ভোটাধিকার বঞ্চিত করার প্রান্তে

যোগেন্দ্র যাদব, রাহুল শাস্ত্রী

 

উপসংহার অতি স্পষ্ট: যদি নির্বাচন কমিশন তার ইচ্ছামতো এই ১১টি নথির মধ্যে অন্তত একটি জমা দেওয়ার নিয়মে অনড় থাকে, তাহলে ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের অন্তত ৫০ শতাংশ ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারেন। সর্বশেষ অনুমান অনুযায়ী, দুটি জেলার অনানুষ্ঠানিক তথ্যের ভিত্তিতে, ২০০৩ সালের ভোটার তালিকার এক-তৃতীয়াংশকেও নির্বাচন কমিশন খুঁজে পায়নি। সেক্ষেত্রে অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৪.৮ কোটি মানুষের কাছে নথি চাইতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ না করলে এবং নির্বাচন কমিশন এই শর্ত শিথিল না করলে, বর্তমান খসড়া ভোটার তালিকার ৭.২৪ কোটির মধ্যে ২.৪ কোটি মানুষের ভোটাধিকার হারানোর ঝুঁকি থাকবে। এটা হবে কোনও নির্বাচনী গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভোটার বঞ্চনা

 

চলমান বিশেষ নিবিড় সংশোধন (Special Intensive Revision বা এসআইআর) প্রক্রিয়া নিয়ে একটি সহজ কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে— বিহারের প্রাপ্তবয়স্ক বাসিন্দাদের মধ্যে কত শতাংশের কাছে ভারতের নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) ঠিক করে দেওয়া ১১টি নথির অন্তত একটি রয়েছে, যা তারা তাঁদের কাছ থেকে চাইছে? এই প্রশ্নের উত্তরই প্রথমে বিহার এবং পরে গোটা দেশে কারা ভোটার হতে পারবে, তা নির্ধারণ করবে।

অবশেষে আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এক অদ্ভুত সরকারি জবাব পেয়েছি, যা তারা সুপ্রিম কোর্টে এক পাল্টা হলফনামা হিসাবে দাখিল করেছে। বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে যে, যোগ্যতার নথির মোট সংখ্যা বিহারের সম্ভাব্য ৭.৯ কোটি ভোটারের প্রায় তিনগুণ।

এই অসাধারণ দাবির ভিত্তি কী? সৌভাগ্যক্রমে, কমিশন প্রতিটি নথির পরিসংখ্যান-সম্বলিত একটি টেবিল দিয়েছে। তার উপসংহার সন্দেহজনক হলেও তা এমন কিছু সরকারি তথ্য দেয় যা জনসমক্ষে সহজে পাওয়া যায় না। আমরা কমিশনের দাবি যাচাই করেছি এবং লেখকদের একজনের দেওয়া প্রাথমিক অনুমান সংশোধন করেছি।[1]

সংযুক্ত টেবিলে প্রতিটি নথি নিয়ে ইসিআই-সিএ-র দাবি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় কলামে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া সংখ্যা রয়েছে। যেহেতু তারা তা জনসংখ্যার অনুপাতে প্রকাশ করেনি, আমরা সম্ভাব্য ভোটারের শতকরা হারের উল্লেখ করেছি। তৃতীয় কলামে সরকারি তথ্য-সহ প্রকাশ্য সূত্রের ভিত্তিতে প্রকৃত অবস্থা দেখানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে ১৮-৪০ বছর বয়সী যোগ্য ভোটারদের শতাংশ ধরা হয়েছে, কারণ ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় এই অংশের নাম থাকার সম্ভাবনা কম এবং এদেরকেই এই ১১টি নথির একটি জমা দিতে হতে পারে।

