নীহারকান্তি হাজরা
নদ-নদীর সঙ্গমভূমে
অধ্যায় ১: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭
ক্ষেত থেকে রান্নাঘর: দুগ্ধপোষ্য আমরা
আধুনিক হয়ে ওঠার আগে আমার, আমাদের, আমাদেরই মতো আর পাঁচটা গৃহস্থের খাওয়াদাওয়াটা কেমন ছিল তার একটা বিবরণ স্মৃতিধরে চলমান হলেই আকাশে মুখ উঠে চোখ বন্ধ হয়ে যায়। মধ্যবিত্ত পাড়াগুলো ধরে নামগুলো মনে এলেই দেখি সকলের বাড়িতেই দুটো একটা গাইগরু বা তার বেশি। এবার মানুষগুলির হাতের কৃচ্ছ্রতা বা উদারতার উপর নির্ভর করত গরুগুলির দুধের পরিমাণ। আমাদের দুটো গাইগরুর দুধের পরিমাণ দু-বেলা মিলিয়ে হত ছ-পাই। এখনকার মাপে সাত লিটারের বেশি। বাদুড়কুলকে শাসানি দেওয়া উকিলবাবু, গ্রামের ন-কাকার গরুর সংখ্যা ছিল সাত-আট। এর মধ্যে তিন-চারটে গাই। দুধের পরিমাণ হত আধ পাই। শীতে এক ছটাক। তাঁর একটা বিলাস ছিল। তখনকার জেলাসদরের ঈদগা মহল্লার একমাত্র বেকারির একটি কোয়ার্টার লোফ তিনি কিনে আনতেন। তারপরে ভর সন্ধেয় তাঁর রান্নাঘরের বারান্দায় বসে দুধ দিয়ে এটি আত্মসাৎ করতেন। বাগালেরা একটা সময় জবাব দিলে— “না খুড়া, মাঠে কোনওরকম হিল্লে করলেই শুকনি ভাঁউর দেয়। আর মরে গেলে? না খুড়া।”

ঘোষালপাড়ার গোপাল ঘোষালের ছিল সব মিলিয়ে এগারোটা গরু। দুধ হত দেড় ছটাক। গোপাল বলত দুধ না হোক গোবরটা তো হচ্ছে। গোপালের সারের সুখ্যাতি ছিল। এখানে একটা ছিট এসে গেল। গোপাল সে সময় স্পেশাল ক্যাডারের চাকুরি করত। বিধানচন্দ্রের সরকার গ্রামে যেমন গ্রামসেবক নিযুক্ত করেছিল, তেমনই এই স্পেশাল ক্যাডার। এদের মূল পেশা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা। মাসে মাইনে ৬০ টাকা। মাইনেটি এক জায়গায় স্থির। মাসে একদিন আবার বসে যেতে হত। শিক্ষার কাজের বাইরে তাঁদের খেজুরগাছের ডালের গোড়া ছেঁচে ব্রাশ তৈরি করে আলকাতরার ভাঁড় নিয়ে গ্রামের ঘরগুলিতে নম্বর দিতে হত আর তার সঙ্গে ম্যালেরিয়া আর যক্ষার পরিসংখ্যান। গোপাল সঙ্গে করে একটি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের বাক্স আর বই নিয়ে যেত। মাস্টারি আর ডাক্তারি একই সঙ্গে চলত। কাজেই গোবর একটা রোজগার বৈকি!

নতুন বাছুর জন্মানোর পর থেকে দুধের পরিমাণ অনেকটাই বাড়ত, তবে একুশ দিন পর থেকে। নবীন গো-বৎসটি দফায় দফায় মাতার দুগ্ধ পান করত। তারপরেও একুশদিন ধরে উদ্বৃত্ত দুধ দুয়ে ফেলে দিতে হত। অন্যথায় গোমাতার দুগ্ধথলির উপর বিষ্ফোট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। এ-সময়ের দুধ পান করা নিষিদ্ধ ছিল।

গরুগুলির খাদ্যের দিকে পরিবারের নজর ছিল তার সদস্যদের মতোই। খামারে পর্যাপ্ত খড়ের পালই। সকালবেলা সরষের খোল মেশানো নরম খড়ে প্রাতরাশ সারতে সারতেই নটা বাজত। রাখাল বা বাগাল গরু খুলে বাগিয়ে নিয়ে চলল নদীতীরের চারণভূমিতে। তাদের দুপুর আর রাত্রের খাবার খাওয়া ঘটত ঠিক সাড়ে তিন-চারটের মধ্যে। শীতের দিনে তিনটে পার হত না। এই খাদ্যটা বসত কাঠের জ্বালানির একটা বিরাট মাপের লোহার কড়াইতে। উপাদান হত সবজির সমূহ খোসা। গরমকালের স্বল্পতা পুষিয়ে যেত শীতে। চালের উপরের নরম তেলতেলে কুঁড়ো। বেশ পরিমাণ সরষের খোল। পরিমাপ করে কাটা নরম খড়ের ছানি। মাঝেমধ্যেই গোদুগ্ধ বৃদ্ধির অন্যতম সহায়ক কন্টিকারি বেগুনের গাছের ছাঁট। গরু মুখ তুললেই যতিমাসি তৈরি থাকত খানিকটা কুঁড়ো মিশিয়ে দিতে। পেট ভরলে তারা সরে আসত পাত্র থেকে। অধিকন্তু মুখের কাছে দেওয়া থাকত এক আঁটি করে খড়। তারা ভোররাত্রে একটু-আধটু মুখে কাটবে। শীতের সময় তাদের পিঠে ঝুলত শনের তৈরি নরম চট। গোয়াল গরম রাখার জন্যে ফাঁকফোকরে ঝুলত চটের ঝালর। তারা যখন পালে যেত, তাদের গদাইলস্করি চাল আর ঝকমকে চিকন দেহ মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিত।

