গেলেই যাত্রী বা আশপাশের গ্রামের লোকেরা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসত। আবার আকছার একটা বিপদ ঘটত: কাপলিং খুলে যাওয়া। ইঞ্জিন একটা বগি নিয়ে চলে গেল, পড়ে রইল বাকিটা। এরকম একটি ঘটনা আমার দেখা। বাঁকুড়া স্টেশন ছেড়ে খানিকটা এলেই পথটা বেশ উঁচু। একেবারে গন্ধেশ্বরী নদীর ব্রিজ পর্যন্ত। ইঞ্জিন ক্লান্ত হয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে লালবাজারের ফটক পার হয়ে একটু এগোতেই একটা বগি নিয়ে ইঞ্জিন বেগে চলে গেল। বাকি তিন কয়েক গজ গতির টানে এগিয়ে গিয়ে যাত্রা শুরু করল পিছনের দিকে। যে সময় ইঞ্জিন গন্ধেশ্বরীর ব্রিজ পার হয়ে বিকনা স্টেশনে, তখন ফেলে যাওয়া টুকরো বাঁকুড়া ফিরছে। যাত্রীরা এতে রাগ করত না। এই রেলগাড়িটি চেপে তো কেউ অফিসকাছারি করত না। গ্রামে ফেরা ঘড়ি ধরে নাই হল!

কালক্রমে অতিরিক্ত আপন হতে হতে ক্রমশ রেলগাড়িটি রক্তশূন্য হয়ে গেল। আর একটা বড় কারণও ছিল। সেটা হল নতুন করে পুরনো রাস্তার সংস্কার আর নতুন রাস্তা তৈরি। জেলা বোর্ডের অধীনে যে কাঁচা রাস্তাগুলি জেলাভর ছড়িয়ে ছিল সেগুলির সংস্কার শুরু হল। কিছু কিছু হল নতুন রাস্তা। শুরু হল জেলার সব জায়গায় বাসচলাচল। আমার পিতৃদেবের মামাতো ভাই ফকিরচন্দ্র রায় বাঁকুড়া-সোনামুখী বাস চালানো শুরু করলেন। এর ড্রাইভার ছিল আমাদের গ্রামের হিরু কামার। বিডিআরকে পিছনে ফেলে এগুলি আগেই পৌঁছে যেত ঠিকানায়। লরিচলাচলের ফলে মালপত্র পৌঁছে যেতে লাগল ঠিকানা থেকে ঠিকানায়। এর ফলে আমাদের গ্রামের লোকোশপের সূত্রধরেরা যেমন বেকার হয়ে গেল তেমনই রেলের কর্মচারীদের মাইনে অনিয়মিত হয়ে গেল— তারপরে ছাঁটকাট হতে লাগল। এরকম একটা সংকটকালে আমাদেরই গ্রামের এক বিখ্যাত চাটুজ্জেমশায়ের ছেলে, যিনি এই রেলের উচ্চপদের প্রযুক্তিবিদ ছিলেন, তিনি রেলের সাময়িক আয়ের বলিহারি উপায় বার করলেন। সাতানব্বই মাইল রেলপথের দুপাশের খেজুরগাছ মহলদারদের কাছে ইজারা দেওয়া শুরু করলেন। শীতকাল ধরে তৈরি গুড়ের আয় মাইনে পদমর্যাদা অনুযায়ী ভাগ হতে লাগল।
আমার সঙ্গে একটি ছেলে পড়ত যার নাম আমার আর মনে নেই, তার পিতা ছিলেন রেলের বুকিং ক্লার্ক, তাকে মাস্টারমশাইয়েরা বিডিআর বলে ডাকতেন। চারপাশে ঘুঁটেছাপা তাদের রেলকোয়ার্টারে গিয়ে দেখা এক অসহায় পরিবারের ছবি আজও আমার মনে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত রেলের ইন্তেকাল এসে গেল ১৯৯৫ সালে। তারপরে বছর দশেক আন্দোলনের কাল শেষ করে জেলার এমপি বাসুদেব আচার্য, যিনি রেলবোর্ডের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন, তাঁর চেষ্টাতেই এই রেল ব্রডগেজ হয়ে গেল ২০০৫ সালে। বেড়ে চলে গেল মশাগ্রাম পর্যন্ত।
[ক্রমশ]