প্রথম শ্রেণির (ক্যাটেগরির) ছয়টি নথি নিয়ে তেমন মন্তব্যের প্রয়োজন নেই— এগুলো হয় অপ্রাসঙ্গিক, নয় অতি সামান্য, এগুলো নিয়ে তর্ক নেই। এনআরসি বিহারে প্রযোজ্য নয়। সরকার, এলআইসি বা পিএসইউ কর্তৃক জারি করা কোনও পরিচয়পত্র বা নথির শর্ত হচ্ছে, তা অবশ্যই ১৯৮৭ সালের আগে ইস্যু করা হতে হবে। ফলে ইসিআই স্বীকার করেছে এগুলো কার্যত অস্তিত্বহীন। একইভাবে, বিহারে তফসিলি উপজাতির জনসংখ্যা মাত্র ১.৩ শতাংশ এবং বনাধিকার আইনের আওতায় মাত্র ১৯১টি আবেদন হয়েছে— এটা নগণ্য। সরকারি কর্মচারীদের পরিচয়পত্রের সংখ্যাটি সামান্য বেশি ধরা হয়েছে, কারণ পেনশনভোগীদেরও ধরা হয়েছে, যাঁরা ১৮-৪০ বয়সসীমায় পড়েন না। পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও সংখ্যা কিছুটা বেশি ধরা হয়েছে, কারণ এর মধ্যে মৃত ব্যক্তিদের অবৈধ পাসপোর্টও রয়েছে।

মাধ্যমিক পরীক্ষার সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে ইসিআই যে সংখ্যা দিয়েছে তা অপ্রাসঙ্গিক সাল (১৯৮০-২০২৫) থেকে নেওয়া, যা ২০০১-২০২৩ সীমার মধ্যে হওয়া উচিত। ফলে আমাদের হিসাব ২.০৬ কোটি, যা ইসিআই-এর ২.৯১ কোটির চেয়ে অনেক কম। তবে প্রাসঙ্গিক বয়সসীমায় (১৮-৪০) মাধ্যমিক পাশের হার বেশি হওয়ায় আমাদের আনুমান অনুযায়ী সেই হার ৪৩.৩ শতাংশ, যা ইসিআই-এর ব্যবহৃত প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার হার ৩৬.৮ শতাংশের চেয়ে বেশি। সিবিএসই ও আইসিএসই পরীক্ষার্থীদের যোগ করলে হার কিছুটা বাড়তে পারে, কিন্তু স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত অনেক মানুষকে বাদ দিলে তা কমতেও পারে।

এবার আসি বাকি পাঁচটি নথির ক্ষেত্রে, যেখানে ইসিআই-সিএ প্রায় ভিত্তিহীনভাবে বিরাট দাবি করেছে। স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে প্রথমেই বলেছে— “বিহারে স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না।” সে-ক্ষেত্রে সংখ্যা শূন্য হওয়া উচিত। অথচ পরের বাক্যেই তারা— কোনও উৎস উল্লেখ না করেই— দাবি করেছে যে ২০১১-২৫ সালের মধ্যে বিহারে ১৩.৯ কোটি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে, যা বিহারের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। তাছাড়া, বিহারে এই সনদের মেয়াদ মাত্র এক বছর, তাই প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ নতুন করে আবেদন করে।

জাতিগত সনদের ক্ষেত্রেও একই ভুল। ২০১১-২৫ সালের মধ্যে মোট কত সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে তা হিসাব করেছে, প্রাপক ব্যক্তির সংখ্যা নয়। একজন ব্যক্তি একইসঙ্গে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় উভয় সরকারের ওবিসি সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে পারে। কেন্দ্রীয় সার্টিফিকেটের মেয়াদ এক বছর। এই সার্টিফিকেট মূলত উচ্চশিক্ষা বা সরকারি চাকরিপ্রার্থীরাই নেন— তাই মাধ্যমিক পাশের প্রায় অর্ধেক মানুষের কাছে সার্টিফিকেট আছে, এমন ধরে নেওয়ার কারণ নেই। ২০১১-১২ সালে ‘ইন্ডিয়া হাউসহোল্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভে-২’ অনুযায়ী ধরা হয়েছিল যে, মাত্র ১৬ শতাংশ পরিবারের কাছে জাতিগত সার্টিফিকেট রয়েছে।

পারিবারিক নিবন্ধনের (রেজিস্টার) ক্ষেত্রেও নির্বাচন কমিশন পাহাড়কে তিল বানিয়েছে। পঞ্চায়েতি রাজ দপ্তরের দেওয়া বংশাবলি সার্টিফিকেট পেয়েছেন ১৫.৮ লক্ষ মানুষ (১৮-৪০ বয়সের ৫.৮ লক্ষ)। এর সঙ্গে কমিশন যোগ করেছে ‘বিকাশ রেজিস্টার ২.০’-এর ২ কোটি নাম— যা বিহার মহাদলিত বিকাশ মিশনের একটি প্রশাসনিক রেকর্ড, যেখানে সরকারি কর্মচারী ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই।