বোঝা গেল যে, দুধ এবং তার প্রকারভেদ সে-সময়টাতে আমাদের খাদ্যতালিকার একটা বড় ভাগে দখল বসিয়েছিল— দুগ্ধপোষ্য। সকাল নটা থেকেই একটা বড় লোহার কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া হত। খানিকক্ষণ পরেই তার উপরে পড়ত পুরু সর। আর সরের উপর জেগে থাকত ফোটা দুধের ফেনার অবতল অবশেষ। এবার পলারি (এটা একটা বড় কানা-উঁচু কাঁসার থালা, সম্ভবত ফলহারি থেকে পলারি) ভর্তি মুড়ির উপরে দানাদার আখের গুড় আর সর সরিয়ে দু-হাতা দুধ। এই হাতার নাম ডাবু।

রাত্রে দুধের সরটা তুলে একটা বড় কালো পাথরের বাটিতে রেখে সেটি তোলা থাকত রান্নাঘরে কড়িকাঠে ঝোলানো শিকায়। সপ্তাহ দুয়েক জমার পর এটি নামিয়ে ঢালা হত একটি বড় কানা-উঁচু কালো পাথরের থালায়। এই কাজটি মা-ই সারতেন। জমানো সর থালাটির উপর চটকানোর পর উপযুক্ত সময়ে বিন্দু-পরিমাণ জল ঢেলে ঢেলে বস্তুটি ফেটিয়ে ফেনময় মসৃণ আকারে আনা হত। এই পদ্ধতিটির উৎকর্ষের উপর নির্ভর করত পরিণামী বিশুদ্ধ গব্য ঘৃত। তারপর সন্ধিক্ষণ বুঝে পরিমাণমতো জল ঢালা হত। এর পরে আঙুলের খেলায় বিলি কাটলেই থালাভর্তি জলের উপর ভাসত নবনী— ননী। এর অবশেষটুকুও সংগ্রহ করে আর একটি পাথরের বাটিতে রাখা হত। উদ্বৃত্ত সরের ছিট-সহ যেটি পড়ে রইল সেটি ঘোল। স্বল্প লবণ সহযোগে এটির ব্যবহার পাকস্থলির সর্বরোগহর। বলকারক। শীতল। রুচিকর। ইত্যাদি চারকীয় স্তুতি। এবং যারপরনাই সত্য। তারপরে উনুনে কড়াই। কাঠের জ্বাল। তাপ কম-বেশি করা জরুরি। তপ্ত কড়াইয়ে ননী পড়লেই গলন শুরু হল। এ-সময় সমিধ উনুন থেকে বার করে বা আবার দু-চার খণ্ড বেশি সমর্পণ করে এটির পাক হত। নামানো হলে এর উপর স্থির হত হালকা খয়েরি রঙের পরিপক্ক ঘি। এবার কড়াইয়ের নিচে যেটি পড়ে রইল সেটির বর্ণ খয়েরি। নাম খাঁকরি। ঘি-সিক্ত এই বস্তুটি মুড়ি সহযোগে অনবদ্য। অতিরিক্ত দুধ ক্ষীর হত। ক্ষীর থেকে নাড়ু। এছাড়া বাড়িতে তৈরি হত মুড়কি। নির্দিষ্ট ধানে খই ভেজে সেগুলি ধানের খোসামুক্ত হত একটা তিন ফুট ব্যাসের বাঁশের উপযুক্ত চালুনিতে। তারপরে গুড়ের পাক নির্দিষ্ট মাত্রায় এনে খই দিতে হত। গুড়ের পাকটির মুন্সিয়ানায় খইগুলি ঝুরঝুরে মুড়কি হত। এর পরের কোনও ক্রম বাড়িতে হত না। তবে দুর্গাপূজার পরে চালের গুঁড়ো গুড়ের ভিয়েনে মিশিয়ে লুচির মতো বেলে তেলে ভাজা হত। আর কোনও সময় শারীরিক প্রয়োজনে হত ছানা।

কিন্তু স্কুলে যাওয়ার সময় খাদ্যতালিকা অন্যরকম হত। সকালবেলা এক কাপ চায়ের সঙ্গে এক বাটি মুড়ি। বিস্কুটের চল ছিল না। তখন অবশ্য বাজারে পাওয়া যেত কেবল ব্রিটানিয়া থিন আর আয়তাকার বিচিত্রিত বাক্সে ক্রিমক্র্যাকার। এটি কেবল মহাশয়দের খাদ্য ছিল। তারপর এল লিলি বিস্কুট। আরও পরে জগন্নাথ কোলের কোলে বিস্কুট। (জগন্নাথ কোলের খাসমহল বিষ্ণুপুর মহকুমার কোতুলপুরে। সেখানকার বিধায়ক। তিনি বিধানচন্দ্রের সময় ছিলেন ডেপুটি স্পিকার। বৌবাজারের মুখে কোলে মার্কেটটি তাঁরই। এ-সময়ে বাঁকুড়ার বহু ছাত্র কোলে মার্কেটের কোনও কোনও ঘরে থেকে পড়াশুনা করত। এর সমস্ত ব্যয়ভার মহাশয়ই বহন করতেন।) এ বিস্কুটগুলির পরমায়ু বেশিদিনের ছিল না।
[ক্রমশ…]


স্মৃতির গহনে ডুব দিলাম আরেকবার। লেখককে প্রণাম। আপনি আরো মনি মুক্ত তুলে আমাদের উপহার পাঠান।