জন্মের সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে, কমিশন ২০০১-২৪ সালের মধ্যে ইস্যু করা সব সার্টিফিকেটের হিসাব ধরেছে, অথচ একই অনুচ্ছেদে স্বীকার করেছে যে ২০০৭ সালের পরে যারা জন্মেছে তারা ২০২৫ সালের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়। সঠিক হার ২ শতাংশেরও কম। এনএফএইচএস-৩ জানিয়েছিল, ২০০১-০৫ সালের মধ্যে যারা জন্মেছে তাদের মধ্যে মাত্র ২.৮ শতাংশ ক্ষেত্রে জন্ম সার্টিফিকেট ছিল। ১৯৮৫-২০০৭ সালের দলে এই হার আরও কম হবে। কারণ এদের বেশিরভাগই ২০০১ সালের আগে জন্মেছে।

বাড়ি বরাদ্দ সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রে, কমিশন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (গ্রামীণ ও শহর) এবং ইন্দিরা আবাস যোজনার ১.১৮ কোটি সুবিধাভোগীকে এক সঙ্গে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই সুবিধাভোগীরা একটি অনুমোদনপত্র পায় এবং তা জমি/বাড়ি বরাদ্দের সার্টিফিকেট নয়। ফলে তারা এসআইআর-এর প্রয়োজনীয় “জমি/বাড়ি বরাদ্দের নথি”-র আওতায় পড়ে না।

তাহলে অন্তত একটি করে নথি থাকা ব্যক্তির বাস্তবসম্মত সংখ্যা কত হতে পারে? মনে রাখতে হবে, তৃতীয় কলামের সংখ্যাগুলি যোগফল নয়, বরং ওভারল্যাপ। যারা সরকারি কর্মচারী, পাসপোর্টধারী বা জন্ম সার্টিফিকেটধারী, তাদের প্রায় সবাই ৪৩.৩ শতাংশ মাধ্যমিক পাশের মধ্যেই পড়ে। যারা মাধ্যমিক নয়, তারা মূলত সরকারের জমি পাওয়া ভূমিহীন (১.২ শতাংশ) এবং পারিবারিক রেজিস্টারে থাকা মানুষ (১.২ শতাংশ)। অতএব, ১৮-৪০ বয়সী জনগোষ্ঠীতে যোগ্য নথি থাকা মানুষের হার প্রায় ৪৫.৭ (৪৩.৩+১.২+১.২) শতাংশ, এর সঙ্গে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম (যেমন: মাধ্যমিক পাশ নয় কিন্তু জাতিগত সার্টিফিকেট রয়েছে) যোগ করলে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ধরা যেতে পারে।

উপসংহার অতি স্পষ্ট: যদি নির্বাচন কমিশন তার ইচ্ছামতো এই ১১টি নথির মধ্যে অন্তত একটি জমা দেওয়ার নিয়মে অনড় থাকে, তাহলে ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের অন্তত ৫০ শতাংশ ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারেন। সর্বশেষ অনুমান অনুযায়ী (দুটি জেলার অনানুষ্ঠানিক তথ্যের ভিত্তিতে), ২০০৩ সালের ভোটার তালিকার এক-তৃতীয়াংশকেও নির্বাচন কমিশন খুঁজে পায়নি। সেক্ষেত্রে অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ ৪.৮ কোটি মানুষের কাছে নথি চাইতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ না করলে এবং নির্বাচন কমিশন এই শর্ত শিথিল না করলে, বর্তমান খসড়া ভোটার তালিকার ৭.২৪ কোটির মধ্যে ২.৪ কোটি মানুষের ভোটাধিকার হারানোর ঝুঁকি থাকবে। এটা হবে কোনও নির্বাচনী গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভোটার বঞ্চনা।


[1] শাস্ত্রী, রাহুল। দ্য হিন্দু ডেটা পয়েন্ট। ১ আগস্ট, ২০২৫।


*নিবন্ধটি গত ১২ আগস্ট ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে Edge of disenfranchisement শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...